১)
ইঁদুরের উপদ্রব সহ্য করতে না পেরে হপ্তাখানেক আগে অস্থিমজ্জায় জমে থাকা কুঁড়েমি ঝেড়ে ফেললাম আর বাসার স্টোররুমে জমে থাকা আস্তাকুরেটা সাফশুতরো করে ওটাকে ভদ্রস্থ করলাম। করে একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে। আমার একঘেয়ে দুপুরগুলো এখন বেশ কাটছে, গল্প পড়ে পড়ে। অখ্যাত কোনো এক লেখকের গোটা কয়েক খেরোখাতা খুঁজে পেয়েছি, ওই স্টোররুমে ডাঁই করা ছিল। ভাবতে অবাক লাগে এই লেখাগুলো এখন সময় কাটানোর জন্য বেশ উপাদেয়, কিন্তু কোনো একসময় এগুলোই পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল প্রচণ্ড হতাশাগ্রস্ত সেই লেখক! খাতার উপর নিজের নামখানা মোটা হরফে দেখতে পেয়ে নিজের কাছেই মনে হল যেন পূর্বজন্মের কোনো স্মৃতি! কিছু গল্প প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলো তারিখসহ লেখা আছে। আর বেশিরভাগ হেলায় পড়েছিল। অপ্রকাশিত গল্পগুলোর প্রায় সবকটা একটা খাতায় আছে, ভাবছি ওটাই আগে পড়ে দেখব।
আমি থাকি ছোট্ট এক শহরে, সে শহরে সৈকত আছে। খুব ভোরে আমার দিন শুরু হয়। ঘুম ভাঙ্গতেই সৈকতে চলে যাই। কিছুক্ষণ পায়চারির পর ক্ষিধেটা চনমন করে, তখন ফিরে আসি। হেঁসেলের পাট দিনের বেলাতেই চুকে যায়, আমার নির্ঝঞ্ঝাট ক্ষুদে সংসারের একমাত্র সদস্য আমিই! দুপুরের ভাতঘুম শেষে বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে আবার সৈকতে চলে যাই। কখনো নারিকেল বাগানে। সমুদ্রের হাওয়ায় গা জুড়িয়ে ফিরে আসি সূর্যাস্তের ঘণ্টা খানেক পর। রাতে বই পড়ি, নয়ত মুভি দেখি। আক্ষরিক অর্থে আমি অকর্মন্য, জমানো টাকা দিয়ে সংসার চালাই।
আমার রোজনামচা থেকে ভাতঘুম বাদ দিয়েছি কদিন ধরে, গল্পের খেরোখাতাগুলো পাবার পর থেকে।
২)
সারারাত জেগে থাকলাম ভোরের অপেক্ষায়। জরুরি কয়েকটা ফোন করতে হবে। আমার লেখা কিছু গল্প খসড়া অবস্থাতেই থেকে গিয়েছিল। কালরাতে তেমন একটা গল্প পড়তে গিয়ে ভীষণ চমকে গিয়েছি, প্রায় বছর দুয়েক আগের লেখা। কিন্তু ঠিক এমনই একটা কিছু ঘটে গেছে কদিন আগে! লিখতে গিয়ে অবচেতনে গল্পের চরিত্রগুলো আশেপাশের পরিচিত মানুষগুলোর সাথে কিছু কিছু মিলে যায়। কিন্তু গল্পটাই সত্যি হয়ে গেলে? আমার স্মৃতিকোষগুলো এখনো বার্ধক্যে পৌঁছায় নি, তবু গল্পটা ঘটনা ঘটার আগে লিখেছি কিনা আরেকবার যাচাই করা দরকার। খাতার তারিখ বলছে গল্পের খসড়াটাই পুরোনো। গল্পের মূল চরিত্রের মৃত্যু ঘটেছে বৃষ্টির দিনে বাসার ছাদ থেকে পিছলে পড়ে গিয়ে। আর যদ্দুর মনে পড়ে আমার সেই আধচেনা মানুষটি, যার ছায়া আমার গল্পের চরিত্রে ছিল, ঠিক এভাবেই মারা গেছে কিছুদিন আগে।
ফোনে খোঁজ নিয়ে বেশ অস্বস্তি লাগছে আমার। পুরো ব্যাপারটাকে কাকতালীয় মনে করে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছি বটে কিন্তু ভেতরে খচখচ করতে থাকল।
