চরিত্র-সত্যায়ন

ভবঘুরে এর ছবি
লিখেছেন ভবঘুরে (তারিখ: সোম, ১৮/০৮/২০০৮ - ৪:১৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(বি.দ্র.: এটা আমার জীবনের প্রথম সাহিত্য! ১৯৯৮ সালে লিখেছিলাম!)

পরীক্ষা পাশের পরে চাকুরী খুজিতে গিয়া যে সমস্যাটি প্রধান হইয়া দাড়াইল তাহা হইল সত্যায়ন। অর্থ্যাত গত বিশ বছর অধ্যয়নের ফলস্বরূপ যে কখানা সনদপত্র অর্জন করিয়াছি উহাদের অনুলিপির সত্যায়ন। চাকুরীদাতার ভয়, পাছে কেহ নকল সনদপত্র দাখিল করে। তাই উহাদের সীলমোহর মারিয়া প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা (দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেনীর হইলে হইবেনা!) কর্তৃক সত্যায়ন করাইয়া চাকুরীদাতার সম্মুখে হাজির করাইলে তবেই উনাদের মনঃপূত হয়। ভাবখানা এমন যে উহাতে কোনরূপ ভেজাল হইতে পারে না। অথচ তাঁহারা কি জানেননা যে প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তার ডিগ্রী এখন দোকানে অর্ডার দিয়া বানানো হয় ? চাকুরী প্রার্থী বেকার যুবকেরাই এখন এক একজন প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা ? কি অবাক হইলেন ? অবাক হইবার কিছুই নাই। ইহা বাংলাদেশ। এই দেশে সবই সম্ভব। কিভাবে উহা হয় তাহাই এখন বলিতেছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে হান্নান নামে আমার একজন বন্ধু ছিল। সে র্ছিল দর্শন বিভাগের ছাত্র। বি,সি,এস, পরীক্ষার ফরম পূরণ করিয়া উহা দাখিল করিবার সময় আমি সত্যায়ন সমস্যায় পড়িলাম। আমার অর্জিত সকল সনদের অনুলিপি সত্যায়ন করিতে হইবে। ইহা ছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক নাগরিকত্বের সনদপত্রসহ প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তার নিকট হইতে চারিত্রিক সনদপত্রও দাখিল করিতে হইবে। আবার সেই প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা! হায়, ভাবিয়া দুঃখ হয় ২০ বছরের অর্জিত স্বভাব চরিত্রের মালিকানা নাকি প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তার হাতে। তা না হইলে কি আর নিজের চরিত্রের খবর বাবা-মা কিংবা শিক্ষকদিগের কাছ হইতে না নিয়া নিতে হইবে ‘অজানা অচেনা’ কোন প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তার নিকট হইতে? মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় যে সনদপত্র দুখানার মালিক হইয়াছিলাম উহাদের অনুলিপি সত্যায়ন করাইয়াছিলাম মহাবিদ্যালয়ের পরিচিত শিক্ষক দ্বারা। তবে আরও যে একখানা সনদপত্র চাওয়া হইয়াছিল তাহা হইল চারিত্রিক সনদপত্র। তাহাও আবার মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের নিকট হইতে। ব্যাপারটা তখন আমার অর্ধপক্ক মস্তিস্ক মানিয়া লইয়াছিল। চারিত্রিক সনদপত্র অধ্যক্ষ সাহেব দিবেন না তো কে দিবেন। যাহাই হউক, গেলাম মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের নিকট চারিত্রিক সনদপত্রের আশায়। মনে ভয় ছিল অধ্যক্ষ সাহেব কি আমাকে চিনিবেন ? কোন দিন তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইয়াছি বলিয়াওতো মনে পড়ে না। আর কেনই বা যাইব। তাহাকে কি আমার কোন কারণে দরকার হইয়াছে ? ভয়ে ভয়ে উনার কামরায় ঢুকিলাম। ভাবিলাম চরিত্র স¤পর্কে যদি খারাপ কিছু লিখিয়া দেন তবে কি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইতে পারিব ? হায়, কি নির্বোধ ছিলাম আমি। সেদিন অধ্যক্ষের গালমন্দ খাইয়া হোচট খাইতে খাইতে করণিকের কামরায় প্রবেশ করিয়াছিলাম। তাহাকে চারিত্রিক সনদপত্রের কথা বলিতেই তিনি পান চিবাইতে চিবাইতে উত্তর দিলেন - “দশ টাকা বাইর কর”। আমি হতভম্ভের মত দশ টাকা বাহির করিয়া দিলাম। তিনি আমার নাম ধাম সব জিজ্ঞেস করিয়া একখানা ছাপানো কাগজ আমার হাতে ধরাইয়া দিলেন। আমি দেখিলাম - আমি নিদারূন দেশপ্রেমিক, কখনোই ঝগড়া ফ্যাসাদ করি নাই, অতি ভদ্র এবং উত্তম চরিত্রের অধিকারী - তাহা আগেই লেখা রহিয়াছে। ইহা ছাড়া অধ্যক্ষ সাহব নিজে সহি করিয়া বলিয়াছেন ‘আমি তাহাকে ব্যাক্তিগত ভাবে চিনি এবং সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করি’। একটু আগের গালমন্দের কথা মনে পড়িল। করণিক সাহেবকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করিলাম - “ইহা কি যাহারা দ্বিতীয় বিভাগ পাইয়াছে তাহারাও পাইবে ?” (দুর্ভাগ্যবশতঃ আমি প্রথম বিভাগ পাইয়াছিলাম) উনি উত্তর দিলেন - “শুধু তাহারাই না সবাই পাইবে’। তার মানে সেই লিটন তরফদার, যে কিনা প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে নিয়া বিভিন্ন জনকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করিয়া চাঁদাবাজি করিত এবং পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করিয়া তৃতীয় বিভাগে পাশ করিয়াছিল তাহাকেও এরকম সনদপত্র দশ টাকার বিনিময়ে দেওয়া হইবে। যাহার মধ্যে একই কথা লিখা থাকিবে ? হায় দুর্ভাগ্য আমার, লিটন তরফদার দশ টাকা দিয়া নিজেকে ধুইয়া মুছিয়া একেবারে আদর্শ দেশ প্রেমিক, ভদ্র বিনয়ী এবং উত্তম চরিত্রের অধিকারী হইয়া আমার কাতারে আসিয়া দাড়াইল। মনের সেই খেদ মুছিতে আমার অনেক দিন লাগিয়াছিল।

