ছায়া (পর্ব-১)

ভবঘুরে এর ছবি
লিখেছেন ভবঘুরে (তারিখ: মঙ্গল, ১২/০৮/২০০৮ - ৯:৩৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(জনাব মৃদুল আহমেদ কে উৎসর্গ করা হল। উনার দেয়া প্লটের ’ছায়া’ অবলম্বনে লিখলাম। ভুতের গল্প লেখার কথা ছিল; হচ্ছে কিনা জানিনা)

'স্যার, অনেক্ষন যাবৎ আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। '- রুমে ঢুকতেই লোকটাকে দেখতে পান মৃদুল আহমেদ; ঘরের ঠিক মাঝে দাড়িয়ে আছে। জানালা দিয়ে শেষ বিকেলের রোদ এসে পড়েছে ঘরে। জানালা বরাবর দাড়িয়ে থাকা লোকটির ছায়া পড়েছে দ্বিগুন হয়ে। একাগ্রচিত্তে নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে আছে সে।

'মোতালেব' - মৃদুল আহমেদ চিৎকার করে ডাকলেন। লোকটির মেকি আচরন গায়ে মাখলেন না। অনেকেই অদ্ভুত আচরন করে তার সাথে। বোঝাতে চায় তারা ব্যাতিক্রমী কিছু। কোন রকম সম্ভাষন বিহীনভাবে তার সাথে কথা শুরু করা এই লোকটিকেও সেই গোত্রের মনে হচ্ছে।

মোতালেব উকি দিল দরজায়। ইশারায় তাকে পর্দা টেনে দিতে বলেন মৃদুল আহমেদ। শেষ বিকেলের রোদ তার প্রিয় হলেও আজকের রোদ তার ভাল লাগছে না। আজ সারাটা দিন মাটি হয়েছে। গতপরশু ধানমন্ডীতে তার পরিচিত একজন ব্যবসায়ী হার্টএটাক করে মারা গেছেন। খুবই সাধারন একটা কেস। তদন্ত করে ডাক্তারী রিপোর্ট মোতাবেক তাই প্রমানিত হয়েছে। কিন্তু সমস্যা বাধিয়েছে সেই ছায়া। বাড়ির মালকিনের বক্তব্য সে ছায়াটাকে তার স্বামীর ঘরে যেতে দেখেছে। স্বামীর চিৎকার শুনে ঘরে গিয়ে দেখে স্বামী তার মরে পরে আছে। বাড়ির দারোয়ানও একই কথা বলেছে। সে নাকি ছায়াটাকে বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখেছে। সে এতই ভয় পেয়েছে যে সে চাকরীর মায়া ত্যাগ করে সে বাড়ি ছেড়ে ভেগেও গেছে।

সেদিন বাড়ির মালকিনের মরা কান্নার জন্য তার সঙ্গে এ ব্যাপরে কোন কথা বলেননি তিনি। আজ গিয়ে সারাটাদিন তাকে বোঝাতে গলদঘর্ম হয়েছেন। তাকে কোনভাবেই বোঝানো যায়নি যে তার স্বামীর স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে।

বেশ কিছুদিন যাবৎ এই ছায়ার উৎপাত শুরু হয়েছে ঢাকা শহরের কয়েকটি এলাকায়। এতদিন ছায়া দেখা, ভয় পাওয়া, চিৎকার চেঁচামেচী - এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল ঘটনা। কিন্তু ছায়াকে জড়িয়ে এই মৃত্যুর ঘটনায় মানুষের ভীতি আরও বেড়ে গিয়েছে।

এদিকে এটা নিয়ে পত্রিকাওলারাও বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। বিশাল হেডিং দিয়ে নিউজ করেছে। 'ঢাকা শহরে এবার ছায়ার প্রথম শিকার'। 'ছায়ার আক্রমনে ব্যবসায়ীর মৃত্যু'। ইত্যাদি ইত্যাদি। আরে বাবা প্যানিক ছড়ানোর দরকারটা কি?

ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে। কমবেশী সবাই এখন ছায়া দেখা শুরু করেছে। মৃদুল আহমেদের ধারনা এসবই তাদের অবচেতন মনের ভুল। যেমন সেদিন কে একজন রাতের বেলা তার নিজের ঘরে ঝোলানো কাপড় দেখে ছায়া ছায়া করে মুর্ছা গেছে। এই হচ্ছে অবস্থা।

মৃদুল আহমেদের সন্দেহ কিছু লোক এই সুযোগে প্রতারনা করার চেষ্টা করছে। মিরপুরে গতরাতে এক বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। সেখানেও নাকি লোকজন শুধু ছায়া দেখতে পেয়েছে। বাড়ির সিকিউরিটির লোক নাকি কয়েকটা ছায়া ঢুকতে দেখেছে। খুব সম্ভবতঃ কালো পোষাক পরে ঢুকেছিল দুর্বৃত্ত। ছায়ার ভয়েই লোকজন কিছু করার সাহস করেনি। নির্বিঘ্নে ডাকাতি সেরে গেছে ডাকাতেরা।

সবগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলেও প্রতারক চক্রের পোয়াবারো হয়েছে।

'স্যার, অনেক্ষন যাবৎ আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।' -লোকটি আবার বলে ওঠে। এবার অবশ্য ঘরের মাঝখানে নয়। তার ডেস্কের সামনের চেয়ারে বসে আছে সে।

'ওহ গড', লোকটিকে যে বসিয়ে রেখেছে তা মনেই নেই। ছায়ার ভাবনায় ডুবে গিয়ে লোকটির কথা ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি। লোকটিকে বসিয়ে রাখার জন্য এখন একটু খারাপই লাগছে।-
'আমি খুবই দুঃখিত; আপনাকে এতক্ষন বসিয়ে রাখার জন্য।' -একটু ভাল করে দেখলেন তিনি লোকটিকে। মাঝ বয়েসি লোক। চোখের নীচে কালশিটে দাগ। চেহারা দেখেই বোঝা যায় প্রচুর টেনশন করেন সবকিছুতেই। -'বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি আমি।'

'আমি একটা সমস্যায় পড়েছি।'- ইতস্ততঃ করতে থাকে লোকটি।
'হ্যা বলুন। আমার কাছে তো সমস্যা নিয়েই আসবেন। বলুন নিঃসংকোচে বলুন।'
'মানে আমি আমার ছায়া নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়ে গেছি।'
এই কথা- মনে মনে একটু নিরাশ হন মৃদুল আহমেদ। ছায়া ছাড়া কি আর কোন কিছু দেখতে পাচ্ছে না নাকি লোকজন?
'ও আচ্ছা। তাহলে আপনিও ছায়া দেখতে শুরু করেছেন। আপনি কোথায় থাকেন আর কিভাবে ছায়া দেখলেন ডিটেইলস বলুনতো?'
'না মানে- আমি আসলে ছায়া দেখে ভয় পাচ্ছি না।'- একটু থামে লোকটি। -'শ্যামলীতে আমার বাসা।'
'আর' - আবারো ইতস্তত করে লোকটি।- 'আপনি তো পত্রিকায় ছায়া দেখে ভয় পেয়ে মৃত্যুর খবরটি দেখেছেন তাইনা?'
'ব্যবসায়ী আকবর সাহেবের মৃত্যুর খবর?'-এইবার একটু আগ্রহী হন মৃদুল আহমেদ।- 'আপনি কি আকবর সাহেবের কেউ হন?'
'না আমি উনার কেউ না। আমি আসলে তাকে কোনদিন দেখিওনি চিনিওনা।'
'তাহলে?'
'আসলে- কিভাবে যে বলি। এতদিন বিষয়টা নিজেই সমাধানের চেষ্টা করছিলাম তাই কাউকে কিছু বলিনি। কিন্তু আকবর সাহেবের মৃত্যুর ঘটনার পর থেকে আমি অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছি। আর আপনার সাথে আগেই দেখা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। ' - এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলে লোকটি।

