মামা কাহিনী
শেখ ফেরদৌস শামস ভাস্কর
চ্যান্ডলার, অ্যারিজোনা
মরহুম সৈয়দ মুজতবা আলীর “চাচা কাহিনী” আমাদের মধ্যে অনেকেরই পাঠ করিবার সৌভাগ্য হইয়াছে নিশ্চয়। কিন্তু মামাদের লইয়া ঐরূপ নামের কোন পুস্তক লিপিবদ্ধ হইয়াছে কিনা তাহা আমা...মামা কাহিনী
শেখ ফেরদৌস শামস ভাস্কর
চ্যান্ডলার, অ্যারিজোনা
মরহুম সৈয়দ মুজতবা আলীর “চাচা কাহিনী” আমাদের মধ্যে অনেকেরই পাঠ করিবার সৌভাগ্য হইয়াছে নিশ্চয়। কিন্তু মামাদের লইয়া ঐরূপ নামের কোন পুস্তক লিপিবদ্ধ হইয়াছে কিনা তাহা আমার জানা নাই। তবে মামাদের লইয়া অসংখ্য ছড়া, কবিতা, গল্প, সংগীত রচিত হইয়াছে যাহাতে মামা-ভাগিনার মধ্যে যেই মধুর সম্পর্ক বিদ্যমান তাহা যথার্থই প্রকাশ পাইয়াছে। ছোট বয়সেই “তাই তাই তাই মামা বাড়ি যাই” ছড়াটির মাধ্যমে শিশুদের মনে মামা এবং মামা বাড়ির আদর সম্পর্কে বাড়তি আগ্রহ তৈয়ার করা হয়। যদিও ছড়াটিতে মামীর লাঠি লইয়া তাড়া করিবার কথা থাকিলেও তাহাতে মামাবাড়ির প্রতি শিশুদের অনুরাগের কোনই কমতি হয় না। বরং বিখ্যাত “মামা বাড়ির আবদার” প্রবাদটি আরো প্রতিষ্ঠিত হয়।
ঢাকার বিখ্যাত “মামার হালিম” এর স্বাদ পান নাই অথবা এই নামটি কর্ণগোচর হয় নাই এইরকম লোকের সন্ধান পাওয়া খুবই দুষ্কর। “মামার হালিম” এর অপরিসীম সাফল্য এবং জনপ্রিয়তার পর “নানা হালিম”, “চাচা হালিম”, “দাদা হালিম” ইত্যাদি নামে বিভিন্ন স্থানে উন্নত মানের হালিমের দোকান খুলিলেও সেইগুলি মামা হালিমের খ্যাতিতে বিন্দু মাত্রও আঁচড় কাটিতে পারে নাই। আমার কাছে মনে হয় এইখানে হালিমের চাইতেও দোকানটির নামের মধ্যে “মামা” নামটিই দোকানটির জনপ্রিয়তার আসল কারণ।
ছোটবেলায় যখন বিদ্যালয়ে পড়িতাম, বিদ্যালয়ে যাইবার একটি অন্যতম আকর্ষন ছিল টিফিনের সময় মামাদের সহিত সাক্ষাত করা। এই মামারা ছিলেন আর কেহই নয়, বিদ্যালয়ের প্রবেশ পথে চটপটি, ঝাল-মুড়ি এবং আইসক্রীম বিক্রেতাগণ। পৃথিবীতে কতো রকম সম্বোধন থাকিলেও বিদ্যালয়ের সকল ছাত্রগণ তাহাদিগকে তাহাদের প্রিয় সম্বোধন “মামা” অথবা “মামু” বলিয়াই ডাকিত। মনে হয় ইহাতে হয়তো ছাত্রদিগের বাড়তি আবদার করিবার সুযোগ থাকিত - যেমন “মামু, আজকে একটু ভালো করিয়া ঝাল দিয়া আলু-চটপটি বানাইয়া দাও, টাকা কাইল পাইবা”। আমার মনে পড়ে অনেকদিনই আমাকে আমার স্বর্গীয়া মাতা প্রশ্ন করিয়াছিলেন উহারা কিভাবে তাঁহার ভ্রাতা হইল, যাহাদের সহিত তাঁহার কখনোই সাক্ষাত হয় নাই। সেই সময় ঐ প্রশ্নের তেমন কোন সদুত্তর দিতে পারিতাম না, তবে এখন বুঝি কেন তাহারা মামা। একসময় অনেক অভিভাবক-অভিভাবিকারা ঐসব মামাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত হইয়া বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ করিলে কর্তৃপক্ষ তাহাদের বিতাড়িত করিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া নামিয়া পড়েন। কিন্তু ছাত্রদিগের মাতুলপ্রীতি এতোই প্রবল ছিল যে বিদ্যালয়ের প্রবেশ পথ হইতে অনেক দূরে মামাগণ নির্বাসিত হইলেও তাহাদের ব্যবসার কোনই ক্ষতি হইতে দেয় নাই তাহাদের প্রিয় ভাগিনাগণ। অনেক দূর পথ অতিক্রম করিয়া হইলেও তাহাদের সহিত সাক্ষাত পর্বটি ভাগিনারা প্রতিদিনই সারিতে লাগিল। অতপর একসময় কর্তৃপক্ষ এই মামা-ভাগিনার সম্পর্কের কাছে নতি স্বীকার করিয়া মামাদিগকে আবার বিদ্যালয়ের প্রবেশ পথে পুনরায় অবস্থান করিবার অনুমতি দিতে বাধ্য হইলেন। মামাদের বিদ্যালয়ের প্রবেশ পথে পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য সেইদিন ছাত্রদের যেই নিরব আন্দোলন হইয়াছিল তাহার বিজয় ছিল যেন বিশ্বের সমগ্র মামা-ভাগিনা সম্পর্কের বিজয়।
বাঙ্গালির গন্তব্য যেইখানেই হউক না কেন সেইখানেই কোন না কোন ভাবে মামা-ভাগিনার সম্পর্ক তাহারা তৈয়ার করিতে খুবই পটু। এই সুদূর যুক্তরাষ্ট্রেও মামাপ্রিয় বাঙ্গালি ভাগিনারা তাহাদের মামাদিগকে আবিস্কার করিয়াছে। কিন্তু এইখানে ব্যতিক্রম হইল যে এইখানকার মামাদের জানা নাই যে তাহাদের অসংখ্য ভাগিনারা তাহাদের অগোচরে তাহাদিগকে মামা বলিয়া সম্বোধন করে এবং তাহাদের সান্নিধ্যের পরিবর্তে দূরে থাকিতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। পাঠকগণ হয়তো ইতিমধ্যেই অনুমান করিতে পারিয়াছেন যে আমি কোন মামাদের কথা বলিতেছি। হ্যা, ঠিকই ধরিয়াছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের এই দেশের বাঙ্গালিরা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় মামা বলিয়াই সম্বোধন করেন। আর এই সব মামাদের সহিত সাক্ষাত হয় নাই এমন লোকের সংখ্যা নাই বলিলেই চলে। অন্ততঃপক্ষে পথে ঘাটে যাহারা গাড়ী চালনা করেন অথবা গাড়ীতে চড়িয়া থাকেন তাহারা কখনোই কোন মামার সাক্ষাত পান নাই তাহা বিশ্বাস করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এইরকম যদি কেহ থাকিয়াই থাকেন তবে তাহাকে কি উপাধি দেওয়া সমীচীন হইবে তাহাই চিন্তা করিতেছি। তবে এই কথা নিশ্চিত করিয়া বলিতে পারি যে ওইসব গাড়ীচালকদের বীমাকৃত প্রতিষ্ঠানসমূহ তাহাদের দ্বারা খুব একটা লাভবান হন না।
