খোলা শার্সি দিয়ে ঘোর লাগা চোখে দূরের দিগন্তে বহুক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন আজাদ সাহেব। সম্বিত ফিরল বাসের হেল্পারের ডাকে। ‘হায়রে বুড়া মানুষটা কানে কম শুনে মনে হয়!’ ছেলেটার দিকে কটমট করে তাকাতেই হেসে ফেলল সে। আবার বলল
-চাচা কখন থেইকা বলতেসি জানলাটা বন্ধ করেন, ভিইজা গেলেন তো! দেখি আপনে সরেন, আমি জানলাটা লাগায়ে দেই। বলেই বেরসিকের মত শার্সিটা টেনে দিল ছেলেটা।
সত্যিই বৃষ্টির ছাট লেগে বেশ ভিজে গেছেন তিনি, কিন্তু টের পান নি। কি গভীর খেয়ালে আজ মগ্ন হয়ে যাচ্ছেন একটু পর পর! বাসস্ট্যান্ড থেকে অনেক বায়নাক্কার পর ঘণ্টাখানেক পার করে বাসটা ছাড়তে না ছাড়তেই আজাদ সাহেব ঘুমে একেবারে কাদা হয়ে গেলেন। শহরের যানজট ছাড়িয়ে কিছু পথ যাবার পর হঠাৎ ঝাঁকুনি খেয়ে বাসটা দুলে উঠতেই তার ঘুমটা চটে গেল। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে তিনি জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন আর তাকাতেই একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। কাজলপরা আকাশ থেকে সদ্য ফোটা জুঁইফুলের মত নিঃশব্দে বৃষ্টিদানা ঝরে পড়ছে, সাথে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ। যেন অনন্তকাল ধরে ঝরে চলেছে এমন ধারা! বহুদিন তিনি এমন বৃষ্টি দেখেন নি। নাকি দেখেছেন, মনে করতে পারছেন না! স্মৃতিগুলো আজকাল বেশ বেয়াড়া গোছের হয়ে যাচ্ছে, মনের অলিতে গলিতে ডানপিটের মত ঘুরে বেড়ায়, একেকবার একেক জামা জুতো পরে আসে আর তার চেহারা বদলে যায়! শত ডাকাডাকিতেও ধরা দেয় না! কিন্তু আজকের দিনটাই যে অন্যরকম, তাই সবকিছুই নতুন লাগছে হয়তো! মনে মনে হাসলেন আজাদ সাহেব।
সকাল থেকে খুব ছটফট লাগছিল, বহু কষ্টে চেপে রাখছিলেন আজাদ সাহেব তার উত্তেজনা। বয়স সত্তরের কোঠায়, নিজের উপর ভরসা করার মত শারীরিক আর মানসিক অবস্থা কোনটিই এখন নেই। কিন্তু হপ্তাখানেক ধরে তিনি যে এডভেঞ্চারের ফন্দি আঁটছেন সেটা এবারে ঠিকঠাক সেরে নিতে তিনি বদ্ধপরিকর, আরেকবার নিজের দোষেই সব ভণ্ডুল হয়ে গেলে কিছুতেই মেনে নিতে পারবেন না। খুব খেটেখুটে বাড়ি থেকে পালানোর গোপন নকশাটা তৈরী করেছেন তিনি! সকালে তার লিকপিকে পৌত্রটিকে নিয়ে তার ছেলের বউ যখন স্কুলের দিকে রওনা হবে তখন তিনিও আলগোছে বেরিয়ে পরবেন বাসা থেকে। এতক্ষণ প্ল্যান মতই সবকিছু হয়েছে। তবু খুব টেনশন হচ্ছিল, কিন্তু বাসটা চলতে শুরু করতেই তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন! বুকটা এখন কেমন ফাঁকাফাঁকা লাগছে, স্কুলের ইউনিফর্ম পরা দেবশিশুটির মুখ মনে পড়ছে বারবার। বাবা মা নাম রেখেছে কাব্য। প্রতিদিন সাত সকালের বেশ আগেই কাব্যকে তার মা ঘুম থেকে তুলে স্কুলের জন্য তৈরি করে দেয়, খুব কষ্ট হয় বেচারার। আজ সকালেও ঘুমজড়ানো চোখে পালিয়ে এসে দাদুর কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিল, মা