ফিরিয়া যাই বি,সি,এস, পরীক্ষা প্রসঙ্গে। বন্ধু হান্নানকে সমস্যার কথা বলিতেই সে উত্তর দিল - ‘আরে এইডা কোন সমস্যা হইলনি, তুই কাগজপত্র নিয়া আয়’। আমি অবাক হইয়া বিস্মিতঃ দৃষ্টিতে তাহার পানে তাকাইলাম। সে তখন তাহার কাগজপত্র বাহির করিয়া আমাকে দেখাইল। আমি দেখিলাম উহাতে দিনাজপুর জেলার কোন এক কর্মকর্তার সীলমোহর সহ দস্তখত রহিয়াছে। ‘এত জায়গা থাকিতে দিনাজপুর হইতে সত্যায়িত করাইয়াছিস ?’ - আমি অবাক হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম। সে একগাল হাসিয়া আমাকে বোকাচন্দর বলিয়া গালিগালাজ করিয়া একখানা সীলমোহর বাহির করিয়াআমাকে দেখাইল। আমি জন্মলগ্ন হইতে নিতান্তই গোবর গণেশ। আমি উহার মর্ম বুঝিলাম না। বলিলাম ‘ইহাই বা তুই কোথায় পাইলি আর সেই কর্মকর্তাকেই বা আমি পাইব কোথায়’। হান্নান আমাকে পাগল ছাগল, গাধার লেজ ইত্যাদি বলিয়া গালিগালাজ করিয়া ব্যাপারটা বুঝাইয়া দিল।

