জালাল স্যারের মেয়ে মানু আমার সাথেই পড়ত, মানে একই ক্লাসে কিন্তু ভিন্ন স্কুলে। মানুর আসল নাম কী ছিল আমি জানিনা, হয়তো মনোয়ারা বা অন্য কিছু। আমি যখন জালাল স্যারের কাছে অঙ্ক করতে যেতাম তখন মানুও এসে বসত। আসলে স্বেচ্ছায়তো আর আসত না, স্যারের ভয়ে আসত। মেয়েটা অঙ্কে বড় কাঁচা ছিল, তার চেয়েও অঙ্ক ভীতি ছিল বেশি। চলিত নিয়মের অঙ্ক করতে গিয়ে এমন কোনো দিন নেই যেদিন স্যারের ঝাড়ি খায়নি বেচারি। একদিন স্যার এমন রেগে গেলেন, দিলেন মানুর মাথাটা জোরে ঠেঁসে। আর সে গিয়ে ধাক্কা খেল পাশের দেয়ালে। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মানু বেচারি প্রথমে সামলে নিলেও চোখ বেয়ে পড়া অশ্রু রুখতে পারছিলনা কোনোভাবেই। নত মুখে সারাটা সময় বসে রইল গ্যাজ হয়ে আর খাতা ভিজে যেতে থাকল চোখের পানিতে। কষ্ট আর লজ্জায় ছোট্ট মুখটা তার নীল হয়ে গেল, সেটা যতটা না অঙ্ক না পারার জন্য তার চেয়েও বেশি আমার সামনে তাকে এমন অপমানিত হতে হল বলে। আমার সাথে সেটাই ছিল তার শেষ পড়া। আমার মনে মানুর সেই বেদনা মাখা শুকনো মুখের ছবিটাই হয়ে গেল কষ্টের নীল পোষ্টার। যখন গল্প বা উপন্যাসে কোনো চরিত্রের খুব কষ্ট, মরম জ্বালা বা এমন কিছুর বর্ণনা থাকত আমি মনে মনে মানুর মুখটা ভেবে নিতাম।
কাজী মাইন উদ্দিন আমার ছোট বেলার বন্ধু। অনেকদিন বাদে হঠাত সে ফোন করে আমাকে মনে করিয়ে দিল রামগড়ের কথা। স্মৃতি কাতর আমার মনে পড়ে সেই রামগড়, ফেনী নদীর কূল ঘেঁষে ছোট পাহাড়ি মফস্বল শহর। যে শহর আমার দুরন্ত কৈশোরের জাতক, পাহাড়ের কাছে আমাকে বোকা ছাত্র হিসেবে সমর্পণ করেছিল যে শহর, সেই রামগড়। হেমন্তের শেষ দিকে যখন শীত আসব আসব করছে, কুয়াশার চাদর সন্ধ্যার আগেই ঢেকে দেয় রামগড় বাজারের চারপাশটা। আমরা রফিক মেম্বারের ব্রিক ফিল্ড থেকে এক প্রস্থ আড্ডা সেরে বাজারে যাই চা খেতে, তারপর আরেক প্রস্থ আড্ডার তোড়জোড় শুরু হয়। টেলিফোনের এই প্রান্তে আমি স্মৃতিতে বিভোর হয়ে রই। কুয়াশার চাদরে আমি কেন যেন বেদনায় ভরা মানুর নত মুখের আবছা প্রজেকশন দেখতে পাই। মানু কেমন আছে সেটা জানতে ইচ্ছা করে আমার। কিন্তু মাইন উদ্দিন আবার কী না কী ভেবে বসে, তাই জিজ্ঞেস করা হয়না তবে তাকে কথা দিয়ে ফেলি কবে এবং কয়টার গাড়িতে রামগড় যাব। ফোন রেখে আমি কিছুটা অবাকও হই, ঘটনা কী! আমার অবচেতন মনে মানু কি তাহলে সবসময়েই ছিল? কে জানে?
