শিশু-কিশোরদের সংগঠন খেলাঘরের বয়স ৫৫ পেরিয়েছে। কিন্তু সংগঠনটির কাছে যা আশা করা হয়েছিলো, তা কি পূরণ হয়েছে? উত্তর হবে, হয় নি। নেত্বত্বের দ্বন্দ্ব আর খেলাঘরের বিভাজনই মূলত সংগঠটিকে পিছিয়ে রেখেছে। দ্বিধাবিভক্ত খেলাঘরের উভয় অংশের নেতৃবৃন্দসহ সারাদেশের অসংখ্য কর্মী সংগঠক আজ বুঝতে পেরেছেন, দ্বিখণ্ডিত খেলাঘর খুব একটা এগোয় নি। ফলে এখন তারা চাচ্ছেন দ্বিখণ্ডিত খেলাঘরকে এক করতে। সেরকম একটি প্রয়াসেই এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে 'আমাদের খেলাঘর, আমাদের প্রত্যাশা' বইতে। লেখকের অনুমতি নিয়ে লেখাটি এখানে প্রকাশ করা হলো।
আমাদের খেলাঘর: প্রয়োজন নতুন ভাবনার
সমীর রঞ্জন নাথ
ভূমিকা
এই রচনাটির প্রথম নামকরণ করা হয় ‘আমার খেলাঘর’। প্রথম খসড়া লিখিত হওয়ার পর আমি কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব ও খেলাঘর সংগঠককে লেখাটি দেই পড়ে তাদের মতামত দেওয়ার জন্য। তারা বেশ কিছু চিন্তাভাবনা সংযোজন করে একে সমৃদ্ধ করেন। আমার লেখার অধিকাংশ মতের সঙ্গে প্রকাশ করেন একাত্মতা। তাই ভাবলাম এর নাম হওয়া উচিত ‘আমাদের খেলাঘর’। আমার মনে পড়ে গেল, খেলাঘরের প্রথম শাখা আসরটির নাম ছিল ‘আমাদের খেলাঘর’।
খেলাঘরের জন্ম ১৯৫২ সালে, আজ থেকে ৫৫ বছর আগে সংবাদের ‘খেলাঘর পাতার’ মাধ্যমে। সাহিত্যকর্ম দিয়ে কাজ শুরু হলেও খেলাঘরের কর্মকাণ্ড শুধু সাহিত্য রচনার মধ্যেই সীমিত থাকে নি। শুরুর দিকের সংগঠকরা ভেবেছিলেন, সচেতন সুনাগরিক গড়ে তোলার জন্য সাহিত্য সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে শিশুকিশোরদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। খুবই ছোট আকারে কাজ শুরু হলেও উদ্যোক্তাদের অন্তর্দৃষ্টি ছিল গভীর আর দূরদৃষ্টি ছিল প্রখরতর। তারা দেখতে পেয়েছিলেন দেশের ভবিষ্যৎকে, স্থির করতে পেরেছিলেন উজ্জ্ব¡ল ভবিষ্যৎ নির্মাণের ভিত্তিভূমি তৈরির কৌশল। বেছে নিয়েছিলেন সর্বকালে সর্বদেশে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় বলে স্বীকৃত জনগোষ্ঠী শিশুকিশোরদের। যার ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা বলতে পেরেছিলাম “আজকের খেলাঘর, আগামীদিনের বাংলাদেশ”।
পত্রিকার পাতাভিত্তিক সাহিত্যকর্ম দিয়ে শুরু হলেও ক্রমে তা সংগঠনে রূপ নেয়। গঠিত হতে থাকে শাখা সংগঠন। খেলাঘর কার্যক্রম শিশুকিশোর আন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে যায় সারা দেশে। তৎকালীন সংগঠকদের সচেতনতার মাত্রা বোঝা যায় মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজস্ব ব্যানারে খেলাঘরের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশে এক পর্যায়ে খেলাঘরের শাখা সংগঠনের সংখ্যা দাঁড়ায় চারশ’টির অধিক। এই যে ব্যাপক বিস্তৃতি তা একদিনে হয় নি, হয় নি কোন এক জনের দ্বারাও। সারা দেশের প্রগতিশীল একঝাঁক উজ্জ্বল, উচ্ছ্বল দেশপ্রেমিক তরুণ কর্মীদলের একাগ্র নিষ্ঠা আর কর্মের ফসল আমাদের খেলাঘরের সেই সব উজ্জ্বল সোনালী দিনগুলো। আমরা তাদের প্রত্যেককে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করি।
ইংরেজিতে একটি কথা আছে Small is beautiful but big is necessary অর্থাৎ ক্ষুদ্র সুন্দর কিন্তু বি¯তৃতি প্রয়োজন। খেলাঘরের ক্ষেতে্রও তা সত্য বলে প্রতিভাত হলো। ব্যাপক বিস্তৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে ব্যাপক দায়িত্ববোধের জন্ম হতে হয়, প্রয়োজন হয় ব্যাপক সাংগঠনিক দক্ষতার, সহিষ্ণুতার, নমনীয়তার এবং কঠোর শৃঙ্খলাবোধের - তা আমরা গড়ে তুলতে পারি নি। মূলত নেতৃত্বের অদক্ষতার কারণে এবং উপর্যুক্ত গুণাবলীর অভাবে আজ থেকে বিশ বছর আগে থেকেই (কারো কারো মতে তারও আগে থেকে) খেলাঘরে ধস নামতে থাকে, এক পর্যায়ে তা ভেঙ্গে দু’টুকরো হয়ে যায়, তবুও ধস নামা বন্ধ হয় না। আমরা নিঃশেষিত হতে থাকি। একটি প্রজন্মের ব্যাপক সংখ্যক শিশুকিশোর বঞ্চিত হয় খেলাঘর করার স্বাদ থেকে।
কেন এই লেখা
বেশ কিছুদিন ধরে কেউ কেউ চেষ্টা করছেন ঐক্যবদ্ধ খেলাঘর আন্দোলন পুনরুদ্ধারের। আমরা প্রত্যেকেই এই প্রচেষ্টার সাথী। আমরা প্রত্যেকেই চাই নিজ নিজ ক্ষুদ্র সামর্থ দিয়ে এই প্রচেষ্টায় শামিল হতে। এর অংশ হিসেবেই এই প্রবন্ধের অবতারণা। এই প্রবন্ধ রচনায় খেলাঘরের ঘোষণাপত্র, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, অতীত ইতিহাস এবং বাংলাদেশ ও বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