সবারই কম বেশী বিভিন্ন সময় মামাদের সহিত সাক্ষাত ঘটে। এমন অনেকেই আছেন যাহারা কিছুদিন অন্তর অন্তর মামাদের কাহারো সহিত সাক্ষাত না করিয়া থাকিতেই পারেন না। তবে কখনোই এইসব সাক্ষাত পর্ব খুব একটা সুখকর হয় না। বেশীরভাগ সময়ই দেখা যায় পথে ঘাটে কোন দুর্ঘটনার পর পরই তত্ক্ষণাত কোথাও হইতে তাহারা ভূতের মতো আসিয়া হাজির হইবেন অথবা ইচ্ছাকৃত কিংবা অসাবধানতাবশতঃ পথে চলিবার নিয়ম-কানুন মানিতে আপনার কিছু ভুল-ভ্রান্তি ঘটিলেই তাহাদের অনাকাঙ্খিত আবির্ভাব ঘটিবে। শেষোক্ত ক্ষেত্রে দেখা যায় মামারা আসিয়া খুবই বিনীতভাবে একখানা কাগজ যাহা কিনা “টিকেট” নামেই অধিকতর পরিচিত, তাহা আপনার হাতে ধরাইয়া দিয়া আপনার দস্তখতটির জন্য বিনীত অনুরোধ করিবেন এবং আপনার মনটি খারাপ করিয়া দিয়া প্রস্থান করিবেন। কাগজখানা আর কিছুই নয় নিয়ম ভঙ্গ করিবার জন্য জরিমানা অথবা আদালতে আপনাকে উপস্থিত থাকিবার আদেশপত্র। তবে প্রস্থান করিবার পূর্বে নিরাপদে গাড়ি চালাইবার উপদেশসহ আপনার বাকি সারাটা দিন যেন সুন্দর কাটে সেই কামনা করিতে মামাগণ কিন্তু কখনোই ভুল করেন না। ইহা যেন গরু মারিয়া জুতা দান করিলেন আর কি। একবার ঐরূপ একখানা কাগজ হাতে পাইলে কাহারো পক্ষেই দিনের বাকিটা সময় সুন্দর কাটাইবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ হইয়া পড়ে তাহা নিশ্চিত করিয়াই বলিতে পারি। বরঞ্চ তখন সবাইই চিন্তা করিতে থাকেন যে শেষ কবে ঐরূপ একখানা কাগজ হাতে পাইয়াছিলেন, তাহাতে কি জরিমানা দিতে হইয়াছিল, নাকি আদালতে যাইতে হইয়াছিল, নাকি পথে ঘাটে চলিবার নিয়মাবলী পুনরায় ঝালাই করিবার জন্য দপ্তর হইতে ছুটি লইয়া মামাদের দ্বারা পরিচালিত আট ঘন্টাব্যাপী অসহনীয় ক্লাসে উপবিষ্ট হইতে হইয়াছিল। আর অঙ্ক কষিতে থাকেন এই ধাক্কায় কত টাকা জরিমানা হইতে পারে, জরিমানা নাকি মামাদের ক্লাস কোনটির খরচ কম হইবে, ক্লাস লইলে দপ্তর হইতে ছুটি পাওয়া যাইবে তো, আদালতে গেলে কি অভিযোগ হইতে নিষ্কৃতির কোন সুযোগ আছে কিনা, এই কাগজের সহিত গাড়ী চালাইবার লাইসেন্সের রেকর্ডে কত পয়েন্ট যোগ হইবে এবং মাসিক বীমার টাকাইবা কত বৃদ্ধি পাইতে পারে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এইসব মামাদের সহিত সাক্ষাত পর্বের চমকপ্রদ এবং মজাদার অভিজ্ঞতার গল্প বাঙ্গালিদের যেকোন আড্ডা জমাইয়া তুলিবার জন্য একটি অতি উত্কৃষ্ট উপাদান। এই লেখাটিতে এই প্রবাসের মামাদের লইয়া আমার নিজের ভান্ডার হইতে এবং বিভিন্ন আড্ডা হইতে শোনা কিছু গল্পের অংশ বিশেষ লিপিবদ্ধ করিবার খায়েশ হইল। গল্পগুলি স্বাভাবিকভাবেই অনেক পাঠকদেরই অতি পরিচিত মনে হইতে পারে। আমি নিশ্চিত অনেক পাঠকদেরই নিজেদের ভান্ডারে এই সংক্রান্ত আরও গল্প আছে যাহা কিনা আরও বেশী চমকপ্রদ এবং মজাদার।
