ভুলের আপেক্ষিকত্ব (২/২)

জি.এম.তানিম এর ছবি
লিখেছেন জি.এম.তানিম (তারিখ: সোম, ০৯/০৫/২০১১ - ১:৫১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(আইজ্যাক আসিমভের The Relativity of Wrong-এর অনুবাদের দ্বিতীয় ও শেষ খণ্ড এটি। মূল রচনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যে আবারও সচল স্পর্শকে জানাই কৃতজ্ঞতা। প্রথম দফা প্রুফ দেখে দিয়েছে সচল সুরঞ্জনা হক। পারিভাষিক সহযোগিতায় সচল হিমু, স্পর্শ এবং সংসারে এক সন্ন্যাসী। সবাইকে ধন্যবাদ। কিছু ক্ষেত্রে বোঝার সুবিধার জন্যে উইকিপিডিয়ার কিছু লিঙ্ক ব্যবহার করেছি, ইংরেজি ভাষার লিঙ্ক। সে কারণে আগাম ক্ষমা প্রার্থনা করছি পাঠকের কাছে।)

ভুলের আপেক্ষিকত্ব (১/২)

তাহলে কি পৃথিবী গোলাকার?
না, পৃথিবী গোলাকার নয়, অন্তত গাণিতিকভাবে তো নয়। একটা গোলকের কিছু গাণিতিক বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন, এর সকল ব্যাসের (যে সরল রেখাগুলো পৃষ্ঠের একবিন্দু থেকে অপরবিন্দুতে যাওয়ার সময় কেন্দ্র দিয়ে যায়) দৈর্ঘ্য সমান।
পৃথিবীর ক্ষেত্রে এটা সত্য নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন বিন্দুতে অঙ্কিত ব্যাসের দৈর্ঘ্য ভিন্ন।
পৃথিবী যে প্রকৃত গোলক নয় এই ধারণা মানুষ তবে কীভাবে পেলো? অতীতকালে মানুষের হাতে পরিমাপের যে সীমিত যন্ত্রপাতি ছিলো, তার হিসেবে সূর্য আর চাঁদের আকার নিখুঁত বৃত্তাকারই মনে হয়েছে। সূর্য আর চাঁদের গোলাকার রূপ সম্পর্কে যে অনুমান ছিলো এটা সেটার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
তারপরে যখন টেলিস্কোপে প্রথম বৃহস্পতি আর শনি দেখা হলো, তখন সবাই খেয়াল করলো এরা বৃত্তাকার নয়, বরং উপবৃত্তাকার। অর্থাৎ বৃহস্পতি আর শনি প্রকৃত অর্থে গোলাকার নয়।
সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে আইজ্যাক নিউটন দেখান যে একটা বৃহৎ পিণ্ড মহাকর্ষ বলের প্রভাবে একটা গোলকে পরিণত হবে (অ্যারিস্টোটলের ব্যাখ্যার অনুরূপ) কেবল যদি এটা ঘূর্ণনশীল না হয়। কিন্তু যদি বস্তুটি ঘূর্ণনশীল হয়, তবে ঘূর্ণনজনিত কেন্দ্রাতিগ বলের কারণে পিণ্ডটির কিছু অংশ মধ্যাকর্ষণের বিপরীতে উঁচু হয়ে যাবে। এই পরিবর্তন সবচেয়ে বেশি হবে বিষুবরেখার কাছাকাছি, আর মেরুতে হবে সবচেয়ে কম। এই বৈশিষ্ট্যটি দ্রুত ঘুরতে থাকা বস্তুতে ধীরে ঘুরতে থাকা বস্তুর চেয়ে বেশি দেখা যাবে। বৃহস্পতি ও শনি খুবই দ্রুতবেগে ঘূর্ণনশীল।
পৃথিবী বৃহস্পতি ও শনির চেয়ে আস্তে ঘুরে তাই পৃথিবীর ক্ষেত্রে এটি খানিকটা কম দেখা যাবে, তবে একেবারে অনুপস্থিত থাকবে না। অষ্টাদশ শতাব্দীতে পৃথিবীর বক্রতা সঠিকভাবে পরিমাপ করা হয়, এবং নিউটনের কথা সত্যি বলে প্রমাণিত হয়।
বিষুবরেখা বরাবর পৃথিবী একটু স্ফীত। অন্য কথায়, দুই মেরুতে একটু চাপা। তাই একে গোলাকার না বলে ঈষৎ উপগোলাকার বলা যেতে পারে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে হিসেব করলে এর ব্যাসের মান বিভিন্ন হবে। দীর্ঘতম ব্যাস পাওয়া যাবে বিষুবরেখার কোনো বিন্দু থেকে অপরপ্রান্তের বিন্দুতে টানা রেখায়। পৃথিবীর বিষুবীয় ব্যাস ১২,৭৫৫ কিলোমিটার (৭,৯২৭ মাইল)। হ্রস্বতম ব্যাস পাওয়া যাবে উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত রেখা বরাবর আর পৃথিবীর মেরুব্যাসের মান ১২,৭১১ কিলোমিটার (৭,৯০০ মাইল)।
পৃথিবীর দীর্ঘতম ব্যাস আর হ্রস্বতম ব্যাসের মধ্যে যে পার্থক্য সেটা ৪৪ কিলোমিটার অর্থাৎ ২৭ মাইল, তার মানে দাঁড়াচ্ছে পৃথিবীর উত্তর দক্ষিণে চেপে যাওয়ার বা গোলাকার অবস্থা থেকে বিচ্যুতির পরিমাণ ৪৪/১২,৭৫৫ অর্থাৎ ০.০০৩৪। এটা ১ শতাংশের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ।
অন্যভাবে বলতে গেলে, সমতলপৃষ্ঠে তলের বক্রতা সব জায়গাতে প্রতি মাইলে ০। পৃথিবীর গোলাকার পৃষ্ঠে তলের বক্রতা প্রতি মাইলে ০.০০০১২৬ (অথবা প্রতি মাইলে ৮ ইঞ্চি)। পৃথিবীর উপগোলকপৃষ্ঠে বক্রতার মান থাকে প্রতি মাইলে ৭.৯৭৩ ইঞ্চি থেকে ৮.০২৭ ইঞ্চি এর মধ্যে। গোলাকার থেকে উপগোলাকার পৃথিবীর ধারণায় যেতে যে সংশোধন তার মান সমতল থেকে গোলাকার পৃথিবীর ধারণায় যেতে যে সংশোধন তার তুলনায় অনেক কম। তাই খুব নির্ভুল ভাবে বলতে গেলে পৃথিবী গোলাকার এই বক্তব্যটি ভুল হলেও পৃথিবী সমতল এই ধারণার চেয়ে সেটা বেশি সঠিক।
ঠিকঠাকভাবে বলতে গেলে, পৃথিবী উপগোলাকার সেই ধারণাটাও ভুল। ১৯৫৮ সালে ভ্যানগার্ড ১ উপগ্রহটি যখন নিজ কক্ষপথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করা শুরু করে, তখন এটি অভূতপূর্ব সূক্ষ্মভাবে পৃথিবীপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানে অভিকর্ষজ আকর্ষণ এবং পৃথিবীর আকার পরিমাপ করতে সক্ষম হয়। দেখা যায়, বিষুবরেখা সংলগ্ন স্ফীতি উত্তর গোলার্ধের তুলনায় দক্ষিণ গোলার্ধে বেশি, এবং উত্তর মেরুর তুলনায় দক্ষিণ মেরুতে সমুদ্রপৃষ্ঠ পৃথিবীর কেন্দ্রের সামান্য কাছে অবস্থিত।
পৃথিবীর আকার নাশপাতির মতো, এটা বলা ছাড়া একে বর্ণনা করার উপায় নেই আর সাথে সাথে অনেক লোক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন পৃথিবী মোটেই গোলাকার নয় বরং শূন্যে ঝুলে থাকা একটা বার্টলেট নাশপাতির মতো। বাস্তবে, স্ফীত উপগোলক আকৃতি থেকে এই নাশপাতি আকৃতিতে যে বিচ্যুতি সেটা মাইল নয়, বরং কয়েক গজ এবং বক্রতার যে সংশোধন করতে হয়েছে সেটা প্রতি মাইলে এক ইঞ্চির কয়েক মিলিয়ন ভাগের এক ভাগ।
স্বল্পকথায় বলতে গেলে, আমার ইংরেজি সাহিত্যের যে বন্ধুটি পরম সঠিক আর পরম ভুলের মানসিক জগতে বসবাস করছেন, তিনি হয়তো ভাবছেন যেহেতু সকল তত্ত্বই ভুল, পৃথিবীকে এখন হয়তো গোলাকার মনে হচ্ছে কিন্তু আগামী শতকে ঘনাকৃতির মতো, তারপরের শতকে ফাঁপা আইকোসাহিড্রনের অর্থাৎ ২০ তল বিশিষ্ট ঘনবস্তুর মতো আর তার পরের শতকে ডোনাট আকৃতির মনে হবে।
আসলে যা ঘটে তা হলো, বিজ্ঞানীরা কোনো ব্যাপারে একটা শক্ত ধারনা পেয়ে গেলে ধাপে ধাপে পরিমাপের যন্ত্রপাতির উৎকর্ষতার সমান্তরালে নিরন্তর সূক্ষ্মতার সাথে সেটির পরিশোধন ও পরিবর্ধন করেন। যার মানে দাঁড়াচ্ছে, তত্ত্বগুলো ভুল না বলে বলা যেতে পারে সেগুলো অসম্পূর্ণ।

