১।
আরেকটা সেমিষ্টার শুরু হয়ে গেল। ক্লাস, রিপোর্ট নিয়ে ব্যাস্ততাও শুরু হয়ে গেছে। দীর্ঘ সামার ভেকেশনের পর ক্যাম্পাসের সবাই আবার আগের ফর্মে। এবার দেশ থেকে পোষ্টগ্রেড ছাত্র/ছাত্রী একদম নাই বললেই চলে। বর্তমান ছাত্রদের সবার মধ্যেই এক প্রশ্ন, ঘটনা কী! দেশের অনেকেরই শুনি এপ্লিকেশন রিজেক্ট। অন্যদিকে চীন বা ভারত থেকে তো প্রচুর ছাত্র/ছাত্রী আসছে। এর মানে রিসার্চ ফান্ড এর অভাব হবার কথা না। বাংলাদেশের ছাত্র/ছাত্রীদের সুনাম কি দিনে দিনে কমে যাচ্ছে? নতুন আসা চৈনিক বালক বালিকাদের কিচিরমিচির শুনে শুনে কানে পোকা ধরে গেল। কথা বলতে গেলে আরেক বিপদ! উচ্চারণের বেহাল দশা। উল্টো প্রশ্ন করে করে জেনে নিতে হয় আসলে কী জানতে চায়। ভারতীয় ছাত্র/ছাত্রীদের নিজেদের মধ্যকার যোগাযোগটা খুব ভাল হয়, তাই প্রথম থেকেই তাদের সাহায্যের দরকার পড়লেই নিজেদের মধ্যে কেউ না কেউ তার সাহায্যের জন্য থাকবেই। এটা অবশ্য চৈনিকদের ক্ষেত্রে আরো বেশি। মানে নিজেদের শক্তিশালী কমিঊনিটি থেকেই তারা সাধারণত সব ধরনের তথ্য পেয়ে থাকে। একটা ব্যাপার খুব মজার লেগেছে, বেশির ভাগ চৈনিক বালক/বালিকাই প্রথম প্রথম স্কলারশিপের টাকা পেয়ে কী করি কৈ যাই অবস্থা! নিত্য নতুন জামা/জুতা কেনা, আইফোন/আইপড, ল্যাপটপ কেনা শেষ হলে তারা একটু স্থির হয়। আমার ল্যাবের এক মেয়ে প্রথম এসে আমাকে বলেছিল, প্রতি উইকে একজোড়া ড্রেস আর প্রতি দুই উইকে এক জোড়া জুতা না কিনলে তার চলে না। সেই মেয়ে এসেছিলতো লং স্কার্ট পরে কিন্তু সেটা ছোট হতে হতে মিনি থেকেও ছোট হয়ে যাবার পর তার কেনাকাটা আপাতত বন্ধ হয়। বাংলাদেশিদের কথা একটু বিশদে বলতে চাই। দেশের সেরা ইউনি থেকে আসা ছাত্র/ছাত্রীরা বেশির ভাগই পিএইচডি করতে আসেন। অল্প কিছু মাষ্টার্স আর রিসার্চ ফেলো আছেন।
২।
একধরনের মানুষ থাকে, তাবলীগ জামাতের জন্য নিবেদিত প্রাণ। সারা বছরই দীনের দাওয়াত দিয়ে আমাদের জন্য দোজাহানের অশেষ নেকী হাসিল করেন। রোযা শুরু হবার পর তাদের দাওয়াতি কাজের জোশ বেড়ে যায় কয়েকগুন। এদের সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার হচ্ছে তাদের কাছে পাকি ভাইদের কদর কোন কোন সময় আমাদের থেকেও বেশি। পাকি ভাইরাও ব্রাদার আবার দেশি ভাইরাও ব্রাদার। তবে পাকি ব্রাদারদের ধর্মীয় জোশ বেশি কিনা তাই তারা একটু বেশি কাছের লোক। বাসার কোন অনুষ্ঠানে দাওয়াত সবার আগে তাদের কাছে পৌছায়। নিজের সন্তান হবার খবর দেশি ভাইদের জানানোর দরকার মনে না করলেও পাকি ব্রাদারদের জানিয়ে মিষ্টি খাবার দাওয়াত দিতে ভুলেননা। দেশে তেমন একটা পাত্তা না দিলেও এখানে তেনাদের কিছু বলাও যায়না আবার সওয়াও যায়না। শেষে দাওয়াতের গ্রুপ দেখলে কেটে পড়ার একটা উপায় বের করতে হয়। তেনারা থাকেন তেনাদের মত, আমি আমার মত।
