ভুতের বাড়ী

ভবঘুরে এর ছবি
লিখেছেন ভবঘুরে (তারিখ: রবি, ০৭/০৯/২০০৮ - ৩:৩৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এক.
বাসাটা দেখেই পছন্দ হয়ে গেল শম্পার। কি সুন্দর! ঢাকা শহরে দুইদিকে খোলামেলা বাড়ি খুজে পাওয়া মুশকিল। বিশেষ করে মগবাজারের মত এলাকায়। হাসান সেই অসাধ্য সাধনই করেছে। বেশ বড়সড় বাসাটা। পুর্ব ও উত্তর পাশে দুদিকেই খোলা। দুটো বেডরুম; ড্রইং - ডাইনিং। মাস্টার বেডরুমের সাথে বড় বারান্দা। যদিও দুই বেডরুমের বাসার কোন প্রয়োজন ছিলনা - তারা দুজন মাত্র মানুষ। তবুও হাসানের সবসময়ই একটু বড় বাসা পছন্দ - 'আত্মীয় স্বজন কেউ এলে যাতে শোয়ার আলাদা ব্যবস্থা থাকে সেজন্যই দুটো বেড দরকার' - এই হচ্ছে হাসানের বক্তব্য।

বাসাটা অবশ্য একটু পুরোনো ধাঁচের। দশ বার বছরের পুরোনো তো হবেই। আর ভেতরটা এখনকার বাড়িগুলোর মত এত আধুনিক নয়। অবশ্য সে কারনে ভাড়াটাও তুলনামুলকভাবে একটু কম হয়েছে।

তার কাছে সবচেযে ভাল লাগে রাতের ঢাকা। প্রথম রাতে বারান্দায় গিয়ে বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল সে। কি সুন্দর লাগছে দেখতে আশেপাশের দৃশ্য। দশতলার উপরথেকে এলাকার বড় একটা অংশ চোখে পড়ে। রাস্তাঘাট, অফিস, বাড়ি, মার্কেট সব! রাতে বারান্দা থেকে সবকিছু ঝলমলে আলোকিত দেখায় - বিশেষ করে আলোকিত জানালাগুলো দেখতে তার কাছে অদ্ভুত সুন্দর লাগে। বিয়ের পর মালয়েশিয়ায় বেড়াতে গিয়েছিল তারা। রাতের বেলা হোটেলের ব্যলকনি থেকে অদ্ভুত লেগেছিল তার কাছে কুয়ালালামপুর সিটি; তার মনে হয়েছিল আর জীবনে বুঝি আর ওরকম দৃশ্য দেখা হবে না। অথচ নিজের ঘর থেকেই এখন ওরকম দৃশ্য চোখে পড়ছে!

এখানকার প্রতিবেশীরাও বেশ মিশুক। ইতিমধ্যে পাশের বাসার মহিলার সাথে তার বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। বয়সে শম্পার থেকে খুব একটা বড় হবে না অথচ এরই মধ্যে দুই বাচ্চার মা। মহিলা তুলনামুলকভাবে অনেক ভাল। অন্ততঃ আগের বাসার প্রতিবেশী থেকে।

আগের বাসায় প্রথমদিন উঠে জিনিসপত্র গুছিয়ে সৌজন্য দেখাতে পাশের বাসায় নক করল সে। খান্ডারনী চেহারার এক মহিলাকে দেখা গেল দরজায়; শাড়ীর আচল পেচিয়ে কোমড়ে গোঁজা। শম্পার মনে হল মহিলা এই মাত্র তার স্বামীকে একচোট কিলিয়ে তারপর হাত ধুয়ে এল।

’কি চাই?’ - শাড়ীর আচল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করে খান্ডারনী।

'জি মানে আমরা নতুন এসেছি। এই পাশের ফ্লাটে।' - আঙ্গুলের ইশারায় তার বাসার গেটের দিকে ইঙ্গিত করল শম্পা। মহিলাকে আন্টি বলবে নাকি আপা সেটা বুঝে উঠতে পারছে না।

’তাই নাকি’? - যেন ব্যাঙ্গ করে উঠল মহিলা।

শম্পা একটু মুচকি হাসার চেষ্টা করল। মহিলার মুখে কোন ভাবান্তর নেই। আজব মানুষ। আরে দুদন্ড কথাবার্তা বল। কথাবার্তা কি বাজার থেকে দাম দিয়ে কিনে আনতে হয়। বললেই ফুরিয়ে যাবে।

’আচ্ছা ঠিক আছে, আজ যাই আরেকদিন আসব। আপনাকে খুব ব্যাস্ত মনে হচ্ছে’ - শেষে না পেরে নিজেই আবার বলে উঠে।
'আচ্ছা ঠিক আছে।' - বলেই দরজা লাগাতে শুরু করল মহিলা! যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল সে!

