‘মাসুদ রানা’ পড়ার কারণে কি-না জানি না, জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক কাকতালীয়গুলো এখন আর দ্বিধাহীনভাবে বিশ্বাস হয় না। কত কাকতালীয় ঘটনার আড়ালে কত তালি মারা ঘটনা থাকে, মাসুদ রানা পড়লে জানা যায়। আর জানা যায় পেন্টাগন বা কেজিবি-রা যখন সময়ের ব্যবধানে তাদের পুরনো গোপন দলিল প্রকাশ করে। ফলে একই সময়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে শেভরনের ভূতাত্ত্বিক জরিপ কার্যক্রম চালানো অনুমতি প্রদানের পাশাপাশি পর্যটকদের কারণে সেখানকার পরিবেশ নষ্টের খবর প্রকাশকে কাক বসলো আর তাল পড়লো বলে মানতে কষ্ট হয়।
লাউয়াছড়া সংরক্ষিত রেইন ফরেস্টে গ্যাস-তেল অনুসন্ধানে ত্রিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ অনুসন্ধানের জন্য বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পেয়েছে মার্কিন কোম্পানি শেভরন। তারা যদিও বলছে, লাউয়াছড়ার বন ও পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করেই জরিপের কাজ সম্পন্ন করা হবে, কিন্তু পরিবেশবাদীরা লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী এসব স্থানে জরিপের জন্য ছাড়পত্র দিতে হলে জনসাধারণকে বিষয়টিতে সম্পৃক্ত করতে হয়। আমরা বিষয়টি জানার জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে লিখেছি। কিসের ভিত্তিতে ছাড়পত্র দেওয়া হলো- তা জানার অধিকার জনসাধারণের আছে। এটা জনগণের সম্পদ’ (প্রথম আলো, ১৫ মার্চ)।
প্রায় একই সময় পত্রিকায় রিপোর্ট বেরিয়েছে- লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলে সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে পর্যটকদের কারণে। প্রতিদিন এখানে অসংখ্য পর্যটক আসছেন, খাবারের উচ্ছিষ্ট এবং যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত চলাচল বনভূমিক স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করছে।
লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চল আমাদের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সিপাহীজলা বনাঞ্চল ইতোমধ্যেই পর্যটকদের কাছে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে এর সৌন্দর্য, ব্যবস্থাপনা ও জীববৈচিত্র্যের কারণে। প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক সেখানে যাচ্ছেন, কিন্তু দক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে সেখানকার পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। এমনকি এই বনের পাশ দিয়ে যে রাস্তা আগরতলা থেকে মেলাঘর পর্যন্ত গিয়েছে, সেখানে বনের পশুপাখিরা নির্ভয়ে যাতে চলাচল করতে পারে, সেজন্য যানবাহনের গতিসীমা এবং সেখানে মানুষের আচরণ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তবে যারা সিপাহীজলা এবং লাউয়াছড়া- দু’জায়গাতেই গিয়েছেন, তাদের বক্তব্য হচ্ছে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের দিক দিয়ে সিপাহীজলার চাইতে লাউয়াছড়া অনেক বেশি ধনী। গরীব কেবল ব্যবস্থাপনার দিকটিকে।
লাউয়াছড়া যখন পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের দিক দিয়ে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তখনই গ্যাস-তেল অনুসন্ধানের জন্য কার্যক্রম চালানো শুরু হচ্ছে। এতে পশুপাখির আবাসস্থল ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি পর্যটনশিল্পের বিকাশও রুদ্ধ হবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই কার্যক্রমের ফলে স্থানীয় আদিবাসীদেরও উচ্ছেদ হতে হবে। শেভরনের পক্ষ থেকে বন ও পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করেই জরিপকাজ সম্পন্ন করার কথা বলা হলেও একইসঙ্গে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। প্রশ্ন জাগে, বন ও পরিবেশের ক্ষতি না হওয়ার বিষয়টিতে কোম্পানি যখন এতোটাই সচেতন এবং নিশ্চিত, তাহলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রসঙ্গটি কী কারণে আসলো? এই বিষয়টি পরিষ্কার নয়; বা পরিষ্কার করা হয়নি। কোম্পানিটির পরিষ্কার করে বলা উচিত, এই জরিপ কাজে কোন কোন দিক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এবং ক্ষতিগ্রস্ত হলে কী কী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। তাদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে- শেভরন-উল্লিখিত সম্ভাব্য ক্ষতির বিষয়গুলো বন ও পরিবেশের ওপর কতোটুকু প্রভাব ফেলবে এবং এ কারণে তাদের দিয়ে জরিপকার্য চালানো হবে কি-না, এবং সেটা যদি সহনীয় হয় তাহলে তাদের প্রস্তাবিত ক্ষতিপূরণ যথাযথ কি-না। বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে পরীক্ষিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দিয়ে এ কাজগুলো করানো উচিত।
