১.
আমি মোস্তাফিজুরুদ্দিনুজ্জামানিয়া। নামটা শুনে ভয় পাবেননা। আমার বাপ দাদাদের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় তাদের মধ্যে প্রচন্ড পাগলামি ছিল। আমাদের বংশের লোকজনের নামগুলোও এই পাগলামীর একটা অংশ। আমার বাবার নাম খায়রুজ্জাচৌমাদ্দিরহদার; আমার দাদা এই নাম রেখেছিলেন। একই ভাবে আমারটা রেখেছেন আমার প্রিয় আব্বাজান।
তাই বলে আমাদের অকর্মা পাগলছাগল ভেবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার কিছু নেই। আমাদের বংশের পাগলগুলো একএকজন আল্ট্রাজিনিয়াস ছিলেন। এই আল্ট্রাজিনিয়াস শব্দটা গত ৮০০ বছর ধরে এই পৃথিবীতে এমনকি আশেপাশের গ্যালাক্সীগুলোর কিছু কিছু গ্রহে - যেখানে মানবসভ্যতা গড়ে উঠেছে সেসমস্ত জায়গায় প্রচলিত। আর এই শব্দটা তৎকালীন অক্সফোর্ড ডিকশনারীতে আমাদের বংশের কোন এক পুরুষের বিভিন্ন আবিস্কারের কারনেই অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল বলে জানি।
আমার দাদা ছিলেন একজন নামকরা পদার্থবিদ। আমার দাদার ছিল পৃথিবীজোড়া খ্যাতি। বিভিন্ন গ্রহে মনুষ্যবসতি স্থাপনে তার অবদান অনেক। তবে দুঃখ জনক হলেও সত্য যে পদার্থবিদ্যার ছিটেফোটাও আমার বাবার মধ্যে ছিল না। তিনি ছিলেন সখের বেহালা বাদক। তিনি দাদার সহায় সম্পত্তি সব পাওয়াতে অন্য কোন কিছু করার প্রয়োজন বোধ করেননি।
বাবার পাগলামির ছোট্ট একটা উদাহরন দেই। ট্যাক্সের টাকা দেয়ার নোটিশ নিয়ে সরকারের তরফ থেকে একদিন এক ডাকরোবট এল আমাদের বাসায়। ওর একমাত্র কাজ চিঠি বিলি করা। আমার বাবা প্রচন্ড অপমানিত বোধ করেন ট্যাক্সের চিঠি পেয়ে। রোবোটটির সাথে রাগারাগির এক পর্যায়ে রোবটের মাথায় বাড়ি দিয়ে তার শখের বেহালা ভেঙে ফেলেছিলেন তিনি।
আমার মধ্যে অবশ্য অত পাগলামি নেই তবে আমি প্রচন্ড অলস প্রকৃতির। আমার নিজের নামে এই ঢাকা শহরে ৩টা ছাতামিনার (আম্রেলাটাওয়ার) রয়েছে। আর বঙ্গোপসাগর থেকে দেড়শো মাইল দুরে অবস্থিত ’মোস্তার চর’ এর মালিক আমি। পুর্বপুরুষের সুত্রে আমার এই (সরকারের সঙ্গে পার্টনারশীপের) মালিকানা। অগাধ এই সম্পদের কারনেই বেশী কিছু করতে ইচ্ছে হয় না আমার।
২.