রাস্তায় কোন কারণে কোন মামারা তাহার গাড়ীর লাল-নীল রকমারী আলো ঝলকানি বাতি দিয়া আপনার পথরোধ করিয়া আপনার সাম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়া, আপনাকেই একটি ধাঁ ধাঁ র মতো করিয়া প্রশ্ন করিবেন - বলুন তো আপনাকে কেন আটকানো হইয়াছে। এমন একটা ভাব করেন যেন এই ধাঁ ধাঁ র উত্তর আপনি সঠিক ভাবে বলিতে পারিলে আপনি এক্ষুনি ক্ষমা পাইয়া যাইবেন। আপনার বেশী গতিবেগই যদি কারণ হয় তাহা হইলে পরবর্তী প্রশ্নটি আরো একটু কঠিন - বলুন তো আপনার গতিবেগ কতো ছিল এবং এই রাস্তার জন্য নির্ধারিত গতিবেগ কত? মনে হয় আপনাকে আরেকবার সুযোগ দেওয়া হইল। এইবার সঠিক উত্তর দিতে পারিলে আপনি নির্ঘাত এই যাত্রায় পরিত্রাণ পাইবেনই। আহা সত্যিই যদি এমনটি ঘটিত! তাহার পরে মামাদিগের পরের প্রশ্নটি থাকে আপনার কি কোন তাড়া আছে, কেন এতো জোরে গাড়ী চালাইতেছিলেন? এইবার মনে হয় আসলেই একটি সুযোগ পাওয়া গেল। এই প্রশ্নের উত্তরে শুনিয়াছি সত্য কিংবা মিথ্যার আশ্রয় লইয়া বিভিন্ন অজুহাত দাঁড় করাইয়া মামাদিগের নিকট হইতে অনেক সময় অনেকেই পরিত্রাণ পাইয়াছেন। অজুহাতগুলির মধ্যে আপনার গাড়ীতে উপস্থিত অথবা নিকট কাহারো অসুস্থতার অজুহাত - হাসপাতালে যাইতে হইতেছে কিংবা বিমান ধরিতে দেরী হইয়া যাইতেছে অথবা প্রকৃতির অদম্য ডাকে এক্ষুনি সাড়া না দিলেই নয় - এমন কোন অজুহাত যে মাঝে মধ্যে মামাদের কঠিন মন বিগলিত করে না তাহা কিন্তু নয়। তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় মামাদের ঐ শেষ প্রশ্নটি নিতান্তই একটি আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। বরঞ্চ আপনার গাড়ী চালাইবার লাইসেন্স এবং বীমার কাগজ লইয়া তাহার দায়িত্ব পালনে অর্থাত্ আপনার জন্য সেই বিশেষ কাগজটি অর্থাত্ টিকেটটি প্রস্তুত করিতে আত্মনিয়োগ করেন। আবার দেখা যায় কোন কোন বিশাল মনের মামা আপনার অপরাধ সত্ত্বেও আপনার লাইসেন্স এবং বীমার কাগজ দেখিয়া মনঃপুত হইলে শুধুমাত্র মৌখিক অথবা লিখিত সাবধানসূচক বার্তা দিয়াই আপনাকে রেহাই দিয়া দেন। সেই সব মামাদের সাক্ষাত পাইলে কৃতজ্ঞচিত্তে সারা জীবন মামাদের যেই পরিচিত রূপের সাথে আমাদের পরিচয় হইয়াছিল তাহার কথাই মনে পড়িয়া যায়।
রাস্তায় গাড়ী চালাইবার সময় তাই সব সময়ই সকল চালকগণ তাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সচল রাখেন যেন তাহারা মামাদের উপস্থিতি আগেভাগেই অনুধাবন করিতে পারেন এবং মামারা আটকাইবার আগেই সচেতন হইতে পারেন। অনেকেই মামাদের প্রিয় রাস্তাগুলি গাড়ী চালাইবার সময় পরিত্যাগ করিতেই ভালোবাসেন। আর মামারা তাহাদের প্রিয় রাস্তায় বাঘ মামাদের মতো ঝোঁপ ঝঁড়ের আড়ালে কিংবা বিড়াল মামাদের মতো কোন চিপা গলিতে