আমি বোধকরি কথাবার্তায়া একেবারে অতীতে চলিয়া গিয়াছি। আমার বিষয় ছিল চাকুরীর দরখাস্তকরন। এ বিষয়ে এখনই বলিব। স্নাতোকোত্তর পরীক্ষার সনদপত্র পাইবার পর (যথাসময়ের দুই বছর পরে) নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আশায় পত্রপত্রিকা দেখিতে শুরূ করিলাম। অচিরেই আশানুরূপ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়িল। পদবি, বেতন এবং সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি দেখিয়া মুহুর্তের মধ্যে টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি, ঘুষ-নারী ইত্যাদি মস্তিস্কে তোলপাড় শুরূ করিল। যথাসময়ে দরখাস্ত লেখিয়া আমি আবারও সত্যায়ন সস্যায় পড়িলাম। কোথায় পাই প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা ? বন্ধু হান্নানের সেই নির্ভেজাল পদ্ধতি ঝামেলামুক্ত (?) হইলেও আমি তাহা গ্রহন করিতে পারি নাই। ভয়ও পাইয়াছিলাম আবার বিবেকের দংশনও ছিল। উহা আবার আমাকে কারনে অকারনে মাঝেমধ্যেই কামড়াইয়া থাকে। তাই সেইবার বহু কষ্টে নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে একজন প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা ধরিয়া রেহাই পাইয়াছিলাম। কিন্তু এইবার ? এইবার সমস্যা আরও বাড়িয়াছে। আগে ছিল একজন কর্মকর্তা কর্তৃক চারিত্রিক সনদ, এইবার দুইজন। কি মুশকিল ? চারিত্রিক সনদ দুইজন হইতে নিতে হইবে কেন ? নাকি দুইজনে চারিত্রিক সনদপত্র প্রদান করিলে চরিত্রের বৈশিষ্ট্য আরও মজবুত হইবে ? নাকি নিয়োগ কর্তারা হান্নান টেকনিক’ বুঝিয়া ফেলিয়াছেন। কিন্তু উনারা কি জানেন না যে হান্নানের জন্য ইহা মাত্র একঘন্টার ব্যাপার ? শুধু দোকানে যাইয়া খুলনা কিংবা চট্রগ্রামের কোন কর্মকর্তার সীলমোহর তৈরী করিয়া আনিতে হইবে। আর সেই সাথে হাতের কিছু নতুন ‘কেরিকেচার’। এ প্রসঙ্গে আর একজন ব্যাক্তির কথা আমার মনে পড়িতেছে। তাহার কথা ভাবিলে আমার নিজেরই লজ্জা হয। আমি যখন সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকি তখন তিনি ছিলেন হলের প্রভাবশালী নেতা। প্রসঙ্গক্রমে বলিয়া রাখি, তাহার কারনেই আমাকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে হয়, যাহার ফলে তাহার উপর আমার কিঞ্চিত রাগও ছিল। সে যখন চলিয়া যায় যায় অবস্থায় তখন আমি নিজেই হলের একজন হর্তাকর্তা (বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ক্রমশঃ আমার বুদ্ধিবৃত্তির আশাব্যাঞ্জক পরিবর্তন ঘটিয়াছে!) একদিন উপর মহল হইতে খবর পাইলাম আমাদের সেই বড়ভাই তিনতলার একটি কক্ষ একা দখল করিয়া রাখিয়াছে এবং আমার উপরই হুকুম হইল উহার কর্তৃত্ব লওয়ার। সেইদিনই রাত্রিরে আমি আমার বাহিনী লইয়া হুমহাম করিয়া উক্ত কক্ষের কর্তৃত্ব লইলাম। কক্ষের অবস্থার কথা বর্ণনা করিয়া পাঠককে বিব্রত করিব না। শুধু এইটুকু বলিতে পারি উহা মানুষের বসবাসের অযোগ্য ছিল। সেই কক্ষে আমি পাইয়াছিলাম এক ব্যাগ সীলমোহর। অমুক জেলার কর্মকর্তা, অমুক থানার ম্যাজিস্ট্রেট, কলেজের অধ্যাপক হেন পদবী বাকি নাই যাহার সীলমোহর ওখানে ছিলনা। ভাইটি আবার এক রাজনৈতিক দল হইতে কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন করিয়া ছাত্র সংসদে অবস্থান করিয়া লইয়াছিল। নির্বাচনের আগে তাহার যে নির্বাচনী লিফলেট ছিল তাহাতে লেখা ছিল - ‘রাজ্জাক মোল্লা জিতবেই, কারণ সে ভদ্র ও বিনয়ী’। আর সেই ভদ্র ও বিনয়ী মোল্লা সাহেবের এহেন কর্মকান্ড দেখিয়া আমরা বিস্ময়ে হতবাক হইয়া গিয়াছিলাম।

