যে সময়ে এই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে থাকার কথা খেলাঘর থেকে বিকশিত মানুষদের কাছে, সে সময়ে ‘আমাদের খেলাঘর’ নিয়ে সমীর রঞ্জন নাথের নতুন ভাবনার প্রয়োজন কেন হলো? প্রশ্নটি শুধু রচনাটির লেখকের কাছে নয়, খেলাঘর-সংশ্লিষ্ট সবার কাছে, বিশেষ করে দুই গ্রুপের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে উপস্থাপন করতে চাই। একই সঙ্গে আমি মনে করি, যারা একসময় খেলাঘর করেছেন তাদের যেমন এই প্রশ্নটি উত্থাপন করা উচিত; যারা এখনও খেলাঘরের বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত আছেন, তাদেরও তেমনি নিজ নিজ ফোরামে এটি আলোচনা করা উচিত। প্রশ্নটি সবচাইতে বেশি আসা উচিত বর্তমান প্রজন্মের শিশুকিশোরদের কাছ থেকে, যারা বিভিন্ন কারণে খেলাঘর করতে পারছে না। আমার মতে কারণগুলোর প্রধানটি হলো পাড়ায় পাড়ায় শাখা আসরের অনুপস্থিতি। সন্দেহ নেই যে তাদের কেউই এই প্রশ্নটি করবে না, কারণ ব্যতিক্রম ছাড়া বর্তমান সময়ের শিশুকিশোররা জানে না খেলাঘর কী। তাই এই প্রশ্নটি আসতে হবে এমন মানুষদের কাছ থেকে- যারা মনে করেন একটি ঐক্যবদ্ধ বেগবান খেলাঘর আন্দোলন না থাকায় এ সময়ের শিশুকিশোররা ‘উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণের ভিত্তিভূমি তৈরির কৌশল’ জানা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের একজন হয়ে আমি খেলাঘর-সংশ্লিষ্ট সবার কাছে এই প্রশ্নটি তুলছি।
বলে নেওয়া দরকার, খেলাঘরের কোন সাংগঠনিক পদে আমি কখনোই ছিলাম না। তবে একথা নিঃসংশয়ে বলতে পারি, আমার মানসিক বিকাশ শুরু এবং কৈশোর পর্যন্ত তা বিস্তৃত হয়েছে যারা খেলাঘর করতেন তাদের হাত দিয়েই। ফলে তারা যেমন আমাকে খেলাঘরের বাইরের মানুষ হিসেবে ভাবেন নি, ঠিক তেমনি শৈশব ও কৈশোরে আমার কখনোই মনে হয় নি আমি এই সংগঠনের বাইরে। শৈশব ও কৈশোরে খেলাঘরের অনুষ্ঠানাদিতে অংশগ্রহণ এখনো আমার জীবনের উজ্জ্বল স্মৃতি। নেতৃত্বের বিভাজনের কারণে খেলাঘর নতুন দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে, কৈশোরের সেই ঘটনাগুলো কিছুটা বুঝেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠার পর। ততোদিনে খেলাঘরের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে অনেক। বর্তমানে কারা খেলাঘর করছেন, কে কোন অংশের নেতৃত্বের সঙ্গে আছেন, সেগুলোও ভালোভাবে আমার জানা নেই। শুধু একটি বেদনাবোধ আছে মনে- এই সংগঠন কী করতে পারতো, আর এখন কী করছে! কোন সাংগঠনিক পদে না থাকায় আমার এই বক্তব্যগুলো হয়তো অনেকের কাছে অগ্রহণযোগ্য এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ মনে হতে পারে। কিন্তু কেউ যদি ভাবেন যে- বেদনাবোধ, কাক্সিত কিছু না পাওয়ার হতাশার পাশাপাশি মনের মধ্যে জমাট বেধে থাকা তীব্রতম আশা সময়ের আবর্তে একসময় ঔদ্ধত্যে পরিণত হতে পারে, তাহলে তিনি হয়তো এই লেখাটির স্পিরিট বুঝতে পারবেন।
শুনেছি এবং সমীর রঞ্জন নাথের লেখাটির মাধ্যমে জেনেছি, খেলাঘরের দু’অংশের সকল সংগঠককে সাথে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ খেলাঘর আন্দোলনের চেষ্টা চলছে। কিন্তু বর্তমানে দু’অংশের শীর্ষ নেতৃত্বকে বহাল রেখে বা তাদের যৌথ নেতৃত্বে খেলাঘর ঐক্যবদ্ধ হয়ে কার্যকর কিছু করা সম্ভব বলে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি না। এই নেতৃত্ব বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংগঠনটিকে কতটুকু এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন, সে বিষয়েও আমি সন্দিহান। আমি মনে করি, খেলাঘর একত্রিত হওয়া উচিত নতুন নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে। কারণ দু’অংশের বর্তমান নেতৃবৃন্দ ইতোমধ্যেই দেখিয়েছেন তাদের দ্বারা কতটুকু এগুনো সম্ভব। আমার কাক্সিত নতুন নেতৃত্বকে একদিকে যেমন ধারণ করতে হবে খেলাঘরের স্পিরিট, অন্যদিকে খেলাঘরের জন্য সময় দিতে হবে প্রচুর পরিমাণে। খেলাঘর নিয়ে যারা নতুনভাবে ভাবতে পারবেন, খেলাঘরকে যারা নতুনভাবে সাজাতে পারবেন, তাদেরকেই এ জায়গায় আনতে হবে। এেেত্র কারো দীর্ঘমেয়াদী অভিজ্ঞতা হয়তো সংগঠনের কাজে না-ও লাগতে পারে। অভিজ্ঞতায় বৃদ্ধ নয়, চাই অভিজ্ঞতায় যুবক এমন কাউকে।