প্রচন্ড রকম মেজাজ খারাপ হয়ে গেল শম্পার; অস্ফুটকন্ঠে বলেই ফেলল - ’যান এবার নতুন উদ্দমে কিল শুরু করুন।’

ওবব্বাহঃ সাথে সাথেই আবার দরজা খুলে গেল। ’কিছু বলছিলেন?’ শুনে ফেলল নাকি!
'না মানে বলছিলাম আপনিও আসবেন কিন্তু।'- ভেঙচি হাসি হাসল শম্পা।

'আচ্ছা।' - দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

সেই আগের অভিজ্ঞতার কথা মনে রেখে বেশ ভয়ে ভয়ে পাশের বাসার দরজায় নক করে সে। শুরুতেই মহিলার মিষ্টি হাসিমুখ দেখে মনে মনে আপন করে নেয় তাকে। বেশ মিশুক এই প্রতিবেশী। তবে একটু ফাজিল টাইপের। প্রথম দিনেই তা টের পাওয়া গিয়েছে।

'আপনাদের নতুন বিয়ে বুঝি।' - মুখ টিপে হেসে জিজ্ঞেস করে; চোখে দুষ্টুমির আভাস।
'হ্যা, কেন?' - একটু ভারীগলায় উত্তর হয়ে গেল তার! নতুন বিয়ে হয়েছে বলে মুখ টিপে হাসতে হয় নাকি?
'ও মা, এ দেখি লজ্জা পায়! তা দুজনে রাতে দু বিছানায় ঘুমান নাকি?'
'না তা কেন হবে।'
'ও আচ্ছা, এক বিছানাতেই থাকেন। তা রাতে ঘুমানতো ঠিকমত? নাকি সারারাত ডলাডলি করে কাটান?'
'কি বলছেন এসব। আমার শুনতে ভাল লাগছে না।'
'ভাল না লাগারই কথা। আগে আমারও ভাল লাগত না। আমার মত দুটো বাচ্চার মা হোন দেখবেন এসব শুনতে আপনারও ভাল লাগছে। '
'তাই নাকি? আপনার দুটো বাচ্চা?'
'ক্যান বিশ্বাস হয়না?'
'না ঠিক তা নয়। আপনাকে সেরকম লাগে না।'
'কি করবো ভাই, এগুলো সবই ওভারটাইমের ফল। জামাই আমার কর্মক্ষেত্রের চেয়ে ঘরে ওভার টাইম করতে বেশী পছন্দ করে।' - চোখ টিপে উত্তর দেয় মহিলা!

দুই.
খুব সহজেই কাজের একটা বুয়া পাওয়া গেল। ঐ মহিলাই কাজের বুয়াটা জোগাড় করে দিলেন। অবশ্য জোগাড় ঠিক না। তাদের বাসায় কাজ করে। ওদের বাসায়ও করবে। অন্য কেউ হলে নিজের বাসার কাজের ক্ষতি হবে ভেবে এ খবরই দিত না। এ কারনে মহিলাকে আরো বেশী ভাল লেগে যায় শম্পার।

’জমিলার মা কাজকর্মে খুবই ভাল। কোন চুরিচামারীর স্বভাব নেই। তবে ও সবসময় আবোলতাবোল বকে; উল্টা পাল্টা কথা বলে। ওকে বেশী পাত্তা দিবেন না।’ - জমিলার মার সম্পর্কে জানিয়ে দেন তিনি।

সত্যিই খুব বকরবকর করে জমিলার মা। কথা ছাড়া কোন কাজই করতে পারেনা সে।

'আফনেরা দুইজন মাত্র মানুষ তা এত বড় বাসায় উঠছেন ক্যান?'

'এত বড় বাসা হল কোথায়। আর আমাদের আত্মীয়স্বজন আসলে তাদের থাকার যায়গা দিতে হবে না?'