প্রসঙ্গেঃ ফিরিয়া যাই। চাকুরীর নিয়োগে দুইজন কেন, দশজন কর্মকর্তার নিকট হইতে চারিত্রিক সনদপত্র চাওয়া হইলেও হান্নান বা রাজ্জাক মোল্লার মত ছেলেদের জন্য তাহা কোন সমস্যা হইবেনা। সমস্যায় পড়িব আমরা - যাহারা ক্ষুদ্র বিবেক সম্পন্ন নির্বোধ। আর যা অবস্থা দেখিতেছি, সামনে হয়তো চাকুরীদাতা তিন চারজন প্রথমশ্রেনীর কর্মকর্তার নিকট হইতে চারিত্রিক সনদপত্র চাহিয়া বসিবেন। তখন আমার মত ভূক্তভোগীরাই বিপদে পড়িবে। তখন বলা যায়না, বাধ্য হইয়া আমাদেরও হয়তো ‘হান্নান টেকনিক’ বাছিয়া লইতে হইবে। (এইভাবে যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দু‘একটা দিক বিনষ্ট হইবার উপক্রম হইবে তাহা কি কেহ ভাবিয়া দেখিবেন?)

ইউনিয়ন পরিষদের নিকট হইতে নাগরিকত্বের সনদপত্র আনিতে গিয়া নতুন অভিজ্ঞতা অর্জিত হইল। অফিসের করণিককে নাগরিকত্বের সনদপত্রের কথা বলিতেই উনি আমাকে জিজ্ঞেস করিলেন - ‘কয়খানা লাগিবে?’ আমি খুব একটা অবাক হইলাম না। বলিলাম - ‘দুইখানা হইলেই চলিবে’। তিনি বলিলেন - ‘পার পিচ পাঁচ টাকা’। আমি বলিলাম - ‘লে হালুয়া, একি মাছের টুকরা?’ তিনি আমাকে পাঁচ টাকার বিনিময়ে ‘দুই পিচ’ নাগরিকত্বের সনদপত্র দিয়া দিলেন এবং যথাযথ ভাবে পূরণ করিয়া লইতে বলিলেন। আমার নাম-ধাম-গ্রাম কিছুই জিজ্ঞেস করিলেন না। আমি এই গ্রহের বাসিন্দা নাকি অন্য জগতের মানুষ তাহাতে তাহার বিন্দুমাত্র মাথাব্যাথা নাই আর তিনিই কিনা বিতরণ করেন নাগরিকত্বের সনদপত্র!