লুকাইয়া থাকিতেই পছন্দ করেন। ওইখানে বসিয়া বসিয়া তাহারা তাহাদের লেজার বন্দুক দিয়া আসা যাওয়া গাড়ীগুলির গতি নিরূপণ করেন এবং বেশী গতির গাড়ীচালক কোন ভাগিনাকে পাইলেই মনের আনন্দে তাহার পিছু নেন। যেকোন লং উইকেন্ডে মামাদের দৌড়াত্ব অন্যান্য সময়ের চাইতে আরো বৃদ্ধি পায়। আবার মাসের শেষে মামারা নিজেদের চাকুরি রক্ষা করিবার জন্য মাসিক কোটা পূরণে যারপরনাই সচেষ্ট হন। সেই সময় অনেক মামাই ভাগিনাদের পান হইতে চুন খসিলেই তাহাদের পিছু নিতে ছাড়েন না।
মামাদের হইতে রক্ষার পাইবার জন্য অনেক অতিশয় চালাক ভাগিনা “রাডার ডিটেক্টর” নামক এক “মামা সন্ধানী” যন্ত্রের শরণাপন্ন হন। এই যন্ত্রটি রাস্তা ঘাটে মামাদের ব্যবহৃত তরঙ্গ সনাক্ত করিয়া তাহাদের উপস্থিতি সম্পর্কে ভাগিনাদের আগে হইতেই সজাগ করিয়া দেয় এবং ভাগিনারা সচেতন হইয়া তাহাদের গাড়ীর গতি তত্ক্ষণাত হ্রাস করিয়া সহজেই মামাদিগকে ধোঁকা দিতে পারেন। তবে এইসব “অতি চালাক” ভাগিনাদের বোকা বানাইয়া তাহাদের “গলায় দড়ি” পরাইবার জন্য ততোধিক চালাক মামাদেরও কিন্তু অভাব নাই। তাহারা ভাগিনাদের ব্যবহৃত “মামা সন্ধানী” যন্ত্রকে সনাক্ত করিতে অথবা তাহাকে অকেজো করিতে পারে এমন আরেকটি যন্ত্র যেমন “পাঁজি ভাগিনা সন্ধানী” ব্যবহার করিয়া থাকেন।
পথে গাড়ি চালাইবার সময় যদি কেহ খেয়াল করেন যে তাহার পিছনে হঠাত্ একটি মামার গাড়ী আসিয়া তাহাকে অনুসরণ করিতেছে, তাহা হইলে তাহার হৃদ-স্পন্দন বৃদ্ধি পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। কাহার যেন এইরকমই একটি ঘটনা ঘটিয়াছিল। হঠাত্ করিয়া তিনি দেখিলেন পিছনে একটি মামার গাড়ী। সাথে সাথে তিনি গাড়ীর গতিবেগ কমাইতে শুরু করিলেন। কমাইতে কমাইতে নির্ধারিত বেগের চাইতেও অনেক কম করিয়া ফেলিলেন। চিন্তা করিতে লাগিলেন তাহার কি অপরাধ হইতে পারে? তিনি কি খুব বেশী জোরে চালাইতেছিলেন? মামা কি আসলেই তাহাকে থামাইবে? মামার গাড়ী অনেক ক্ষণ তাহাকে অনুসরণ করিয়া শেষ পর্যন্ত তাহার রকমারী বাতি জ্বালাইয়াই দিলেন। অগত্যা চালককে গাড়ী থামাইতেই হইল। মামার গাড়ী হইতে একজন নামিয়া আসিলেন। ও মা ইহা তো দেখি মামা নয়, মামী। নারীজাতির মোলায়েম মনের কথা ভাবিয়া তিনি একটু যেন স্বস্তিই বোধ করিলেন – তাহার মনে হইল মামীকে কোনরূপে বুঝাইয়া দিয়া তিনি এই যাত্রায় পার পাইয়া যাইতে পারিবেন। কিন্তু বিধি বাম। এই মামীতো দেখি মামাদের চাইতেও কঠিন। তাহাকে টিকেট হাতে ধরাইয়া দিতে খুব বেশী দেরী করিলেন না। তবে টিকেটটি তাহার গাড়ির গতিবেগ বেশী থাকিবার জন্যে নয় বরং নির্ধারিত গতির চাইতে অনেক কম বেগে চালাইবার জন্য তাহার পিছনে অন্যান্য গাড়ীর যে লাইন লাগিয়া গিয়াছিল সেই অপরাধে। কম গতিতে গাড়ী চলাইবার জন্যও যে কেহ টিকেট পাইতে পারে ইহা তাহার চিন্তাতেও ছিল না।
