ইকোসিস্টেম
ইকোসিস্টেম নিয়ে বর্তমান সময়ে বেশ কথাবার্তা চলছে। শব্দটি বিভিন্ন মহলে পরিচিত হয়ে উঠছে ক্রমাগত। যদিও ইকোসিস্টেম সম্পর্কে অনেকেরই কোনো সুস্পষ্ট আইডিয়া বা ধারণা নেই। সাধারণত ধরে নেয়া হয়, ইকোসিস্টেমের উন্নত ঘটালেই পরিবেশের উন্নতি ঘটবে। কিন্তু সঠিকভাবে ইকোসিস্টেমের উন্নতি না ঘটাতে পারলে তা পরিবেশের উন্নতির চাইতে অবনতিই ঘটায়।
ইকোসিস্টেমের সর্বজনীন সংজ্ঞা না থাকলেও একটি নির্দিষ্ট এলাকায় একদল উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রাকৃতিক সহাবস্থানকে সাধারণভাবে ইকোসিস্টেমের প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। এই সহাবস্থানে কৃত্রিম কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। কোনো প্রজাতির প্রাণী বা উদ্ভিদকে ধ্বংস করা যাবে না, এবং সেই এলাকায় অভিযোজিত হতে সক্ষম নয় এমন কোনো প্রজাতির প্রাণী বা উদ্ভিদকে নতুনভাবে অভিযোজিত করা যাবে না। অর্থাৎ কোনোভাবেই সেখানকার প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক অবস্থাকে ক্ষুণ্ন করা যাবে না। যেখানে পর্যায়ক্রমিক খাদ্যপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিটি প্রাণীর খাদ্য যোগান হয়ে থাকে। ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ পরিবেশবিদ স্যার আর্থার জর্জ টেনসলি প্রথম ইকোসিস্টেম শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি একটি দ্বীপের উদাহরণের মাধ্যমে দেখান যে, সেখানকার ভূ-বৈচিত্র্য, মাটির অবস্থা এবং আবহাওয়ার ওপর ভিত্তি করে কমপক্ষে দুই হাজার প্রজাতির গাছ এবং সাড়ে সাতশ প্রজাতির প্রাণীর সহাবস্থান বাধ্যতামূলক না হলে দ্বীপটির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। পাশাপাশি দ্বীপে অবস্থিত মানুষের অস্তিত্ব সংশয়ে পড়তে বাধ্য হয়। উদ্ভিদ ও প্রাণীর এই সহাবস্থানের সিস্টেমকে তিনি ইকোসিস্টেম হিসেবে অভিহিত করেন।
ইকোসিস্টেম কীভাবে কাজ করে
একটি প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থানকারী বিভিন্ন ধরনের প্রাণী ও উদ্ভিদ থাকে। প্রাণীদের মধ্যে স্থলচর, জলচর ও উভচরÑ উভয় প্রজাতির প্রাণীই থাকে। অন্যদিকে ব্যাঙের ছাতা থেকে বিশালকায় বৃক্ষতো আছেই। প্রতিটি প্রাণীই তার জীবনধারণের জন্য কোনো না কোনোভাবে অন্য প্রাণীর ওপর নির্ভরশীল। এ প্রাণীগুলোর যে কোনো একটি প্রাণীর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হলে আস্তে আস্তে সবকটি প্রাণীর অস্তিত্বই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সারা পৃথিবীতে উদ্ভিদ ও প্রাণীর সহাবস্থানের শর্ত এই ইকোসিস্টেম। ইকোসিস্টেম না থাকলে আস্তে আস্তে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যেতে বাধ্য। বর্তমানে আফ্রিকায় যেখানে সাহারা মরুভূমি অবস্থিত, সেখানে একসময় বনভূমি ছিলো। ছিলো হাজারো প্রজাতির প্রাণী। বিজ্ঞানীদের মতে, সাহারার তখনকার ইকোসিস্টেম নষ্ট হওয়ার কারণে আস্তে আস্তে সেখানকার সব প্রাণী ও উদ্ভিদ ধ্বংস হয়ে যায়, যার পরিণতি এই মরুভূমি।
ইকোসিস্টেম ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কোনো পরিকল্পনা নেই
আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে একসময় জীববৈচিত্র্যে পূর্ণ একটি দেশ ছিলো। কিন্তু বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের ফলে সেই পরিবেশ এখন আর নেই। ফলে আস্তে আস্তে পার্বত্য এলাকার পাহাড়ের পরিবেশ যেমন ধ্বংস হচ্ছে, তেমনি ধ্বংস হচ্ছে ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ের পরিবেশ। নষ্ট হচ্ছে ভাওয়াল ও মধুপুরের বনভূমির ঘনত্ব। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে এই পরিবেশ ধ্বংসের কথা বলা হলেও মূলত পরিকল্পনা ও সচেতনতার অভাবই বাংলাদেশের ইকোসিস্টেম ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের জন্য দায়ী।
পরিবেশের এই অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষে সরকার কিছু কিছু কাজ করছে। বৃক্ষনিধনকে অনুৎসাহিত করা হচ্ছে, একটি গাছ কাটলে বিপরীতে দুটি গাছ লাগানোর কথা বলা হচ্ছে। ব্যাপক বনায়ন করা হচ্ছে। বিভিন্ন ঐতিহ্যমণ্ডিত অংশকে সংরক্ষিত করা হচ্ছে। ইকোপার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে। নির্দিষ্ট আকারের নিচে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। অতিথি পাখি নিধন বন্ধ করার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। প্রাণী হত্যার ব্যাপারে কঠোর আইন করার কথা ভাবা হচ্ছে। একটা বিষয় এখানে লক্ষণীয়, আমাদের দেশে যারা ইকোসিস্টেমের কথা বলে পরিবেশ ও বনাঞ্চল রক্ষার কথা বলছেন, তারা সচেতন বা অবচেতনভাবেই হোক, ইকোসিস্টেমের বিরুদ্ধেই বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করছেন। ইকোসিস্টেম শব্দের অর্থ ও কাজ এবং বাংলাদেশে তার বাস্তবায়নে ব্যাপক ফারাক। এই সিস্টেমে কিন্তু কোথাও বলা নেই, বনের পশুপাখিকে রার জন্য মানুষ উচ্ছেদ করতে হবে, কাঠ-ইটের শক্ত কাঠামো বানাতেই হবে; কিন্তু আমরা ইকোসিস্টেমের নাম করে প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজ প্রতিনিয়ত করেই যাচ্ছি। ফলে ধারণা হিসেবে ইকোসিস্টেমের আবেদন দিন দিন নষ্ট হচ্ছে। এখন ইকোপার্ক বা ইকোসিস্টেম শব্দগুলো শুনলে আতঙ্ক জাগে মনে।
তাই বলা যায়, মূল কাঠামো ঠিক নেই। ছাড়াছাড়াভাবে এই কাজগুলো করে দেশের পরিবেশ রক্ষা করা যাবে না। একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর অধীনে নির্দিষ্ট কর্মসূচি ঠিক না করে এবং সেখানে সঠিক পরিকল্পনা না থাকলে আলাদাভাবে যতো কর্মসূচি নেওয়া হোক না কেনো, তা একসময় ব্যর্থ হতে বাধ্য। ১৯৯২ সালে বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলনের সময় জীববৈচিত্র্য সংক্রান্ত যে চূড়ান্ত কনভেনশন করা হয় তা ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে কার্যকর করা হয়। সেই কনভেনশনে যে বিষয়গুলোর ওপর জোর দেয়া হয়, সেগুলো হচ্ছে- জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং জীববৈচিত্র্যের বিভিন্ন উপাদানসমূহের টেকসই ব্যবহার ও জেনেটিক সম্পদের ব্যবহার থেকে প্রাপ্য লাভের সুষ্ঠু ও সমবিভাজন নিশ্চিত করা।
কনভেনশনের স্বাক্ষর করা প্রতিটি দেশই তাদের নিজ দেশে দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে পরিবেশ রক্ষায় উদ্যোগী ভূমিকা পালন করার কথা থাকলেও বাংলাদেশ এখনো এ ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো কর্মকৌশল বা পরিকল্পনা তৈরি করেনি।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আইইউসিএন এ ব্যাপারে কর্মকৌশল তৈরি করছে বলে জানা গেছে। কিন্তু যার এই মূল কাজটি করা উচিত, সেই পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এ ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনা চোখে পড়ছে না। যেখানে জীববৈচিত্র্যের কারণে বাংলাদেশের পরিবেশের অস্তিত্বই হুমকির সম্মুখীন, সেখানে এ ব্যাপারে পরিকল্পনাহীনতা যতো তাড়াতাড়ি কাটিয়ে ওঠা যায়, ততোই মঙ্গল। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিবেশ অধিদপ্তর ও বন বিভাগ এর আগে সারা দেশে ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল অ্যারিয়া বা সংকটাপন্ন প্রতিবেশ হিসেবে আটটি এলাকা চিহ্নিত করলেও সেগুলো রক্ষার ক্ষেত্রে নতুন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বন বিভাগ তাদের নিজস্ব জরিপ অনুযায়ী সারা দেশের ১৬টি এলাকাকে সংরক্ষিত করার প্রস্তাব করেছে। তার কয়েকটিকে অবশ্য সংরক্ষিত বলে ঘোষণাও করা হয়েছে। কিন্তু তারপর আর তাদের কোনো কাজ নেই। ১৯৭৩ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের বলে বলীয়ান হলেও পরিবেশ মন্ত্রণালয় নতুন কোনো ব্যবস্থা গত দুই দশকে নেয়নি। যদিও এ কাজটি মূলত তাদেরই। ইরানের রামসার কনভেনশনে আন্তর্জাতিকভাবে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে অঙ্গীকার করলেও দায়িত্ব নিয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয় এ কাজটি করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
পরিবেশের এ সংকটাপন্ন অবস্থায় এখন দরকার জরুরিভিত্তিতে একটি বড় পরিকল্পনা গ্রহণ করে সেটিকে যতো দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা। শুধু সরকারিভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করলেই হবে না, সেটিকে বাস্তবায়নে দেশের সবস্তরের জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণে একদিকে জনগণের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা সম্পর্কে ধারণা জন্মাবে, তেমনি পরিকল্পনার দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। তা না হলে সব কাজ স্বাক্ষর প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
(লেখাটি ইতোপূর্বে সায়েন্স ওয়ার্ল্ড-এ ছাপা হয়েছিলো। এখানে কিছুটা সম্পাদনা করা হয়েছে।)
মন্তব্য
জনসচেতনতা গড়ে তোলা দরকার। তবে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। দূরদর্শী লোকজন জায়গামতো না থাকাই একটা বড় সমস্যা। বনবিভাগের কর্তারাই দেখা যায়, বন কেটে বিক্রি করছে, একবার এক টিএনওর সরকারী গাছ কেটে বিক্রির কথা পত্রিকায় পড়েছিলাম।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
ঠিক জায়গায় ঠিক লোক আছে কি-না, সেটি একটি বড় সমস্যা। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, ঠিক লোক থাকলেও দেশের প্রতি তিনি কতোটুকু কমিটেড, সেটি। দুটোর যে কোনোটিতে ঘাটতি থাকলে সর্বনাশ হতে বাধ্য।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
আমাদের দেশে এসমস্যা সমাধান সত্যিই কঠিন। মানুষের হাজারো অপূর্ণতা রয়েছে, সেখানে জীববৈচিত্র রক্ষার কথা তুললে অনেকেই চোখ তুলে তাকায়। আবার প্রাণধারনের জন্য এর বিকল্পও একসময় থাকবেনা। এ এক অদ্ভুত দুষ্টচক্র।
আমাদের দেশে অবশ্য মানুষের এই অপূর্ণতার সাথে জীববৈচিত্র্য রক্ষার প্রত্যক্ষ সাযুজ্য কম। কারণ যেখানে জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে মানুষের চাহিদাও রাক্ষুসে নয়। কেবল উদ্দ্যেশ্যমূলকভাবে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা, বনের মাঝে পাকা দালান করা ইত্যাদির প্রসঙ্গগুলো আসে, তখনই সমস্যাটা বাধে। যোগ্য মানুষের হাতে পড়লে এই দিকগুলো মাথায় রেখেই পরিকল্পনা করা ও তার বাস্তবায়ন সম্ভব।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
নতুন মন্তব্য করুন