'কি জানি। চাইরতালায়তো এই বাসায় বিশ জন মানুষ থাহে। এক ঘরে পাচজন কইরা। '

'তাই নাকি?'

'হ, বেডায় মনে লয় এলাকার লোকজনরে ডাইকা তার বাসাত উঠায়। হইটাল বানাইছে হইটাল। সব মিলায়া ২০ জন মানুষ। আমি তো দেইখা তাব্বা খাইয়া গেলাম হেইদিন। এত মানুষ এক ঘরে থাকে। বিল্ডিংডাও মনে লয় এত মাইষের ভার সহ্য করতে পারে না। হেইদিন দেখলাম বিল্ডিংডা কাইত হইয়া গেছে।'

'কাইত হইয়া গেছে মানে?'

'ক্যা বাসায় ঢুকতে দেখেননা? বিল্ডিংটা ডাইনদিকে কাইত?'
'তাই নাকি? খেয়াল করিনি তো!'
'এত মানুষ এক ঘরে থাকলে বিল্ডিং কাইত হইবনা? তয় ঠিকমত না চাইলে দেখা যায় না। '
'ও আচ্ছা।'

ফালতু কথার পাশাপাশি বাজে কথায়ও ওস্তাদ। সেদিন কথায় কথায় হাসানের সাথে কিভাবে পরিচয় তারপর বিয়ে এসব জিজ্ঞেস করছিল সে।

'আসলে ও খুব ভাল মানুষ' - হাসান সম্পর্কে মন্তব্য করতেই জমিলার মা শুরু করে -
'ব্যাডা মাইনষেরে বিশ্বাস নাইগো আফা ব্যাডা মাইনসেরে বিশ্বাস নাই। হেরা হারাদিন উপরে উপরে মিষ্টি মিষ্টি কতা কইবো আর তলে তলে আকাম করবো।'
'মানে?'
'মানে আফনের মতন তিনতালার ব্যাডার বউও কইতো হের সোয়ামী নাকি ফেরেস্তার লাহান মানুষ। কিন্তুক হেই ব্যাডায়ও বউ বাড়িত গেলে ভাড়াইট্যা মাগী নিয়া ফুর্তি করে। '
'কি যা তা বলছ?'
'আমি কি মিছা কতা কই? হের বউ বাপের বাড়িত গেছিল। আমি সকালে কামে গেছি। দেহি ব্যাডার বাইত অন্য মাগী। ভাবছিলাম হের কোন আত্মীয় হইব। পরে হেই মাগীরে জিগাইলাম। অয় কয় হে নাকি হের ফেরেন্ড। '
'তুমি চুপ করতো? ভদ্রলোকের পরিচিত মেয়েরা বাসায় আসতে পারেনা।'
'হ, তা পারে, তয় অর বউ বাসায় থাকতে তো বেডিরে কুনদিন আইতে দেখি না।'
'তুমি চুপ কর। আর একটা কথাও বলবে না।'

তারপরও একা একা গজর গজর করতেই থাকে সে।

অবশ্য কাজের হাত খুবই ভাল জমিলার মা’র। শম্পাকে কিছু বলতে হয় না - নিজেই সব করে দেয়। এ কারনেই তার ফালতু অসভ্য কথাবার্তায় খুব একটা আমল দেয় না সে। অবশ্য শম্পা নিজেই মাঝে মধ্যে কথা শুরু করে তার সাথে। জমিলার মা ছাড়া আর কেই বা আছে কথা বলার মত! একা বাসায় কথা না বলে থাকতে পারে না সে - দম বন্ধ হয়ে আসে।

'আচ্ছা বুয়া - তুমি কি জান আমাদের এই বাসায় আগে কারা থাকত?'

'বাড়িওলার মাইয়া আর তার জামাই থাকতো। ক্যান আপনেরে কেউ কয়নাই?'

'না ঠিক তা নয়। আসলে জিজ্ঞেস করা হয়নি। '

'আর কইয়েন না। হেরা দুইডাই আছিল বদের গুরা। হারা দিন কাইজ্যা করত। কিলাকিলি চুলাচুলি কোনডাই বাদ যাইতনা। একদিন আমার সামনেই বেডি টান দিয়া ব্যাডার লুঙ্গী ছিড়া হালাইল। বেডায়ও কম যায়না - হেও টাইনা ম্যাস্কি ছিড়া ন্যাংটা কইরা ফালাইল অর বউরে। '

'তুমি চুপ কর। একটাও বাড়তি কথা বলবে না। আমি যা জিজ্ঞেস করব শুধু তার উ্ত্তর দেবে। ঠিক আছে?'