কেহ অতিরিক্ত গতিতে গাড়ী চালাইতে থাকিলে এবং হঠাত্ কোন মামাকে দেখিয়া গাড়ীর গতি তত্ক্ষণাত কমাইয়া দিলে অনেক সময় দেখা যায় মামা তাহার গাড়ীর চক্ষু ঝলসানো বাতি আর জ্বালান নাই। এই ক্ষেত্রে খুব সম্ভবতঃ মামা তাহার লেজার বন্দুকটির ট্রিগার সময় মত ব্যবহার করিতে পারেন নাই কাজেই গতিবেগটি কত ছিল বুঝিতে পারেন নাই অথবা মামাকে দেখিয়া যে ভাগিনা গাড়ীর গতি কমাইলেন ইহাতে মামা খুবই পুলকিত এবং সম্মানিত বোধ করিয়াছেন আর ভাগিনাকে ক্ষমা করিয়া দিয়াছেন। অনেক দ্রুত গতির গাড়ীচালক ভাগিনারা আছেন যাহারা যদি দেখেন রাস্তার পাশে কোন এক মামা অন্য এক ভাগিনাকে লইয়া ভীষন ব্যস্ত আছেন, তাহারা আর নিজেদের গাড়ীর গতি কমান না। কারণ তাহারা ভাবেন মামাতো ব্যস্তই আছেন, কাজেই তাহার পিছু লইবার ফুরসত হইবে না। এই ক্ষেত্রে বেশীর ভাগ ভাগিনা আসলেই বাঁচিয়া যান। কিন্তু কাহারো কাছে শুনিয়াছিলাম যে এক মামা তাহাকে আটকাইয়াছিলেন এবং শুরুর ধঁ ধাঁ পর্ব চলিতেছিল। সেই সময় মামার ঐ কিসিমের এক চালাক ভাগিনার গাড়ী দ্রুত গতিতে পাশ দিয়া চলিয়া গেলে মামার যেই ভাগিনা ধাঁ ধাঁ র উত্তর দিতে ব্যস্ত ছিলেন তাহাকে অপেক্ষা করিতে বলিয়া মামা ঐ চালাক ভাগিনার পিছু নিলেন এবং ঐ চালাক ভাগিনাকে আগে টিকেট ধরাইয়া দিয়া আবার ফেরৎ আসিলেন ধাঁ ধাঁ র উত্তর শুনিতে।
একবার সদ্য বাংলাদেশ হইতে আগত এক ব্যক্তি সম্পূর্ণ দেশীয় স্টাইলে জেব্রা ক্রসিং ছাড়া রাস্তা পার হইতে গিয়া রাতের অন্ধকারে গাড়ী চাপা পড়িয়া ভীষণভাবে আহত হইয়াছিলেন। অনেক দিন তাহাকে হাসপাতালে থাকিতে হইয়াছিল এবং অতঃপর বাসায় মাসের পর মাস বিছানায় শুইয়া থাকিতে হইয়াছিল। দুর্ঘটনার পর পর মামারাই আসিয়া তাহাকে অবচেতন অবস্থায় রাস্তার পাশ হইতে উদ্ধার করিয়া দ্রুত হাসপাতালে প্রেরণ করিয়াছিলেন। সত্যিই একটি মহান দায়িত্ব তাহারা পালন করিয়াছিলেন। তাহা না হইলে হয়তো আরো বড় কোন অঘটন ঘটিয়া যাইতে পারিত। কিন্তু সেই সাথে মামাগণ তাহাদের দায়িত্বের বাকিটুকুও সারিতে ভুল করেন নাই। দুর্ঘটনায় কবলিত ব্যক্তিটি একটু সুস্থ হইলেই জানিতে পারেন যে জেব্রা ক্রসিং ছাড়া রাস্তা পার হইবার অপরাধে তাহাকে উদ্ধার করা ঐ মামারাই সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তাহার সয্যাপাশে টিকেটখানি সযত্নে রাখিয়া উপস্থিত কর্তব্যরত নার্সকে বুঝাইয়া দিয়া চলিয়া যান। হায় কি বিচিত্র এই দায়িত্বজ্ঞান সচেতন মামাগণ!