খেলাঘর সদস্য
প্রথমে যে মৌলিক প্রশ্নটি আমরা উত্থাপন করতে চাই তা হলো, কাদের জন্য এই সংগঠন? অর্থাৎ কোন্ জনগোষ্ঠীকে উদ্দিষ্ট করে সংগঠনটি পরিচালিত হবে। দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, খেলাঘর শিশুকিশোরদের সংগঠন। আর্ন্তজাতিক মানদণ্ডে শূন্য থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত জনগোষ্ঠীকে শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়। আমাদের খেলাঘরও এই বিধান মেনে চলবে। উক্ত বয়সী যে কোন বাংলাদেশি শিশুকিশোর খেলাঘরে অংশ নিতে পারবে। খেলাঘরে যে সব শিশুকিশোর সদস্য হিসেবে নাম লেখাবে, তারা প্রথমে নিজ নিজ উন্নয়ন সাধনে ব্রতী হবে। কারণ যে নিজের উন্নয়ন ঘটাতে পারে না, সে অপরের উন্নয়নে খুব একটা কাজে লাগতে পারে না। এখন কথা হলো. নিজ উন্নয়ন বলতে আমরা কী বুঝি। প্রথমে বুঝি নিজ নিজ পড়ালেখার মান উন্নয়ন, তারপর বুঝি সাধারণভাবে সৎ ও চরিত্রবান মানুষ বলতে বাংলাদেশের সমাজে যে ধারণা প্রচলিত আছে, সেই অনুসারে সৎ ও চরিত্রবান মানুষ হয়ে গড়ে ওঠা। এর মধ্যে অবশ্য পরমতসহিষ্ণু, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক, জনকল্যাণমূখী কাজে উদ্বুদ্ধ হওয়া, পরোপকার করা ইত্যাদি নানা গুণাবলীর সমন্বয়ও বোঝাবে। এখানে একটি কথা বলা দরকার, বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামো সাধারণভাবে গণতান্ত্রিক ও পরমতসহিষ্ণু নয়। একই বিষয়ে একাধিক মত যে একত্রে থাকতে পারে, সে সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষ সাধারণভাবে পরিষ্কার ধারণা রাখেন না অথবা তারা এ ব্যাপারে দৃঢ়প্রত্যয়ী (convinced) নন। আমাদের খেলাঘরের সদস্যরা উপর্যুক্ত গুণাবলী অর্জনে ব্যক্তি ও সাংগঠনিকভাবে প্রচেষ্টা চালাবে।
খেলাঘর সংগঠক
আমাদের খেলাঘর মূলত শিশুকিশোরদের জন্য হলেও সংগঠনের পরিচালনায় প্রয়োজন সৎ, নিষ্ঠাবান, দক্ষ, চরিত্রবান এবং সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ একদল কর্মীবাহিনীর। যাদের কাছ থেকে সংগঠনের শিশুকিশোর ভাইবোনেরা উপর্যুক্ত গুণাবলী হাতেকলমে শিখবে। সংগঠকরা যদি দক্ষ ও প্রশিক্ষিত না হয়, তবে কোন সংগঠন উন্নতি লাভ করতে পারে না। উপর্যুক্ত গুণাবলীসম্পন্ন কর্মীদলের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর থেকে শুরু করে একেবারে শাখা আসর পর্যন্ত অর্থাৎ সংগঠনের সর্বস্তরে। একথাও সত্য, বর্তমানে সংগঠনের যে অবস্থা তাতে আমরা সবাই যে আদর্শ সংগঠন গড়ার মাপকাঠিতে যোগ্যতার মানদণ্ড উৎরাতে পারবো তা বলা যায় না। আমাদের খেলাঘর এ ব্যাপারে যথাসাধ্য প্রচেষ্টা গ্রহণ করবে। ক্রমাগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে কর্মীদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হবে। পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিশুকিশোরদের নিয়ে যে ভাবনা ও পরিকল্পনাগুলো নেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে, কর্মীরা যেন সে সম্পর্কে জানতে পারে এবং এধরনের কাজে অংশ নেওয়ার জন্য নিজেকে ও সংগঠনকে প্রস্তুত করতে পারে তার জন্য নিরন্তর পড়াশুনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নিয়মিতভাবে পাঠচক্রে অংশগ্রহণ করা কর্মীদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হবে। এ লক্ষে পাঠাগার আন্দোলনকে শাখা পর্যায়ে দৃঢ়তর করা হবে। সদস্য ভাইবোনদের মত কর্মীদেরও প্রথম কর্তব্য হবে নিজ নিজ পড়াশুনা ও পেশায় উন্নতি সাধন করা। কোন শিক্ষার্থী কর্মী যদি তার পড়ালেখার সঙ্গে খেলাঘরের কর্মকাণ্ডের সমন্বয় সাধন করতে না পারে, তবে সে ভালো কর্মী হিসেবে গণ্য হবে না। আবার পেশাজীবী কোন কর্মী যদি খেলাঘরের কোন কাজ করতে গিয়ে নিজ পেশায় উন্নতি লাভ করতে না পারেন, তবে তিনিও ভালো কর্মী বলে গণ্য হবেন না। আমরা শুনতে চাই না যে, খেলাঘরের কাজ করতে গিয়ে কারো ব্যক্তিগত পড়ালেখার বা পেশার কোন ক্ষতি সাধিত হয়েছে। মেধাবী শিক্ষার্থী ও নানা পেশার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা খেলাঘরের সমৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারেন। খেলাঘরের প্রাক্তন সদস্য ও কর্মীদের মধ্যেও এদের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। এই লক্ষে আমরা আমাদের কর্মপদ্ধতিকে ঢেলে সাজাবো। কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের সংগঠক ও কর্মীদের শাখাসংগঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বাঞ্ছনীয়।