আমি আজ আমার ’পাতাল এক্সপ্রেস’ এর অফিসে বসেছি। পৈত্রিক সুত্রে আমি আমার বাপদাদার পুরানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ’গোমস্তা ট্রাভেলস’ এর কর্নধারও বটে। এই এজেন্সীর যানবাহন হল ’পাতাল এক্সপ্রেস’। পৃথিবী থেকে তেল নাই হয়ে যাবার পর থেকে বংশানুক্রমে আমরা এই ট্রাভেল এজেন্সী মারফত আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা রক্ষা করে আসছি। তবে একথা ঠিক যে গত কয়েকশ বছরে আমাদের ব্যাবসারও ক্রমশঃ অবনতি ঘটেছে। এই অবনতি মুলতঃ বাতাস থেকে জালানী আবিস্কারের পর থেকে হয়েছে। এখন সবাই দ্রুতগামী রকেটগুলোতে চলাফেরা করে থাকে। তবে আমার এলাকার সকল যাত্রী আমাদের এই ট্রাভেল এজেন্সী মারফত তথা ’পাতাল এক্সপ্রেসে’ যাতায়াত করে থাকে।
আজ সাতসকালে অফিসে বসে আছি। কিছুক্ষন আগে পাতাল এক্সপ্রেস ১ আমেরিকা থেকে চলে এসেছে - এক নম্বর স্টেশনে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। দুই নম্বর স্টেশনে পাতাল এক্সপ্রেস ২ আমেরিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু কোন প্যাসেন্জার পাচ্ছি না। এদিকে আমেরিকা স্টেশন থেকে আমার ম্যানেজার একটু আগে জানিয়েছে ’বস একটা পাতাল এক্সপ্রেস পাঠায়া দেন। বেশ কয়েকজন ঢাকা যাবার বুকিং দিয়ে ফেলেছে।’ কি করব ভাবছি। খালি অবস্থায় আমেরিকা পাঠিয়ে দেব কি?
হঠাৎই আমি মনস্থির করলাম। খালি পাঠাব না, নিজেই আমেরিকা চলে যাব আজ। বেশ অনেকদিন হয়ে গেছে আমেরিকা যাই না। ওপাশ থেকে আমার ম্যানেজারকে পাঠিয়ে দেব ঢাকায়। ’ঘটু’ কে বসিয়ে রেখে যাব অফিসে। এ অফিসে আমার একমাত্র কর্মচারী ’ঘটু’। জন্ম সুত্রে ’ঘটু’ একটি বেকুব টাইপের রোবট। অবশ্য বেকুব বলা মনে হয় ঠিক হচ্ছে না। ওকে বানানোই হয়েছে বেকুবের মত করে। আমি নিজে মাঝেমধ্যে ওকে বেকুবী আচরন করার প্রোগাম সেট করে দেই। যেমন ওকে যদি জিজ্ঞেস করি এই ’ঘটু’ তোর বাপের নাম কি? সে সাথে সাথে উত্তর দিবে ’তুমিই আমার বাপ, তুমিই আমার বাপ।’ তবে যে প্রশ্নটার উত্তর ও বুঝতে না পারে (অর্থ্যাৎ ওর প্রোগামে নেই) সে প্রশ্নের উত্তরে সে সটান চিৎ হয়ে চেঁচাতে থাকে - ’হে খোদা আমাকে রক্ষা কর। আমাকে রক্ষা কর।’
আমি ওর বাটন গুলো টিপেটুপে সকল প্রশ্নের জন্য একটি মাত্র উত্তর সেট করে দিলাম। যে যাই জিজ্ঞেস করুক ও নাচতে নাচতে বলতে থাকবে - ’আমেরিকা যাওয়া বন্ধ। আজ পাতাল এক্সপ্রেস চলবে না। আমেরিকা বন্ধ। হিঃ হিঃ হিঃ।’ কেউ এসে ওর এই কান্ড দেখে মজা পাবে নিশ্চয়ই।
আমি ২নম্বর স্টেশনে চলে এলাম। অফিসের সাথেই লাগোয়া পাতাল এক্সপ্রেসের স্টেশন দুটি। মাত্র পনের ফুট ব্যাসের একটি করে বৃত্তাকার ঘর। প্রতিটি বৃত্তের কেন্দ্রে চব্বিশফুট উচ্চতার টিউবের মত বস্তু যার প্রতিটির মধ্যে তিনটি করে চেম্বার। এগুলোই আমার পাতাল এক্সপ্রেস। প্রাচীন যুগের রেলগাড়ী যেভাবে লাইনের উপর দিয়ে চলত পাতাল এক্সপ্রেসের চালচলন মোটামুটি ঐ টাইপের।