এতোক্ষণ শুধু এই পুলিশী মামাদের কথা বলিতে গিয়া ভাগিনাদের প্রতি তাহাদের বিরূপ (!) আচরণের কথাই বলিলাম। কিন্তু মামারা যে খালি টিকেটই দেন তাহা কিন্তু নয়। তাহারা কিন্তু বিপদের সময় ভাগিনাদের চরম উপকারেও আসেন। যেমন একটু আগেই উল্লেখ করিয়াছি বাংলাদেশী ভদ্রলোকের গল্পে। আর আমি নিজেও দুইবার দুর্ঘটনার শিকার হইয়াছিলাম। প্রতিবারই এই মামারাই আমাকে উদ্ধার করিয়াছিলেন। তবে প্রতিবারই দুর্ঘটনায় আমার কোন দোষ ছিল কিনা তাহা অবশ্য মামারা ভালো মতোই পরীক্ষা করিয়াছিলেন। একবারতো এক পাহাড়ী দুর্গম অঞ্চলে নব পরিনীতা বধুকে লইয়া দুর্ঘটনায় পড়িয়াছিলাম। কাছের শহর হইতে দুর্ঘটনার জায়গাটি ঘন্টা দেড়েক এর পথ। আমাদের উদ্ধার করিতে মামা আসিলেনও প্রায় এক ঘন্টা ড্রাইভ করিয়া। তাহার পর ওই স্থান হইতে আমাদের দুর্ঘটনা কবলিত ভাঙ্গা গাড়িটি পথে থামিয়া যাইতে পারে ভাবিয়া আমাদের ভাঙ্গা গাড়ির পিছন পিছন দেড় ঘন্টা ড্রাইভ করিয়া ঐ মামা আমাদের গন্তব্য পর্যন্ত আসিলেন। একজন মামা সব সময় আমাদের পিছনে আছেন উহা ভাবিয়া আমাদের স্বস্তি হইলেও সাথে সাথে যে স্বাভাবিক মামা ভীতিও যে ছিল না তাহা কিন্তু নয়। ভাবিয়াছিলাম যে - এখন যদি অসাবধানতাবশতঃ কোন ভুল করিয়া ফেলি তাহা হইলে কি মামা তাহার গাড়ীর চক্ষু ঝলসানো বাতি জ্বালাইয়া আমাকে একখানা টিকেট ধরাইয়া দিবেন? যাক সেইরকম কিছু আর সেইদিন ঘটে নাই। তবে ঐ মামার সেই দিনের আচরণে সত্যিই যেন আমাদের চিরাচরিত প্রিয় মামাকেই খুঁজিয়া পাইয়াছিলাম।
____________________________
এই লেখাটি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্য হইতে বাংলাদেশ থিয়েটার অব অ্যারিজোনা (বিটিএ) কর্তৃক প্রকাশিত বার্ষিক সাহিত্য পত্রিকা "সিঁড়ি" র পঞ্চম সংখ্যায় (অক্টোবর, ২০০৭) প্রকাশিত হইয়াছে।
মন্তব্য
মামা ভাইগ্না যেখানে আপদ নাই সেখানে
-----------------------------------------
মৃত্যুতে ও থামেনা উৎসব
জীবন এমনই প্রকান্ড প্রচুর ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
রাজশাহীতে একটা মধুর গালি আছে- মামুর বেটা
সুন্দরবনের লোকজন বাঘকে বলে - মামা
আর সুনির্মল কুমার বসু মামাদের নিয়ে রচিত লেখার নামকরণ করেছেন -মামায়ন
(যেহেতু রামকে নিয়ে লেখার নাম রামায়ণ। সেজন্য)
(বিপ্লব)
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
মামাগণ মনে হয় কোনভাবে আমার এই লেখাটির কথা জানিতে পারিয়াছেন। কারণ ইতিমধ্যেই আমি একজন মামার সাক্ষাত্ পাইয়া গিয়াছি। মামার প্রথম ধাঁ ধাঁটির উত্তর ইচ্ছা করিয়াই ভুল বলিলাম। অনেক কম করিয়াই বলিলাম - কারণ আমি জানি আমি কত জোরে চলিতেছিলাম। সত্য বলিলে হয়তো মামা তক্ষুনি আমাকে "শশুরালয়" এ লইয়া যাইতে পারেন। আমার উত্তর শুনিয়া মামা যেন ভিমরি খাইলেন। বলিলেন ঠিক আছে - তুমি কি আবার ওই বেগে একটু চালাইবে - লেটস ট্রাই। দ্বিতীয় ধাঁ ধাঁ র উত্তরে তেমন কোন গ্রহণযোগ্য কারণ মনে পড়িল না। তাহার পরেও বানাইয়া বানাইয়া কিছু একটা বলিবার চেষ্টা করিলাম। মামার মন বিগলিত হইল না। বরং বলিলেন তুমি কি জান তোমাকে ইচ্ছা করিলে আমি এক্ষুনি "শশুরালয়" এ লইয়া যাইতে পারি। পাঠকগণ হয়তো আন্দাজ করিতে পারিতেছেন আমি কত জোরে