কেবল পৃথিবীর আকৃতির ক্ষেত্রেই নয়, আরও নানা ক্ষেত্রে এটা দেখানো যেতে পারে। এমন কি যখন একটা যুগান্তকারী তত্ত্ব আসে, সেটার শুরুটাও হয় ছোট ছোট ভুল শুদ্ধ করার মাধ্যমে। যদি শুদ্ধ করা ভুলের পরিমাণ বেশিই হতো, তাহলে সেই তত্ত্ব এতদিন টিকতো না।
কোপার্নিকাস পৃথিবীকেন্দ্রিক গ্রহমণ্ডলের বদলে সূর্যকেন্দ্রিক গ্রহমণ্ডল অর্থাৎ সৌরজগতের ধারণা দিয়েছিলেন। তখনকার বিচারে মনে হয়েছিল তিনি অবশ্যম্ভাবী একটা ধারনার বদলে আজগুবি একটা ধারনার জন্ম দিচ্ছেন। কিন্তু মানুষ যখন আকাশের গ্রহগুলোর গতিপথ সূক্ষ্মতার সাথে পরিমাপ করতে শিখলো তখন পৃথিবীকেন্দ্রিক গ্রহমণ্ডলীর ধারনাটি ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল।পুরনো তত্ত্বটি এতদিন টিকেছিল এর একমাত্র কারণ তখনকার কারিগরি যন্ত্রপাতির উৎকর্ষতা অনুযায়ী পরিমাপ করার সময় তত্ত্বগুলো বেশ ভালো ফলফলই দিয়েছিল। আবার, পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক গঠন এবং এতে বাস করা জীবসমূহের বিবর্তন এতই আস্তে ঘটে যে পৃথিবী আর জীবনের অস্তিত্ব সবসময় একই রকম ছিলো, এতে কোনো পরিবর্তনই হচ্ছে না,এটা ভেবে নেওয়া প্রথম দৃষ্টিতে খুব অবান্তর মনে হয় নি। তাই যদি হতো তাহলে প্রাণের সূচনা বিলিয়ন বছর আগে হয়েছে, নাকি হাজার বছর আগে হয়েছে তাতে কোনো ফারাক থাকত না। বরং হাজার বছর আগে হয়েছে সেটা উপলব্ধি করাটা মানুষের মনের জন্য সহজতর।
কিন্তু যখন খুব সতর্ক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেখা গেলো পৃথিবী এবং প্রাণ খুব সামান্য কিন্তু শূন্য নয় এমন একটা হারে পরিবর্তিত হচ্ছে, তখন এটা বোঝা গেল যে পৃথিবী এবং প্রাণের অস্তিত্বের বয়স অনেক। আধুনিক ভূতত্ত্ববিদ্যার জন্ম হলো, সাথে জন্ম হলো জৈববিবর্তনের ধারণার।
পরিবর্তনের এই হার যদি অনেক বেশি হতো, তাহলে প্রাচীনকালেই ভূতত্ত্ব এবং বিবর্তন বর্তমানের অবস্থায় চলে আসত। একটা স্থিত মহাবিশ্ব (অর্থাৎ যেখানে আদতে কোনো পরিবর্তনই হচ্ছে না) এবং একটা বিবর্তনরত মহাবিশ্বের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে শূন্য আর প্রায় শূন্যের পার্থক্য, আর সে কারণেই সৃষ্টিতত্ত্ববিদরা তাদের হাস্যকর চিন্তা প্রচার করে যেতে পারেন।
বিংশশতাব্দীর দুটি বিরাট আবিষ্কার আপেক্ষিকত্ব এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি কেমন সেটা দেখা যাক।
গতি এবং মহাকর্ষ বিষয়ক নিউটনের তত্ত্বগুলো সঠিকের খুব কাছাকাছি ছিলো, এবং সেগুলো সম্পূর্ণ সঠিক হতো যদি আলোর গতি অসীম হতো। তবে, আলোর বেগ সীমিত এবং সেটা আইন্সটাইনের আপেক্ষিকতার সমীকরণে আমলে আনা হয়েছে, যেটা আসলে নিউটনের সমীকরণের সাথে সংযোজন এবং পরিশুদ্ধি।
এটা হয়তো বলা যেতে পারে যে অসীম আর সসীমের মধ্যে পার্থক্যটাও তো অসীম। তাহলে নিউটনের সূত্র প্রথমেই ভূপাতিত হলো না কেন? ব্যাপারটা আরেকটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, প্রশ্ন করি, এক মিটার যেতে আলোর কত সময় লাগে।
আলোর বেগ যদি অসীম হতো, তাহলে এক মিটার যেতে এর সময় লাগত শূন্য সেকেন্ড। বাস্তবে আলোর যে বেগ, তাতে আলোর এক মিটার যেতে সময় লাগে ০.০০০০০০০০৩৩ সেকেন্ড। ০ আর ০.০০০০০০০০৩৩ এর মধ্যের যে পার্থক্য, তা আইন্সটাইন ঠিক করেছেন।
গুরুত্বের দিক থেকে এই সংশোধনটি ০ থেকে প্রতি মাইলে ৮ ইঞ্চির পৃথিবীর বক্রতার সংশোধনের মতোই। এই সংশোধন ছাড়া, গতিশীল অতিআণবিক কণাসমূহ যে আচরণ করে তা করবে না, কণা ত্বরণযন্ত্র বা পার্টিকল এক্সেলেরেটর যেভাবে কাজ করে তা করবে না, নিউক্লিয়ার বোমা বিস্ফোরিত হবে না, এমন কি তারারা আকাশে জ্বলবে না। তারপরেও, এটা আসলে ছিলো খুব ছোট একটা সংশোধন এবং যেহেতু নিউটনকে সীমিত গতি এবং দূরত্বের ক্ষেত্রে তার পর্যবেক্ষণগুলো করতে হয়েছে যেখানে এই সংশোধনের কোনো তাৎপর্য নেই, তাই তার পক্ষে এগুলো হিসেবে না নেওয়া মোটেই আশ্চর্য না।
প্রাককোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের যে প্রধান সীমাবদ্ধতা ছিলো তা হলো, এটি মহাবিশ্বের গ্রেইনিনেস অর্থাৎ বিচ্ছিন্নতা কে স্বীকার করেনি। সব ধরনের শক্তিকে অবিচ্ছিন্ন মনে করা হতো, আর ধারণা করা হতো শক্তিকে অসংখ্যবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে ভাগ করা যাবে।
পরে দেখা গেল এটা ঠিক নয়। শক্তি প্যাকেট আকারে আসে, যাকে বলে কোয়ান্টা, যেটার আকার নির্ভর করে প্ল্যাংকের ধ্রুবকের উপরে। প্ল্যাংকের ধ্রুবকের মান যদি ০ আর্গ-সেকেন্ড হতো, তাহলে মহাবিশ্ব হতো নিরবচ্ছিন্ন (কন্টিনিউয়াস), এতে কোনো বিচ্ছিন্নতা(গ্রেইন) থাকত না। প্রকৃতপক্ষে প্ল্যাংকের ধ্রুবকের মান ০.০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০৬৬ আর্গ-সেকেন্ড। শূন্য থেকে এর বিচ্যুতি আসলে খুবই কম। এতই কম যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে শক্তি সম্পর্কিত সাধারণ প্রশ্নগুলো এর দ্বারা প্রভাবিত নয় মোটেই। অপরপক্ষে যখন অতিপারমাণবিক কণা নিয়ে কাজ করতে হয়, তখন এই বিচ্ছিন্নতা বা গ্রেইনিনেসের পরিমাণ এতটাই বেড়ে যায় যে, কোয়ান্টাম বিবেচনা বাদ দিয়ে সেগুলো নিয়ে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

যেহেতু তত্ত্বের পরিশুদ্ধিগুলো হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধাপে, সেহেতু বেশ প্রাচীন অনেক তত্ত্বও পরবর্তী অগ্রগতির জন্যে যথেষ্ট উপযোগী ছিলো; এবং সেগুলো পরিশোধনের ফলে মুছে যায় নি।
গ্রীকরা পৃথিবীর গোলাকৃতির ধারণা ছাড়াই অক্ষরেখা এবং দ্রাঘিমারেখার প্রচলনের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরীয় অববাহিকার বেশ কিছু চলনসই মানচিত্র তৈরি করে। আজও আমরা অক্ষ ও দ্রাঘিমা ব্যবহার করছি।
সুমেরীয়রা মনে করতো পৃথিবী এই মহাবিশ্বের কেন্দ্র। তারা আকাশে গ্রহদের গতিপথ ও অবস্থান নির্ণয়ের মূলনীতি প্রতিষ্ঠা করেছিলো এবং এর মাধ্যমে কোনো সময়ে গ্রহের অবস্থানের ভবিষ্যতবাণী সঠিকভাবে করতে পারত। সেসব পরিমাপের অনেক সংশোধন হয়েছে কিন্তু মূলনীতি একই রয়ে গেছে।
বিরাট দূরত্ব এবং গতির ক্ষেত্রে নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব অসম্পূর্ণ হলেও সৌরজগতের জন্যে সেটি যথেষ্ট উপযুক্ত। নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব ও গতির সূত্র অনুযায়ী হ্যালির ধূমকেতু যখন আসার কথা, তখনই আসে। রকেট বিদ্যার মূলেও রয়েছে নিউটনের তত্ত্ব, আর ভয়েজার ২ ইউরেনাসে পৌঁছেছিল ভবিষ্যতবাণীকৃত সময়ের এক সেকেন্ডের মধ্যে। আপক্ষিকত্বের কারণে এগুলো কিছুই অবাঞ্ছিত হয়ে যায় নি।
উনবিংশ শতাব্দীতে, যখন কোয়ান্টাম তত্ত্বের কথা মানুষ স্বপ্নেও ভাবে নি, ততদিনে তাপগতিবিদ্যার সূত্রগুলো প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। শক্তির সংরক্ষণশীলতা ছিলো প্রথম সূত্র আর এনট্রপির অনিবার্য বৃদ্ধি ছিলো দ্বিতীয় সূত্র। আরও যেসব রূপান্তরের সূত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল তার মধ্যে ছিলো ভরবেগ, কৌণিক ভরবেগ আর তড়িৎ চার্জের সূত্র। ম্যাক্সওয়েলের তাড়িৎচৌম্বকত্বও ততদিনে প্রতিষ্ঠিত। এগুলো কোয়ান্টাম তত্ত্ব আসার পরেও দৃঢ় অবস্থানে রয়ে গেছে।
স্বাভাবিকভাবেই, যে সব তত্ত্বগুলো আমার ইংরেজি সাহিত্যের বন্ধুটির সরল দৃষ্টিতে ভুল বলে মনে হচ্ছে, সূক্ষ্মভাবে দেখলে সেগুলো আসলে কেবল অসম্পূর্ণ।
যেমন ধরুন, কোয়ান্টাম তত্ত্ব এমন কিছু “কোয়ান্টাম অস্বাভাবিকত্ব” তৈরি করেছে যেগুলো বাস্তবতার রূপকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং এমন কিছু দার্শনিক ধাঁধার জন্ম দিয়েছে যা নিয়ে পদার্থবিদরা কোনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেন না। হতে পারে আমরা এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছি যেখানে আমাদের মস্তিস্ক জিনিসগুলো উপলব্ধি করতে আর পারছে না। আবার এটাও হতে পারে যে কোয়ান্টাম তত্ত্ব আসলে অসম্পূর্ণ, এবং যখন এটি পূর্ণতা পাবে তখন “অস্বাভাবিকত্ব”গুলো দূর হয়ে যাবে।
আবার, কোয়ান্টার তত্ত্ব এবং আপেক্ষিকত্ব একে অপরের উপরে নির্ভরশীল বলে মনে হয় না, কারণ, কোয়ান্টাম তত্ত্ব চারটি জ্ঞাত মিথস্ক্রিয়ার (এই চার ধরনের মিথস্ক্রিয়ার ব্যাখ্যা একীভূত ক্ষেত্র তত্ত্ব বিষয়ক উইকিভূক্তিতে পাওয়া যাবে) মধ্যে তিনটিকে একটি গাণিতিক ব্যবস্থার মধ্যে একীভূত করতে পেরেছে, কিন্তু মহাকর্ষ এখনও আলাদা অনমনীয় রয়ে গেছে।
যদি কোয়ান্টাম তত্ত্ব আর আপেক্ষিকত্ব একীভূত করা যায়, তবেই “একীভূত ক্ষেত্র তত্ত্ব” বা unified field theory প্রকৃতপক্ষে একদিন সত্যি হবে।
এসব হয়ে গেলে, আমাদের জ্ঞানের সীমা বাড়াতে হলে তখন আরও ক্ষুদ্র ও সূক্ষ্মতর পরিশুদ্ধির দরকার হবে- বৃহৎ বিস্ফোরণের প্রকৃতি, মহাবিশ্বের সৃষ্টি, কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রের বৈশিষ্ট্য, ছায়াপথ এবং সুপারনোভাদের বিবর্তনের কিছু সূক্ষ্ম বিষয় ইত্যাদি।
সেই অর্থে, আমরা আজকে যা জানি, তা টিকে থাকবে অপরিবর্তিত হয়ে, তাই যখন আমি বলি যে আমি এমন একটা শতাব্দীতে বসবাস করি যখন আমরা মহাবিশ্বকে মূলত বুঝে ফেলেছি, আমার মনে হয় আমি ঠিক কথাই বলছি।

(সমাপ্ত)


মন্তব্য

সুরঞ্জনা এর ছবি

দেখা যাচ্ছে জি এম তানিম একটি ফুটবল দল সঙ্গে রেখে লিখতে বসেন চিন্তিত
দেঁতো হাসি

অনুবাদ দারুণ হাসি
আসিমভ এবং তোমাকে উত্তম জাঝা!

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

জি.এম.তানিম এর ছবি

তুই তাহলে অন্যতম ডিফেন্ডার...

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

দারুণ, জিয়েমটি।

তাসনীম এর ছবি

চলুক

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

সাফি এর ছবি

আসলেই দারুন

জি.এম.তানিম এর ছবি

ধন্যবাদ শুভাশীষদা, তাসনীম ভাই, সাফি ভাই।

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

রানা মেহের এর ছবি

খুব ঝরঝরে অনুবাদ

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

আযাদ রাফি  এর ছবি

চমৎকার অনুবাদ চলুক

আমার একটা ব্যাপার মনে হয়েছে যে উদাহরণটি ব্যবহার করে লেখক বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন তাকে কেন্দ্র করে। একটা কাল্পনিক পরিস্থিতির কথা ধরা যাকঃ পৃথিবির ত্রিমাত্রিক আকৃতি (প্রায়) বার্টলেট নাশপাতির মত বলে বোঝা গেছে, কিন্তু আরো গবেষণার পরে দেখা গেলো জগৎ আসলে বহুমাত্রিক যেখানে পৃথিবির আকৃতি আদৌ এরকম নয় (এমনকি সেই বহুমাত্রিক জগতের বার্টলেট নাশপাতির সাথেও তার কোন মিল নেই)। আমাদের বোধন ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার জন্যই আমরা এরকম তুলনা করেছিলাম, কারণ তখন তিনের চেয়ে বেশি মাত্রার ব্যাপার বোঝার ক্ষমতা আমাদের হয়নি, আর তাই পৃথিবির এই রূপ কল্পনা করাও আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

সেরকমই, মহাবিশ্ব সম্পর্কে বিজ্ঞানের বর্তমান ধারণাও হয়তো আরো অনেক বেশি পরিবর্তিত হওয়ার অবকাশ আছে, যদিও তার মানে অবশ্যই এই নয় তা অতীতের ধারণাগুলোর মত একইসমান ভুল। অথবা হয়তো লেখক যেমন বলেছেন, আমরা এখন সত্যিই মহাবিশ্বকে মোটামুটি বুঝে ফেলেছি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।