ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য: দরকার দ্রুত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন ১

গৌতম এর ছবি
লিখেছেন গৌতম (তারিখ: মঙ্গল, ১২/০২/২০০৮ - ১১:৩৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জনসংখ্যার তুলনায় আয়তন ছোট হলেও বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি বৈচিত্র্যময় এবং যথেষ্ট সমৃদ্ধ। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকের হয়তো তথ্যটি বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। মানুষের হাতে ভূ-প্রকৃতির অনেক অংশ ধ্বংস এবং গাছপালা-জীবজন্তু উচ্ছেদের পরও এখন দেশে জীববৈচিত্র্য যতোটুকু রয়েছে, সেটুকুও কিন্তু অনেক দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজ থেকে কয়েক দশক আগেও জীববৈচিত্র্যে বাংলাদেশের যে অবস্থা ছিলো, এখন তার অর্ধেকও অবশিষ্ট নেই। প্রকৃতির অফুরন্ত দানকে মানুষ নিজের বাঁচার তাগিদে এবং অপ্রয়োজনে উন্মত্তের মতো ধ্বংস করেছে। অবস্থা এখন এমন দিকে যাচ্ছে যে, এই ধ্বংসের প্রতি এখনই মনোযোগ না দিলে প্রকৃতির পাশাপাশি মানুষের দুর্দশাও ঘনিয়ে আসবে শিগগরিই। ইতোমধ্যেই যার আলামত স্পষ্ট। তবে বিষয়টি আমরা এখনো গুরুত্ব দিয়ে উপলব্ধি না করতে পারলেও সারা বিশ্বে পরিবেশ সচেতন মানুষেরা সভা-সেমিনার করে সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। ঐতিহ্যমণ্ডিত এলাকাকে জাতিসংঘ ঘোষণা করছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। যেখানকার কোনো অংশকে মানুষ ধ্বংস বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিবর্তিত করতে পারবে না। বাংলাদেশের সুন্দরবনও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ। সামগ্রিক পরিবেশ রক্ষার লক্ষে জাতিসংঘ কাজ করলেও নিজেদের পরিবেশকে রার কোনো চেষ্টা আমাদের নেই। নেই পরিকল্পনা, পরিকল্পনার বাস্তবায়ন।

বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য
বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের প্রধান উদাহরণ এদেশের ধানের প্রজাতি। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে দেশে ৫ হাজারেরও বেশি প্রজাতির ধান ছিলো। এগুলো লুপ্ত হতে হতে এখন মাত্র কয়েক শত প্রজাতি অবশিষ্ট রয়েছে। জিনপ্রযুক্তির প্রচারণার প্রভাবে জিএম ফুডের চাহিদা বাড়ায় হাজার হাজার প্রজাতির ধান যেমন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তেমনি বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার চাপে অল্প জমিতে বেশি ধানের আশায় কৃষককেও সুমিষ্ট বিভিন্ন প্রজাতির ধানের চাষ বাদ দিয়ে অধিক ফলনশীল ইরি ধানের দিকে ঝুঁকতে হয়েছে। ফলে এখন সারা বাংলাদেশে দ্রুত বর্ধিষ্ণু ধানের কদর যতো বেশি, কম ফলনশীল কিন্তু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ও গুণসম্পন্ন ধানের কদর ততোই কম। কদর ও চাহিদা না থাকার কারণে কৃষকরা এ সমস্ত ধান ফলাতে আগ্রহী হচ্ছে না। যদিও ওইসব ধানের স্বাদের কাছে ইরি বা ইরিজাতীয় ধান হার মানতে বাধ্য। বর্তমানে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কিছু প্রজাতির ধানের নমুনা বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা বিআরআরআই-এ রক্ষিত আছে। উবিনীগও এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে।

ধানের মতোই অবস্থা পাটেরও। পাটের অবস্থা বরং আরো খারাপ। এককালে শুধু বাংলাদেশেই প্রায় ১৫০০-র কাছাকাছি পাটের প্রজাতি ছিলো। সোনালী আঁশ বলে খ্যাত এই উদ্ভিদটির বিভিন্ন প্রজাতির ধ্বংসের পেছনে একমাত্র দায়ী বাংলাদেশের কিছু মানুষ। পাটের কলগুলোতে বিভিন্ন ধরনের পাটের যথেষ্ট চাহিদা থাকা সত্ত্বেও এবং বিশ্বব্যাপী পাটের বাজার থাকা সত্ত্বেও পলিথিনজাতীয় পণ্যের ব্যাপক প্রসার এবং বহুজাতিক কোম্পানির ষড়যন্ত্রের ফলে পাটের চাষই এখন বাংলাদেশে অস্তিত্বের সম্মুখীন।

উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা দেশে মোট কতো প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে, এ সম্পর্কে সঠিক কোনো জরিপ বা হিসাব না চালালেও ধারণা করা হয় বাংলাদেশে প্রায় ৫ হাজার প্রজাতির গাছ (ভাসকুলার প্লান্ট) রয়েছে। বনভূমি কেটে আবাসস্থল গড়ে তোলা, নির্বিচারে পাহাড় কাটা এবং গাছ কাটার পর নতুন করে গাছ না লাগানোর কারণে কয়েক শত প্রজাতির গাছ এখন ধ্বংসের মুখে। এছাড়া ঘাসের মধ্যে বিদেশী ঘাসের চাহিদা ও আমদানি বাড়ায় কিছু প্রজাতির ঘাস এখন লুপ্ত হয়ে গেছে ধারণা করা হয়।