আর একটি ঘটনার উল্লেখ করিয়া উপসংহার টানিব। ঘটনাটি ঘটিয়াছে সাম্প্রতিককালে একটি চাকুরীর দরখাস্ত করিতে গিয়া। গিয়াছিলাম যথারীতি এক অফিসে সনদপত্র সত্যায়ন করিতে। কর্তা সাহেব যাবতীয় সনদপত্র সত্যায়ন করিয়া দিলেন। এমনকি চারিত্রিক সনদপত্রও দিলেন। যদিও তিনি আমাকে আগে কোনদিন দেখেন নাই। বিপত্তি ঘটিল আরেকজন প্রথমশ্রেনীর কর্মকর্তার অভাবে। কারন চাকুরীদাতা দুইজন কর্তৃক চারিত্রিক সনদপত্র চাহিয়াছেন। কি করি ... ... শেষে উনিই উপায় বাতলাইয়া দিলেন। বলিলেন অমুক তলায় অমুক কক্ষে একজন প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা আছেন। উনার নিকট যাও। অগত্যা কাগজপত্র লইয়া খোজাখুজি করিয়া উক্ত কক্ষের সন্ধান পাইলাম। দরজায় দাড়াইয়া বলিলাম - ‘ভিতরে আসিতে পারি?’ ভদ্রলোক অনুমতি দিলেন। আমি সালাম জানাইয়া ভিতরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম এক শান্ত সৌম্য টুপী পাঞ্জাবী পরিহিত ভদ্রলোক বসিয়া আছেন। উনাকে অতিমাত্রায় সৎ লোক বলিয়া মনে হইল। আর তাহাতেই আমার মনে সন্দেহ জাগিল। উনি চারিত্রিক সনদপত্র দিবেন তো? উনার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির পানে তাকাইয়া সংবিত ফিরিয়া পাইলাম। তাহাকে তাড়াতাড়ি আমার সমস্যার কথা জানাইলাম। উনি প্রথমেই না করিয়া ফেলিলেন। বলিলেন আমি কাগজপত্র সত্যায়ন করিনা। আমি বলিলাম আমাকে অমুক ব্যাক্তি পাঠাইয়াছেন। এই বলিয়া আমি আমার সদ্য সত্যায়িত কাগজপত্রগুলো তাহার সম্মূখে তুলিয়া ধরিলাম। তিনি বিরক্ত বোধ করিলেন। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা বুঝিতে পারিয়া বলিলেন - ‘ঠিক আছে মূল কপি এবং অনুলিপি গুলো আমাকে দাও’। আমি তখন ভয়ে ভয়ে বলিলাম - ‘আসলে আমি আসিয়াছি একটা চারিত্রিক সনদপত্র নিতে। এটা ঠিক সত্যায়ন নয়। চাকুরীর দরখাস্ত করিতে এখন দুইখানা সনদপত্র লাগে ... ... ... আমি হরবর করিয়া সবকিছু বলিতে লাগিলাম। তিনি এমনভাবে আমার দিকে তাকাইয়া রহিলেন যেন আমি সাক্ষাত শয়তান। তাহাকে কুমন্ত্রণা দিতে আসিয়াছি। আমি তাড়াতাড়ি পূর্ববর্তী ভদ্রলোকের দেওয়া চারিত্রিক সনদপত্র খানা তাহার সম্মুখে তুলিয়া ধরিয়া বলিলাম - ‘দেখুন উনি যদি দিতে পারেন তাহা হইলে আপনিও নিশ্চয়ই দিতে পারিবেন। আর তাহাছাড়া আপনারা না দিলে আমরা কোথায় যাইব ... ... আবার একগাদা কথা বলিয়া ফেলিলাম। তিনি মনে হইল একটু চিন্তায়ই পড়িলেন। একজন বিপদগ্রস্থ ছেলে আর তাহাছাড়া ... ...। ‘কিন্তু তুমি যে সচচরিত্রবান ছেলে তাহার প্রমান কি?’ - তিনি জিজ্ঞেস করিলেন। এই বার আমি পড়িলাম গ্যাড়াকলে। কি করিয়া এখন আমি আমার চরিত্রের প্রমান দেই? কি বলি কি বলি শেষে আমতা আমতা করিয়া নিজের চরিত্রের পক্ষে সাফাই গাইবার চেষ্টা করিলাম - ‘দেখুন যে ছেলে জীবনের সকল পরীক্ষায় প্রথম শ্রেনী পাইয়া আসিয়াছে সে কি করিয়া দুশ্চরিত্র হইতে পারে? আপনিই বলুন। এভাবে আরও দু’একটা উদাহরন দেওয়ার চেষ্টা করিলাম। তিনি তীক্ষ্ন দৃষ্টি মেলিয়া আমার দিকে তাকাইয়া রহিলেন। হয়তো বা দৃষ্টি শক্তি দিয়া মাপিবার চেষ্টা করিতেছেন আমার চরিত্র। আমিও হাতদুখানা এক করিয়া মুখখানায় একখানা কার্টুন মার্কা হাসি ফুটাইয়া তুলিলাম। এরপর তিনি আমার শিক্ষাগত যোগ্যতার যাবতীয় সনদপত্র খুটাইয়া খুটাইয়া দেখিলেন। তাহারপর দয়া করিয়া সেই সনদপত্র খানা পড়িতে শুরূ করিলেন যাহাতে তাহার দস্তখত পড়িলে আমি আমার চরিত্র সম্পর্কে নিঃসন্দিহান হইতে পারি। ‘কিন্তু’ - তিনি শুরূ করিলেন আর তাহাতেই আমার ভিতর কম্পন শুরূ হইল - ‘এই যে কথাটা লিখিয়াছ “আমি তাহাকে ব্যাক্তিগত ভাবে চিনি” এই কথাটাতো ঠিক না। আমি তো তোমাকে চিনি না’। চেয়ারে হেলান দিয়ে সদ্যজেতা যুদ্ধনায়কের মত তাকাইলেন তিনি আমার দিকে। এইদিকে আমার ধৈর্য্যরে বাধ ভাঙ্গিয়া যাইতেছে। এত সৎ মানুষ হইলেতো সমস্যা। আমি রাগ চাপিয়া বলিলাম -‘আজ তো আপনি আমাকে বেশ ভালভাবেই চিনিলেন। আগামীকাল যদি আমি আবার আসি তবে কি আপনি দিবেন?’ - মনে ভয় ছিল না জানি কি বলিয়া বসেন। কক্ষ হইতে বাহির করিয়াও দিতে পারেন। কিন্তু না। ভদ্রলোক কলমদানী হইতে কলমখানা লইলেন। তারপর আমার চরিত্রের গ্যারান্টী স্বরূপ দস্তখত করিয়া বলিলেন - ‘ঠিক আছে আজই শুধু দিলাম। কিন্তু ভবিষ্যতে আর দিব না।’ আমি মনে মনে বলিলাম শুকুর আলহামদু ... ... । কাগজপত্র গুছাইয়া বাহির হইতেছি। তিনি বলিলেন- ‘কিন্তু ঐ যে লিখেছ “আমি তাহাকে ব্যাক্তিগত ভাবে চিনি”, ঐ কথাটি ঠিক না’। বুঝিলাম তিনিও আমার মত অতি বিবেকসম্পন্ন। হয়তো কথাটা তাহার মাথায় টোকাইতেছে। আমি তাড়াতাড়ি সালাম জানাইয়া কাটিয়া পড়িলাম। মনে ভাবিলাম - ‘দেশটা সৎ মানুষে থুড়ি সৎ প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তায় ভরিয়া গেলে যে কি হইত?’