এসে কোল থেকে নিয়ে যায়। দিন কতক আগে একবার খুব মন খারাপ করে আজাদ সাহেব গনগনে রোদ্দুর মাথায় করে বের হয়ে গেছিলেন বাসা থেকে। এদিক ওদিক অন্যমনস্কের মত ঘুরোঘুরি করে কখন যে কাব্যর স্কুলের গেইটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন খেয়াল করেন নি! আজাদ সাহেবের রাগ হবার কথা, কিন্তু তিনি হেসে ফেলেছিলেন, মনে মনে বলেছিলেন-‘পারবে না তুমি, তোমার ওই ক্ষুদে উত্তরপুরুষটার জন্যই তুমি গৃহত্যাগী হতে পারবে না!’ সেদিন স্কুল ছুটি হলে দাদুর কোলে চরে মহানন্দে কাব্য বাসায় ফিরেছিল। সংসার নামের রঙ্গমঞ্চে কী এক অদ্ভুত মায়াগ্রন্থিতে বাঁধা পড়ে যায় মানুষ। কিন্তু তাকে এই গ্রন্থি শিথিল করতেই হল। অন্যের গলগ্রহ হয়ে কদ্দিন আর থাকা যায়। সময়ের নিষ্ঠুর পরিহাসে নিজের আত্মজের কাছেই যেন বোঝায় পরিণত হয়ে যায় বৃদ্ধ বাবা মা, হ্যাঁ তিনিও হয়েছেন। এটাই এখনকার স্বার্থপর সময়ের রীতি। তাইতো এই স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যাচ্ছেন আজাদ সাহেব, বাসে নয় যেন একটা টাইম মেশিনে চেপে সময়ের উল্টো দিকে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছেন তিনি। যাপিত জীবনের শহুরে অক্ষমতায় বা অপারগতায় বহু যুগ আগে যে গ্রামটির সাথে তার বিচ্ছেদ হয়েছিল সেখানেই ফিরে যাচ্ছেন তিনি, তার শৈশব-কৈশোরের নিশ্চিন্দিপুরে।
বাস থেকে নেমে মিনিট বিশেক হেঁটে যখন বাড়িতে পৌঁছুলেন তখন সূর্যটা হেলে পড়েছে, চারপাশে তখন কনে দেখা আলো। অনেক পুরোনো বাড়ি। বাড়িটি তার মামার। বেশ বড় একটা উঠোন। দুপাশে টিনের ছাউনি দেয়া প্রায় দশ বারোটি ঘর। এককোনে বহু হাসি কান্নার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই দোতলা মাটির ঘরটি, যেখানে দৈত্যদানো আর রাজারানীর গল্প শুনে অসংখ্য রাত্তির কেটেছে তার! বাড়ির মানুষগুলোর সাথে কুশল বিনিময়ের পর উঠোনে পাটি পেতে বসলেন আজাদ সাহেব। আজকে নাকি পুর্নিমা, আকাশে কোজাগরী চাঁদ। তার আলো লুটোপুটি খাচ্ছে টিনের ছাউনিগুলোতে আর উঠোনটাকে মনে হচ্ছে যেন একটা পুরোনো রুপোর থালা! কতদিন এমন পুর্নিমা দেখেন নি তিনি মনে করতে পারলেন না! দেখবেন কি করে, তাদের শহরের আকাশটা তো ঢেকে গেছে ইট সুরকির গগনচুম্বী দালানকোঠা দিয়ে।
আজাদ সাহেব চায়ে চুমুক দিচ্ছেন আর ভাবছেন জীবনটা যদি চার অধ্যায়ের এক উপন্যাস হয়ে থাকে তো দুটো অধ্যায় তার এখানেই কেটেছে। তখন কি আর তিনি আজকের আজাদ ছিলেন! তিনি ছিলেন এই নিশ্চিন্দিপুরের অপু! এমনকি তার একজন দুর্গাও ছিল, আম আঁটির ভেপু ফেলে রেখে যে কিশোরীটি এক নিরালা দুপুরে এই অপুর ছেলেবেলাকে প্রায় নিঃস্ব করে দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিল। আজ খুব মনে পড়ছে তার সেই দুর্গা মানে বেলা দিদির কথা। আজাদ সাহেবের বাবার ছিল বদলির চাকরি, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই নতুন শহরে তাকে চলে যেতে হত চাকরির কারনে। মা, আজাদ সাহেব আর তার ভাইবোনেরা অনেকদিন এই মামার বাড়িতে কাটিয়েছেন। বেলাদিদি ছিল তার মামার মেয়ে, তার ভাই বোনেরা তাকে বুবু বলেই ডাকতো। আজাদ সাহেবের নিজের অনেকগুলো ভাইবোন থাকলেও তিনি ছিলেন ওই দিদির ন্যাওটা, সব বায়না ছিল তার কাছে, সব দুষ্টুমিতে বেলাদিদি ছিল ইন্ধনদাতা, সে ছিল সব অপকর্মের শাস্তির ভাগীদার! তার এখনো মনে পড়ে রান্নাঘরের সামনে ওই জায়গাটিতে চাটাই বিছিয়ে বাড়ির সব ছোটদের একসাথে খাবার দেয়া হত। খাওয়া সেরেই শাড়ির ছোট্ট আঁচলে মুখটা মুছে নিয়ে বেলাদিদি তাকে ইশারায় ডাক দিত। তারপরই দুজনে মিলে ব্যস্ত সমস্ত হয়ে বেড়িয়ে যেত বাড়ি থেকে। নিজঝুম দুপুরবেলা, সকলে ভাত-ঘুমে আচ্ছন্ন। আর তারা দুই ভাই বোনে মিলে তখন হয়তো বাঁশঝাড়ের কাছে হলদে পাখিটার নতুন ছানাটার সন্ধান করছে অথবা বিলের ধারে গিয়ে বসেছে। বোনটা বয়সে বড় আর দুরন্তও খুব, সে একের পর এক শাপলা তুলে আনছে আর লক্ষী ভাইটা নামতা পড়ার মত গুনে রাখছে ফুলগুলি! দৃশ্যটা একেবারে একটা ঝকঝকে ছবির মত তার মনের ফ্রেমে গেঁথে আছে! আজাদ সাহেব আশ্চর্য হয়ে গেলেন মনে করে! অনেক কথাই তো ভুলে ছিলেন এতগুলো দিন। আজ এই অবসরে একেকটা পুরোনো দিন যেন ডুবসাঁতার থেকে মাথা তুলে পানকৌড়ির মত চেয়ে আছে তার দিকে। তবে ঐদিনটির কথা মাঝে মাঝেই মনে পড়ত তার। একটা অদ্ভুত শুনশান দুপুর ছিল, অপুকে সাথে নিয়ে বেলাদিদি সেদিনও বিলের ধারে গিয়েছিল, শাপলা তুলতে নয়, ডাহুকের ডাক শোনাতে। অপু ডাকটা প্রথমবার শুনে খুশিতে চেঁচিয়ে উঠতেই তার মুখখানা হাত দিয়ে চেপে ধরেছিল বেলাদিদি। ডাহুকটা তাদের দেখতে পেয়ে বোধ হয় বিরক্ত হয়ে উড়ে চলে গেল। দুম করে অপুর পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে দিদি বলল ‘তুই এত গাধা কেন রে?! যা তো এখান থেকে, তোকে আর আনব না দেখিস, হাবা একটা…’ বকুনি থামতেই চায় না। শেষমেশ খুব কান্না পেয়ে গেল , ছুটতে ছুটতে একাই বাড়ি ফিরে গেল অপু। গিয়ে একগাদা নালিশ করল দিদির মাকে। মা বললেন –‘তোকে মেরেছে, না? দাঁড়া আসুক না হতচ্ছাড়িটা, খুব মারব আজকে, ধাড়ি মেয়ে, দুপুর বেলা টই টই করে ঘুরে বেড়ায়।’ ‘খুব মজা হবে’ ভাবতে ভাবতে অপু খুশিমনে ঘরে গিয়ে ভাল ছেলের মত ঘুমিয়ে পড়ল। সেদিন বিকেলে ঘুম ভাঙল বাড়ির মেয়েদের কান্নার রোল শুনে। অপু একছুটে উঠোনে এসে দেখে বেলাদিদির শরীরটা নিথর হয়ে পড়ে আছে, তার পাশে মা আর্তনাদ করে কাঁদছেন! শাপলা তুলতে গিয়ে সাপের কামড়ে মারা গেল তার খেলার সঙ্গীটা!
ইলেক্ট্রিসিটি নেই সারাদিন। হারিকেনের টিমটিমে আলো জ্বলছে। হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরের দাওয়ায় এসে বসলেন আজাদ সাহেব। অনেকদিন পর ছোট মাছের চচ্চড়ি দিয়ে খুব তৃপ্তি করে ভাত খেলেন তিনি।
-বউমার রান্নার হাত বেশ ভাল,জামাল! খুব আয়েশ করে খেলাম!