'আইচ্ছা হ, ঠিক আছে।'

তিন.
জি,এম,জি,র ফ্লাইট শিডিউল দেখছিল হাসান। নেক্সট রবিবার অফিস ছুটি। তিনদিনের ট্যুর করা যেতে পারে কক্সবাজারে। অনেকদিন থেকেই কক্সেসবাজারে যেতে চাইছে শম্পা। হাসানের জন্য যায়গাটা পুরোনো। সে কারনেই যাওয়ার প্রতি তার আগ্রহ হয়নি। এবার বউকে ছোট্ট একটা সারপ্রাইজ দেবার চিন্তাভাবনা করছে সে। সব রেডি করে শম্পাকে চমকে দেয়া। মনে মনে সারপ্রাইজ দেবার স্ক্রীপ্টও ঠিক করে ফেলে সে।

পরবর্তী বৃহঃবার একটু আগেভাগেই বাসায় পৌছে যাবে সে।

’শরীরটা ভাল লাগছে না তাই চলে এলাম। ’

'কি হয়েছে? শম্পা উদ্বিগ্ন হয়ে গায়ে হাত দিয়ে দেখবে - কই গায়ের তাপ তো ঠিকই আছে?'

'খারাপ লাগছে কেন?'

'শরীর কিছু চাচ্ছে মনে হয়। '

'দেখ দিনে দুপুরে ঝামেলা করবেনা বলে দিলাম। '

'আরে আমি চাইলাম কি আর তুমি ভাবছ কি? শরীর একটু ঘোরাফেরা করতে চাইছে আরকি।'

'ও, এই কথা তাহলে চলনা যাই। বড় আপার বাসা থেকে ঘুরে আসি। '

'না আশে পাশে কোথাও যাব না। ঢাকার বাইরে চলে যাব। '

'তাহলে চল কক্সেজবাজার যাই। আমার কত শখ কক্সেসবাজার সমুদ্র দেখার। '
'ঠিক আছে তাই সই; কাল সকালেই কক্সবাজার চলে যাব তুমি পোটলা গোছাও। '

শম্পা কিছুটা বিষ্মিত হবে। সে তখন টিকিট দুটো দেখিয়ে তার বিষ্ময় বাড়িয়ে দেবে।

'নাহ' - স্বগতিক করে হাসান। এই স্ক্রিপ্টটা পছন্দ হচ্ছে না তার। একটু ম্যাড়মেড়ে হয়ে যায়। রস কম। আরেকটা স্ক্রীপ্ট ভাবে সে।

বৃহঃবার বিকেলে এসেই হুঙ্কার ছাড়বে সে - 'চল, ছুটিটা আমাদের গ্রামে গিয়ে বাবা মার সাথে কাটিয়ে আসি।'
সে জানে শম্পার শ্বশুর বাড়ি যেতে আগ্রহ কম। তারপরও সে হাসানকে খুশি রাখতে যেতে রাজি হবে। পরদিন ভোরে তারা ট্যাক্সিকরে বাসস্টেশনের দিকে রওনা হবে।

শম্পা যেতে যেতে বলতে থাকবে - 'বাবা মার কাছে যেতে আনইজি লাগে। একটু পর পর নামাজ পড়, কোরান পড় ইত্যাদি ইত্যাদি বলতে থাকেন। আমার বিরক্ত লাগে।'
'ও, তোমার যেতে ইচ্চে করছে না?'
'না, ঠিক তা না। তবে অন্য কোথাও গেলে আরও ভাল লাগত।'
'আচ্চা ঠিক আছে তোমার পছন্দের যায়গায়ই যাব তাহলে। বল কোথায় যেতে চাও।'
তুমিতো জানই আমি কোথায় যেতে চাই।'
'ও হ্যা, তাইতো। এই ট্যাক্সি' - সে ট্যাক্সিওলাকে বলবে ’এয়ারপোর্ট চল।’
তারপর শম্পার দিকে তাকিয়ে বলবে ’কক্সেসবাজারই চলে যাই। তুমি কি বলো?’
শম্পা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে। ও নিশ্চয়ই আরো অবাক হয়ে যাবে যখন এয়ারপোর্টে গিয়ে তারা কক্সেসবাজারের ফ্লাইট ধরবে।