এখন বলা দরকার, কেন আমরা এত সুদক্ষ কর্মীবাহিনী চাই। প্রথম যুক্তি হলো, সদস্য ভাইবোনরা এদেরকে সামনে রেখে যেন এগিয়ে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করা। খেলাঘরের কর্মীরাই যেন খেলাঘরের সভ্যদের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব (রোল মডেল) হতে পারে তার ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয় যুক্তি হলো, খেলাঘরের প্রতি অভিভাবকদের আস্থাশীল করে তোলা। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেছেন এবং ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করছেন, এমন খেলাঘর কর্মীরা যত সহজে অভিভাবকদেরকে বুঝিয়ে শিশুকিশোরদেরকে সংগঠনভুক্ত করতে পেরেছেন, অন্যরা তা পারেন নি। সদস্যরাও এই ধরনের কর্মীদের কাছ থেকে উপকৃত হয়েছে বেশি। আমাদের তৃতীয় কারণ আরও গভীর ও সুদূরপ্রসারী। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, শিশুকিশোরদের নিয়ে অথবা তাদের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে কতই না কাজ হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে প্রশ্ন করা যায়, ১৯৯০ সালের পর বিশ্ব নেতৃবৃন্দ প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তারের জন্য যে উদ্যোগগুলো নিয়েছেন, বাংলাদেশও যার অংশ, সেগুলো বাস্তবায়নে খেলাঘরের অবদান কতটুকু? শিশুদেরকে সাধারণ রোগব্যাধি থেকে মুক্ত রাখার জন্য যে স্বাস্থ্য কর্মসূচি (Expanded Programme on Immunization বা EPI) দেশব্যাপী চলছে, তাতে আমরা সংগঠনগতভাবে কিইবা অবদান রাখতে পেরেছি? সর্বোপরি জাতীয় শিশুনীতি, সমাজকল্যাণনীতি, প্রাথমিক শিক্ষানীতি ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে খেলাঘরকে গণ্যই করা হয় না। জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় অংশ নিয়ে অবদান রাখার মত কর্মী/সংগঠক তৈরি করতে পারি নি বলেই এমনটি হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে আয়োজিত শুধু বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে অংশ নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট থাকতে পারি না। পঞ্চান্ন বছর বয়সী একটি সংগঠনের এহেন দুর্দশা আমাদেরকে আহত করে, আমরা পীড়িত হই। আমরা আমাদের খেলাঘরকে এই দুরবস্থা থেকে মুক্ত করে সমাজের সর্বস্তরে শিশুকিশোরদের জন্য অবদান রাখার মত যোগ্য করে গড়ে তুলতে চাই। সুদক্ষ ও প্রশিতি কর্মীবাহিনী ছাড়া এই কাজগুলো করা মোটেই সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে, বর্তমান বাংলাদেশে অনেক সংগঠনই শিশুদের জন্য কাজ করছে।
কর্মসূচি তৈরি করবে সংগঠক
উপরের তিনটি প্যারাগ্রাফে যে ধরনের সদস্য ও কর্মী/সংগঠকের চিত্র আঁকা হয়েছে, তা শুধু আকাঙ্ক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়। খেলাঘরের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডকে আবার আন্দোলনের ধারায় ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে আমরা ধীরে ধীরে উপর্যুক্ত আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে পারি। এ পর্যায়ে আমি আন্দোলন শব্দটি দ্বারা কী বোঝাতে চাচ্ছি তা বলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। মনে রাখতে হবে, দেশ ও সমাজের সামগ্রিক কিছু অভাববোধ থেকেই খেলাঘরকে জাগ্রত করার এ প্রচেষ্টা। অভাব পূরণের দুই রকম পন্থা অধিক জনপ্রিয়। একটি হলো, যথাযথ কর্তৃপকে অভাব পূরণের তাগাদা দিয়ে মিছিল-সমাবেশের মাধ্যমে মাঠ গরম রাখা এবং অভাব পূরণের জন্য নিজেরা কোন উদ্যোগই না নেওয়া। আমরা এ ধরনের নেতিবাচক আন্দোলনের ধারায় থাকতে চাই না। দ্বিতীয় পন্থা হলো, অভাব পূরণের জন্য নিজেই সক্রিয় হওয়া। সাংগঠনিকভাবে অগ্রসর হয়ে স্থানীয় উদ্যোগে স্থানীয় সম্পদ সমাবেশের মাধ্যমে অভাব পূরণের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা। আমরা