(এই লেখাটি আইজাক আসিমভের একটি প্রবন্ধ থেকে অনুবাদ করা। ১৯৫৯ সালে লেখা এই রচনাটি একটি সরকারী গবেষণার নির্দেশিকা হিসেবে লিখিত হয়ে ছিল। লেখক এইখানে বৈজ্ঞানিক নতুন সৃষ্টি এবং এর পেছনে প্রয়োজনীয় চিন্তার জন্যে আদর্শ পারিপার্শ্বিকতার কথা বলেছেন। লেখাটি অনেক বছর অপ্রকাশিত অবস্থায় রয়ে গিয়েছিল লেখকের এক বন্ধুর কাছে। তারপরে এটি প্রকাশিত হয় এমআইটি টেকনলজি রিভিউতে।
বছর চারেক আগে বন্ধু সচল স্পর্শের কল্যাণে লেখাটি হাতে পাই। তখন থেকেই ইচ্ছা ছিল এটার অনুবাদ করার। শুরু করার পরে আলসেমি, আর জীবনের নানান ঘটনায় ভুলে গিয়েছিলাম লেখাটির কথা। কিছুদিন আগে আবারও শুরু করে অবশেষে শেষ করতে পারলাম। দাপ্তরিক কাজে লিখিত এই লেখাটি মূলানুগ করতে গিয়ে ভাষাটি একটু আলঙ্কারিক হয়ে গিয়েছে কিছু জায়গায়। পাঠক ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।)
সৃষ্টিশীলতা নিয়ে
মানুষ নতুন সংকল্পনা বা আইডিয়া পায় কীভাবে?
ধারণা করা যেতে পারে, সৃষ্টিশীলতার প্রক্রিয়া (সেটা যাই হোক না কেন) তার সব শাখাপ্রশাখায় কিংবা বৈচিত্র্যে আদতে একই রকম। তাই একটা নতুন শিল্পমাধ্যম, নতুন যন্ত্র, নতুন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, এদের সবার বিবর্তনের কারণগুলোও একইরকম। যদিও এই লেখায় আমরা একটা নতুন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের "সৃষ্টি" কিংবা একটু পুরনো তত্ত্বকে নতুনভাবে ব্যবহারের বিষয় নিয়ে আলোচনায় বেশি আগ্রহী, তবুও এই কথাটা সর্বজনীনভাবেও নেওয়া যায়।
এই সমস্যাটি অনুসন্ধান করার একটা উপায় হতে পারে অতীতের অসাধারণ সংকল্পনাগুলো তৈরির প্রক্রিয়া খতিয়ে দেখা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই প্রক্রিয়াগুলো তাদের "প্রস্তুতকারকের" কাছেও কখনো ঠিক পরিষ্কার নয়।
কিন্তু যদি একই দুনিয়া-কাঁপানো সংকল্পনা (আইডিয়া) একই সাথে এবং আলাদা আলাদা ভাবে দুইজন মানুষের কাছে আসে, তাহলে? সেক্ষেত্রে হয়তো, আমরা দুই জনের একই কারণগুলো থেকে আলোকিত হতে পারব। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন তত্ত্বের কথা, যা আলাদা আলাদা ভাবে সৃষ্টি করেছেন চার্লস ডারউইন এবং আলফ্রেড ওয়ালেস।
এই দুইজনের মধ্যে অনেক বিষয়ে মিল রয়েছে। দুইজনই বহু জায়গা ঘুরেছেন, বহু আশ্চর্য প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রাণী পর্যবেক্ষণ করেছেন। তারা দেখেছেন প্রাণী ও উদ্ভিদেরা কীভাবে স্থানভেদে আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়। দুইজনই এসবের একটি ব্যাখ্যা খুঁজতে আগ্রহী ছিলেন এবং ম্যালথাসের "জনসংখ্যার উপরে রচনা" (Essay on Population) পড়ার আগে পর্যন্ত সেই ব্যাখ্যা খুঁজে পেতে সফল হন নি।
দুজনই তারপরে বুঝতে পেরেছেন অতিজনসংখ্যা এবং অপেক্ষাকৃত অক্ষম প্রাণীর মরে যাওয়ার ধারণা (যেটা ম্যালথাস মানবজাতির উপরে প্রয়োগ করেছেন) কীভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন মতবাদের সাথে (সাধারণভাবে প্রজাতির উপরে প্রয়োগ করলে) মিলবে।