হঠাৎই সেল ফোনটা বেজে উঠল। বিরক্ত ভঙ্গিতে ফোনটার দিকে তাকাল। দিলতো সারপ্রাইজ নাটকের রিহার্সেল নষ্ট করে! ইদানীং ফোনগুলো বেশ বিরক্ত করছে। যার বেশীরভাগই ক্রস কানেকশন অথবা রং নাম্বার।

এইতো কিছুক্ষন আগে একটা ফোন এল। ফোন ধরে হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে কেউ একজন বলতে শুরু করল - ”হ্যালো - টিএনটি অফিস। আমার একটা টেলিফোন ডেড হয়ে গেছে।”
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল হাসানের -
”আহা তাই নাকি; চরম দুসংবাদ। কি আর করবেন; কাফন পেচিয়ে কবর দিয়ে ফেলেন।”
'কি? তামাশা করেন আমার সাথে? জানেন আমি কে?'
'হ্যা জানিতো, আপনি মরা টেলিফোনের বাপ; যাই হোক, কুলখানির আয়োজন করলে জানায়েন কিন্তু।'
ঘটাং করে রিসিভারটা রেখে দেয় সে। 'শালার যন্ত্রনা।'

তবে সেল ফোনেরস্ক্রীনে তাকাতেই বিরক্তভাবটা কেটে গেল তার। শম্পাই ফোন করেছে।

'হ্যাল্লো ডিয়ার হামিঙবার্ড।' - চেয়ারে আস্তে হেলান দিয়ে গলায় মধূ ঢেলে কথা শুরু করল হাসান।
হামিঙবার্ডের গলা খাচায় আটকানো লাভবার্ডের মত ভীতসন্ত্রস্ত আর করুন শোনাল - 'এই শুনছো। তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এস। আমি আর এক মুহুর্ত এখানে থাকব না। আমার ভয় করছে। '
'তড়াক করে চেয়ারে সোজা হয়ে বসল হাসান -কেন কি হয়েছে?'
'এটা ভুতের বাড়ি। '
'ভুতের বাড়ি? কি বলছো?'
'হ্যা এইটা ভুতের বাড়ি। এই বাসা ভাল না। '
'তাই নাকি? তুমি কি ভুত দেখেছ নাকি?'
'তুমি কি জান বাড়িওলার মেয়ে এই বাসায় থাকত?' - উল্টো হাসানকে প্রশ্ন করতে শুরু করল শম্পা।
'হ্যা তাতে কি হয়েছে?'

'বাড়িওলার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে এই ঘরে?'

এক মুহুর্ত থামল হাসান। ’তাতে কি হয়েছে?'

'কি হয়েছে মানে? তুমি ব্যপারটা জানতে?'

'হ্যা জানতাম। মানুষ আত্মহত্যা করেনা?'

'আশ্চর্য তুমি আমাকে বলনি কেন?'

'এটা বলার মত কোন ব্যপার হল?'

'ও এই জন্যই এটা বেশ ভাল বাসা, অনেক কমে পাওয়া গিয়েছে এগুলো বলে আমাকে ভুলিয়েছ?'

'না তা ঠিক না। আর যে মরেছে সে তো মরেই গেছে। তাকে ভয় পাওয়ার কি আছে?'

'এটা ভয় পাওয়ার ব্যাপার না?'

'আহা, দেখ পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে বাংলাদেশের বুকে কমসেকম কয়েক হাজার কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। সে কারনে যারা বেচে আছে তাদের ভয় পেতে হবে?'

'তুমি বুঝছনা? মেয়েটা আমাদের বেডরুমের ফ্যানে ঝুলে মরেছে। আমি বেডরুমে ঢুকতে ভয় পাচ্ছি। তুমি তাড়াতাড়ি চলে আস। '

'ঠিক আছে। আমি আসছি। তবে তুমি খুব একটা ভয় পেয়োনা। বাড়িওলার মেয়ে ভুত হলে তোমাকে ভয় দেখানোর কথা না - আমাকে দেখালেও দেখাতে পারে। '

'দেখ ইয়ার্কী করো না - পাশের বাসার ভাবি নেই বাসায়। আমার একা থাকতে প্রচন্ড ভয় করছে। তুমি তাড়াতাড়ি এস।'

আর কথা বাড়ানো সমিচিন হবে না মনে করল হাসান ’ঠিক আছে, আমি আসছি। '
যন্ত্রনা হল তো!

