ডোরবেলটা আরও একবার খুব বিচ্ছিরিভাবে বেজে উঠল। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু দরজার ওপাশের একগুঁয়ে মানুষটাকে সহ্য করা মুশকিল হচ্ছে, একনাগাড়ে বেল বাজিয়েই যাচ্ছে মানুষটা। অগত্যা উঠে পড়তেই হল। পেপারের বিল নিতে এসেছিল, টাকাটা দিয়ে ধড়াম করে লাগিয়ে দিলাম দরজা।
কদিন ধরে ঘর থেকে বেরুচ্ছি না। রাতভর জেগে থাকি, ছটফট করি ঘুমোনোর জন্য, শেষরাতে চোখ বুজে আসে। দুপুরের পর ঘুম ভাঙ্গে, তারপর একটু খাই। রেবা চলে যাবার পর আক্ষরিক অর্থেই একাহারী হয়ে গেছি। বেসিনের আয়নায় নিজের উসকোখুসকো চেহারা দেখে নিজেই চমকে গেলাম।
রেবা, আমার স্ত্রী। ডাক্তার বলেছিলেন রোগটার নাম পোস্টপার্টাম সাইকোসিস। ওকে বাসায় রাখতে পারিনি। মাসখানেক আগে হসপিটালে ভর্তি করিয়ে ছিলাম। খুব হাসিখুশি মেয়ে ছিল রেবা। জীবনটাকে কানায় কানায় ভরে দিয়েছিল- রেবা আর রেবার ভেতরে বাড়তে থাকা আমাদের মেয়ে-ঝিলাম।
আলট্রাসনোতে যখন জানতে পেলাম মেয়ে হবে তখন এই নামটাই ঠিক করেছিলাম আমি। রেবা খুব খুশি হয়েছিল মেয়ের কথা জানতে পেরে। রেবা খুশি, তাই আমিও খুশি। মেয়ের জন্য জামা-জুতো-খেলনা-দোলনা কিনে একটু একটু করে ঘর গুছোচ্ছিলাম। তারপর সময় ঘনিয়ে এলো, একদিন প্রচণ্ড ব্যথায় নীল হয়ে গেল রেবা, ওকে নিয়ে ছুটলাম হসপিটালে। লেবার রুমের বাইরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার অপেক্ষায় কেটে গেল, ডেলিভারি করা গেল না। অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হল শেষমেশ। তারপর ঝিলামকে পেলাম, কিন্তু ওর ছোট্ট শরীরটাও নীল হয়ে গিয়েছিল, যেন নীলচে কোনো ফুল। রেবা তখন ব্যথানাশকের কৃপায় ঘুমে আচ্ছন্ন, আর আমি ঝিলামের প্রাণহীন শরীরটাকে বুকে নিয়ে ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছি। মেয়েটা রেবার শরীর থেকে বার হতেই নিষ্প্রাণ হয়ে গিয়েছিল। আমি একসময় আতঙ্কে শিউড়ে উঠলাম কারণ রেবার ঘুম ভাঙ্গলে ঝিলামকে খুঁজবেই। ঝিলামকে কোথায় লুকোবো!
দুঃস্বপ্নের রাতও কেটে যায়। রেবাকে নিয়ে শূন্য ঘরে ফিরে এলাম হপ্তাখানেক পর। মেয়ের জন্য গুছিয়ে রাখা ঘরে তালা লাগালাম, রেবাকে যে করেই হোক ভুলিয়ে রাখতে হবে। ওর অস্বাভাবিক আচরন দিনদিন বেড়েই যাচ্ছিল। একা একা কথা বলত সারাক্ষণ। জানতে চাইলে ক্ষেপে যেত, বলত - 'মা-মেয়েতে কথা হচ্ছে, তুমি বুঝবে না।' আমি মনে মনে ভেঙ্গে পড়লাম, দিশেহারা লাগছিল খুব। দিন গুনছিলাম রেবার সেই হাসিমুখের অপেক্ষায়। বছর গড়িয়ে গেল। আমাদের গুছোনো সংসার এলোমেলোই পড়ে রইল।
ঝিলামের জন্মের বা মৃত্যুর বছর দেড়েক পর ডাক্তার পরামর্শ দিলেন রেবাকে হসপিটালে ভর্তি করাতে। সেই দিনগুলিতে ওকে সামলে রাখা আমার জন্য সত্যিই কঠিন ছিল। প্রায়ই বলত 'ঝিলাম এখন কথা বলতে শিখেছে', 'ঝিলাম দিব্যি দৌড়োতে পারে। দৌড়ে এসে কোলে ঝাঁপ দেয়'। একদিন কষ্টটাকে চেপে রাখতে না পেরে ওকে বললাম- রেবা শুধু মায়ের মেয়ে? বাবার কাছে কখনো আসে না কেন?
রেবা বিড়বিড় করে বলল- 'বাবা ঝিলামকে লুকিয়ে রাখে।'
মনে হল , রেবার সাথে সাথে আমারো ওষুধ প্রয়োজন, বিষণ্ণতার।
তারপর একদিন রেবাকে ভর্তি করালাম হসপিটালে। এর কদিন আগে একগাদা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলেছিল ও। ওকে আর একা থাকতে দেয়া যাবে না। মাসখানেক ধরে হসপিটালের কেবিনই আমাদের ঘরে পরিণত হল। দুদিন আগে খুব ভোরে ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙল আমার, এর আগের রাতে বাসায় ছিলাম আমি। খবর পেলাম রেবাও চলে গেছে। ওকে বিদায় দিয়ে এসে গৃহবন্দি দিন কাটাচ্ছি আজকাল। দুদিন আগেও মানুষটা ছিল, এখন আর নেই। ক্লান্ত আমার এখন অখণ্ড অবসর, সারা ঘরে ছায়ান্ধকার।
আজকাল ঘুম ভেঙে যায়, চমকে উঠি, বাচ্চামেয়ের আদুরে গলা শুনে- 'বাবা, কোলে নাও।' অফিস ছেড়ে দিয়েছি। অবসর কাটছে মেয়ের সাথে গল্প করে, ওকে দোলনায় ঘুম পাড়িয়ে। ঝিলাম এখন আমার ন্যাওটা হয়েছে খুব! রেবার সাথে এই নিয়ে আজকাল খুনসুটি চলছে আমার।
--------------------------------
মন্তব্য
ছোট্ট অথচ কি মন খারাপ করিয়ে দেয়া গল্প!