জামাল তার মামাতো ভাইয়ের ছেলে। বেলাদিদির ঠিক পরের ভাইটি ছিল রফিক মানে জামালের বাবা, বহুদিন রোগে ভুগে ভুগে দুবছর আগে মারা গেছে। জামাল এ বাড়িতেই থাকে, পড়াশুনা বেশিদূর করে নি। ছোট একটা দোকান দিয়েছে আর জমি জমার দেখাশোনা করে।
-গ্রামের মেয়ে, আপনার বাসার মত কি আর রাঁধতে পারে?! ঠিকমত যত্ন হচ্ছে কিনা জানি না চাচা, দোষ ত্রুটি হইলে বলবেন।
-না জামাল, বেশ ভালই লাগছে এখানে।
-তা থাকবেন তো কিছু দিন?
-হুম, ভাবছি থেকেই যাব একেবারে।
-কী বলেন চাচা! এই গ্রামে মন টিকবে নাকি আপনার?
-এক সময় তো ঠিকই ছিলাম, ছেড়ে যেতেই খুব কষ্ট হয়েছে।
-না চাচা, ঠিকই দুইদিন পর ফিরা যাবেন।
-না বাবা, আমার ইচ্ছা তো থেকে যাবার। কিন্তু তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে না তো?
অবিশ্বাসের চোখে তাকালো জামাল, তারপর হাসতে হাসতে বলল
-না না চাচা, অসুবিধার কি আছে! থাকেন আপনার যতদিন ভাল লাগে।
আজাদ সাহেব টের পেলেন ছেলেটা তার কথা বিশ্বাস করে নি। না করুক, কদিন গেলে ঠিকই বুঝে নেবে, কিন্তু তখন আবার আপত্তি করলেই মুশকিল। অন্য কোনো পথ দেখতে হবে তখন।
অনেক দিন পর রাত্তিরে মাটির ঘরে পাটি পেতে ঘুমোলেন আজাদ সাহেব। জামাল খুব আপত্তি করেছিল, কিন্তু তিনি পাত্তা দেন নি।
পরের দিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙল। বাইরে এসে দেখেন সদ্য নিকানো উঠোন। জামালের বউটা একহাতে থালা বাসন আর কাঁখে কলস নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকছে। তখন মনে পড়ল বাড়ির পেছনের পুকুরটার কথা। একটু পায়চারি করলেন উঠোনে। তারপর লঘু পায়ে চলে গেলেন পুকুর পাড়ে। বকুল গাছটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। তার ছায়া পড়েছে পুকুরের জলে, কেঁপে উঠছে ছায়াটা। আজাদ সাহেব ঘাটে গিয়ে বসলেন, আলো ছায়ার খেলা দেখলেন বসে বসে।
এখন মনে পড়ল তাড়াহুড়োয় ডায়েরিটা ফেলে এসেছেন। একটা না একটা ভুল তার হবেই জানা কথা, তাই বলে এত দরকারি জিনিসটা আনতে ভুলে গেলেন! মোবাইল ফোনটাই বরং রেখে আসা উচিৎ ছিল, কিন্তু ওটা পকেটেই রয়ে গেল! বাসে উঠেই বিচ্ছিরি যন্ত্রটার সুইচ অফ করে দিয়েছিলেন তিনি। তখন থেকেই অফ করা আছে। কি মনে করে সেটাকে এখন অন করলেন। অন করতেই মেসেজ ভেসে উঠলো, ছেলের নাম্বার থেকে এসেছে মেসেজটা-
‘বাবা তুমি কোথায়? বাসায় চলে এসো, কাব্য খুব কান্নাকাটি করছে, আমরা অনেক টেনশনে আছি’ পড়েই দ্রুত ফোনটা আবার অফ করে দিলেন। বুকের বাঁদিকে চিনচিনে একটা ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। উত্তরপুরুষের মায়াময় মুখটা ভাবতেই মনটা হু হু করে উঠল। ওই মুখটা দেখলে আরো একটা শিশুর আদল ভেসে উঠে, তার নিজের ছেলে নিলয়ের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়। একবার অফিস থেকে ফিরতে খুব দেরি হয়ে গিয়েছিল আজাদ সাহেবের, হরতালের দিন ছিল। নিলয় তখন সবেমাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছে। আর তার লন্ডন প্রবাসী মেয়ে নিশাত তখন একেবারে কোলের শিশু। সেটা মোবাইল ফোনের যুগ ছিল না, তাদের বাসায় ল্যান্ডফোনও ছিল না তখন। রাত দশটা নাগাদ যখন ডোরবেলে চাপ দিলেন সাথেই সাথেই দরজা খুলে গেল আর নিলয় এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বুকে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে ছেলেটা! কান্না জড়ানো গলায় হড়বড় করে অনেক কিছু বলে ফেলল এক