৩)
পাশের শহরে বন্ধুর কাছ থেকে বেড়িয়ে এলাম পুরো একটা সপ্তাহ। মনটা এখন ফুরফুরে হয়ে আছে। বিস্তর ঘোরাঘুরি হয়েছে, সাথে প্রচুর খাওয়াদাওয়া। আমার বন্ধুটি- ফুল্লরা, আমাকে অনেক বোঝালো, আবার লেখালেখি শুরু করতে বলল। আমি উচ্চবাচ্য করলাম না। ও হতাশ হয়ে চুপ হয়ে গেল একসময়, ভাবল হয়ত ওর অনুরোধও রাখব না আমি। ওকে খসড়াটার কথাটা বলব বলব করেও বলা হয় নি, হেসে উড়িয়ে দিতে পারে ভেবে।
ফেরার পর দুদিন শুধু ঘুমিয়ে কাটালাম। ভাবছি আবার লিখতে শুরু করব। দুপুর আর রাতগুলো আবারো একঘেয়ে হয়ে উঠছে। গতরাতে খেরোখাতাটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করেছি। লেখা শুরু করার আগে নিজের পুরোনো লেখাগুলো একবার পড়ে ফেললে ভাল হবে মনে হচ্ছে।
৪)
আবারো প্রচণ্ড অস্থিরতায় কাটালাম পুরো রাত। দুটো গল্প পড়া হয়েছে। প্রথম গল্পে একটা বাচ্চা মেয়ে হারিয়ে যায়, তাকে খুঁজে পাওয়া যায় বহু বছর পর। গল্পটা লিখেছি তিন বছর আগে। যাকে ভেবে এটা লিখেছিলাম সে সত্যিই ফিরে এসেছে গত বছর। প্রায় সত্যি হয়ে গেছে এ গল্পটাও!
কিন্তু পরের গল্পটাতে গল্পের চরিত্র ফুল্লরার সাথে মিলে যাচ্ছে। এই গল্পে ওকে আমি স্মৃতিভ্রষ্ট করে দিয়েছি। দেড় বছর আগের লেখা এই গল্প। নিজেকে এখন একটা অসহ্য ক্রিমিন্যাল মনে হচ্ছে আমার। প্রচণ্ড আতঙ্কে রীতিমত কাঁপছি আমি।
আমার খসড়াগুলোই কেন সত্যি হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। ভেবেচিন্তে বুঝতে পারলাম যে গল্পগুলো কোথাও না কোথাও প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো নিয়ে কোন সমস্যা নেই। বছর তিনেক আগে যখন আমার লেখা একেবারেই অজনপ্রিয় হয়ে গেল ঠিক সে সময়কার খসড়াগুলো সত্যি হয়ে যাচ্ছে!
আর ভাবতে পারছি না। কাল সকালেই ফুল্লরাকে ফোন করব। হেসে উড়িয়ে দিক আর পাগল-উন্মাদ যাই ভাবুক, ওকে পুরো ব্যাপারটা জানাতেই হবে। কিন্তু এই রাতটা যেন ফুরোবার নয়।
৫)
অনুশোচনায় মরে যাচ্ছি। ফুল্লরাকে ব্যাপারটা জানানোই ভুল হয়েছে। আমার আতঙ্ক প্রায় চরমে পৌঁছে যাচ্ছে দেখে আমাকে না জানিয়েই ও আমার শহরে রওনা দেয় দুদিন পর। শহরের কাছাকাছি এসে পৌঁছুতেই দুর্ঘটনায় ওর গাড়িটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। মাথায় মারাত্মকভাবে আঘাত পায় ফুল্লরা।
এখন ও আমার শহরেই আছে, হসপিটালে ইন্টেন্সিভ কেয়ারে। জ্ঞান ফিরে নি, দুদিন হয়ে গেল।
ভাবছি ওই অসমাপ্ত গল্পটার আরেকটা পর্ব লিখে ফেলব। স্মৃতিভ্রষ্ট মেয়েটা কী করে সুস্থ হয়ে ওঠে তাই নিয়ে হবে এই পর্ব। খাতা কলম নিয়ে বসে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গল্প এগোয় না। দুলাইনের বেশি লিখতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ি। মাঝেমাঝে চমকে যাই। অবচেতনে অন্য কারো ক্ষতি করে ফেলছি না তো?