শুরূতে প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তার অবতারণা করিতে গিয়া ‘অজানা অচেনা’ বিশেষন যোগ করিয়াছিলাম। কারণ আমি এমন এক পরিবারে জন্মগ্রহন করিয়াছি যাহার চৌদ্দপুরূষ হাতড়াইলেও কোন প্রথমশ্রেনীর কর্মকর্তা খুজিয়া পাওয়া যাইবেনা। যাহার ফলে আমাকেই অনেক হাতড়াইয়া প্রথমশ্রেনীর কর্মকর্তা বাহির করিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক প্রভাষককে জিজ্ঞেস করিয়াছিলাম তাহারা কেন সত্যায়ন কিংবা চারিত্রিক সনদপত্র দিতে পারেননা। তিনি উত্তরে বলিয়াছিলেন - ‘আমরা তো গেজেটেড কর্মকর্তা নই।’ হায়রে দুর্ভাগ্য আমার। যেখানে ৫/৬ বৎসর অধ্যয়ন করিলাম সেখানকার শিক্ষকদেরই সত্যায়ন বা চারিত্রিক সনদপত্র দিবার ক্ষমতা নাই আর ওদিকে প্রথমশ্রেনীর কর্মকর্তা হইলেই তিনি সচচরিত্র বিতরণ করিবার ক্ষমতা রাখেন। কেন? চারিত্রিক সনদপত্র প্রথমশ্রেনীর কর্মকর্তা দিবেন কেন? এমন ব্যবস্থা হইলে কি ভালো হইতো না যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্রের পাশাপাশি চারিত্রিক সনদপত্রও দেওয়া হইবে। যাহাতে নূন্যতম দুইটি শ্রেনী থাকিবে। যাহারা নিয়ম শৃংখলা মানিয়া অধ্যয়ন করিয়াছে তাহারা অপেক্ষাকৃত ভালো শ্রেনীর চারিত্রিক সনদপত্র অর্জন করিবে। ইহাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসের পরিমান কিছুটা হইলেও হ্রাস পাইতো। আর আমার মত রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বের অধিকারী ছাত্ররা যে পড়াশোনা ও নিয়ম শৃংখলায় বেশী মনোযোগী হইতো তাহা অšততঃ জোর গলায় বলা যায়। লিটন তরফদারের কথা মনে পড়িতেছে। চারিত্রিক সনদপত্রে দুইটি শ্রেনী থাকিলে তাহারও মনে ভয় থাকিত। চরিত্রের উপর কালিমা লেপন কাহার ভালো লাগে? আর বর্তমান অবস্থা এমন মনে হইতেছে যাহাদের প্রথমশ্রেনীর আত্মীয় স্বজন রহিয়াছে তাহারাই সচচরিত্রবান আর যাহাদের এরূপ আত্মীয় নাই তাহাদের চরিত্রের কোন গ্যারান্টী নাই।