নিঃশ্বাসে যার সারমর্ম ছিল এই যে সে ভেবেছে বাবা কোথায় হারিয়ে গেল, বাবা কোথায় চলে গেল, আর বুঝি ফিরে আসবে না। আদর করে কোলে নিয়ে ছেলেটার মান ভাঙ্গিয়েছিলেন সেদিন। নিলয়ের মা এরপর বাসায় ল্যান্ডফোন আনালো, স্কুল থেকে ফিরেই বাবার সাথে ফোনে কথা বলত নিলয়। সেসব দিন কোথায় চলে গেল। দুদিন হয়ে গেছে তিনি বাসা ছেড়ে চলে এসেছেন, কিছু না জানিয়ে। আজাদ সাহেবের খুব জানতে ইচ্ছে করছে তার ছেলেটা কি সেদিনের মত কাঁদছে? এত বড় হয়ে গেছে, নিজেই এখন ছেলের বাবা, হয়তো লুকিয়ে কাঁদছে! মা নেই, আর কোনো আশ্রয় নেই, কিছু বলতে পারছে না কাউকে। মেসেজে বলেছে তার ছেলের কথা, নিজের কথা বলতে পারেনি। হঠাৎ খুব ফিরে যেতে ইচ্ছে হল তার। জীবন সায়াহ্নে এসে ভেবেছিলেন নিজেকে নিয়েই কাটিয়ে দিবেন যেটুকু সময় হাতের মুঠোয় আছে। না বোধ হয় পারলেন না। স্নেহবোধ নিম্নগামী, প্রকৃতির নিয়মেই অপত্যস্নেহ কাটানো যায় না কিছুতেই! কাল সকালেই ফেরার বাসে চেপে বসবেন, খুব ইচ্ছে হলে আবার এভাবেই হুট করে এডভেঞ্চারে বেরিয়ে পরবেন। গৃহত্যাগী হবার অধ্যায়টা এবার নাহয় অসমাপ্ত থেকে যাক।
-আমি বলছিলাম না চাচা , আপনেরা শহরের মানুষ, এইখানে মন টিকবে ক্যান?! তবু আবার আইসেন বেড়াইতে, ভাই-ভাবিদের সাথে নিয়ে আইসেন।
জামাল আর তার বউয়ের কাছ থেকে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে সকাল সকাল বেরিয়ে পরলেন আজাদ সাহেব। পুরোটা পথ এবার ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলেন তিনি। শহরের কাছাকাছি আসতেই সেই বিশ্রী জ্যামে আঁটকে পড়ল বাসটা। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, একচুলও নড়ছে না অনেকক্ষণ ধরে! নিলয় বারবার ফোন করছে, বাস ছাড়তেই তাকে ফোন করে আজাদ সাহেব বলে দিয়েছেন যে তিনি দুপুর নাগাদ বাসায় পৌঁছে যাবেন। ঘড়ির কাঁটায় বেলা আড়াইটা। দরদর করে ঘামছেন তিনি। মেজাজটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। প্রচণ্ড অস্থির লাগছে, ভাবছেন বাস থেকে নেমেই পড়বেন কিনা। এই ভেবে উঠতে যাচ্ছিলেন তখনই নড়েচড়ে উঠল বাসটা। এবার চলতে শুরু করল। আধঘণ্টা পর বাস থেকে নেমে একটা সিএন জি নিয়ে নিলেন। বাসার কাছে পৌঁছে চোখটা উপরে চলে গেল তার। দেখলেন দুজোড়া উৎসুক চোখ নিয়ে দুই প্রজন্মের দুটো শিশু দাঁড়িয়ে আছে ব্যালকনিতে! হ্যাঁ ছেলে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিলয়কেও তার শিশুর মতই মনে হল। হঠাৎ নিচে তাকে আবিষ্কার করে উপরে একটা হটোপুটি শুরু হয়ে গেল, কাব্য কোল থেকে নেমে চেঁচাতে শুরু করেছে। আজাদ সাহেব হাসতে হাসতে লিফটে গিয়ে ঢুকলেন। আজ আর ডোরবেল চাপতে হয় নি। দরজা হা করে খোলা, ছেলে আর ছেলের বৌ দরজায় দাঁড়িয়ে, কাব্য এসে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। গলা জড়িয়ে ধরে বকবক করে অনেক কিছু বলেই চলেছে শিশুটা, একবার মনে হল তাকে বকাবাদ্য করছে আবার মনে হল যেন বলছে –তুমি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে, তুমি কেন হারিয়ে গিয়েছিলে! বাবা বলেছে তুমি নাকি পালিয়ে গিয়েছিলে? আজাদ সাহেবের চোখে জল চলে এল, তাই তিনি বোধ হয় দেখতে পেলেন না দরজায় পাশে দাঁড়িয়ে তার নিজের ছেলেটাও তখন কাঁদছে, নিঃশব্দে।
--------------------------------
মন্তব্য
আজাদ সাহেবের ধৈর্য আছে বলতে হয়, দুটো শিশু পর্যন্ত 'পালাননি', মাঝে মাঝে আসলেই 'পালাতে' ইচ্ছা করে!