‘খেলাঘর সংগঠক’ অংশে লেখক সংগঠকের কী বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে তা যেমন বলেছেন, তেমনি নতুন সংগঠক তৈরির জন্য কী কী করা দরকার, তাও কিছুটা বলেছেন। এটি বলতে গিয়ে তিনি কিছু কাজকে বাধ্যতামূলক করার কথা বলেছেন। লেখকের এই অংশের সাথে আমি দ্বিমত পোষণ করে বলতে চাই, শিশুকিশোরদের জন্য কোনো কিছু বাধ্যতামূলক না করাই ভালো। সংগঠক হওয়ার মতো অনেক উপাদান সেখানে থাকবে এবং যে শিশু বা কিশোর যে উপাদানের প্রতি আগ্রহী হবে, তাকে সেই উপাদানের মাধ্যমেই বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। লেখক কর্মীদের পাঠচক্রে অংশগ্রহণ ‘বাধ্যতামূলক’ করার কথা বলেছেন, কিন্তু বাধ্যতামূলক করে কি সত্যিকার অর্থে কাক্সিত ফলাফল পাওয়া সম্ভব? যে সঙ্গীত নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চায়, তাকে পাঠচক্রে বাধ্যতামূলক না করাই ভালো হবে। সঙ্গীতে ভালো করার জন্য যতটুকু পড়াশুনা করা দরকার, সে বিষয়ে সে নিজ আগ্রহেই যাতে পড়তে পারে, সেই সুযোগটুকু তাকে করে দিতে পারাই হবে খেলাঘরের কাজ। সঙ্গীতচর্চার পাশাপাশি এ বিষয়ে পড়াশুনা করলে যে সঙ্গীতে তার দতা ও উৎকর্ষ বাড়বে, সেই ধারণাটুকু তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারলে সে আপনা থেকেই পড়াশুনায় আগ্রহী হয়ে উঠবে। তখন সে সঙ্গীতের পাশাপাশি অন্য বিষয়ের বই পড়তেও আগ্রহী হবে।
লেখক এখানে আচরণবিধির প্রসঙ্গটি এনেছেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তিনি শুধু সাংগঠনিক আচরণবিধির কথা বলেন নি, সামাজিক আচরণবিধির প্রশ্নটিও উত্থাপন করেছেন। এখানেও আমি তার সাথে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করতে চাই। আমার মতে, খেলাঘরের সব সদস্যের জন্য সাংগঠনিক আচরণবিধি অবশ্যই দরকার; কিন্তু লিখিত সামাজিক আচরণবিধি হতে হবে শুধু সংগঠকদের জন্য। কারণ শিশুকিশোরদের সামাজিক আচরণ কোন বিধির মাধ্যমে বেঁধে দিলে তার মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। আর শিশুরা ভুল করতে করতেই যেহেতু শেখে, তাই সামাজিক আচরণগুলোও ভুল করতে করতে শেখা উচিত। ছোটবেলায় করা ভুলগুলো যেন ভবিষ্যতে না হয়, সে ব্যাপারে নিজ থেকেই সে সচেতন থাকতে পারবে। সংগঠকরাই এখানে মেন্টরের ভূমিকা পালন করবেন। মনে রাখা দরকার, অ্যাকাডেমিক ও প্রফেশনাল অ্যাসোসিয়েশনের আচরণবিধির সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পার্থক্য রয়েছে। তাছাড়া এলাকা, ভাষা, ধর্ম, জাতিগোষ্ঠী ইত্যাদিভেদে সামাজিক আচরণ পরিবর্তিত হয়। তবে সংগঠনের শৃঙ্খলার স্বার্থে সবাইকে সাংগঠনিক বিষয়গুলো মেনে চলতে হবে।