'দেখুন এভাবে বললে তো আমি কিছু বুঝতে পারছি না। অযথা হেয়ালী না করে যা বলতে চান সরাসরি বলুন। আপনি কি আকবর সাহেবের মৃত্যুর সাথে জড়িত?'
'ঠিক তা নয়। তবে আকবর সাহেবের স্ত্রী এবং বাড়ির দারোয়ান যেকথা বলেছে তা সঠিক।'
'তার মানে?'
'মানে যে ছায়াটা ওরা দেখেছে ওটা সত্যিই একটা ছায়া।'
'ও'- চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেন মৃদুল আহমেদ। তার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। ছায়া দেখা যাচ্ছে লোকজনের মানসিক সমস্যারও সৃষ্টি করছে।
'তারমানে আপনি বলতে চান ঢাকা শহরে যে ছায়ার উৎপাত শুরু হয়েছে সেগুলো সত্যিই ছায়া?'
'জি- আসলে তাই। ছায়াটা সত্যিই একটা মানুষের ছায়া।'
'তাহলে গতকাল যে ডাকাতিটা হল ওখানে অতগুলো ছায়া এল কিকরে?'
'সেটা অবশ্য আমি জানি না। ঐ ছায়াগুলোর ব্যাপারে সত্যিই আমি কিছু জানি না। '
'তারমানে অন্ততঃ একটা ছায়ার ব্যাপারে আপনি জানেন বলতে চাচ্ছেন?'
'জি ঠিক তাই।'
'আপনি ছায়াটাকে চেনেন মনে হচেছ?'
'জি - ছায়াটাকে আমি চিনি।'
'তা আপনার এমন মনে হবার কারন?'
'কারন যে ছায়াটা নিয়ে এত হুলুস্থুল শুরু হয়েছে' - চোখ তুলে সরাসরি তাকাল সে মৃদুল আহমেদের দিকে - 'সে ছায়াটা আমার।'

(চলবে...)


মন্তব্য

কীর্তিনাশা এর ছবি

ভালোই জমে উঠেছে। তাড়াতাড়ি বাকি অংশ ছাড়েন।
আর মৃদুল ভাই কই? তাইনে কি ইদানিং ডিবিতে জয়েন করছেন নাকি?
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

ভবঘুরে এর ছবি

পরবর্তী পর্ব মৃদুল আহমেদ লিখবেন !!

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

গল্পটা পুরোপুরি শেষ হলেই পরে কমেন্ট করি।
তবে প্রথমেই বলে রাখি, ভূতের গল্প মানে কিন্তু পাঠককে ফিল করানো এই গল্পটা সত্যি। এটা বলে বা রিকোয়েস্ট করে বা আদেশ করে তো আর কাউকে করানো যাবে না... এমন একটা আবহ তৈরি করতে হবে যেন নিজে থেকেই মনে হয়, এই ঘটনাটা আসলেই ঘটছে। গড়গড়িয়ে সংবাদ পাঠ করে গেলে কিন্তু গল্প হবে না!
তবে গল্পের প্লট দেয়ার অপরাধে আমাকেও যে গল্পে ভেতরে পড়তে হবে তা কে জানত?
লঘু অপরাধে এত গুরু দণ্ড দেয়ার উদাহরণ বোধহয় ইতিহাসে বিরল। হাসি
ইয়ে... নামটা চেঞ্জ করে দিলেই খুশি হব... উৎসর্গে আমার নাম তো আছেই... আপনার যদি তাতে গল্প লিখতে খুব অসুবিধে হয়, তাহলে আহমেদ সাহেব দিতে পারেন... দেঁতো হাসি প্লিজ...
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

ভবঘুরে এর ছবি

ঠিক আছে আহমেদ সাহেব!!

ক্যামেলিয়া আলম এর ছবি

এ তো এক্স ফাইলস হয়া গেছে------।
.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........

.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........

ভবঘুরে এর ছবি

ভাল কথা বলেছেন। এক্স ফাইল হিসাবেই থেকে যাক এটা!
অবশ্য আহমেদ সাহেবে যদি মোল্ডারের ভুমিকা নেন তবে কাহিনী এগিয়ে গেলেও যেতে পারে!
দেখা যাক আহমেদ সাহেব কি করেন!!

রাফি এর ছবি

বাকি অংশের অপেক্ষায় রইলাম....

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

জি.এম.তানিম এর ছবি

শুরুটা ভালই...এখন দ্বিতীয়টা পড়ব!
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।