সুন্দর লেখা।
অটঃ 'গান্ধর্বী' ট্যাগ দিচ্ছেন বোধ হয় লেখাগুলোকে খুঁজে পেতে সুবিধা হবে বলে। আগের ট্যাগের পরে একটা 'কমা' দিয়ে নেবেন। আর নয়ত এখন যেমন হয়েছে 'বাড়ি থেকে পালিয়ে গান্ধর্বী' হয়ে যাবে, 'বাড়ি থেকে পালিয়ে'ও মিলবে না, 'গান্ধর্বী'ও না
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
হ।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
আপনি তো বেশ নিয়মিত লিখছেন। আগের লেখাগুলোও পড়েছি।
সচল থাকুন।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
তিথিডোর
গান্ধর্বী
ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
হ্যাঁ সহজে খুঁজে পেতেই ট্যাগ দিয়েছি, এখন দেখি বাড়ি থেকে পালিয়ে গান্ধর্বী হয়ে গেছে!
গান্ধর্বী
বাহ, গল্প অতীব সৌন্দর্য্য হইছে। দরকারী কাজ ফেলে রেখে একটানে পড়লাম। আপনি তো ভাল লিখেন।
লেখা থামাবেন না। আপ্নের পিলিজ লাগে।
-----------------------------------------------------------
আঁখি মেলে তোমার আলো, প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
ঐ আলোতে নয়ন রেখে মুদবো নয়ন শেষে
-----------------------------------------------------------
আবেগে কেঁদে ফেলার ইমো নাই নাকি?!
অসংখ্য
গান্ধর্বী
সবাই দেখি অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে আছে। অনু ভাই, উদাস দা, রাজু ভাই....
সাথে অ্যাডভেঞ্চারের গল্প ও।
পড়ে তো রোমাঞ্চিত হয়ে গেলাম, যদিও এখনো মধ্য পুরুষই আছি।
নাহ! আর কিছু ভালো লাগছেনা। কিছুদিনের জন্য বেরিয়ে পড়তে হবে।
-ছায়াবৃত্ত
গান্ধর্বী
আজকে নীড়পাতায় অনেক গুল ভাল ভাল গল্প। আপনার লেখার মুগ্ধ ভক্ত হয়ে যাচ্ছি।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
জেনে খুব ভাল লাগল।মন্তব্যের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ
গান্ধর্বী
-দারুণ উপমা।
"দরজায় পাশে দাঁড়িয়ে তার নিজের ছেলেটাও তখন কাঁদছে, নিঃশব্দে" - এটাই বোধহয় মর্মকথা এই গল্পের।
সুন্দর গানের গলার একটা উপমা আছে - কিন্নরকন্ঠ। আপনি এভাবে লিখতে থাকলে ভালো গল্পের উপমা হয়ে যাবে গান্ধর্বগল্প।
সচলে থাকুন, সচল থাকুন।
____________________________
কি যে বাড়িয়ে বলেন না! তবু অশেষ ধন্যবাদ এভাবে উৎসাহ দেবার জন্য!
গান্ধর্বী
চমৎকার হচ্ছে। লিখতে থাকুন।
গান্ধর্বী
বারে বারে পড়ার মত গল্প হয়েছে
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
গান্ধর্বী
আপনি অনেক ভাল লিখেন!!!
সুবোধ অবোধ
ধন্যবাদ আপনাকে লেখাটি পড়ার জন্য
গান্ধর্বী
বেশ লাগল!
গান্ধর্বী
নতুন মন্তব্য করুন