৩।
আরেক ধরনের মানুষ থাকবে, নিজেকে বড় করে দেখাবার নিরন্তর চেষ্টা করে। দুনিয়ার তাবত বিষয়ে যে তার জ্ঞান অগাধ সে বিষয়ে যেন কারও কোন বিন্দু মাত্র সন্দেহ না থাকে তার জন্য মস্তিষ্কের সব নিউরণের সর্বোচ্চ ব্যাবহার করে যাবে। সোজা বাংলায় যাকে বলে চাপাবাজী। কিন্তু এটা উনাদের বলা যাবে না; সামনে একশ একটা যুক্তি নিয়ে হাজির হয়ে যাবে। গলার জোর এত বেশি হয় বিতর্ক তখন নিছক ঝগড়াতে পরিণত হবে। পরে যখন ঘটনার পরম্পরায় দেখা যায় তার দেয়া যুক্তি খাটেনা, তখনও স্বীকার করে নেয়না যে তিনি ভুল ছিলেন। আজীব! এই ধরনের লোকজনের সাথে কথা বলার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, তারা আশপাশের অন্য সবাই কতটা খারাপ সেটার ব্যাখ্যা দিতে দিতে হয়রান। এতে করে যদি নিজেকে একটু উচুঁতে তোলা যায়! দেশ থেকে এত দূরে এসেও লীগ-বিম্পি, প্রো-এন্টি নানাবিধ শতরকমের গ্রুপ না করলে তাদের চলেনা। তারপরে একজন আরেকজনের পিছে লেগে থাকবে, নাহলে রাতে ঘুম হয়না।
৪।
জামাত শিবিরের কিছু চেলা চামুন্ডা থাকবে, বলা যায় বিশিষ্ট জ্ঞানপাপী। দেশের কোন না কোন ভার্সিটির প্রফেসর অথবা হয়তো ডিগ্রী শেষেই গিয়ে জয়েন করবেন এরকম সব লোকজন। দেখে অবাক লাগে, এদের কাজ হৈল তাবলীগ গ্রুপের সাথে মিলে ধরে ধরে নতুন আসা ছাত্রদের কাউন্সেলিং করা। সদ্য গ্রেজুয়েট পোলাপাইন এসেই হালে পানি পায়না, কোর্স, রিসার্চ নিয়ে হিমশিম খায়। অবশেষে তেনাদের মাথায় হাত বুলানিতে আর মিষ্টি কথায় একটু স্বস্তি পায়। আর অন্যদিকে প্রগতিশীল আর বামপন্থি লোকজনের ভাবের চোটে কেউ কাছেই ভিড়তে পারেনা। চাপাবাজীর চোটে আবার কেউ কথা কইব! ঘাড়ে কয়টা মাথা! বিশ্বের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক সব সমস্যায় যারা কাতর, দেশের যেকোন সমস্যার তাতক্ষনিক সমাধান যাদের কাছে হাতের আঙ্গুলের তুড়ি বাজানোর মত সহজ, এদের ব্যাক্তিগত চরিত্র কিন্তু উপভোগ করবার মত এক বিনোদন! এগুলা বলতে গেলে হয়তো খুব ক্লীশে শোনাবে, তাই বাদ দেই। মাঝে মাঝে এটা ভেবে কষ্ট লাগে যে, আমরা কেউ দেশে ফিরে যাবনা। গাল ভরা বুলি যতই ঝাড়ি না কেন তলে তলে পারমানেন্ট রেসিডেন্সির এপ্লিকেশন ফরমটা ফিলাপ করে বসে আছি। শুধু জমা দেবার জন্য অপেক্ষা। আর দেশে ফিরে যাবে তারা, যাদের আমরা মানুষ মনে করিনা। তার মানে পাক চক্রে সবকিছু একদিন নষ্টদের অধিকারে যাবেই!