অভিশপ্ত মনে হয় নিজেকে। ফুল্লরার সংজ্ঞাহীন মুখটার দিকে তাকানোর সাহস হয় না আর, ওকে দেখতে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।
৬)
আলুথালু অবস্থাতেই ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েছি। মাত্র খবর পেলাম ফুল্লরার জ্ঞান ফিরেছে। তীব্র বেগে গাড়ি ছুটেছে হসপিটালের দিকে। জানি না কী অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য। যাকে দেখতে ছুটে যাচ্ছি, সে আমাকে আদৌ চিনতে পারবে তো? গল্পটা এবার মিথ্যে হতে পারে না? মিথ্যে হওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয়?
বিড়বিড় করে একটানা বলে চলেছি- 'গল্পটা মিথ্যে হোক, গল্পটা মিথ্যে হোক।'
-------------------------
মন্তব্য
পরিচিত প্লটের গল্প বলেই আরেকটু জমবে আশা করছিলাম।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
একটু তাড়াহুড়ো ছিলই, তাই হয়ত জমে নি, ঠিক বলেছেন।
ধন্যবাদ
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
গল্পের প্লটগুলো অনেক পুরনো,তবে ভালই লেগেছে! আপনার কাছে থেকে ভবিষ্যতে আরও মৌলিক গল্প আশা করছি|
ধন্যবাদ
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
কেমন যেন ছাড়া ছাড়া মনে হল। মনে হয় তাড়াহুরা করে লেখা। আরও গলপের অপেক্ষায় রইলাম।
-এ এস এম আশিকুর রহমান অমিত
:
গান্ধর্বী, আপনার গল্প বলা অবশ্যই চমৎকার। যে ব্যাপারটায় যত্ন নিতে পারলে ভালো হয় বলে আমার মনে হল সেটা এই -
লিখতে বসার সময় সাধ্যমত খোঁজ নিয়ে নেওয়া যে ঐ পটভূমি বা তার কাছাকাছি কিছু নিয়ে কিরকম গল্প লেখা হয়েছে। বিশেষ কিছু না পাওয়া গেলে, খুব ভাল। পাওয়া গেলে গল্পের মোচড়, পরিণতি এগুলিতে যথাসাধ্য নুতনত্ব নিয়ে আসা। আরো একটা ধরণ হয়, পরিচিত ছক, পরিচিত উপসংহার কিন্ত ঘটনাপ্রবাহ এগোল অপরিচিত রাস্তায়। তখন সে গল্পের একটা অন্যরকম আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। তবে সে পথে সাফল্যে পৌঁছান আরো দুরূহ বলেই মনে হয়।
এত কথা বললাম কারণ আপনার কাছ থেকে দুরন্ত গল্প পাওয়া যাবে বলে আশা রাখি।
পরের গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
দুরন্ত পাঠককেও অ-নে-ক ধন্যবাদ, এতগুলো দরকারি কথা বলার জন্য!
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
এরকম হলে ব্যাপারটা আসলেই আতংকজনক হত।
গল্প খারাপ লাগেনাই
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
ভালো লেগেছে গান্ধর্বী।
আপনার জন্য শুভকামনা।
----------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
অনেক ধন্যবাদ।
ভাল থাকুন।
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
আইডিয়াটা ভাল। কিন্তু একদম নতুন না বোধহয়। “Stranger than Fiction” নামে একটা মুভি দেখেছিলাম একসময়। মিল পাচ্ছি অনেকটা। লেখার প্রকাশভঙ্গী ভাল, গল্পের শুরুটা বেশ। স্বচ্ছন্দে পড়ে ফেলা যায়। লেখাটা আরেকটু বাড়তি হবার প্রয়োজন ছিল। নিশাচর জীব।
মুভিটা দেখিনি, তবে দেখে ফেলব সুযোগ হলেই।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনার সুচিন্তিত মন্তব্যের জন্য।
শুভকামনা।
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
গল্পটা পড়া শেষ করে কেমন একটা অস্থির লাগছে। গল্পের মধ্যেই অস্থির হবার উপাদান উপস্থিত আছে বলেই কী?
গল্পটা মিথ্যেই হবে দেখবেন!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ধন্যবাদ
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
নতুন মন্তব্য করুন