উদ্ভিদ ছেড়ে আসা যাক প্রাণীতে। নদনদীর দেশে একসময় বিজ্ঞানসম্মত মাছের চাষের ধারণা না থাকলেও বর্তমানে সারা দেশের পুকুরগুলিতে মাছ চাষ হচ্ছে। কিন্তু চাষ যতোই হচ্ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মাছের ঘাটতি। নদনদীতে আশঙ্কাজনকহারে কমে যাচ্ছে মাছের পরিমাণ। চাষাবাদের উদ্দেশ্যে কাটা পুকুর ছাড়া অধিকাংশ পুকুরেই এখন আর মাছ পাওয়া যায় না। খাল-বিল সব শুকিয়ে যাচ্ছে ক্রমেই। হাওরে মাছের পরিমাণ শূন্যের কোটায়। মৎস্যবিজ্ঞানীদের হিসেব অনুযায়ী, একসময় বাংলাদেশে মিঠা পানির মাছ ছিলো প্রায় দুই হাজারের মতো। বর্তমানে এই সংখ্যা ২৬৬-তে এসে ঠেকেছে। সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে অবশ্য মাছের প্রজাতির সংখ্যা কমেনি। বর্তমানে সমুদ্র উপকূলে ৪৪২ প্রজাতির মাছ রয়েছে।

এদিকে নির্বিচারে গাছপালা ধ্বংসের কারণে পাখির সংখ্যাও কমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। বিজ্ঞানীরা ৩৮৮টি দেশীয় পাখির সংখ্যা রেকর্ড করেছেন। একসময় দেশে শীতকালে ৮০০-র বেশি প্রজাতির অতিথি পাখি আসলে এখন এই সংখ্যা কমতে কমতে এসে ২৪০-এ দাঁড়িয়েছে। অতিথি পাখি নিধন বন্ধ না করা হলে এ সংখ্যা আরো দ্রুত কমবে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। দেশীয় পাখিও কমে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে পাখিদের নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত এই বাংলাদেশ পাখিশূন্য হয়ে যাচ্ছে।

পাখিদের মতো অবস্থা বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীদেরও। বর্তমানে দেশে ১৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী পাওয়া যায়। সরীসৃপের প্রজাতির সংখ্যা ১১২। চামড়া ও অন্যান্য প্রয়োজনে কিছু প্রজাতির সরীসৃপের চাষ করা হলেও আকারে ছোট সরীসৃপগুলো ধ্বংস হচ্ছে প্রতিনিয়ত। স্তন্যপায়ী জীবের প্রজাতি সংখ্যা ১১০।

উপরের দেয়া সংখ্যাগুলো একটি দেশের জন্য কোনোমতেই উৎসাহব্যঞ্জক হতে পারে না। দেখাতে পারে না কোনো আশার আলো। ইকোলজিক্যাল সিস্টেমের কারণে একটি দেশে যতো বেশি সম্ভব প্রজাতির বাসস্থানের ব্যবস্থা করা উচিত। মানুষ, বেশি গাছ ও অধিক প্রজাতির প্রাণীর সহাবস্থানের ফলে পরিবেশ যতোটা উপকৃত হয়, ততোটা অন্য কোনোভাবে হয় না।

(লেখাটি ইতোপূর্বে সায়েন্স ওয়ার্ল্ড-এ ছাপা হয়েছিলো। এখানে কিছুটা সম্পাদনা করা হয়েছে।)


মন্তব্য

ইফতেখার নূর এর ছবি

ক্ষুধা রে ভাই, ক্ষুধা। পেটের মধ্যে বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে সব কিছু।
আমাদের কৃষকদের পক্ষে আসলে জার্মপ্লাজম সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়, তারা উচ্চফলনশীল জাত চাষ করতে বাধ্য। এই দায়িত্ব সরকার বা রিসার্চ প্রতিষ্ঠানকেই মুলত নিতে হবে।

চমতকার লিখেছেন। অভিনন্দন!!!

গৌতম এর ছবি

কৃষকরা তো এমনিতেই অসহায়। আমাদের কিছু জ্ঞানপাপী তাদেরকে আরো অসহায় করার জন্য ফন্দিফিকির আঁটছে সবসময়। উচ্চফলনশীলের নামে কৃষকদের বন্ধ্যা করে রাখা হচ্ছে।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

বিপ্লব রহমান এর ছবি

জীব বৈচিত্র রক্ষার সবচেয়ে নৃশংস সরকারি উদ্যোগ মধুপুর ও মৌলভীবাজারের ইকো - পার্ক প্রকল্প। চলেশ রিছিল এই নৃশংসতার সর্বশেষ শিকার!

গুরুত্বপূর্ণ ধারাবাহিক লেখাটি শুরু করার জন্য গৌতমদাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

গৌতম এর ছবি

ধন্যবাদ বিপ্লব দা। চেষ্টা করছি কিছু একটা লেখার। দেখি কী হয়!
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।