এই দ্বিতীয় ধারায় থাকতে চাই। আমাদের মত সমাজের বেশ কিছু সমস্যার সমাধান এভাবেই করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। তবে একথাও ভুললে চলবে না যে, এমন কিছু কিছু অভাব আমাদের রয়েছে যেগুলো পূরণের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের উদ্যোগের প্রয়োজন। যেমন প্রাথমিক শিক্ষায় অর্থায়ন এবং এর কার্যকর মানোন্নয়নের জন্য সামগ্রিক উদ্যোগ গ্রহণ করা। আমাদের খেলাঘর অবশ্যই আইনপ্রণেতাদের সংগে লবিং করাসহ জনসম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে উপর্যুক্ত অভাব মোচনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করবে। প্রয়োজনে খেলাঘর রাষ্ট্রের সঙ্গে একত্রে কাজ করবে। মোদ্দা কথা হলো, আন্দোলন বলতে আমরা ভালো কাজের জন্য, শিশুকিশোরদের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য বিরামহীনভাবে সক্রিয় থাকার কথাই বলছি। খেলাঘরের কর্মসূচিকে এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে যেন এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই আমাদের কাক্সিত সদস্য ও কর্মী/সংগঠক তৈরি করা সম্ভব হয়। সাংগঠনিক কাজের নিয়মিত পর্যালোচনা, ভুল ক্রটি নির্ধারণ ও সংশোধনের ক্রমাগত প্রচেষ্টা, খোলামেলা আলোচনা এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সংগঠনের প্রতিটি স্তরে (কেন্দ্র থেকে শাখা পর্যন্ত) সাপ্তাহিক/পাক্ষিক একটি দিন নির্দিষ্ট করা যেতে পারে যেখানে আমরা বাধাহীনভাবে নিজেদের কাজের সমালোচনা করতে পারি। খেলাঘরের কর্মসূচি পরিচালনা আর দক্ষ সংগঠক তৈরির প্রক্রিয়া আলাদা হতে পারে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রতিটি মানুষের ভেতরেই রয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা। মানুষ সাধারণভাবে সৎ ও সম্ভাবনাময়। মানুষের অন্তর্নিহিত শুভশক্তির জাগরণ ঘটানোই সমাজ ও সংগঠনের কাজ। খেলাঘর এই কাজটিই করবে অত্যন্ত যত্নের সাথে।
আচরণবিধি ও ন্যায়পাল
খেলাঘর সদস্য ও সংগঠকদের জন্য অবশ্য পালনীয় আচরণবিধি (code of conduct) থাকা প্রয়োজন। এতে সাংগঠনিক ও সামাজিক উভয় ধরনের বিষয়াবলী অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। নিজেই নিজের আচরনবিধি তৈরি করতে পারা বড় ধরনের সম্মানের কাজ। উন্নত দেশসমূহে অ্যাকাডেমিক ও প্রফেশনাল অ্যাসোসিয়েশনগুলো নিজেরাই নিজেদের আচরণবিধি তৈরি করে নিয়েছে। এতে সংগঠনগুলোর মর্যাদা অন্যদের কাছে বেড়েছে, সংগঠন পরিচালনায় এসেছে শৃঙ্খলা। খেলাঘরের কোন সদস্য বা সংগঠক আচরণবিধি পালন করতে না পারার কারণে যদি নিজ থেকেই সরে দাঁড়ান এর চেয়ে বড় অর্জন আর কি হতে পারে? এর মাধ্যমে আমরা আমাদের নৈতিক মান উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারি। আমরা খেলাঘরে একটি ন্যায়পালের পদ সৃষ্টি করতে পারি। খেলাঘরের কর্মকাণ্ডের কারণে কেউ (সংগঠনের ভেতরে বা বাহিরে) যদি নিজেকে তিগ্রস্ত মনে করেন তবে তিনি ন্যায়পালের কাছে তার আর্জি জানাতে পারেন। ন্যায়পালের অফিস তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে পারে। অভিযোগ প্রমাণের জন্য ন্যায়পালের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সিদ্ধান্তই হবে চুড়ান্ত। কেন্দ্রীয় কমিটি শুধু ন্যায়পালের সিদ্ধান্ত অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
সংগঠকদের বয়স
খেলাঘরের মত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে কর্র্মীদের বয়সের সীমানা টেনে দেওয়া খুবই মুশকিলের কাজ। এখনই এই ধরনের কোন কাজ হয়ত করা যাবে না। তবে পর্যায়ক্রমে তা করতে পারলে ভালো হয়। তরুণ নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশে সমান সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। পর্যায়ক্রমে তরুণদের হাতে সংগঠনের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের ভার তুলে দিতে হবে। শিক্ষা, বয়স ও সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে সংগঠক, উপদেষ্টা ও শুভাকাক্সী প্যানেল তৈরি করা হবে।
জেন্ডার-সাম্য প্রতিষ্ঠা