জেন্ডার সাম্য প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জেন্ডার সাম্য নিয়ে অনেক সময় অনেক জায়গায় ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সব জায়গায় জেন্ডার সাম্য প্রতিষ্ঠা করা যায় না। যেমন প্রতিযোগিতামূলক কোনো ইভেন্টে। একটি উদাহরণ দিলে হয়তো বিষয়টি পরিষ্কার হবেÑ কোনো প্রতিযোগিতায় যদি জেন্ডার সাম্য মেনে সমান সংখ্যক ভাই ও বোন প্রতিযোগী পাঠাতে চাই, তাহলে সংখ্যাসাম্য রার কারণে যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বিও বাদ পড়তে পারে। সুতরাং এখানে জেন্ডার সাম্য ধারণাটি খাপ খায় না। জেন্ডার সাম্য রা করতে গিয়ে যোগ্য ভাই বা যোগ্য বোন বাদ পড়ছে কিনা, সে বিষয়টি অবশ্যই দেখতে হবে। আমাদের দেখতে হবে, আমরা যাদেরকে প্রতিযোগিতার জন্য গড়ে তুলতে চাই সেখানে এ ব্যাপারে বৈষম্য করা হচ্ছে কিনা। সেখানে আমরা ছেলে ও মেয়ে উভয়কে সমান সুযোগ দিচ্ছি কিনা। জেন্ডার সাম্য তাই প্রতিষ্ঠিত হতে হবে সুযোগ সৃষ্টিতে এবং মেধা বিকাশে; প্রতিযোগিতার মাঠে নয়। লেখক এখানে কোন্টি বলতে চেয়েছেন, তা বুঝতে পারি নি।
আর্থিক নীতির ব্যাপারে লেখক যে বক্তব্যগুলো দিয়েছেন, সেগুলো নিয়ে আরো চিন্তা করা দরকার বলে মনে করছি। কারণ শক্তিশালী আর্থিক নীতি না থাকলে সংগঠনের কাজ সাবলীলভাবে চালিয়ে নেওয়া কখনোই সম্ভব হবে না। স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সেবার মনোভাব আমাদের সমাজ থেকে আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হতে থাকায় বর্তমানে যে কোনো কাজেই পর্যাপ্ত অর্থ না থাকলে সেখানে সফল হওয়াটা দূরূহ হয়ে পড়বে। এ বিষয়টি মনে রেখে এমন আর্থিক নীতি প্রণয়ন করতে হবে, যাতে শুধু টাকার অভাবে সংগঠনের কর্মসূচি ব্যাহত না হয়।
এই লেখায় লেখক অনেক বিষয়ের অবতারণা করেছেন। এখানে যে বিষয়গুলোর সঙ্গে আমি ভিন্নমত পোষণ করেছি, সেগুলোর ওপরই আমি আমার বক্তব্য লেখার চেষ্টা করেছি। বাকি বিষয়গুলোর সঙ্গে আমি অনেকটাই একমত। যদিও সেগুলো বাস্তবায়নের েেত্র লেখকের এবং আমার কৌশল ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু এই বিষয়গুলোতে আমাদের গন্তব্য অভিন্ন। অপরদিকে সংগঠনের আধুনিকায়ন, খেলাঘরের পদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা, দলীয় রাজনীতি, সংগঠনের অগ্রযাত্রা ব্যহত হওয়ার প্রসঙ্গ, দীর্ঘমেয়াদি রূপকল্প- ইত্যাদি বিষয়গুলোতে আমি লেখকের সঙ্গে পুরোপুরি একমত। আর ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের মাধ্যমে খেলাঘর যদি আবার আগের মতো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, তাহলে সব বিষয় নিয়েই বিস্তর আলোচনা সময়ে-অসময়ে করা যাবে। আমরা, আমি সে অপেক্ষায়ই আছি।
(গতকাল সমীর রঞ্জন নাথের একটি লেখা 'আমাদের খেলাঘর: প্রয়োজন নতুন ভাবনার' লেখকের অনুমতি নিয়ে আমি পোস্ট করেছিলাম। এই লেখাটি তারই প্রতিক্রিয়া।)
মন্তব্য
যেভাবেই হোক খেলাঘরকে চালু এবং সক্রিয়া রাখা দরকার
কারণ আমার কাছে খেলাঘরের সবচেয়ে বড়ো গুরুত্ব হলো শিশু বেলা থেকেই মানুষের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক এবং সুস্থ চিন্তার বিকাশ
সবাই বড়ো হয়ে শিল্পী কিংবা সংগঠক হবে এমন কোনো কথা নেই
কিন্তু সবাই উদারনৈতিক মানুষ হবে এটাই বেশি জরুরি
আপনার সাথে পুরোপুরি একমত। খেলাঘর বিভক্ত হওয়ার কারণে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হযেছে শিশুরা। অবস্থা এমন যে, কোনো শিশু খেলাঘর করলে অনেকেই প্রশ্ন করে 'কোন খেলাঘর?' শিশু কী উত্তর দিবে এ প্রশ্নের? তার কি এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কথা?
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
দ্বিধাবিভক্ত খেলাঘরকে একত্রকরণের উদ্যোগটি ভেঙে গেছে। বিভাজন আমাদের খুব কাছের মানুষ, সুযোগ পেলে নিজেদেরকেই দূরে সরিয়ে রাখে।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
::: http://www.bdeduarticle.com
::: http://www.facebook.com/profile.php?id=614262553/
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
নতুন মন্তব্য করুন