৫।
আমি এখানে আসার পর গত কয়েক বছরে বাংলাদেশি ছাত্রদের ডিগ্রী শেষ না করেই চলে যাবার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করলাম। এই ড্রপ রেট কিন্তু কম নয়। কিছু আছে রেজাল্ট/রিসার্চ খারাপ করার কারণে স্কলারশীপ সাস্পেনশনের কবলে পড়ে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখানে এসে আরো ভাল ইঊনিতে চলে যাবার একটা প্রবণতা দেখি। একটা পোষ্টগ্রেডকে স্কলারশীপ সহ আরও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে নিয়ে আসা হয়। সে সব কিছু ব্যবহার করে কিছুদিন পর যখন অন্যখানে চলে যায় সেটা কোন কারনেই ইউনির জন্য সুখকর না, রেপুটেশনেরও বারোটা। এতে করে যে ক্ষতিটা হয় তা হচ্ছে, ইউনিতে দেশ থেকে পরবর্তীতে নতুন ছাত্র/ছাত্রী ভর্তীর ব্যাপারটা আরও কড়াকড়ি হয়ে যায়। নিজের সুযোগ সুবিধার জন্য আমদের অনেক কিছুই করতে হয়। কিন্তু একটা বার ভাবিনা এতে অন্যদের সমস্যা কতটুকু হতে পারে।
৬।
সব মিলায়ে আবার নতুন বছরের (একাডেমিক) যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হয়। এবার আমার কিছু একটা করে দেখাতে না পারলে খবরই আছে। সুপারভাইজরের ঠ্যালা-গুতা খাইতে খাইতে সব সয়ে গেছে, কিছুই আর গায়ে লাগে না। প্রত্যেক উইকে মনে হয় ঠিকাছে এই উইকেতো তেমন কিছু করা হইল না, নেক্সট উইক থেকে একদম ঝাপায়া পড়ুম। কিন্তু কীসের কী! যেই কে সেই। প্রতিদিনই ল্যাব এ গিয়ে ফার্মের মুরগীর মত ঝিমাই। নাহ্ এবার তনুমনঝাঁঝাকরণ ট্যাবলেটের আবিস্কার করেতেই হইবেক!
মন্তব্য
কি কান্ড! আপনেও ইউনি নিয়ে লিখতেছেন দেখি!
চৈনিক বালিকার গল্প এত অল্পে লিখলে কিন্তু খবর আছে।
ডিগ্রী শেষ না করেই চলে যাবার প্রবণতা অন্যান্য দেশগুলির কেমন? ভারতীয় / চিনা?
হা হা...আপ্নের পোষ্টে বলেই লেখাটা জমা দিয়ে দিলাম
অন্যান্য দেশের ছাত্রদের মধ্যে চীনাদের হার বেশি। তবে তাদের ইনকামিং সংখ্যা যেহেতু অনেক বেশি তাই ড্রপ রেইট খুব কম।
হ, আপনার কমেন্টখানা দেখলুম এট্টু আগে। আজকে সচলে ইউনি নিয়ে লেখার ধুম পড়েছে দেখতেছি।
আপ্নে কোন ইউনি, কোন ডিপার্টমেন্ট, সেইগুলান বলেন না। নইলে ওই পরিপ্রেক্ষিতটা ঠিক পাওয়া যাচ্ছে না।
আমি ভাই চাচ্ছিলাম না ইউনির নাম বলতে। এটা অত গুরুত্বপূর্ণওতো নয়।
লেখাটা অনেকটা ডায়েরীর এক পাতার মত করে লেখা। দেশ-ইউনির নামের বাইরে যেখানে আমাদের কিছু ছাত্র/ছাত্রী অধ্যয়ন করছেন বোধকরি মোটামুটি একই চিত্র।
আচ্ছা, সবাই চৈনিক বালিকাদের গল্প আর ছবি এত দেখতে চায় কেন? আমার ডিপার্টমেন্টে ও দেখি চৈনিক বালিকাদের ছড়াছড়ি। তারা খুবই ভাল, হেসে হেসে অনেক কথা ও বলে, কিন্তু তাদেরকে এত দেখার কি আছে! ভাই, আমার জ্ঞানচক্ষু একটু খুলে দেন, আমি আবার কিছু মিস করতে চাইনা
সজল
"কি যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে, কভু আশীবিষে দংশেনি যারে?"
আপনার ভালো না লাগলে না-ই লাগল... এ আর বোঝানোর কি আছে?