আমাদের খেলাঘর হবে জেন্ডার-সাম্য প্রতিষ্ঠার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। সংগঠনের সদস্যদের মাঝে ভাই ও বোন এবং কর্মীদের মাঝে ভাইকর্মী ও বোনকর্মীর সংখ্যা যেন সমান হয় আমরা ক্রমাগত সেই চেষ্টা করে যাব। প্রয়োজনে গঠনতন্ত্রে সংশোধনী এনে এই প্রচেষ্টা চালানো হবে। এটি হবে জেন্ডার-সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদপে। প্রাথমিক পদেক্ষেপ কিছুটা জয়ী হলে শুরু হবে এর পরবর্তী পদক্ষেপ। এই পর্বে খেলাঘর সংস্কৃতির এমন পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করব যেন সংগঠনের সকল চিন্তাচেতনা ও কাজে নারী-পুরুষে কোন ব্যবধান না থাকে। কাজটি করা খুব সহজ হবে না। বিশেষ করে বর্তমানে বোনকর্মীর সংখ্যা যে হারে কমে এসেছে, তাতে মনে হয় আমাদেরকে এই লক্ষে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সমাজ বাস্তবতা মাথায় রেখে কৌশলে অগ্রসর হতে হবে। আমাদের খেলাঘর স্বীকার করে নেবে যে, বাংলাদেশ একটি বহু ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলিত আবাসস্থল। খেলাঘর তাই সকল জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির লালনে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। দরিদ্র ঘরের বিশেষ করে শ্রমজীবী ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণের কথা আমরা ভুলে যেতে চাই না।
সংগঠনের আধুনিকায়ন
আমরা আমাদের খেলাঘরকে এমনভাবে গড়ে তুলতে চাই তা যেন নতুন নতুন ধ্যান-ধারণার পরীক্ষাগার হিসেবে কাজ করতে পারে। শিশুদের উন্নয়ন সংক্রান্ত নতুন ধ্যান-ধারণা ক্ষুদ্র পরিসরে বৈজ্ঞানিকভাবে সফল প্রমাণিত হলে তবেই আমরা তা দেশব্যাপী প্রচলনের ব্যবস্থা নেব। হুট করে কোন কর্মসূচি গ্রহণ করে আমরা আর ব্যর্থতার পাল্লা ভারি করতে চাই না। আমাদের দেখতে হবে সংগঠন কর্তৃক গৃহীত কর্মসূচি এর সদস্য তথা সমগ্র দেশের ওপর কতখানি প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে। শুধু কাজ করে গেলেই চলবে না, এর প্রভাবও পরিমাপ করতে হবে। আমাদের খেলাঘরের সদস্য ও কর্মী ভাইবোনদের একটি ডেটাবেইজ তৈরি করা হবে। তথ্য সংরক্ষণ করা হবে কম্পিউটারে। ডেটাবেইজ নিয়মিতভাবে আপডেট করা হবে। এই কাজের দু’টো উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত, তাৎণিকভাবে কেন্দ্রীয় ও জেলা অফিসে বসে সংগঠনের অবস্থা জানা। দ্বিতীয়ত, সংগঠনের গতিপ্রকৃতি ও উন্নতির একটি পর্যায়ক্রমিক প্রভাব পরিমাপ করা। আশা করা যায়, যদি আমরা এ ধরনের একটি তথ্যভাণ্ডার গড়ে তুলতে পারি, তবে এই তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংগঠনের দুর্বলতা চিহ্ণিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সংগঠনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। আমরা চাই আমাদের খেলাঘরের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে অন্যান্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান শিক্ষালাভ করবে এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে কাজে লাগাবে। আমরা দেখতে চাই খেলাঘরের ক্ষুদ্র কিন্তু পরীতি উদ্যোগগুলো শিশুকিশোর বিষয়ক রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়নে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। কম্পিউটারের মূল্য দিনে দিনে কমতে থাকায় সদিচ্ছা থাকলে সারা দেশের সব শাখায় কমপক্ষে একটি করে কম্পিউটারের ব্যবস্থা করা খুব একটা কঠিন কাজ হবে না। প্রাথমিকভাবে প্রতিটি জেলা সংগঠনে একটি করে কম্পিউটার স্থাপনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উপর্যুক্ত কম্পিউটারই হবে খেলাঘরে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। চিঠি লেখার পুরানো পদ্ধতি হয়তো এখনও কিছুটা রেখে দিতে হবে, কিন্তু আমরা সহজেই ইমেইলের মাধ্যমে সব সাংগঠনিক যোগাযোগ স্থাপন করতে পারি। প্রথমে কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ে এবং পর্যায়ক্রমে শাখা সংগঠনসমূহে ইন্টারনেট সংযোগ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমাদের খেলাঘরের একটি ওয়েব সাইট থাকা খুবই প্রয়োজন। যতদ্রুত সম্ভব এই কাজে হাত দিয়ে আমাদের প্রাণপ্রিয় সংগঠনকে বিশ্ব তথ্যভাণ্ডারের সংগে যুক্ত করতে চাই। ওয়েব সাইট নিয়মিতভাবে আপডেটের মাধ্যমে এটি হতে পারে সার্বণিক তথ্য আদান-প্রদানের এক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। খেলাঘর সদস্য ও সংগঠকদের কম্পিউটার সাক্ষরতা অর্জন এবং ওয়েব সাইটের মাধ্যমে একই ধরনের কাজ করে এমন দেশি-বিদেশি সংগঠনের সংগে যোগসূত্র স্থাপন করে আমরা খেলাঘরকে এক উচ্চতর স্থানে নিয়ে যেতে পারি। এমন একদিন আসবে, যেদিন জাতীয় পরিষদ বা কেন্দ্রীয় কমিটির সভা করার জন্য আমাদের সকলকে আর ঢাকায় আসতে হবে না। কেন্দ্রীয় ও বিভাগীয় বা জেলা অফিসসমূহে টেলি কনফারেন্সিং ও পর্যায়ক্রমে ভিডিও কনফারেন্সিং এর যন্ত্রপাতি স্থাপন করে নিজ নিজ অফিসে বসেই আমরা সভার কাজ সমাধা করতে পারব। এতে সময়ের অপচয় রোধ করা যেমন সম্ভব হবে, তেমনই সংগঠকদের মূল্যবান সময়কে আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যাবে।
আর্থিক নীতি
আর্থিক সংগতি যে কোন সংগঠনের জন্য একটি অতি প্রয়োজনীয় বিষয়। প্রথমত, আমাদের খেলাঘরের সব সদস্য ও কর্মী নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা প্রদান করবেন। নিজ সংগঠনে চাঁদা প্রদান করলে এর সংগে একাত্মতা বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয়ত, আমরা দেশীয় নানা উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করব। সংগঠনের শুভাকাঙ্ক্ষীদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে তাদেরকে সাংগঠনিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত করা হবে এবং আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে অনুরোধ করা হবে। তৃতীয়ত, দেশীয় ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা/উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে কর্মসূচিকেন্দ্রিক চাঁদা সংগ্রহ করা হবে। তবে মনে রাখতে হবে, দেশে কালো টাকার প্রভাব কমে গেলে এই খাতে খুব একটা সাড়া পাওয়া নাও যেতে পারে। চতুর্থত, আমরা বাংলাদেশের উন্নয়নে সহযোগিতা করছে এরকম আর্ন্তজাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকেও আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করতে পারি। আমাদের উদ্দেশ্য ও কর্মসূচির সংগে তাদের উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি মিললেই কেবল এ ধরনের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। আমি মনে করি, খেলাঘর পর্যায়ক্রমে জাতীয় ও বিশ্ব বাস্তবতার সংগে সঙ্গতি রেখে যুগোপযোগী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। শুধু অর্থের অভাবে যেন সংগঠনের কাজ ব্যহত না হয়, সেজন্য আয়ের একটি নিয়মিত উৎসের কথা জোরালোভাবে চিন্তা করা যেতে পারে।
আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণে আমাদের খেলাঘর কঠোর নীতি অনুসরণ করবে। সংগঠন যেন কোনভাবেই দুই-একজন সংগঠকের আর্থিক সামর্থ্যরে ওপর নির্ভরশীল হয়ে না পড়ে, তা নিশ্চিত করা হবে। নির্ভরশীলতার যে কোন প্রচেষ্টা কঠোরভাবে পরিহার করা হবে। কারো কাছ থেকে একটি পয়সাও বিনা রশিদে নেওয়া হবে না। খেলাঘরের সব পর্যায়ে সমস্ত আদায় প্রথমে ব্যাঙ্কে জমা করা হবে, তারপর সেই অর্থ খরচ করা হবে। আর্থিক হিসাব সদস্য ও সংগঠকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। হিসাব নিয়মতান্ত্রিকভাবে অডিট করা হবে। জেলা ও শাখা সংগঠনগুলো নিয়মিতভাবে কেন্দ্রে আর্থিক রিপোর্ট পাঠাবে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় টিম প্রয়োজনমত নিম্নতর কমিটির আর্থিক কার্যক্রম অডিট করবে।
দলীয় রাজনীতি
যে কোন বিষয়ে রাজনীতি টেনে আনা আমাদের এক সাধারণ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের খেলাঘর যে কোন প্রকার দলীয় রাজনীতি থেকে দশ হাত দূরে অবস্থান করবে। খেলাঘরের কর্মসূচি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলের সংগে সংযুক্ত হওয়ার কোন দরকারই নেই। খেলাঘর কর্মীদের নিজ নিজ দলীয় আনুগত্য থাকতেই পারে। তারা রাজনৈতিকভাবে সচেতন হবেন এটাই স্বাভাবিক। আমরা এতে কোন বাধা প্রদান করব না। কিন্তু তাদেরকে এমনভাবে গড়ে তুলব তারা যেন খেলাঘরের কর্মকাণ্ডে দলীয় চিন্তাচেতনা টেনে না আনেন এবং খেলাঘরে কাজ করার সময় সংগঠনের ইতিহাস, আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থা মনে রেখে কাজ করেন। যদি কোন কর্মী এই পার্থক্য বজায় রেখে চলতে অসমর্থ হয়, তবে তাকে আমরা তার আকাক্সা অনুসারে যে কোন একটি কাজ বেছে নিতে সাহায্য করব। তাই বলে আমাদের খেলাঘর দেশের অপরাপর একই ধরনের আদর্শের অন্য কোন সংগঠনের সংগে একত্রে কাজ করতে কোন বাধা থাকবে না।