চালাইতেছিলাম। যাহা হউক, মামা "টিকেট খানা" হাতে ধরাইয়া দিলেন এবং বলিলেন "তোমার ভাগ্য তোমাকে শশুরালয়ে লইলাম না, এবং তোমাকে ক্লাস লইবার সুযোগ করিয়া দিলাম। তুমি ইচ্ছা করিলে আদালতে উপস্থিত হইয়া এই টিকেটের বিরুদ্ধে কথা বলিতে পার। কিন্তু মনে রাখিবা আদালতে যদি তুমি দোষী সাব্যস্ত হও আমি কিন্তু তোমাকে আদালত হইতেও শশুরালয়ে পাঠাইতে পারিব।" আমি একটু ভয়ই পাইয়া গেলাম। আদালতে যাইবারতো প্রশ্নই আসে না। মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলাম শেষ কবে টিকেট পাইয়া ক্লাস করিয়াছিলাম। দুই বছরের কম হইলেতো আমি ক্লাস করার জন্য যোগ্য হইব না। ক্লাস না করিলে জরিমানা দিতে হইবে। আমার যা অপরাধ জরিমানার অংকটি ক্লাসের খরচের দ্বিগুণেরও বেশী। কাজেই মনে মনে দোয়া করিতে লাগিলাম যেন গত ক্লাসটি অন্তত পক্ষে দুই বছর আগে হইয়া থাকে। যাহা হউক ফোন করিয়া জানিতে পারিলাম যে কোন ক্রমে বাঁচিয়া গিয়াছি আমার গত ক্লাসটি দুই বছরের আগেই লওয়া হইয়াছিল। মামার খপ্পরে পরিবার ঘটনাটি বাসায় চাপিয়া যাইতে হইবে। কোনভাবে জানিতে পারিলে সর্বনাশ হইবে। এখন চিন্তা কিভাবে গোপনে সারাদিনের মামাদের ক্লাসটি করা যায়?
এই ঘটনার পর আমি পণ করিয়াছি মামাদের লইয়া আর কোনদিন কোন রসিকতা করিব না। অনেক শিক্ষা হইয়াছে।
____________________________
শেখ ফেরদৌস শামস ভাস্কর
"আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।"
বেশ ভালো মামু অভিজ্ঞতা!
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
রাঙ্গামাটিতে বেড়াইতে যাইয়া একবার সেখানকার এক হোটেলের বয়দিগকে 'মামু' ডাকিয়াছিলাম। আমাদের সুমিষ্ট ডাকে কোনপ্রকার বিগলিত না হইয়া তাহার ম্যানেজারকে যাইয়া অভিযোগ করিল। ম্যানেজার আসিয়া আমাদিগকে বলিলেন, আমরা যেন তাহাদিগকে মামু না ডাকি। তাহাতে তাহারা বড় অপমান বোধ করেন। বাধ্য হইয়া তাহাদিগকে এরপর হইতে বয় ডাকিতে হইত। যদিও যিনি আমাদের রুমে সার্ভ করিতেন তাহার বয়স ছিলো কম করে হলেও পঞ্চাশের ওপরে।
বিধির বিধান, নাকি দুর্ভাগ্য বলিতে পারিব না। অনতিকাল পরেই সেই বয়স্ক বয়-এর এক মামু লাঠি হাতে উপস্থিত হইলেন। আমরা তাহাকে অতীব সম্মানের সহিত আমাদের নাম-ঠিকানা এবং আগমনের হেতু জানাইলাম। তিনি সন্তুষ্টচিত্তে ফিরিয়া গেলেন এবং বয়কে বলিয়া গেলেন, সে যেন আমাদিগের ওপর নজর রাখে।
এরপর একসময় বয় নিজে থেকেই প্রস্তাব করিল, তাহাকে আমরা ইচ্ছে করিলে মামু ডাকিতে পারি।
এক মামু আরেক মামুকে মামু ডাকার অধিকার দিয়া গেলেন।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
- ধীরে চালাইতে গিয়া একবার মামুর খপ্পরে পড়ে ফুসফুস ঠিকঠাক কর্ম করে কীনা তাহা নিঃশ্বাস নির্গমন করাইয়া দেখাইতে হৈয়াছিলো। মামারা বড়ই কেয়ারিং ভাইগনার স্বাস্থ্যের প্রতি।
অতিরিক্ত গতির কারণে এরপরে যদি আপনাকে ধাঁধাঁর দ্বন্দে পড়তে হয় তাইলে বড় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার কথা বলে দিবেন এবং সাথে সাথে ব্যবহারিক প্রমাণ দিয়া দিবেন। এতে করিয়া জামাকাপড় নষ্ট হৈলেও টিকিট হৈতে বাঁচিয়া গেলেও যাইতে পারেন।
___________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
নতুন মন্তব্য করুন