একদম ভাল লাগেনাই, তা কিন্তু না। আসলে আসার পর থেকে দৌড়ের উপর আছি, তাই ঠিকমত দেখা হয়নি আরকি। দেখি তাদের সাথে বনধুত্ব স্তহাপন করা লাগবে সামনে
হ্যাঁ, করে ফেলেন। এই চামে আমার লেখাটার বিজ্ঞাপন করে যাই - ইউনিতে চৈনিকদের প্রভাব নিয়ে আমার লেখাটার প্রথম পর্ব দিয়েছি, পড়ে ফেলেন। চৈনিক বালিকাদের জুতার মাপ গায়ের রঙ কান কটকট করে কি না সব... নাঃ, তা অবশ্য নেই
লেখা কি লালে লাল...নাকি আরেকটা দিছেন?
প্রফেসর জোর তাড়া দিতেছে... একটু সামলে নিয়েই পরেরটা দিমু
দিলেন তো হতাশ করে। আপনার লেখাটা অবশ্য পড়েছি, সিরিজের জন্য অপেক্ষা করছি। আলসেমি করে কমেন্ট করা হয়নি যদিও
সজল
হে হে... চর্মচক্ষু চর্মকান খোলা রাখেন, এমনি এমনি জ্ঞানচক্ষু খুলবে
হে হে... বেশ বলেছেন
ভাল পরামর্শ দিছেন, অ্যাপ্লাই করতে হবে
সজল
তনুমনঝাঁঝাকরণ ট্যাবলেট এর প্রণালি টা আমার ও লাগবে...
ল্যাব এক্সপেরিমেন্ট শেষ হৈলে আপনারে দিমুনে, চিন্তা কৈরেন্না। মুফতে একটা গিনিপিগ পাওয়া গেলেতো ভালই
আপনি বাংলাদেশিদের কে ক্লাসিফাই করার মত অবস্থায় আছেন। আর আমার অবস্থা হচ্ছে, পুরো শহরে আর একটা মাত্র বাংলাদেশি পরিবার আছে, তাদের সাথে ও দেখা হয় কয়েকদিন পর পর। মোদ্দা কথা আমি এমনকি দলাদলি, চাপাবাজি, কলহ সবকিছুই মিস করছি।
আমার একটা প্রশ্ন জাগে মাঝে মাঝে, আমরা কেন ভারত, চীনের মত নিজেদের ব্র্যান্ডিং করতে পারিনা, এটা কি আমরা সংখ্যায় কম বলে, নাকি আমাদের সদিচ্ছা কম বলে! পনের কোটিতো একেবারে কমওনা।
সজল
সহজ কথা, রেখেছে বাঙ্গালী করে মানুষ করেনি।
ভালো লেগেছে। সিরিজ বানিয়ে ফেলেন।
...........................
Every Picture Tells a Story
থেঙ্কু মুস্তাফিজ ভাই।
সিরিজ করতে চেষ্টা করব বস্।
"উল্টো প্রশ্ন করে করে জেনে নিতে হয় আসলে কী জানতে চায়।"- একদম খাঁটি কথা...
-------------------------------------
কেউ যাহা জানে নাই- কোনো এক বাণী-
আমি বহে আনি;
আপনার অভিজ্ঞতা কী? লিখে ফেলুন, আমরাও জানি।
"উল্টো প্রশ্ন করে করে জেনে নিতে হয় আসলে কী জানতে চায়।"
তিন বছর ওই জাতির সঙ্গে চাকরী করেছি, 'হোয়েনিয় ক্যানোইয় ইয়উয় ফিনিশা' এখনো কান থেকে যায়নি। বাংলা ভাষা প্রায় সব শব্দের-ই উচ্চারণ লিখতে পারে, কিন্তু এদেরটা ঠিক মত লেখা বাংলারও কর্ম না। আমাদের মধ্যে একটা কথা চালু ছিল, চৈনিকের সাথে কাজ করতে গেলে প্রতি তিন মাসে IELTS ব্যান্ড স্কোর এক করে কমবে - পরীক্ষিত! আমার এক কালের বস আমাকে ইমেইল করেছিলো "Read this, very impotent" - পড়ে প্রথমেই যেটা মনে হচ্ছিলো সেটা হলো, কাকে বললো, নিজেকে না আমাকে?
বলেন কী! আমারতো মনে হয় শুন্য হয়ে যাবে কদিন পর!
আমার বসের আংরেজীর অবস্থা অবশ্য এত খারাপ না। দীর্ঘদিন বৃটিশ ইউনিতে ছিল বলে হয়তো কিছুটা ভাল হৈছে।
নতুন মন্তব্য করুন