আমি উপরের দুই চেম্বারে ওজন বসিয়ে এ্যাডজাস্ট করলাম। নির্দিষ্ট ওজনে চলে এই পাতাল এক্সপ্রেস; একটু হেরফের হলে চলবে না। তৃতীয় চেম্বারে আমি উঠব। কন্ট্রোল প্যানেল থেকে অটোস্ট্রার্ট বাটন সিলেক্ট করলাম। একমিনিটের মধ্যে যাত্রা শুরু করবে পাতাল এক্সপ্রেস। আমি তৃতীয় চেম্বারে ঢুকলাম। দরজা বন্ধকরে কানে হেডসেট এবং মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগালাম। ছোট্ট ভিডিও স্ক্রিনটিতে আজকের যাত্রার তারিখ দেখাচ্ছে। ১২ অগাস্ট ৩০০৮। স্ক্রীনে কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেল। দশ.. নয়.. আট.. সাত.. ছয়.. পাচ.. চার.. তিন.. দুই.. এক.. সরে গেল টিউবকে আকড়ে ধরে থাকা লিভারটি। আমি প্রচন্ড ঝাঁকি অনুভব করলাম। পাতাল এক্সপ্রেস তার সুরুঙ্গপথে প্রচন্ডগতিতে পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে। প্রতি মুহুর্তে গতি বাড়ছে তার।
আমি আমার চেম্বারের স্ক্রিনে টেপাটেপি করে গান বাজিয়ে দিলাম
তুমি আছ আমি আছি... ভালবাসায় মাহতামাত্তি... তোমার আমার স্বপ্ন হয়ে... উড়ছে দেখ প্রজাপতি...
হাজার বছর আগের গান। হাবিব নামে তৎকালীন বাংলাদেশের নামকরা একজন গায়ক গেয়েছিল গানটি। আমার খুবই পছন্দের।
৩.
ধীরে ধীরে গতি বাড়ছে পাতাল এক্সপ্রেসের। আমাকে নিয়ে প্রচন্ড গতিতে নীচের দিকে নামছে। এই অদ্ভুত যোগাযোগ পদ্ধতি আমাদের পুর্বপুরুষদের সৃষ্টি। আমি এখনো অবাক হয়ে যাই তাদের চিন্তাশক্তি দেখে। পৃথিবীটাকে কিসুন্দর ফুটো করে তার ভিতরদিয়ে কোনরকম জালানী ছাড়াই আশ্চর্য এই যোগাযোগের পদ্ধতি আবিস্কার করে রেখে গেছেন তারা!
ধীরে ধীরে নিজেকে হাল্কা অনুভুত হতে লাগল। মনে হচ্ছে স্থীর হয়ে আছি আমি কোথাও। বুঝতে পারলাম পৃথিবীর কেন্দ্রে প্রায় এসে গেছি। পাতাল এক্সপ্রেসের মূল অপারেটিং রুম পৃথিবীর কেন্দ্রে স্থাপিত। সেখানে অনেক অদ্ভুত যন্ত্রপাতি স্থাপন করা আছে বলে শুনেছি; বাতাসকে ব্যবহার করে কিভাবে চাপ সৃষ্টি করে পাতাল এক্সপ্রেস চালান হয়। আমি কোনদিন এখানে আসিনি। আমাদের রোবট ’বটু’ এর মেইনটেন্যান্স ইন্জিনিয়ার। ’বটু’ বর্তমান জগতের বুদ্ধিশ্রেষ্ঠ রোবটদের একজন। ওর বয়স মাত্র ৬০০ বছর।
হঠাৎ উল্টা ঘুরে যাবার অণুভুতি হল। বুঝলাম পৃথিবী কেন্দ্রে এসে মুখ ঘুরে গেল পাতাল এক্সপ্রেসের। এতদ্রুতগামী টিউবটি কি করে পুথিবীর কেন্দ্রে এসে গতি না হারিয়ে ঘুরে যায় তা আজও আমি বুঝে উঠতে পারিনি। আমার এক বন্ধু যে কিনা টুমারু নামক গ্রহে গতিত্ত্ববিদ হিসাবে কাজ করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম একদিন। সে হেসে বলল ’আরে এই সাধারন ব্যপারটা বুঝিস না? দাঁড়া তোকে দেখাই।’
ভোজবাজীর মত তার হাতে একটি যন্ত্র উদয় হল। অনেকটা স্ক্রু ড্রাইভার জাতীয়; একমাথায় সুচালো তীরের ফলা আর অন্য মাথা ভোঁতা। সে শুচালো প্রান্তে ধরে ধাই করে ছুড়ে মারল আমার দরজায়। স্যাঁত করে সুঁচালো প্রান্ত আমার মেহগনি কাঠের দরজায় গেঁথে গিয়ে তীর তীর করে কাপতে লাগল। ৫০০ বছর আগে বিলীন হয়ে যাওয়া আসল মেহগনী কাঠের দরজা আমার!