চার.
হাসান বেশ তাড়াতাড়িই বাসায় চলে এল। সদর দরজা খোলা - শম্পা ড্রইংরুমে বসে ছিল। তাদের বেডরুমের দরজা বাইরে থেকে লাগানো।
'কি ব্যাপার; এত ভয় পাওয়ার কি ঘটল? আর এ ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছ কেন?
হাসান ওঘরে ঢুকতে চাইলেই শম্পা বাধা দিতে শুরু করল। '
'তুমি ও ঘরে যেও না। '
'কেন?'
'ঐ ঘরে আত্মহত্যা করেছে বাড়িওলার মেয়ে। '
'দেখ তুমি খামোখা ভয় পাচ্ছ। আর ভয়টা কমার বদলে ধীরে ধীরে বাড়ছে। '
'দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল হাসান। '
'শম্পাকেও ডাকল ভেতরে। কিন্তু সে ঢুকল না। '
'বাধ্য হয়ে ড্রইংরুমে এসে বসল তারা। '
'দেখ - বাংলাদেশে তো এ পর্যন্ত অনেক মানুষ আত্মহত্যা করেছ। তাদেও মধ্যে কতজন ভুত হয়ে ফিরে এসেছে? '
'দেখ তুমি আমাকে উল্টা পাল্টা বুঝিও না। তুমি আজই বাড়িওলাকে বলে দাও। আমরা এমাসেই বাসা ছেড়ে দেব। '
'এত ভাল একটা বাসা। এরকম বাসা খুজে পাওয়া যাবে?'
'না এটা ভাল বাসা নয়। এটা একটা ভুতের বাড়ি। '
'ঠিক আছে তুমি শান্ত হও। আমি কালই বাড়িওলাকে জানাব।'
'না তুমি এখনি জানাও।'
'ঠিক আছে এ বাসাটা ছেড়েই দেব। এই যে আমি এখনি ফোন করছি। '
হাসান দ্রুত বাড়িওলার বাসায় ফোন করল।

ভয় কাটাতে অনেক কৌশলই করল হাসান। কিন্তু শম্পার ভয় কাটে না। রাতে অনেক বুঝিয়ে বিছানায় শোয়াল তাকে হাসান কিন্তু ঘুর্নায়মান ফ্যান দেখে ভয় পেতে থাকল সে। আমি এখানে শুয়ে থাকতে পারবনা। ফ্যানটার দিকে চোখ গেলেই ভয় হচ্ছে।
আহা এত ভয় পাচ্ছ কেন বলতো? আরে মেয়ে ভুত কখনো মেয়েদের ভয় দেখায়না। বাড়িওলার মেয়ের ভুতের তো আমাকে ভয় দেখানো উচিৎ। দুই হাত বাড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসা উচিত। ”এই হাসান দেখ। আমি তোর বউয়ের চেয়েও সুন্দরী।” - রাগের বিষয়টা হাল্কা করার জন্য এ রকম অনেক রসিকতা করার চেষ্টা করল হাসান। কিন্তু কোন কথাতেই কোন কাজ হল না। ফোনে ডাক্তার বন্ধুকে সংক্ষেপে ঘটনা জানাল হাসান। রাতটা অন্য ঘরে কাটানোর পরামর্শ দিল সে। ডাক্তারের কথানুযায়ি অন্য বেডরুমে ঘুমাতে গেল তারা। কিন্তু সারাটা রাত ঘুমাতে পারলনা শম্পা। রাতেও দুবার ঘুমের ঘোরে ভয়ে চিৎকার করে উঠল সে।

