ফরহাদের ডিউটি কতক্ষন? -তার ডিউটি আর পাঁচজন সরকারী চাকুরের মত না, যদি জানতে চান। এই এক্সচেঞ্জের অপারেটর আছে দুইজন, ফরহাদ আর মঞ্জুলা'দি। মঞ্জুলা'দির আবার নানা ধরনের সাংসারিক সমস্যা। শাশুড়ির-ননদের সাথে বনিবনা হচ্ছেনা, ছেলেটা বখাটে হয়ে যাচ্ছে, স্বামীর রিটায়ারমেন্টের সময় হয়ে গেছে সেই চিন্তায় ঘুম হচ্ছেনা ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই সবসময়ই তিনি ফরহাদকে ডেকে বলেন, "ভাইরে, তুই ছাড়া আমার আপন কাউরেতো দেখি না। নাইট ডিউটা তুই করে দে ভাই, আমি দিনে থাকবনে। বুঝিসই তো রাতে ঘর থেকে বের হতে কত ঝামেলা।"
ফরহাদ তার পাতানো এই বড় বোনটার কথা ফেলতে পারেনা। তার চাকরীর প্রথম পোষ্টিং হয় এখানে প্রায় দুই বছর আগে। এখানে আসার পর এই মঞ্জুলা'দি তার জন্য বাসা ঠিক করা, রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা সব নিজ থেকে করেছেন। এই মধ্য চল্লিশের মহিলাটি মনের অজান্তেই তার লোকাল গার্ডিয়ান হয়ে গেছেন। ফরহাদ খুশি মনেই প্রতিদিন রাতের ডিউটি করে।
রাজধানী ঢাকা থেকে এত দূরে ছোট সেই মফস্বল শহরের আর কয়জনেরই বা টেলিফোন থাকে বলুন; বিভিন্ন সরকারী অফিসের কর্মকর্তাদের অফিস আর বাসার বাইরে অল্প কিছু ব্যাবসায়ী গোছের লোকজনই টেলিফোন রাখার বিলাসীতা করে। এতে করে যা হয় আর কি-বেশিরভাগ টেলিফোন নাম্বার অপারেটরের মুখস্ত হয়ে যায়। এক্সচেঞ্জে ফোন করে নাম্বার বলার প্রয়োজন পড়ে না, নাম বললেই টেলিফোনে লাইন লেগে যায়। যেমন থানা থেকে ওসি সাহেব ফোন করে বলেন "টিএনও সাবরে দ্যান", বা টিএনও সাহেব ফোন করে বলেন, "চেয়ারম্যান সাহেবকে একটু দিন তো প্লিজ"- এরকম চলতে থাকে। আবার কিছু নাম্বার থাকে অফিসের, যেমন একজন ফোনে বলে "আমারে একটু কলেজে দ্যান" লাইন দেয়া হয় শহরের একমাত্র ডিগ্রী কলেজে। অথবা যখন কেউ ফোন করে বলে "আমাকে সিও অফিসে লাইনটা দেবেন কাইন্ডলী তখন লাইন দিতে হয় বিডিআর এর লোকাল হেডকোয়ার্টারে। এভাবেই সবাই টেলিফোন করে অপারেটরকে অনুরোধ করে তার কাঙ্খিত নাম্বারে কথা বলার জন্য। তো ছোট সেই মফস্বল শহরে "টেলিফোন-এক্সচেঞ্জ-টেলিফোন" এই যান্ত্রিক চক্রের মাঝখানে থেকেও অপারেটর একটা মানবিক স্বত্তা যা দিনে দিনে সবার খুব কাছের, খুব আপন হয়ে ওঠে। অপারেটর যখন অন্যদের সাথে কথা বলে তখন মনে হয় যেন প্রত্যেকে এক একজন আত্মীয়। ধীরে ধীরে শহরের ফোনওয়ালা লোকদের টেলিফোনে লাইন দিতে বলার অনুরোধটা পরিণত হয় আবদারে।
এভাবেই চলছিল কিংবা আমরা বলতে পারি ছোট এই পাহাড়ি শহরে তার দিন ভালই কাটছিল। ধীরে ধীরে শহরের আবদারকারী মানুষগুলোকে ফরহাদ ভালবেসে ফেলে। শুধু মাঝে মাঝে একটু অস্থির লাগে এই ভেবে যে, যারা সমতল থেকে এই শহরে আসে তাদের কেউই পাহাড়কে ভালবেসে আসেনা। বরং তারা পাহাড় থেকে শুধু নিতে চায়, তাকে লুন্ঠন করতে চায়, কেউ ভালবেসে তার জন্য কিছু করতে চায়না। অবশ্য এমনটা ভাবার কারনও আছে, আসুন আমরা সেটাও জানি।
সীমান্তবর্তী পাহাড়ি শহরে গাছ বা কাঠের চোরাকারবার একটা ভাল ব্যাবসা। এখানকার বড় বড় ব্যাবসায়ীরা মোটামুটি সবাই এটার সাথে জড়িত। তারা যে প্রশাসনের লোকজনকে ভাগ দেয় না, তা না। ফরেষ্ট অফিসার, টিএনও, থানার ওসি থেকে শুরু করে পৌরসভার চেয়ারম্যান এমনকি বিডিআর এর সি.ও. সবাই কিছু কিছু করে ভাগ পায়। এটা একটা ওপেন সিক্রেট এবং আপনাদের অবগতির জন্য বলি, আমাদের ফরহাদও এটা জানে, শুধু তাই না হয়তো একটু বেশিই জানে। কারন রাতের বেলায় তার ডিউটিতে বেশির ভাগ টেলিফোন কলের কথা বার্তা হয় এই সংক্রান্ত লেনদেনকে কেন্দ্র করে।