তার মানে দাঁড়ালো, কেবল একটি ক্ষেত্রে ভালো দক্ষতা থাকলেই হবে না, এমন লোকের দরকার যিনি প্রথম জিনিসের সাথে দ্বিতীয় জিনিসের সেই সম্পর্ক বের করতে পারবেন যেটা সাদাচোখে সম্পর্কবিহীন মনে হয়।
একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বহু প্রকৃতিবিজ্ঞানী প্রজাতিসমূহ কী প্রকারে একে অপরের থেকে আলাদা তা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। অনেকেই ম্যালথাসের লেখা পড়েছেন। অনেকেই প্রজাতিসমূহ নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, সেই সাথে ম্যালথাসের লেখাও পড়েছেন। কিন্তু আসলে দরকার ছিল এমন একজনের যিনি প্রজাতি নিয়ে গবেষণা করেছেন, ম্যালথাস পড়েছেন আবার এগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষমতাও যার ছিল।
এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে এই দূর্লভ বৈশিষ্ট্যটি অবশ্যই থাকতে হবে। একবার সম্পর্কটি স্থাপিত হয়ে গেলে এরপরে সবার কাছেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। উদাহরণস্বরূপ, ধরে নেওয়া যেতে পারে টমাস এইচ. হাক্সলি “প্রজাতিসমূহের উৎপত্তি বিষয়ে” (On the Origin of Species) পড়ার পরে আশ্চর্য হয়ে ভেবেছিলেন, " আমি কি এতো বোকা, যে এই সহজ জিনিসটি চিন্তা করে বের করতে পারি নি?"
তাহলে, কেন তিনি সেটা চিন্তা করেন নি? মানবচিন্তার ইতিহাস দেখলে আমরা বুঝতে পারব যে যদি সবগুলো সত্যও টেবিলের উপরে সাজানো থাকে, একটা সংকল্পনা(আইডিয়া) চিন্তা করে বের করা তবু বেশ কঠিন কাজ। বিভিন্ন জিনিসের মধ্যে সম্পর্ক বের করাটার জন্যে দরকার একটি বিশেষ ধরনের সাহস। যেই সাহস না থাকলে, অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করে (যেটা অনেকের একবারে করে ফেলতে পারে) যা পাওয়া যায়, তাকে “নতুন সংকল্পনা” বলা যায় না, বড়জোর একটা “পুরানো সংকল্পনার অনুসিদ্ধান্ত” বলা যেতে পারে।
একটা নতুন সংকল্পনাকে যুক্তিসঙ্গত মনে হওয়ার জন্যে বেশ কিছু সময় পার হয়ে যাওয়া প্রয়োজন। একদম শুরুতে এটাকে বেশ অসঙ্গত মনে হয়। পৃথিবী যে সমতল নয়, গোলাকার; সূর্য নয় বরং পৃথিবীই ঘুরে সূর্যের চারপাশে; কিংবা গতিশীল বস্তুকে থামাতে হলে যে বলের প্রয়োজন এই সবকিছুই বুঝতে পারার জন্যে বেশ অসঙ্গত চিন্তার প্রয়োজন ছিল।
যুক্তি, কর্তৃত্ব এবং সাধারণ জ্ঞানের মুখোমুখি হয়ে যে মানুষ এভাবে পাখা মেলতে পারেন, তিনি নিশ্চয়ই একজন আত্মবিশ্বাসী। এমন মানুষ যেহেতু সংখ্যায় বেশি নয়, সেহেতু তাকে এই বিষয়ে বেশ খামখেয়ালি মনে হতে পারে। যে মানুষ একটি বিষয়ে খামখেয়ালি, সে প্রায়শই অন্য বিষয়েও খামখেয়ালি হয়ে থাকে। ফলে আমরা বলতে পারি, সেই মানুষটির কাছ থেকেই নতুন নতুন আইডিয়া পাওয়া যাবে, যার একটি বিষয়ে ভালো জ্ঞান রয়েছে এবং যে মানুষটির আচরণ প্রথাবিরোধী। (বাতিকগ্রস্থ ব্যক্তি মাত্রই যথেষ্ট, তা বলছি না অবশ্য।)
এখন যখন আপনি আপনার প্রয়োজনীয় লোকগুলিকে পেয়ে গেছেন, আপনার সামনে যে প্রশ্নটি আসব্যে তা হলো, আপনি কি চান তারা একত্রে আলোচনা করে সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা করবে, নাকি আপনি তাদের আলাদা আলাদা ভাবে সমস্যাটি জানাবেন এবং তারা নিজেরা নিজেদের মতো আলাদা হয়ে কাজ করবে?
আমার মনে হয় সৃষ্টিশীলতার জন্যে আলাদা থাকাটাই জরুরি। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ এমনিতেই অবিরাম কাজ করতে থাকে। তার মন পুরোটা সময় ধরে সবগুলো তথ্য নিয়ে খেলা করতে থাকে, এমনকি যখন তিনি বেহুঁশ অবস্থায় থাকেন তখনো। (এই ব্যাপারে একটি বিখ্যাত উদাহরণ রয়েছে। একথা অনেকেরই জানা যে বিজ্ঞানী কেকুল ঘুমের মধ্যে বেনজিনের গঠনের সমাধান করতে পেরেছিলেন।)
অন্য কারও উপস্থিতি কেবল এই প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করবে। এর কারণ, সৃষ্টি একটি অস্বস্তিকর ব্যাপার। একটা নতুন ভাল সংকল্পনা (আইডিয়া) আসার আগে শ’য়ে শ’য়ে, হাজারে হাজারে বোকার মতো সংকল্পনা আসে। আপনি স্বভাবতই সেগুলো প্রকাশ করতে চাইবেন না।
এই অস্বস্তির ব্যাপারটি থাকার পরেও অনেক সময় এমন মানুষদের একত্র করা আকাঙ্ক্ষিত হতে পারে, সেটা কেবল নতুন সৃষ্টির কারণেই নয়।
দু'জন মানুষের মনন একদম একই হয় না কখনোই। একজন মানুষ হয়ত ক জানেন কিন্তু খ জানেন না, আরেকজন হয়ত খ জানেন কিন্তু ক জানেন না, এবং শুধু ক বা খ জেনে দুইজনই হয়ত সংকল্পনাটি পাবেন, কিন্তু সেটা সম্ভবত একই সাথে না এবং সেটা অনেক সময়সাপেক্ষও হবে।
তার উপরে, অনেক সময় এই তথ্যটি যে কেবল পৃথক উপাদান ক এবং খ এর জন্যে, তা নয়। আপাত গুরুত্বহীন ক ও খ এর সম্মিলনে যে তথ্য পাওয়া যায় সেটিও হতে পারে। যখন একজন ব্যক্তি একটি অস্বাভাবিক মিশ্রণ ক-খ এর কথা উল্লেখ করেন, এবং অপরজন আরেকটি অস্বাভাবিক মিশ্রণ ক-গ এর কথা উল্লেখ করেন, তখন পূর্বে তারা কেউই যে ক-খ-গ এর কথা চিন্তা করেন নি সেটি পাওয়া সম্ভব, যা কিনা এই সমস্যার সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে।
আমার মনে হয় এই চিন্তন অধিবেশনগুলোর লক্ষ্য নতুন সংকল্পনা চিন্তা করে বের করা নয়, বরং অংশগ্রহণকারীদেরকে বিভিন্ন ঘটনা ও ঘটনাসমষ্টি, তত্ত্ব এবং এলোমেলো চিন্তায় শিক্ষিত করা।
কিন্তু সৃষ্টিশীল মানুষদের তেমন করতে রাজি করানো যাবে কীভাবে? সবার আগে যে জিনিসগুলো নিশ্চিত করতে হবে তা হলো স্বাচ্ছন্দ্য, নিরুদ্বিগ্ন পরিবেশ আর নিজের মতো করে কাজ করার ক্ষমতা। মোটাদাগে আমাদের পৃথিবীটা সৃষ্টিশীলতার বৈরী, আর জনসমক্ষে সৃষ্টিশীল হওয়াকে বিশেষভাবে খারাপ চোখে দেখা হয়। প্রত্যেককে তাই এই ব্যাপারে আশাবাদী হতে হবে যে, অন্যদের কাছ থেকে তারা কোনো বাধা পাবেন না।
একজন উপস্থিত স্বতন্ত্র ব্যক্তি যদি এমন অধিবেশনে অবশ্যম্ভাবী কোনো বোকামির প্রতি অসহানুভূতিশীল হন, তাহলে অন্যেরা আড়ষ্ট হয়ে যাবে। অসহানুভূতিশীল ব্যক্তি হয়তো একটি তথ্যের স্বর্ণখনি, কিন্তু তার কারণে উপকারের থেকে অপকার বেশি হবে। এই কারণে আমার মনে হয় এরকম সভায় সবাইকে এমন হওয়া প্রয়োজন, যেন তারা নিজেরা বোকার মতো কথা বলতে এবং অন্যের বোকার মতো কথা শুনতে ইচ্ছুক হন।
একজন উপস্থিত স্বতন্ত্র ব্যক্তি যদি অন্যদের থেকে অনেক বেশি খ্যাতিমান হন, কিংবা বেশি স্পষ্টবাদী হন, অথবা কর্তৃসুলভ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হন, তার মানে তিনি আলোচনা সভার কর্তৃত্ব নিয়ে নিবেন অথবা অন্যদেরকে অক্রিয় আজ্ঞাবহত্বে সীমাবদ্ধ করে ফেলবেন। এমন ব্যক্তি নিজে নিজে উপকারী হতে পারেন, কিন্তু তাকে একা কাজ করতে দেওয়াই উত্তম, কারণ তিনি অন্যদেরকে নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছেন।
এমন দলের সদস্যদের সর্বানুকূল সংখ্যা সম্ভবত তেমন বেশি হবে না। আমার মনে হয় সর্বোচ্চ পাঁচ জনের বেশি হওয়ার কোনো দরকার নেই। বড় দলে তথ্যের যোগান অনেক বেশি হতে পারে, কিন্তু কথা বলতে পারার জন্যে প্রত্যেককে অন্য সকলের জন্যে অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে, যেটা নৈরাশ্যজনক। একটি অধিবেশনেই সবাইকে সম্পৃক্ত করার চেয়ে শ্রেয়তর হলো বিভিন্ন সংখ্যক মানুষের সমন্বয়ে বেশ কিছু অধিবেশন। (এতে কিছু পুনরাবৃত্তি সন্দেহাতীত ভাবে হবে, কিন্তু আদতে পুনরাবৃত্তি তেমন অবাঞ্ছনীয় নয়। আলোচনাসভায় মানুষ কী বলছে সেটার থেকে বেশি গুরুত্ব হলো মানুষ অন্যদের কিভাবে পরবর্তীতে উদ্বুদ্ধ করছে।)
সবচেয়ে ভালো হয় যদি এতে একটি অনানুষ্ঠানিকতার অনুভূতি থাকে। আমুদেভাব, নাম ধরে ডাকা, কৌতুক, হাল্কা রসিকতা, এগুলো আলোচনার সারবস্তু না হলেও আমার মতে এগুলোই সৃষ্টিশীলতার বোকামিতে সম্পৃক্ত হওয়ার ইচ্ছাকে জাগিয়ে তোলে। এই কারণে আলোচনাকক্ষের চেয়ে কারো বাড়ি কিংবা কোন রেস্তোরাঁর খাবারের টেবিলে বসা অধিকতর উপকারী বলে আমার কাছে মনে হয়।
সবচেয়ে বড় সংবাধ সম্ভবত দায়িত্বের অনুভূতি। যুগে যুগে ভালো সংকল্পনাগুলো তাদের কাছ থেকে আসে নি, যাদেরকে এগুলোর জন্যে মাইনে দেওয়া হতো, বরঞ্চ তাদের কাছ থেকে এসেছে যারা পয়সা নিতেন শিক্ষক, পেটেন্ট কেরাণী কিংবা সামান্য আমলা হিসেবে, কিংবা একেবারে পয়সা পেতেনই না। বড় সংকল্পনাগুলো সবসময়েই এসেছে অন্য একটা কিছুর পার্শ্বফল হিসেবে।
কেউ যদি এই নিয়ে অপরাধবোধে ভুগতে থাকেন, যেহেতু তিনি একটি দারুণ সংকল্পনা হাজির করতে পারে নি, অতএব তিনি তাকে দেওয়া অর্থ আসলে অর্জন করতে পারেন নি, তাহলে এটাই নিশ্চিত হয় যে পরের বারেও সন্দেহাতীতভাবে তার কাছ থেকে কোন দারুণ সংকল্পনা আসবে না।
অন্যদিকে এটাও মনে রাখতে হবে, আপনার প্রতিষ্ঠানে সরকারী টাকাতে চিন্তনানুষ্ঠান হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা ফাজলামি করছে, অপচয় করছে, নোংরা কৌতুক বলে বেড়াচ্ছে তাও সরকারের টাকায়, এ কথা আইনসভার সদস্যরা কিংবা সাধারণ জনগণ শুনতে পেলে কী হবে ভাবতেই আমার ভয়ে ঘাম ছুটে যাচ্ছে। সত্যি কথা বলতে, এমন কি এসব কেউ জানতে না পারলেও গড়পড়তা বিজ্ঞানীর বিবেক এমন যে, তিনি এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারবেন না যে তিনি এমন কিছু করছেন।
আমি পরামর্শ দেবো চিন্তন অধিবেশনের সদস্যদের কিছু নামকাওয়াস্তে কাজ দেওয়া হোক - ছোট বিবরণী লেখা, কিংবা তাদের সিদ্ধান্তের সারসংক্ষেপ লেখা, কিংবা প্রস্তাবিত সমস্যার সংক্ষিপ্ত উত্তর দেওয়া - এবং এসবের কারণে তাদেরকে বেতন দেওয়া হোক; যেই বেতনটা তাদের চিন্তন অধিবেশনে অংশগ্রহণের জন্যে দেওয়া হতো। এতে চিন্তন অধিবেশন দাপ্তরিকভাবে বিনে পয়সার হবে, এবং এতে যথেষ্ট শিথিলভাব আসবে।
আমি এটাও মনে করি যে, চিন্তন অধিবেশনগুলো অনিয়ন্ত্রিত ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। এমন একজন্যের এর দায়িত্বে থাকা উচিত, যার ভূমিকা অনেকটা একজন মনঃসমীক্ষকের সমতুল। একজন মনঃসমীক্ষক বলতে আমি যা বুঝি তা হলো এমন একজন, যিনি সঠিক প্রশ্নগুলো করে (এবং অন্য সময়গুলোতে যৎসামান্য হস্তক্ষেপ করে), একজন রোগীকে দিয়ে তার পূর্বজীবন নিয়ে এমনভাবে আলোচনা করিয়ে নিতে পারেন, যেন সেটির মধ্যে থেকে নতুন উপলব্ধি বের হয়ে এসে তার নিজের চোখেই ধরা পরে।
একই ভাবে একজন অধিবেশন-নিয়ন্তাকে সেখানে বসে থাকতে হবে, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বুনো চাঞ্চল্য আনতে হবে, ধূর্ত প্রশ্ন এবং দরকারি মন্তব্য করতে হবে, ভুল পথে যাওয়া আলোচনা আলগোছে আবার মূল বিষয়ে ফেরত নিয়ে আসতে হবে। নিয়ন্তার কাজটি হবে বেশ কঠিন হবে যেহেতু তিনি নিজেও জানেন না কোন প্রশ্নগুলো ধূর্ত, কোন মন্তব্যটি গুরুত্বপূর্ণ আর কোনটি মূল বিষয়।
সৃষ্টিশীলতা বের করে আনার যে “যন্ত্রপাতি”, সেটা এমন এঁড়ে আড্ডার ভিতর থেকে নিজে নিজেই বের হয়ে আসবে। প্রকৃতিগত প্রথাবিরোধী অংশগ্রহণকারীরা যদি সম্পূর্ণরূপে সুস্থির হয়ে, দায়িত্বের বোঝা না নিয়ে, আকর্ষণীয় কিছু নিয়ে আলোচনা করতে থাকেন, তাহলে তারা নিজেরাই নিজেদের আলোচনাকে উদ্দীপনের পাঁয়তারা করবেন।
মন্তব্য
রচনাটি যে অনাদিকালের ভাতঘুম শেষে আড়মোড়া ভেঙে উঠে আসার "ডিসকোর্সে" কীবোর্ড-স্থবিরতার মূলে কুঠারাঘাত, সে সত্যে অনাগত কাল সাক্ষী দেবে!
লেখা পড়ার আগেই ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকার লোভ সামালাতে না পেরে মন্তব্য করার অপরাধ ক্ষমার্হ!
আরো মন্তব্য আসিতেছে!