এমনটা না হোক কারে সাথে।
শুভেচ্ছা
শুভকামনা
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
হৃদয়টা ছ্যাত করে উঠল!
এমনি এক শোকগাঁথা রচনা না করলেন, ছড়িয়ে দিলেন ব্যথার তীব্র অনুভূতি! প্রচন্ড ভারী একটা পরিবেশ সৃষ্টি করলেন এমনকি কোন ভারী শব্দ প্রয়োগ না করেই!
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
ধন্যবাদ
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
লাইন দুটো গল্পটাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে
--তানভীর রাব্বানী
অসংখ্য ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য।
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
কেম্নে গপ্পো লিখতে হয় আমারে শিখাইব্নে? সত্যি চাই কিন্তু! খুব সাধারণ শব্দ বাক্য দিয়ে কেমন সুন্দর লিখতে জানেন।
তবে আর নয় কান্না। এরপর একটা বেশ আনন্দে থৈ থৈ করা গপ্পো চাই(ইহা যথার্থই আব্দার বটেক )
আয়নাদিদি, আপনি বায়না করলে যারপরনাই খুশি হই
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
গল্প নিটোল।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
কী সুন্দর গল্প! তবে বড্ড করুণ।
এটাকে বাড়িয়ে উপন্যাস করে ফেলুন, এই প্রিয়জন হারানো যুবককে বিষাদ থেকে বার করে আনুন, সে আবার নতুন প্রিয়জন পেয়ে সুখী হয়ে উঠুক। জীবন তো থেমে থাকে না, নদীর মতন এপাড় ভাঙে তো ওপাড় গড়ে।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আপনার কথা শুনে বহমান নদীর মত জীবন নিয়ে উপন্যাস লেখার একটা ইচ্ছে মাথাচাড়া দিচ্ছে, কিন্তু লিখতে গিয়ে ল্যাজে গোবরে হয়ে যাবে লিচ্চিত!
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
হ্যাঁ শুরু করে দিলেই দেখবেন লিখতে লিখতে এগিয়ে যাচ্ছে কাহিনী। গল্প যেন নিজেই নিজেকে তৈরী করছে, স্রোতের টানে ফেনিয়ে উঠছে ঠিক নদীর মতন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
কী বলবো দিদি, মনটা মেদুর করে দিলেন এই সাত সকালে!!
____________________________
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
মন খারাপ করা গল্প
ইসরাত
মনটাই এমন হয়ে আছে যে মন খারাপের গল্প মাথায় এলো।
শুভকামনা
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
মুগ্ধ হয়েছি।
গোঁসাইবাবু
ধন্যবাদ
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
মন খারাপ করা ছোট্ট কিন্তু সুন্দর একটা গল্প। শেষ লাইনটা গল্পটাকে সম্পূর্ণ করেছে-
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
অসংখ্য ধন্যবাদ
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
গল্প ভালো লেগেছে, কিন্তু মানসিক রোগীর সাথে থাকতে থাকতে মানসিক রোগী হয়ে যায় তাঁর স্বামী, ফোনের আওয়াজ শুনে, ফুলের গন্ধ পায় এমন একটা গল্পের ছায়া চলে এসেছে।
লেখা চলুক-
facebook
আপনিই ধরতে পেরেছেন অণুদা! আমিতো এটাই বোঝাতে চেয়েছি গল্পে!
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
না , আমি বলতে চেয়েছিলাম এমন গল্প পড়েছি আগে, বাংলাদেশে মনে হয় নাটকও হয়েছে। বিটিভিতে।
একই নয় অবশ্যই, কিন্তু থিম এক।
facebook
হুমায়ূনের সেই নাটকটার কথা মনে করিয়ে দিলেন।
অদ্ভুত সুন্দর... অপূর্ব
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
একরাশ
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
সুন্দর
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ধন্যবাদ!
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
হুমমমমমমমমমম...
(একদম শেষ প্যারাটার আগে একটা ... (ডট ডট) ... ব্রেক, বা নাম্বারিং ব্রেক দিলে ভালো হয় মনে হয়। একজন সসুস্থ মানুষ আর কিছুদিন পরে একজন অসুস্থ মানুষের পার্থক্যটা স্পষ্ট হয় তাতে)
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
সাজেশানের জন্য ধন্যবাদ।
শুভকামনা
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
গল্প পছন্দ হয়েছে।
তারা দাগিয়ে গেলাম।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ধন্যবাদ
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
গল্পটা পড়ে আর কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। একটা কলিজা মোচড় দেয়ার ইমো থাকলে ভালো হতো।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
এখন সন্ধ্যা। গল্পটা পড়ে আমার মনের আকাশে সন্ধ্যা নেমে আসল। গল্পের নায়কের মত আমিও অবরুদ্ধ দিন কাটাচ্ছি, তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে।- নিশাচর জীব
স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে আসুক আপনার জীবনে।
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
ধন্যবাদ
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
লেখাটা পড়ে মনটা কেমন করছে।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
নতুন মন্তব্য করুন