তারপর একদিন দেশের একটা কী দুটো দৈনিক পত্রিকার মফস্বল সংবাদের পাতায় একটা খবর ছাপা হয়। যেখান থেকে জানা যায়- ফরহাদ আত্মহত্যা করেছে। খবরে প্রকাশ, স্থানীয় টিএন্ডটি এক্সচেঞ্জের টেলিফোন অপারেটর ফরহাদ চৌধুরীর সাথে কাঠ ব্যবসায়ী জনৈক মকবুল আহমেদের কন্যা জয়া পারভীনের প্রেম হয়। তাদের এ সম্পর্ক জয়ার পরিবারে জানাজানি হলে ফরহাদ জয়ার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দেয় কিন্তু পরে সেখান থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে রাগে ক্ষোভে সে বিষ পানে আত্মহত্যা করে।
বাজারের জনৈক কাঠ ব্যবসায়ী মকবুল আহমেদের মেয়ে জয়া পারভীনের সাথে নাকি অপারেটর ফরহাদের প্রেম- আমরা এত কিছু জানতাম না। তবে যেটা জানতাম তা হলো, মকবুল মিঞা যেনতেন "জনৈক" না বরং অত্যন্ত প্রতাপশালী একজন ব্যাবসায়ী। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সে টিএনও বা চেয়ারম্যানকেও পাত্তা দেয়না। শাল-সেগুন-গামারি-চাপালিশের মত দামি দামি কাঠ চোরাকারবারিতে সে এক নম্বর। সে যেমন জঘন্য লোক তার একহালি মেয়ের সবগুলাও তেমন খারাপ। বাজারে তাদের নিয়ে নানা কুকথা রটে। শহরে তখন জোর গুজব, ফরহাদ আসলে আত্মহত্যা করেনি। মকবুল মিয়ার ভাড়াটে গুন্ডারাই তাকে খুন করেছে। আমাদের বুঝতে একটুও কষ্ট হয়না যে, ডালমে কুছ কালা আছে।
জয়া পারভীনের রুপ যথেষ্টই ছিল। চেনা জানা এলিট শ্রেনীর বিয়ে কিংবা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে জয়া পারভীনকে কড়া মেকআপ সহ দেখা যেত। এমনকি হারমোনিয়াম নিয়ে অন্যদের সাথে নাকি সুরে হিন্দি গানের দুয়েকটা লাইনও সে গাইত। ফরহাদের তার প্রেমে পড়া মোটেই অবাক করার মত কোনো বিষয় না। যেমন গুরুত্বপূর্ণ না কয়দিন আগে বিরতি হোটেলের কেবিনে বসে জয়া আর ফরহাদ কেক-কোক খাওয়ার বিষয়টা। গাঢ় সন্ধ্যার ঠিক আগে বিরতি হোটেলের কেবিনে যে খাওয়া-দাওয়ার বেশি কিছু হয়নি সেটা নিশ্চিত করেছে হোটেলের ম্যানেজার কার্তিক মোহন।
কিন্তু কথা হচ্ছে, জয়া পারভীনের সাথে বিয়ে না হলেই ফরহাদ আত্মহত্যা করবে এটা মেনে নেয়া যায়না। শহরের কেউই মেনে নিতে পারছেনা। সবার মনে এক প্রশ্ন- তাহলে কী আসলে এসব প্রেম-ট্রেম বা বিয়ে-টিয়ে কিছুনা। ঘটনার মূলে আসলে অন্যকিছু। হতে পারে চোরাকারবারিদের কোনো গোপন তথ্য যা শুধু মাত্র টেলিফোন অপারেটর ফরহাদ জানে- আর কেউনা! হতে পারে, এমন কোনো বিষয় যেটা কাঠ ব্যাবসায়ী তো বটেই পুলিশের ওসি, বিডিআর এর সিও সবার জন্য হুমকি! অথবা মকবুল মিয়ার এক ঢিলে দুই পাখি মারার ব্যাপারটাও ফেলে দায়া যায়না। কিন্তু সুষ্ঠ তদন্ত ছাড়া সেটা জানার উপায়ই বা কী।
সেই শহরের একটা ছোট পত্রিকার "আরও ছোট" সাংবাদিক হিসেবে পুরো ঘটনার তদন্তের ভার আমি নিয়ে নিই অনেক ঘুরাঘুরি করে একটা অনুসন্ধানী রিপোর্টও লিখে ফেলি। কিন্তু ঐ রিপোর্ট লেখা পর্যন্তই, সম্পাদক সালেক ভাই আমাকে ডেকে নিয়ে নীচু গলায় বলেন, "বস্ ফোন দিসিলো- এবার ক্ষান্ত দ্যান। আপনেরে যে 'কালাডেবাতে জংলী হাতির উপদ্রব' শিরোনামে একটা স্টোরি করতে বলসিলাম, ঐটার কতদুর?"
আমি বলি, "হয়ে যাবে বস্। কাল পরশুর মধ্যেই দিয়ে দেবনে।"
ফরহাদের মৃত্যু সেই ছোট পাহাড়ি শহরটাতে বড় আলোড়ন তুললেও সেটা ক্ষনিকের জন্য। সবাই খুব দ্রুত সব ভুলে যায়। আমরাও চেপে যাই, চেপে যেতে হয়।
মন্তব্য
হুম। এইই অবস্থা।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ
হ, এইই গঠনা।
লিখেছেন কিন্তু ভাল।
হে হে হে...বলেছেনও ভাল
অনেক শুভেচ্ছা জানবেন শুভাশীষদা।
গপ্প ভালই লাগলো তবে অ্যানালগ এক্সচেঞ্জ ওটা নয় বোধহয়। বরং ম্যানুয়াল এক্সচেঞ্জ বলাটাই যুক্তিযুক্ত।
পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন