ছোটবেলায় বাংলা সিনেমা বা যাত্রা দেখার পর মনের মধ্যে যার উপস্থিতি সবচাইতে বেশি আলোড়ন তুলতো- সে হচ্ছে বিবেক। তখন প্রায় সব সিনেমা বা যাত্রাতেই বিবেকের প্রবল উপস্থিতি ছিলো। নায়ক-নায়কের বাবা-কিংবা যারা ভালো কাজের অনুসারী, তারা কোনো খারাপ কাজ করতে গেলে কিংবা কোনো কাজ বা কথা নিয়ে দ্বিধা-সংশয়ে ভুগলে তাৎক্ষণিক হুবহু একই পোশাকে তার বিবেক হাজির হতো। বিবেকের প্রতাপশালী সেন্টিমেন্টাল কথাগুলো শুনে আমরা দর্শকরা সবেগে হাততালি দিয়ে সমর্থন জানাতাম, পাশাপাশি অসম্ভব খুশি হতাম যার বিবেক এই কথাগুলো বলেছে, সে যদি বিবেকের কথা অনুযায়ী পরবর্তী কাজগুলো করে যায়। ফলে আস্তে আস্তে মনের বিশ্বাস দৃঢ় হচ্ছিলো- মানুষ খারাপ কাজ করতে পারে, কিন্তু বিবেক কখনোই খারাপ কথা দিতে পারে না, খারাপ পরামর্শ দিতে পারে না। সিনেমা বা যাত্রা দেখা শেষে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে তাই বিবেকই দখল করে নিতো আমাদের বন্ধুদের আলোচনার পুরো অংশটা।
ফলে পাড়ার বিবেকদা (বিবেকানন্দ) ছিলেন আমাদের কাছে দেবতাতুল্য। আমাদের মনে বদ্ধমূল ধারণা ছিলো- সিনেমার বিবেকের মধ্যে যেসব গুণাবলী ছিলো, আমাদের বিবেকদার মধ্যেও তার সবগুলো আছে। তা না হলে তার বাবা-মা ছেলের এরকম নাম রাখবেন কেন? তাছাড়া বিবেকদার বাবা স্কুলের মাস্টার, তিনি তো আর না বুঝে এই নাম রাখেন নি! আর তাছাড়া বিবেকদার মতো ভালোমানুষ, সুন্দর মানুষ এবং চকলেট-বিস্কিট খাওয়ানোর মানুষ আর একটাও এই পাড়াতে ছিলো না। বিবেকদা বড়দের সাথে কম মিশতেন। আমাদের মতো ছেলেপুলেদের নিয়ে দিন কাটাতেন, তাদের গান-বাজনা-কবিতা শেখাতেন। আর আমাদের বোধগম্যহীন কিছু কথাবার্তা বলতেন মাঝেমাঝে। দু’একটি রচনার মতো কঠিন কঠিন বই পড়তে দিতেন, আমরা সেগুলো না পড়েই বিবেকদাকে ফেরত দিতাম। বলতাম, তিন পাতা পড়ার পর ভালো লাগে নি। বিবেকদা তাতেই খুশি।
ফুটবল খেলায় মারামারি করে বিবেকদার কাছে একবার নালিশ করেছিলাম। স্কুলের সময় হয়ে গেছে বলে যার বল, অর্থাৎ উত্তম খেলার মাঝে হঠাৎ করেই বল নিয়ে চলে গেছে। আমার রাগ হয়েছিলো খুব। শ্যামলের কাছ থেকে শেখা প্রতিটি গাল দেওয়ার পর বন্ধুরা মিলে তাকে পেটালাম। সে অবশ্য এখন আমাদের পেটানোর ক্ষমতা রাখে। পিটিয়ে বিবেকদার কাছে নালিশ দিলাম এই বলে যে- স্কুলের সময় হয়েছে তো কী হয়েছে! আমরা এতোগুলো ছেলে খেলতে চাচ্ছি। ও কেন আমাদের বল দিবে না?
বিবেকদা আমাদের পুকুরপাড়ে বসে এক এক করে ডেকে নিয়ে গেলেন। প্রত্যেককে বললেন, মনে কর তুই-ই উত্তম। তোর স্কুলের সময় হয়ে গেছে। বলটা তোর। তখন তুই কী করতি?
বিবেকদা সেদিন আমাদের অনেক কিছু বলেছিলেন। যাত্রাপালার বিবেক এবং আমাদের বিবেকদার মধ্যে যে আসলে কোনো পার্থক্য নেই- সেই বিশ্বাস আরো প্রবল হয়েছিলো সেদিন। তাই শেষ দিকে হঠাৎ করেই বিবেকদাকে জিজ্ঞেস করে বসি যে, সিনেমার বিবেক এবং আমাদের বিবেকদারা ভাই কি-না (তখন পর্যন্ত আমি নারী বিবেক দেখিনি। ফলে বিবেকরা সব পুরুষ হয়, সেটাই ভেবেছিলাম)?
বিবেকদা তখন আমাদের একটি অদ্ভুত উত্তর দিয়েছিলেন। আমাদের সবার মধ্যেই নাকি একটি করে বিবেক রয়েছে। বড় হলে সেটা ভালো করে টের পাবো। তবে আমরা আমাদের নিজেদের বিবেক দেখতে চাইলে দাঁড়াতে হবে আয়নার সামনে। তখন নাকি আমরা ইচ্ছে করেও মিথ্যে কথা বলতে পারবো না। কারণ আয়নার সামনেই আমাদের যার যার বিবেক দাঁড়িয়ে থাকবে। এছাড়া কখনো কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে আয়নার সামনে দাঁড়ানো বিবেককে জিজ্ঞেস করে যে উত্তর পাওয়া যাবে, সেই উত্তর বা পরামর্শ অনুসারেই নাকি সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। প্রবলভাবে বিবেকদার কথাকে আঁকড়ে ধরেছিলাম সেদিন, কারণ আমরা তো সবাই জানি, মানুষের বিবেক কখনো ভুল পরামর্শ দেয় না।
তারপর অনেকদিন দাঁড়িয়েছি আয়নার সামনে। কোনো সমস্যায় পড়ি, বা না পড়ি। নিজের বিবেককে বারবার দেখেছি আয়নায়। প্রথম কিছুদিন আত্মগর্বেও ভুগেছি- বিবেকদার মতো আমাদেরও বিবেক আছে! একদিন বিবেকদার সাথে তর্কও করেছি- তোমার বিবেক তোমাকে এই কথা বলেছে, আমার বিবেক তো বলেছে অন্য কথা। কোনটা মানবো? বিবেকদা আরেকটি গল্পের বই আমার ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বলেছিলেন- অবশ্যই তোর বিবেক যেটা বলে তুই সেটাই মানবি।
বিবেকদা আমাদেরকে বলতেন মুক্তিযুদ্ধের কথা। আমাকে একদিন বলেছিলেন, আমার বিবেক বলছে বাংলাদেশের বয়স যতো পুরনো হবে, আমাদের একাত্তর, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতা ততোই মানুষের মনে উজ্জ্বলতর হতে থাকবে। বাংলাদেশের ভালো মানুষগুলো কখনোই এই অনুভূতি-ইতিহাস-গর্ব বদলাতে দিবে না, ভুলতে পারবে না। কখনোই এমন কিছু করিস না যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যায়। যারা এরকম কিছু করতে চায়, সবসময় তাদের বিরুদ্ধে থাকবি। তোর বিবেককে জিজ্ঞেস করিস, দেখবি সেও তোকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকতে বলবে।
বিবেকদা এটাও বলেছিলেন, যুক্তিহীন কথা বলবি না। গালাগালি দিবি না কাউকে। কারো যুক্তি মেনে না নিতে পারলে উত্তেজিত হবি না। তাৎক্ষণিক জবাব না দিতে পারলেও এটা নিয়ে ভাববি, পরে চিন্তা করে যুক্তি বের করবি। দেখবি তোর সামনে কেউ দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু যদি তা না করিস, তাহলে তুই ঠিক থাকলেও হেরে যাবি। এভাবে কখনো হারিস না।
বিবেকদার কথা এখন মনে পড়ে প্রায়ই। তিনি আমাকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিয়েছিলেন। আজ বুঝি, তার দেওয়া রচনার বইগুলো আসলে মুক্তিযুদ্ধের বই। মানুষকে ভালোবাসার বই। আর পরিবেশের প্রেমে পড়ার বই। বিবেকদার কথা মনে পড়ে আরো বেশি করে তখন, যখন দেখি আমরা আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছি যুক্তি থেকে, নিজেদের শক্তিশালী ও ঠিক অবস্থানটাকে আবেগের লোনাপানিতে টালমাটাল করে দিচ্ছি প্রায়ই। ক্ষোভ-ক্রোধ-আবেগ যখন রাজত্ব করে, যুক্তি-চিন্তা-চেতনাকে তখন আশ্রয় নিতে হয় সীমান্তে।
বিবেকদার সাথে কতোদিন দেখা হয় না তাই হিসেব করছিলাম কাল রাতে। কতদিন আয়নার সামনে দাঁড়াই না, সেটি অবশ্য হিসেব করি নি।
মন্তব্য
কলেজে পড়ার সময় কী একটা অনুষ্ঠানে আমাদের প্রিনসিপ্যাল বললেন, রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় একটা মিনিট ব্যয় করে হিসেব করবে আজ সারাদিনে কী কী কাজ করলে, তার মধ্যে কোনটা তুমি ঠিক করেছো আর কোনটা ঠিক করোনি। ঠিক-বেঠিকের হিসেব তুমি নিজেই করতে পারবে - কোনো গুরু দরকার নেই, ধর্মগ্রন্থও নয়।
বহুকাল পর এই স্যারের সঙ্গে আমার দেখা গত বছর। তাঁকে জানালাম, তাঁর ওই পরামর্শ আমি সারাজীবন মনে রেখেছি এবং এখনো চর্চা করি।
তাঁর চোখে আনন্দাশ্রু দেখলাম।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
স্যারের কথাই ঠিক। একমত।
..................................................
ছিদ্র খুঁজে বেড়াই, বন্ধ করার আশায়
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
নতুন মন্তব্য করুন