লাউয়াছড়ায় পর্যটকদের আগমন হঠাৎ করেই যে বেড়ে গেছে বিষয়টি এমন নয়। কিন্তু প্রায় একই সময়ে এই এলাকায় শেভরনের অনুমতি পাওয়া এবং পর্যটকদের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে রিপোর্ট প্রকাশ এক ধরনের সন্দেহ সৃষ্টি করে। পর্যটকদের দ্বারা পরিবেশ নষ্টের দোহাই দিয়ে শেভরনকে নিরিবিলি কাজ করানোর সুযোগ সৃষ্টির জন্য উদ্দেশ্যমূলক রিপোর্ট নয় তো এগুলো? এমন কি হতে পারে, এসব রিপোর্টের সুযোগ নিয়ে কিছুদিনের জন্য সেখানে পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হলো, শেভরন সেখানে কাজ করলো জনগণের কোনো রকম সম্পৃক্ততা ছাড়াই, ফলে সত্যিকার অর্থে কী ঘটছে তা ওই কোম্পানি ছাড়া আর কেউ জানতেও পারলো না? লাউয়াছড়ার পরিবেশ নিয়ে উৎকণ্ঠাজনিত রিপোর্ট যে কোনো সময়েই হতে পারে, কিন্তু সংশ্লিষ্ট আরেকটি উদ্বেগজনক কার্যক্রমের সাথে যখন সময়টি মিলে যায়, তখন শংকা জাগে মনে। হয়তো আসলেই ঘটনাদুটো কাকতালীয়, কিন্তু লাউয়াছড়ার কাছেই মাগুরছড়ার স্মৃতি আমাদের মনে এখনো জাগ্রত। আমাদের মতো গরীব দেশকে আর কোনো বিপর্যয় যেন সহ্য করতে না হয়।
গত একদশক ধরে এসব তেল-গ্যাস কোম্পানির কার্যক্রমের বিরুদ্ধে এদেশে এক ধরনের আন্দোলন হচ্ছে। দেশের সম্পদ রক্ষার স্বার্থে যারা আন্দোলন করছেন তারা এই জরিপ কার্যক্রম নিয়ে চিন্তিত। বন ও পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে গ্যাস-তেল পাওয়া গেলে আমরা অবশ্যই আনন্দিত হবো; কিন্তু এই কাজ করার জন্য আমাদের জাতীয় কোম্পানিগুলোর সাফল্য থাকলেও তাদের দিয়ে কেন করানো হচ্ছে না, তা বোধগম্য নয়। স্বচ্ছ প্রক্রিয়া ও জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া এই ধরনের উদ্যোগ সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ রাখবে সবসময়।
মন্তব্য
গৌতম, আপনার ধারনার সঙ্গে সহমত পোষণ করছি।
জনগুরত্বসম্পন্ন বিষয়গুলোতে সরকার একগুয়েমি প্রদর্শন করে এবং এ একগুয়েমি আমাদের মত দেশকে আরও গরীব ও দুবৃত্তায়ন করে তোলে। আমরা অধিকবার একটি বিষয়ে শীর্ষে অবস্থান করে প্রভুদের কৃপা লাভ করি এবং কতিপয় ব্যক্তি সুইস ব্যাংকে নাম উঠানোর গৌরব অর্জন করে।
বাংলার স্বপ্ন বুনে চলি......
আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ। বড় ভয় হয়! অর্থসম্পদ নাই তেমন, যা আছে তার দিকে লোলুপ দৃষ্টি পশ্চিমা বিশ্বের। ধরে রাখতে পারবো কি-না সে শংকায় থাকি সারাবেলা।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
- ত্যালগ্যাস সন্ধানী কোম্পানীগুলোকে এভাবেই আমাদের ঘরে ঢুকতে সহায়তা করছে আমাদের অথর্ব বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী সরকারগুলো। আর এর জন্য চড়া মাশুল গুণতে হচ্ছে আমাদের। সম্পদ, বৈচিত্রে সমৃদ্ধ হয়েও আমাদের পড়ে থাকতে হচ্ছে ঐসব কোম্পানীর মালিকদের কৃপাবশবর্তী হয়ে, তাদেরই গোলাম হয়ে!
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ধুসর গোধুলীর সাথে একমত ।
আমরা দেশীয় কোম্পনির কাছে যে গ্যাস কিনি সাত টাকা দিয়ে, সেই একই পরিমাণের গ্যাস বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে নাকি কিনতে হয় আড়াইশ টাকা দিয়ে। তারপরও যদি আমাদের বোধোদয় না হয়, দেশপ্রেম জেগে না ওঠে- তাহলে বিদেশিদের খামোকা দোষ দিয়ে কী লাভ! আমরা নিজেরাই টার্গেট ঠিক করে নিজেদের শরীরটায় কুড়াল মারছি...
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
এইটা আর নতুন কি? মামলা তো পরিষ্কার।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
পরিষ্কার কি-না সেটাই তো বুঝি না...
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
নতুন মন্তব্য করুন