হেডফোনে চুপ বড়ে গোলাম। ঝিল্লিমুখর ঘুমন্ত পল্লীর পথ ধরে ছুটে চলেছে নাইটকোচ, যেমন অভিসারে ছুটে যায় গোপন প্রিয়া। ভেতরের ছায়ান্ধকার থেকে মুখ ফিরিয়ে চোখ রাখলাম বাইরের নিরেট আঁধারে। আকাশে নক্ষত্রের মোজাইক। দূরের খেড়োঘরে মাটির প্রদীপ জ্বলছে। কোন কুলবধূ রাত জাগছে, কল্পনায় দেখতে পাই যেন জোড়া বাতিঘরের মতন দৃষ্টিপ্রদীপ জ্বলছে তার। অশ্বিনী আর স্বাতীতারাদের আলোয় পথ দেখে ঘরে ফিরছে গৃহস্বামী, একাকিনী বধূ আর ঘুমন্ত শিশুর জন্য দুশ্চিন্তায় উচাটন মন নিয়ে। অন্তহীন পথ চলছে সে, যেন পৃথিবীর দ্রাঘিমা পেরিয়ে।
শহরতলির পথে এবার নাইটকোচ। ছোট ছোট দোকানের সারি রাস্তার পাশে। সাইনবোর্ডগুলি ফসকে যাওয়া গ্যাসবেলুনের মত হারিয়ে যাচ্ছে। কোন পথ ধরে যাচ্ছি তার হদিশ মেলে না তাই। সময়জ্ঞানও খুইয়ে ফেলেছি। ঘড়ির রেডিয়ামে বা মুঠোফোনের শরীরটাকে আলতো ছুঁয়ে দিলেই মিনিট সেকেন্ডের হিসেব পেয়ে যাব, কিন্তু আমার মন নেই। অন্যমনস্ক এই রাতের মত আমিও অমনোযোগী আজ। জানালার শার্সি গলে ইচ্ছেমতন বেরিয়ে পড়ছি। সোডিয়াম বাতির হলদে আলোয় বাইসাইকেল চালানো যুবকটার সাথে শিস বাজাতে বাজাতে ঘুরে এলাম মাইলখানেক। এক রত্তি চাঁদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নদীর বুকে। সে বুকে বয়ে চলছে নৌকো। সে নৌকোতে এবার মাঝির সাথে দাঁড় বাইছি আমি, আমার গায়ে নদীর জলগন্ধী হাওয়া। জলের ভাষায় মাঝিকে শুধাই- একটা গান গাও ভাই।
শার্সি দিয়ে জলো হাওয়া আছড়ে পড়ে। যুবতীর কাচের চুড়ির মত রাতের নীরবতাকে চুরমার করে দিয়ে আমার কানে তখনও বাজছে- ‘আমি কোন কূল হতে কোন কূলে যাব/ কাহারে শুধাই রে/ নদীর কূল নাই, কিনার নাই রে।’
এরপর মাঠের পর মাঠ পেরুলাম, ফলন্ত শস্যের ক্ষেত পেরিয়ে এলাম, কখনো আমি দুরন্ত রাখাল, কখনো ঘরছাড়া বাউল!
এখন পূবাকাশে সোনারঙের ছটা। শহরতলি আলসি মেয়ের মত আড়মোড়া দিচ্ছে। সদ্য ঘুমভাঙ্গা দোকানী ঝাঁপ খুলছে দোকানের। চায়ের স্টলের উনুন জ্বলে উঠেছে। শিরিষের ছায়ায় একাবোকা দাঁড়িয়ে একটা পোস্টবক্স। আমি গুচ্ছের চৌকো চিঠি পাঠিয়ে দিলাম তার ভেতরে, পুরোনো সব ঠিকানায়। সে ঠিকানায় অচেনা কেউ সে চিঠি পাবে অথবা পাবে না। কৌতুহলী মানুষটা চিঠিটা পড়ে ফেলবে। ইতির পরের মানুষটিকে নিয়ে হয়ত ভাববে কিছুটা সময়, নয়ত বাতিল কাগজের মত দলা পাকিয়ে জানলা দিয়ে ফেলে দেবে, বেমালুম ভুলে যাবে খামখেয়ালী চিঠির কথা। চিঠি হয়ে যাবে চিনেবাদামের প্যাকেট নয়ত বাচ্চাছেলের কাগুজে এরোপ্লেন!