মন্তব্য

কনফুসিয়াস এর ছবি

এই সত্যায়নের ব্যাপারটা আমাদের দেশে একটা জ্বলজ্যান্ত তামশা ছাড়া আর কিছুই না। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির ফরম পূরণের সময় ঝামেলায় পড়েছিলাম, মনে আছে, কেবল শাহজালাল ভার্সিটির ফরমের জন্যে সত্যায়ন করতে হয়নি কিছু, এটা সেই সময়ে বেশ অভিনব ছিল।
*
আপনার প্রথম সাহিত্য বেশ ভাল লাগলো।
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

মজার। আগে পড়িয়াছিলাম।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

হিমু এর ছবি

মূল সনদপত্রের সাথে একশো কপি অনুলিপি ক্রমিক কোডসহ ইস্যু করলেই কিন্তু ল্যাঠা চুকে যেতো।


হাঁটুপানির জলদস্যু

দ্রোহী এর ছবি

এইচ.এস.সি পাশের পর পরই নিজেকে প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার ভেবে নিয়ে নীলক্ষেত থেকে একটা সিল বানিয়েছিলাম।

লোকটার নাম দিয়েছিলাম 'ড. শ্যামল পোদ্দার'! আজও ভেবে পাই না এত কিছু থাকতে "পোদ্দার" নামের প্রতি আমার আগ্রহ হয়েছিল কেন!