প্রচন্ড রাগে আমার মেজাজ হট হয়ে গেল ’এটা কি করলি? আমার দরজা ফুঁটো করে ফেললি?’
সে পাত্তা দিলনা। বলল ’এই দেখ। আমি ছুড়লাম সুঁচালো প্রান্ত ধরে ওপাশেও গেথে আছে সুঁচালো প্রান্ত। মাঝপথে প্রান্ত ঘুরে গেছে - একবারই, কিন্তু প্রান্ত ঘুরে যাবার সময় গতির পরিবর্তন হয়েছে কি?
যদিও আমি ওর ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট ছিলাম না আমার আরও কিছু কৌতুহল ছিল তবুও আমি আর ঘাটালাম না তাকে। শালা আবার পকেট থেকে কিছু বেরটের করে আগুন ধরিয়ে দিয়ে হয়তো বলবে ’দেখছিস, আমার নতুন আবিস্কৃত আগুন? সবকিছু পুড়িয়ে ফেলছে কিন্তু একটুও তাপ নেই।’
প্রচন্ড গতিতে ছুটে চলেছে পাতাল এক্সপ্রেস। অবশ্য ছুটে চলা বলাটা মনে হয় ঠিক হচ্ছেনা; উপরে উঠছি বলা উচিত। কারণ ধীরে ধীরে নিজের শরীরের ভর টের পাচ্ছি, পায়ে শরীরের ওজনের চাপ বাড়ছে ধীরে ধীরে। বুঝতে পারলাম; পৃথিবী কেন্দ্র থেকে আমেরিকার দিকে অনেকদূর উঠে এসেছে পাতাল এক্সপ্রেস। এখন তীব্র গতিতে উপরের দিকে উঠছে। আমি আবার গান শোনায় মত্ত হলাম।
’কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে ফুলে ফাইলা ভ্রমরা ...’
এটিও হাজার বছর আগের গান। কেন জানিনা পুরোনো গানগুলোই এখনো আমার এত প্রিয়!
তন্ময় হয়ে গান শুনছিলাম। হঠাৎ স্বয়ংক্রিয়ভাবে গান বন্ধ হয়ে গেল। গতি কমতে কমতে থেমে গেল পাতাল এক্সপ্রেস। স্ক্রীনে মেসেজ ভেসে উঠল ’ওয়েলকাম টু আমেরিকা’। আমি দরজা খুলে বের হয়ে এলাম। বেশ কয়েকদিন পর আবার আমেরিকার মাটিতে পা রাখলাম আমি।
মন্তব্য
এ্যন্টানার উপর দিয়ে গেল তো !!!
হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে, মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দুইকে আমি এক করি না এক কে করি দুই৷
পুরোনো এ্যান্টেনা বদলে নিন!
সর্বনাশ! এইবার দেখি পুরা ফ্লপ!!
দিক পরিবর্তনের কনসেপ্টটা ধরতে পারলাম না।
বিজ্ঞান অত জানি না, তবে পৃথিবীর কেন্দ্র ফুড়ে মহাদেশ ভ্রমনের কল্পনা অনেকেই করেছেন, লেখার ঢং্যের জন্য পড়তে আরাম লাগল
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
নতুন মন্তব্য করুন