সুশাসন প্রতিষ্ঠা
সিদ্ধান্ত গ্রহণে গণতন্ত্রের চর্চা একটি অতি মূল্যবান কাজ। কোন একক ব্যক্তি যেন সংগঠনের কোন পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে তার ব্যবস্থা থাকা দরকার। গঠনতন্ত্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করে গড়ে তুলতে হবে যৌথ নেতৃত্ব, ব্যাপক টিমওয়ার্ক। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রয়োজনে প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে খেলাঘরের নেতৃত্ব নির্বাচনের দিকে আমরা অগ্রসর হতে পারি। মনে রাখতে হবে, প্রত্য ভোটই গণতন্ত্রের মূল কথা নয়। কর্মী ও সদস্যদের প্রত্যেকের কথা বলার অধিকার, নিজ বক্তব্য উপস্থাপনে যুক্তির ওপর আস্থা স্থাপন, অপরের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং নানা মত যে একত্রে থাকতে পারে তার প্রতি নিষ্ঠা প্রদর্শনের মাধ্যমেই কেবল আমরা সংগঠনে কাক্সিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারব। এসব চর্চায় মনে রাখতে হবে, আমরা যেন কোনভাবেই দুর্বল ও প্রান্তিক মতামতের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন না করি। প্রত্যেকেই যেন অনুভব করতে পারে যে, সিদ্ধান্তগ্রহণে তার মতামতকে উপক্ষো না করে বরং গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এককথায় খেলাঘরের সর্বস্তরে সুশাসন নিশ্চিত করা হবে। কর্তব্যকর্মে ও সিদ্ধান্তগ্রহণে স্বচ্ছতা আর প্রত্যেকের তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে আমরা সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে পারি। কোন বিশেষ সংগঠক সংগঠনের কোন বিশেষ সময়ে সর্বোচ্চ ত্যাগস্বীকারসহ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেই পারেন কিন্তু তিনি কখনোই খেলাঘরের চেয়ে বড় হতে পারেন না। ব্যক্তি ছাড়া সংগঠন চলবে না আবার ব্যক্তিই অনুসরণ করবে সংগঠনকে, সংগঠন ব্যক্তিকে নয়। ব্যক্তিপূজার যে কোন অনুসঙ্গই গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য অমঙ্গলজনক।
খেলাঘরের কোন পদে নির্বাচিত হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা কী সে সম্পর্কে আমাদের কোন বিধিমালা নেই। এটি থাকা প্রয়োজন। সাংগঠনিক অভিজ্ঞতার দৈর্ঘ্য, শিক্ষাগত যোগ্যতা, সংগঠক হিসেবে মান, বয়স, সামাজিক পরিচিতি, যে পদে নির্বাচিত হতে চান সেই পদের জন্য নির্দিষ্ট কর্মে দক্ষতা ইত্যাদির সমন্নয়ে এই মাপকাঠি তৈরি হতে পারে। যে কোন কেউ শুধু সংখ্যাগুরুর সমর্থনে কোন পদে নির্বাচিত হতে পারেন না। এতে অদক্ষ লোকেরা লবিং গ্রুপিং এর মাধ্যমে পদ দখলের চেষ্টা করতে পারে। এই ধরনের লোকেরা মন্দ ছাড়া সংগঠনের জন্য ভালো কিছু করতে পারেন না। প্রাথমিক যোগ্যতায় উত্তীর্ণ হলেই কেবল নির্বাচিত হওয়ার জন্য সংগঠকদের সমর্থনের প্রশ্ন আসবে।
কোন্ কাজটি সাংগঠনিকভাবে শুদ্ধ হলো আর কোনটি হলো না, প্রায়শই আমরা এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হই। অনেক সময় অঘটনঘটন পটিয়সীরা অনর্থক এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করে অনেক ইতিবাচক উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত করতে পারেন। এতে সংগঠনের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হতে পারে। আমাদের খেলাঘর এ ধরনের যে কোন প্রচেষ্টা সম্মিলিতভাবে সমূলে বিনাশ করবে। খেলাঘরের ঘোষণাপত্র এবং ল্ক্ষয ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী নয় এমন সব কাজই সাংগঠনিক - আমরা এই নীতিতে চলবো। সাংগঠনিক যে কোন বিষয়ে গঠনমূলক বিতর্ককে আমরা সর্বদাই স্বাগত জানাবো। অসাংগঠনিক কাজ যদি কেউ করেও থাকে, তাকে তিরস্কার না করে বরং শুধরাতে সাহায্য করব। এ প্রসঙ্গে বিশ্ব ব্যাঙ্ক কর্তৃক প্রকাশিত এবারের বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদন (২০০৭) থেকে কিছু কথা উল্লেখ করতে চাই। প্রতিবেদনের এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো "উন্নয়ন ও আগামী প্রজন্ম"। আগামী প্রজন্মকে ঠিকভাবে গড়ে তোলার লক্ষে নিচের তিনটি কর্তব্যের কথা প্রতিবেদনে বেশ জোর দেওয়া হয়েছে।