তাজমহল হোটেলে চা খেয়ে আমি আর মাইন উদ্দিন যাই বিড়ি কিনতে। 'পিয়া ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোরে'র নতুন রুপ আমাকে একটু অবাক করে। এমন বাহারি রকমের ঝলমলে লাইটিং আর ডেকোরেশন আশেপাশের কোথাও দেখা যায়না। বরাতে ছিল আর মনে আকাঙ্খাও ছিল বোধহয় বেশি তাই মানুর দেখা পেয়ে গেলাম। কিন্তু মানু একা না, তার সাথে আরেকজন পুরুষ। মানুকে খুব হাসি খুশি দেখায়। তারা দুজন কিছু একটা নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে আর দোকানীর সাথে চলে দর কষাকষি। মানুর সাথের লোকটা কি একটা বলতেই মানুর খিলখিল হাসি আমার কানে পৌছায়। আমার কেন জানি এই দৃশ্যটা মোটেও ভাল লাগেনা। আমার মনে মানুর যে ছবিটা ছিল বাস্তবের এই দৃশ্য তার পুরই উলটো। আকৈশোর মনে গেঁথে রাখা একটা ছবির এমন ব্যাতিক্রমী রুপ আমি কেন যেন মেনে নিতে পারিনা। আমার কষ্ট লাগে, বুকে হাসফাঁস লাগে। মানু সারা জীবন কষ্টে থাকুক, তার মুখটা সারাজীবন বেদনায় নীল হয়ে থাকুক এটা আমি অবশ্যই চাইনা, কিন্তু আমার ভেতরের আরেকটা আমি সেটা সহ্য করতে পারেনা। এমন দ্বিধা দন্দ্বে মনের অন্দোলন যেন মুখে প্রকাশ না পেয়ে যায় সেজন্য মাইন উদ্দিনকে রেখে আমি পালাতে চাই, দ্রুত বাংলা বোর্ডিং এর কোঞ্চিপায় পৌছাই। মাইন উদ্দিন একটু পর এসে আমাকে বিড়ি দেয়। আমি টানতে থাকি, ধোঁয়ার কুন্ডুলী বানাতে থাকি, জোরে খুব জোরে। ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় আমার চারপাশে দেয়াল তুলে দিতে চাই। মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে আমার। আচ্ছা বিড়ির মধ্যে কি ঐ বেটা কিছু মিশিয়ে দিল নাকি! আমার জিজ্ঞেস করতে মন চায়না।
মন্তব্য
ভাল লাগল গল্প
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
ধন্যবাদ
হ। ভাল গল্প। কাফ লভের গল্প ভাল পাই। কিন্তু আজকাল ছোটবেলায় আর একটা মাত্র প্রেম ফ্যাশনেবল থাকছে না, হয় ত্রিকোণ প্রেম আনুন নয় পাত্রীর সংখ্যা বাড়ান
হা হা...ত্রিকোণ প্রেম বা একাধিক পাত্রী সাথে প্রেম আর কয়জনের কপালে জুটে বলুন? একজনের তালে নাচতে গিয়েই তো বেশির ভাগ মাতাল হয়ে যায়।
তবে আসলে কী, আমি এখানে প্রেম ব্যাপারটাই দেখাতে চাইনি। প্রেম না হয়েও যে আমাদের মনে কিছু জিনিষের প্রভাব থেকে যায় সেটা উপজীব্য করতে চেয়েছি। হয়তো আমার গল্প বলার দুর্বলতা, সেটা ঠিক মত বোঝাতে পারিনি
ভাল বলেছেন।
না, বরং আমিই বলতে ভুল করেছি। এটাকে কাফ লভ না বলে কাফ ক্রাশ বলা উচিত ছিল বরং। তাও সেই ক্রাশটা একটু অদ্ভুতরকম, একটা অন্যরকম স্মৃতির মধ্যে জীবিত ছিল। আপনি কি বলতে চেয়েছেন সেটা বুঝতে পেরেছি সম্ভবত, তবে আমার মন্তব্যটায় সেটা ঠিকমত প্রকাশ পায়নি। লেখককে হতাশ করার জন্য দুঃখিত।
আরে বস্, এটাইতো সচলের মিথষ্ক্রিয়া। কেউ বোঝাবে, কেউ বুঝবে অথবা না বুঝলে আলোচনা হবে। অনেক ধন্যবাদ।
- ট্যাগ দেখি নাই প্রথমে। তাই ভাবলাম আপনার জীবনের কাহিনী।
- গল্পটা ভাল্লাগসে।
অনন্ত
ভাল্লাগসে জেনে ভাল লাগল।
এই দ্বান্দ্বিক চিত্রণগুলো বেশ ভালো লাগলো !
রোমেল চৌধুরী
ধন্যবাদ।
শুভেচ্ছা জানবেন।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
হ!
অ.ট. আপনার বিষাদনগর পোষ্টে ঢুঁ মেরে ফিরে আসতে হলো। বলে সংরক্ষিত এলাকা!
উপস্, এটা গল্প! হা হতোস্মি...
আমি তো 'আসল হিস্টুরি' ভেবে খাঁটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিচ্ছিলাম!
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
অ.ট: হ,
কোন কুক্ষণে যে এডিট করতে গিয়েছিলাম... এখন কপাল চাপড়াই! (ফুঁপিয়ে কান্নার ইমো)
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ভালো লাগল।
কুটুমবাড়ি
ধন্যবাদ কুটুমবাড়ি।
নতুন মন্তব্য করুন