শেষ স্টপেজে পৌঁছে গেছি। যাত্রীরা একে একে নেমে যাচ্ছে। গাড়ির চালক তড়িঘড়ি নেমে গেল সবার আগে, পোতাশ্রয়ে পৌঁছে যাওয়া জাহাজের ব্যস্ত, বীর নাবিকের মত! ওয়েটিংরুমে কারো কারো জন্য অধীর অপেক্ষায় ছিল কাছের মানুষ। হাসিমুখে এবার ঘরে ফিরছে তারা। অফিসমুখো মানুষগুলো গম্ভীর মুখে চলে যাচ্ছে, যেন ঘরের স্মৃতির শেষ রেশটুকু ছেড়ে যাচ্ছে তারা।
খুচরো মানুষ আমি, আমার কোনো তাড়া নেই। তাই বসে আছি, আরেকটা নাইটকোচ এবং আরো একটা অন্যমনস্ক রাতের অপেক্ষায়।
-----------------------
মন্তব্য
সেই কবে থেকে আমার সাধ, অচেনা কোনো স্টেশনে নেমে পড়ব আর ট্রেনে উঠবোনা। নেমেছি অনেকবার কিন্তু ট্রেন মিস করার সাহস হয়নি কেন জানি। মিস করা দরকার, তাই না?
দারুন লিখেছেন। ছবির মতো ঝুলে আছে চোখের সামনে
------------------------
আশফাক(অধম)
মিস করার সাহস আমারও হয় নি, এমনকি দৌড়ে গিয়ে হঠাৎ চলতে শুরু করা ট্রেনে চরে বসাটাও হয়ে উঠে নি কখনো।
ধন্যবাদ, মন্তব্যের জন্য।
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
আমার কিন্তু যুবকবেলায় অনিশ্চিত যাত্রার নেশা ছিল। সচলেই আমার একটা প্রতিমন্তব্য দেখুন,
আহা, দিনগুলি অনেক রোমাঞ্চকর ছিল নিশ্চয়ই!
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
এই আটপৌরে দেশে বেড়ে ওঠা আমাদের মনে বাস করে এমন খুচরো মানুষ।অন্যমনস্ক হয়ে যাই প্রতিনিয়ত।এই যে দেখুন না কবেকার বর্ষণমুখর শ্রাবণ মেঘের রাতে অন্যমনস্ক হয়েছিলেন অতুল প্রসাদ।
রাজর্ষি
সত্যিই! ধন্যবাদ সুন্দর একটা গানের লিঙ্ক দেয়ার জন্য।
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
পুরো লেখার সুষমামণ্ডিত গদ্যের মধ্যে "বাহিরের" শব্দটির উৎকট প্রয়োগ অত্যন্ত বেমানান লাগল।
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
কী বলবো দিদি - মনকে ছুঁয়ে গেলো লেখাটা - শুধু মাত্র বর্ণনার জোরেই একটা পাকাপাকি ছাপ বসে গেলো মনে -
আপনার হাতে রুপোলী ডট পেন নয়, সোনালী ঝর্ণা কলম আছে, যেখান থেকে উৎসারিত হয় সোনালী শব্দপুঞ্জ।
____________________________
একগুচ্ছ ধন্যবাদ হিজিবিজবিজদা!
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
ইশ! এই দিনগুলি কই যে পালিয়ে গেল?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
কারো কারো ক্ষেত্রে এইসব দিন শুধু কল্পনায় থেকে যায়, সত্যি আর হয়ে ওঠে না
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
কেমন যেন ছবির মত চোখের সামনে যেন দেখতে পেলাম।দারুণ লেখা দিদি।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
যে পর্যবেক্ষণে লেখাটা ধরা হয়েছে, তাতে এই লেখার নামটি অন্য কিছু হ'লে ভাল হত মনে হয়। আমি হলে নাম দিতাম নাইটকোচ বা রাতগাড়ি। লেখার চলটা ভাল লেগেছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নাইটকোচ হতে পারত বটে! 'রাতগাড়ি'টা পছন্দ হয়েছে বেশি
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
বাহ!
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
লেখাটাও আমাকে একটু অন্যমনস্ক করলো বটে।
তাই?
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
এই লেখকের লেখার পেমে না পড়ে উপায় নাই হে! আমিও পড়েছি ধপাস্ জুরে
এইদিক থেকে আমি খুব লাকি কিন্তু। চাইলেই নেমে যেতে পারি যেকোন ইস্টিশনে
আয়নাদিদি, ব্যথা পান নি তো?
তুমি বড় ভাগ্যবতী
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
বেথা পাইলেই কমু নাকি
না, না তুমি, তুমি বড় ভাগ্যবতী
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
ব্যাপক হইসে
অভিমন্যু .
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি
ধন্যবাদ অভিমন্যু!
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
@অভিমন্যু, ভাইয়া আপনার সিগনেচারের ' চক্রবুহ্য' ভানামটা একটু চেক করবেন নাকি?
আমি তো জানি ওটা 'চক্রব্যূহ' । সঠিক কুন্টা সম্ভব হলে জানান দিয়েন তো পিলিজ!
সপ্তরথীর শরাঘাতে ধরাশায়ী সুভদ্রাসুত!
রাজর্ষি
'চক্রব্যূহ' ই সঠিক।
নতুন মন্তব্য করুন