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
বেশ কতগুলো গুরত্বপূর্ন পর্যবেক্ষন পেলাম আসিমভের এই লেখা থেকে -
গবেষনা বিষয়ে সামান্য অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি। আমার কাছে এই কথাগুলো খুবি যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। এবং সরাসরি অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিছু নেতিবাচক ব্যাপার আসলে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় সিস্টেমের বদল ছাড়া। তাই এর ভেতর থেকেই যতটুকু সম্ভব নিজেদের সৃষ্টিশীলতাকে বাঁচিয়ে নিয়ে চলতে হবে যতটুকু পারা যায়।
কতগুলো নতুন বাংলা শব্দ শিখলাম "সংকল্পনা" , "সংবাধ" , "চিন্তন অধিবেশন"। সাথে ইংরেজীটা ব্র্যাকেটে দিয়ে দিলে বুঝতে সুবিধে হতো।
পরিশ্রমী লেখাটা আমাদের উপহার দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
ধন্যবাদ।
পাদটীকায় কিছু সংযুক্তি দিলাম।
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।
ভালো লাগলো লেখাটি। আপনার অনুবাদ ভালো হয়েছে। অনেকগুলো অপ্রচলিত শব্দে বারবার আটকে যাচ্ছিলাম, কিন্তু এই শব্দগুলো এভাবে না এলে হারিয়ে যাবে আসলে। আইডিয়া-র বাংলা যে সংকল্পনা, সত্যি বলছি এটা জানা ছিল না। ধন্যবাদ।
অনুবাদ করা অনেক ঝামেলার কাজ আসলে, মূলানুগ থাকা, নাকি ভাষান্তর করা, নাকি রূপান্তর ঘটিয়ে ফেলা, এরকম অনেক ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এবং সবকিছুর পরে পাঠকেরা সেটা ঠিকঠাক বুঝবে কি না তাই নিয়ে টেনশান।
আসিমভ এই ২০১৯ এ বেঁচে থাকলে অবশ্য মোটামুটি এক লাইনেই এই লেখাটি লিখে ফেলতে পারতেন। অনেকটা এরকম হতো সেটা - " যা কিছু ফেইসবুক তোমাকে দেয় বা দেখায়, তার বিপরীত দিকে হেঁটে চলার নামই সৃষ্টিশীলতা।"
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
ধন্যবাদ কনফু ভাই। অপ্রচলিত শব্দগুলোর ব্যাপারে একমত। ঠিক এই কারণেই অনেকগুলো শব্দ ব্যবহার করেছি, সুন্দর শব্দগুলো হারিয়ে না যায় যেন। সাইকোএনালিস্টের এতো সুন্দর বাংলা পরিভাষা আছে, সেটা জেনে আমারও খুব ভালো লেগেছে।
দ্বিতীয় অনুচ্ছেদেও সহমত। জীবন থেকে নেওয়া
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।
তোর অনুবাদে ক্লাসিক লেখাটা আবার পড়লাম।
আসলেই, ব্রেইনস্টর্মিং সেশন এ এক ধরনের 'নন-জাজমেন্টাল' সম্পর্ক সবার মধ্যে বিরাজ না করলে চলে না। বোকার মত কিছু বলে বসার স্বাধীনতা নিশ্চিত না করতে পারলে এ ধরনের সেশন আড়ষ্ঠ হয়ে পড়ে।
আইডিয়ার বাংলা সংকল্পনা একটু বেশি ফর্মাল হয়ে গেছে।
এটাকে 'ধারণা' লিখলেই মনে হয় ভাল হতো।
যেমন, "হঠাৎ কারো মাথায় একটা ধারনা বাসা বাঁঁধলে তা থেকে আর মুক্তি নেই"
অধিবেশন-নিয়ন্তা - session-arbiter
কে সম্ভবত স্রেফ 'সঞ্চালক' বা অধিবেশন সঞ্চালক বললেই ভাল। নিয়ন্তা শব্দটা ক্ষমতা নির্দেশক। এখানে সঞ্চালক কোনো ক্ষমতা খাটাবেন না স্রেফ আলোচনাকে সঞ্চালনে সহযোগিতা করবেন।
চিন্তন অধিবেশন পছন্দ হয়েছে।
অনুবাদ ভাল হয়েছে।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ধন্যবাদ। সামাজিক যোগাযোগের ডিজিটাল যুগে মানুষ চিন্তার চেয়ে ক্ষণিক তুষ্টিতে বেশি আকৃষ্ট। মূল লেখাটা তাই এই সময়েও বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।
ধারণা শব্দটা ইচ্ছে করেই বাদ দেওয়া। যেহেতু সেই শব্দটা উপলব্ধি, অনুমান, অনুভূতি ইত্যাদি অর্থেও ব্যবহার হয়, আইডিয়া বলতে আমরা তার থেকে কিছুটা ভিন্ন কিছু বুঝি। আরেকটা কারণ মনে হয় শব্দটা দেখতে কিছুটা সুন্দর তাই
সঞ্চালক শব্দটায় একমত।
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।
আসিমভের বিশ্লেষণগুলো সত্যিই চমৎকার আর আপনার সাবলীল অনুবাদে সেটা আরও সহজবোধ্য হয়ে উঠেছে । ধন্যবাদ ।
নাজমুছ ছাকিব
নতুন মন্তব্য করুন