পাঁচ.
মোটামুটি বেশ সকালেই বাড়িওলা তার কথিত ’মৃত’ মেয়েকে সাথে করে উপস্থিত হলেন। হাসান আর শম্পা ওদের অভ্যর্থনা জানাল চোখে কালসিটে দাগ নিয়ে। রাতে মোটেও ঘুম হয়নি তাদের।
'কোত্থেকে এই আজগুবি তথ্য পেলেন আপনারা?'- রীতিমতো ক্রুদ্ধস্বরে চেঁচাতে লাগলেন তিনি।
'দেখুন আমাকে ভুল বুঝবেন না।' - হাসান গতকালের ঘটনা খুলে বলল। 'বাড়িওলা তক্ষুনি জমিলার মাকে ডেকে আনালেন। সে পাশের বাসায়ই কাজে ব্যাস্ত ছিল সে।
ওকে দেখা মাত্রই 'এই বদমাশের বাচ্চা; আমার মেয়ের নামে কি বলেছিস' - বলে দ্রুত গালের মধ্যে চটকোনা মেরে বসলেন ভদ্রলোক!
শম্পা তারাতারি ওকে সরিয়ে নিয়ে পাশের ঘরে এল। ভদ্রলোক ওর গায়ে হাত দিয়েছে। অবশ্য দেবারই কথা। তার জলজ্যান্ত মেয়েকে কেউ আত্মহত্যা করে মরেছে বললে খারাপ লাগারই কথা।

শম্পার ভীষন রাগ হতে লাগল। তুমি কেন মিথ্যে কথা বললে বল। নাহলে আমিও মারব তোমাকে। পুলিশের হাতে তুলে দিব। সত্যি কথা বল।

'আফাগো আমারে মাফ কইরা দেন। কিল্লিগা কইছি আমার জানিনা। আমার মাথা ঠিক নাই। আমি আসলে কি কইতে কি কইছি বুঝি নাই।' - ভয়ে কাপা গলায় উত্তর দেয় জমিলার মা।

'তাই বলে তুমি আমাকে বলবে না যে কথাটা মিথ্যা? আমি মিছেমিছি এত ভয় পেলাম?'

'আমি বুজবার পারিনাই আফনে এত ডরাইবেন। আসলে হেয় আমারে কামে নিছিল কিন্তু হারাদিন খ্যাচখ্যাচ করতো আমার লগে। আবার যেইকামই করতাম কোনডাই তার পছন্দ হইতো না। হেয় আবার জামাইয়ের সাথে ঝসড়া ঝাটি করত হারাদিন। কি থুয়া কি কইতো তার কোন ইস্টিশন নাই। মাঝে মইদ্যে শুনতাম হেয় কইতো দেখ তুমি আমার সাথে বেশী ইয়ে করবা তো গলায় দড়ি দিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়ব। আমার মৃত্যুর জইন্য দায়ী কইরা কি সব লিখ্যা যাইব। তখন বুঝবে মজা। সারাজীবন হাজতে কাটাতে হবে। '

জমিলার মা অঙ্গভঙ্গি করে এমনভাবে বাড়িওলার মেয়ের কথাগুলো অভিনয় করে দেখালো যে শম্পা না হেসে পারল না।

'হাইসেন না আফা। বেডির উপরে আমার দুনিয়ার রাগ। প্রতিদিন ঝগড়া বিবাদ হইতো আর আমি আশায় থাকতাম হেয় হয়তো একদিন ঝুইলা পড়বো। কিন্তুক ঝুলে নাই। তাই আপনার কাছে কইয়া আশা পুরন কইরা ফালাইছি। '

'এটা কোন কথা হল? ছিঃ' - পাশের বাসার ভাবীর সাবধানবানী মনে পড়ল। বুয়ার উল্টাপাল্টা কথা বিশ্বাস করে কি কান্ডটা হয়ে গেল!

বাড়িওলা কারো কথা শুনলেন না। ততক্ষনাৎ জমিলার মাকে বিতাড়িত করা হল। ভবিষ্যতে এই এলাকায় যেন না দেখা যায় তাকে সে ব্যাপারে সাবধান করেও দেয়া হল।

আর বাড়িওলার মেয়ের সাথে কথা বলে বেশ অবাকই হল শম্পা। এত ভদ্র নম্র তার ব্যবহার। অথচ জমিলার মা কি উল্টাপাল্টা কথাই না বলেছিল তাকে নিয়ে। তাকে নিয়ে এতবড় একটা রটনার পরও সারাটা সময় চুপচাপ বসে থাকতে দেখা গেল তাকে!