কী ব্লগার? ডরাইলা?

মনজুরাউল এর ছবি

এত কিছু থাকতে "পোদ্দার" নামের প্রতি আমার আগ্রহ হয়েছিল কেন!

পোদ্দাররা সাট্টিফিকিটের পোঁদে সীল মারে. সে কারণেও হতে পারে !

.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......

.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- যার পোঁদ আছে সে-ই পোদ্দার, এইটা একটা গ্র্যামাটিক নিয়ম।
আর আরেকজনের উপরে ফাপরিং তাফালিং করার খায়েশ থাকলেও লোকজন পোদ্দার নাম নেয়।
উদাহরণঃ পরের ধনে পোদ্দারী
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

মাহবুব লীলেন এর ছবি

সরকারি চাকরিতে চারিত্রিক সনদ এবং সত্যায়ন চাওযা হয় ক্যান্ডিডেটের স্মার্টনেস পরীক্ষা করার জন্য
কারণ তারা জানে যারা বোদাই তারা সত্যি সত্যি সার্টিফিকেট আর সত্যায়ন জোগাড় করতে গিয়ে আবেদনের শেষ সময়সীমা পার করে ফেলবে
আর যারা স্মার্ট তারা ফার্মগেটে গিয়ে ২৫ টাকায় জন্ম থেকে মৃত্যুর সার্টিফিকেট এবং দরকার পড়লে প্রধান উপদেষ্টার সত্যায়নও নিয়ে আসতে পারবে

০২
সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের থেকে স্মার্টদের বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়

০৩
যে ছেলে কীভাবে সার্টিফিকেট জোগাড় করতে হয় তা জানে না তারতো চাকরিতে আবেদনেরই যোগ্যতা নেই

ভবঘুরে এর ছবি

মনে হচ্ছে আপনার কথাই ঠিক। মেধাবীদের থেকে স্মার্ট; - নীলক্ষেত বা ফার্মগেট থেকে দুর্নীতিতে হাতে খড়ি রয়েছে কিনা তার একটা প্রাথমিক পরীক্ষা করা হয় সম্ভবতঃ। এরপর দেশকে দুর্নীতিতে গোল্ডমেডেল এনে দেয়ার যথাযোগ্য সৈনিক হিসেবে ওরাই চাকুরী পায়।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- আমার একটা সীল আছিলো।
"প্রভাষক
সরকারী ফেনী কলেজ"

আমি নিজেই সাইন মারতাম, এম এ কাশেম। কারণ এই নামে আমার দেওয়া সাইনটা দেখতে অনেকটা আসল আসল লাগতো! দেঁতো হাসি

মামাতো ভাই যখন এমবিবিএস করার পর কয়েক জায়গায় অ্যাপ্লাই করছিলো চাকরির, তখন মাঝে মাঝেই অন্য ঘর থেকে আমার ডাক পড়তো, "প্রভাষক সাহেব একটু এদিকে আসেন। সত্যায়িত করা লাগবে!" হাসি
মাঝে মাঝে অবশ্য এম এ কাশেম সাহেব বলে ডাকলেও ছুটতে হতো হাতে সীল আর কালি নিয়ে। সত্যায়িত করার চেয়ে মজার কোনো কাজই নাই। দেঁতো হাসি
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

দীর্ঘ রচনাটি ভালই লাগিল। কিন্তু ঘটনার ক্রোনোলজী রক্ষা করা হয়নাই বিধায় বারংবার হোঁচটা খাইতে হইতেছিল। তবে লেখার গুনে ক্রোনোলজীর সমসাটা অনেকাংশেই কাটিয়া গিয়াছিল।

এইরকম লেখা আরো চাই।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।