১. আগামী প্রজন্ম যেন দক্ষ হয়ে গড়ে উঠতে পারে তার জন্য এদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে অন্যান্য প্রশিক্ষণ সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে।
২. আগামী প্রজন্ম যেন তার অর্জিত দক্ষতা কাজে লাগাতে পারে তার জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
৩. অনুকূল পরিবেশ পাওয়ার পরও দক্ষতা কাজে লাগাতে গিয়ে যদি কেউ ভুল করে থাকে, তবে তাকে ভুল শুধরানোর দ্বিতীয় সুযোগ দিতে হবে।
খেলাঘর পরিচালনার ক্ষেত্রে উপর্যুক্ত কথাগুলো আমরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেব। মনে রাখব, মানুষের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভার স্ফুরণ ঘটানোই সমাজ ও সংগঠনের কাজ।
দীর্ঘমেয়াদি রুপকল্প
ক্ষুদ্র আকারের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আমাদের খেলাঘর চলতে পারে না। প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি সামগ্রিক নীতিপরিকল্পনার। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা কেমন খেলাঘর আন্দোলন দেখতে চাই তার একটি স্বচ্ছ চিত্র আমাদের সামনে থাকা দরকার। কর্মশালার মাধ্যমে সারাদেশের সংগঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের মতামত নিয়ে আমরা আগামী ১৩ বছর পর কেমন খেলাঘর দেখতে চাই তার একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করতে পারি। এই মহাপরিকল্পনার নাম হতে পারে "খেলাঘর ২০২০"। দুই হাজার কুড়ি (২০২০) সালের খেলাঘরের যে চিত্র আজ আমরা আঁকব, তার বাস্তবায়নে প্রয়োজন হবে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি কর্মপরিকল্পনার। বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে যদি এরকম একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়, তবে অবশ্যই আমরা ২০২০ সালে আমাদের কাক্সিত খেলাঘর আন্দোলন দেখতে পাবো। সার্বিকভাবে শিশুকিশোরদের কল্যাণের বিষয়টিকে মাথায় রেখে এই রুপকল্প তৈরি করা হবে।
উপসংহার
এতণ যে বিষয়গুলো উপস্থাপন করা হয়েছে তার বেশিরভাগই পুরোনো। ব্যাপক অর্থে কোনটিই খেলাঘরের ঘোষণাপত্র, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং গঠণতন্ত্রে বর্ণিত কর্মসূচির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। কেবল চর্চার অভাবে আমরা এর অনেকটাই ভুলতে বসেছি। যা ভুলে গেছি তা পুনরুদ্ধার করতে হবে। যোগ করতে হবে আধুনিক চিন্তা ও চেতনার। আমরা আশা করি, ঐক্যবদ্ধ খেলাঘর রচনার যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে তা অনতিবিলম্বে সফলতার মুখ দেখবে। মনে রাখা দরকার, সুযোগ বার বার আসে না। আর সুযোগের সদ্ব্যবহারও করতে হয় অত্যন্ত যত্ন আর দক্ষতার সাথে। উদ্যোগের কাণ্ডারীরা 'আমাদের খেলাঘর' রচনা থেকে যদি কিছুমাত্র উপকৃত হন তাহলে আমাদের শ্রম সার্থক হবে। যদি আমরা বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতা আর শিশুকিশোরদের আশাআকাক্সাকে অনুধাবন করতে না পারি এবং খেলাঘরকে সেই মোতাবেক আধুনিকায়ন করতে না পারি, তবে ঐক্যবদ্ধ খেলাঘরও কোন কাজে আসবে না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আজকের খেলাঘর অনেক ত্যাগী কর্মী ও সংগঠকের মেধা আর শ্রমের ফসল। একে বাঁচিয়ে রাখা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উভয় প্রজন্মের জন্যই প্রয়োজন। খেলাঘর আন্দোলন দীর্ঘজীবী হোক।
কৃতজ্ঞতাস্বীকার
লেখার বিভিন্ন পর্যায়ে ধৈর্যসহকারে পাঠ ও মতামত প্রদান করে যারা অকুণ্ঠ সহযোগিতা করেছেন তারা হলেন, রীতা দাশ রায়, তাহমীন সুলতানা, নাজনীন কবীর চৌধুরী, গৌতম রায়, নিরঞ্জন অধিকারী, লেলিন চৌধুরী, প্রণয় সাহা ও আব্দুল্লাহ্ আল্ ফারুক। অর বিন্যাসে সাহায্য করেছেন আনোয়ার হোসেন আর প্রচ্ছদ তৈরিতে আব্দুর রাজ্জাক। এদের সমর্থন ছাড়া লেখাটি বর্তমান পর্যায়ে আনা সম্ভব হতো না। এদের প্রত্যেকে আমাকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন।
লেখক: সদস্য, খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটি
মন্তব্য
এই বইটি এখন পাওয়া যাচ্ছে শাহবাগের আজিজ মার্কেটের প্যাপিরাস, শ্রাবণ, বিদিত ও নন্দিত কম্পিউটার্সে।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
নতুন মন্তব্য করুন