ছয়.
রাতে শুয়ে পড়েছে শম্পা। ফ্যানটা ঘুরছে মাথার উপর। আনমনে ঘুর্নায়মান ফ্যানটা দেখছিল সে। কোন ভয়ই লাগছে না এখন তার। সে ভাবছিল অন্য কথা। ’আচ্ছা দেখতো এখন কাজের লোক কোথায় পাব? দিল তো বেটিকে তাড়িয়ে।’ পাশেই আধশোয়া হয়ে টিভি দেখায় রত হাসানকে উদ্দেশ্য করে বলে শম্পা।

'আরে চেষ্টা করলে ওরকম আরও পাওয়া যাবে। বেশী চিন্তা কোরো নাতো; কালই আমি লোক লাগিয়ে দেব।' - চ্যানেল টিপে দর্শনযোগ্য অনুষ্ঠান বের করতে ব্যার্থ হয়ে বন্ধ করে দিল টিভিটা।
হঠাৎ পাশ ফিরে বলতে থাকে শম্পা। - ’তুমি ব্যাপারটা জান ভেবেই আমি আরো ভয় পেয়ে গেলাম; অথচ তুমি -’
’আমিতো বলেছিই আমি হাল্কা করতে চাইছিলাম ব্যাপারটা। তোমার মাথা থেকে ভুত তাড়াতে চাইছিলাম আরকি। আসলে তাৎক্ষনিকভাবে অন্যকিছু মাথায় আসেনি। ’
'অথচ তুমি অস্বীকার করলেই জমিলার মাকে আমার সন্দেহ হতো। আর এত ঘটনাও ঘটতো না। সেই সুযোগ তুমি আমাকে দাওনি। '
'যাক বাদ দাও - বেশ ভাল একটা শিক্ষা হল। তবে একটা ব্যাপার খেয়াল করেছো?' - হাসান আবার শুরু করে। 'গতকালও তুমি এ ঘরে থাকতে ভয় পাচ্ছিলে। ফ্যানটা ঘুরতে দেখে। অথচ আজ - '
শম্পা আবার তাকাল ঘুর্নায়মান ফ্যানের দিকে। নিরিহ ফ্যানটি ঘুরছে - ভয় লাগার কোন কারনই নেই।
'বাহ - ভয় পাবনা? কেউ সত্যিই ওখানে ঝুলে মরে গেলে ভয় পাবনা?'
'ও তারমানে ঘটনা সত্য হলে তুমি ভয় পেতে?'
'অবশ্যই পেতাম। '
'হু তবেই বোঝো - ভুত আসলে কোথায় বাসা বাধে?'
'তার মানে?'
'মানে বলতে চাইছি ভুতটা কোথায় বাসা বেধেছিল তা কি তুমি ধরতে পেরেছ?'
এইবার বুঝল হাসান কি বুঝাতে চাইছে।
'হু জানি। ভুতের বাড়িটা কোথায় ছিল তা আমি বুঝতে পেরেছি। '
'বলতো কোথায়?'
এই যে এখানে ’আঙ্গুল দিয়ে নিজের মাথায় একটা টোকা মারল শম্পা। ’আমার মাথায়।’
'তাহলে? এই বাসায় থাকতে আর সমস্যা নেই তো? এটা ভাল বাসা নিশ্চয়ই?'
শম্পা মুচকি হাসল।
'তাহলে ভাল বাসায় আবার নতুন করে ভালবাসা শুরু হোক? কি বল?' - চোখ মেরে কিছু একটা ইঙ্গিত করে হাসান।
'জি নেহি জনাব। আপনার ইচ্ছে পুরন করতে পারছি না।' - মুখে একথা বললেও তার চোখে ষ্পষ্ট আমন্ত্রন দেখতে পায় হাসান। এই অদ্ভুত আচরন সবসময় কেন করে শম্পা তা বুঝতে পারে না হাসান। সব মেয়েরাই কি তাই করে? ভাবনাটা মনে আসতেই টিপ করে বেডসুইচ টিপে বাতিটার সাথে ভাবনাটাকেও নিভিয়ে দেয় সে। তারপর ’আমি ভুত; হাই মাই খাই’ - বলে জড়িয়ে চেপে ধরে শম্পার...

ধেত্তোরি, অন্ধকারে ওরা কি করলো না করলো তার আমি কি জানি...


মন্তব্য

স্বাতী দাস এর ছবি

এটা একটা গল্প হয়েছে নাকি আপনী একটা পাগল , গাধা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।