১৩.
মানুষ এক অবাক প্রাণী- চলতে গেলে থামতে চায়, থেমে থাকলে চলার প্রেমে মজে। সারাদিন গাড়ি ছুটছে তো ছুটছেই, ছুটছেই, ছুটছেই... থামার ইচ্ছে বাড়ছেই, বাড়ছেই...
রংপুর পার হয়ে গাড়ি ছুটছে নীলফামারীর দিকে। উদ্দেশ্য ডোমার। দুটো সুন্দর জায়গা- ডোমার, ডিমলা। কেমন যেনো ডিম-ডিম-ডোম-ডোম গন্ধ! সেই সাতসকালে ‘অংপুরত ছাড়ি’ আসার পর গাড়ি শুধু চলছেই, ডোমার যাবে, ডিমলা যাবে, ডিমলা যাবে, ডোমার যাবে, ডোমলা যাবে, ডিমার যাবে, ডোমলা, ডিমার... গৌতমের কি তন্দ্রা এসে গিয়েছিলো? ডোমলা-ডিমার জিনিসগুলো কী?
গাড়ির প্রবল ঝাঁকুনিতে তন্দ্রা ছুটে যায়। সিটবেল্ট বাঁধে নি, ড্যাশবোর্ডে মাথা ঠুকতে গিয়ে অল্পের জন্য নিজেকে সামলাতে পারে- সামনের গাড়ি হঠাৎ করেই থেমে গেছে, থেমেছে আর আগেরটিও। কী যেনো ঝামেলা! দেখবে কি নেমে? কী দরকার? কী দরকার ঝামেলায় জড়ানোর? কী দরকার?
ঢাকার শাহবাগে সেদিন দুটো মানুষ পড়েছিলো- নিথর হয়ে, সবাই দেখছে, মন্তব্য করছে, চলে যাচ্ছে। গৌতম দাঁড়িয়েছিলো অনেকক্ষণ সেখানে। না, কিছুই করে নি। শুধু দাঁড়িয়ে ছিলো, দেখেছিলো মানুষের যাওয়া-আসার খেলা, একটা সময় সে নিজেও চলে গিয়েছিলো গান গাইতে গাইতে-
শুধু যাওয়া-আসা শুধু স্রোতে ভাসা, শুধু আলো-আঁধারে কাঁদাহাসা...
আজও কি গৌতম অযাচিত ঝামেলাগুলো উপভোগ করবে এই পৃথিবীর আটদশটা সাধারণ মানুষের মতোই? কী হচ্ছে সামনে? দেখবে কি? ঠিক তক্ষুণি মাথার ভেতর ঘুণপোকা মনে করিয়ে দিতে থাকে- এগারটায় অমুক অ্যাপয়েন্টমেন্ট, দুটোয় অমুক মিটিং, চারটায় অমুক ভিজিট... অসম্ভব ক্লান্ত হয়ে গৌতমের বোধি শির তুলে জানান দেয়- এনজিও আর কর্পোরেট সংস্কৃতি মানুষকে জঞ্জাল ভাবতে শিখিয়েছে, ফার্মের মোরগের সাথে গৌতমের কোনো পার্থক্য নেই, দুটোই আত্মকেন্দ্রিক, নির্জীব, পলায়নবাদী।
১৪.
সব ধরনের অস্পৃশ্যতাকে জয়যুক্ত করে গৌতমের গাড়ি আবারও এগিয়ে চলেছে... এবার সঙ্গী হয়েছেন কোনো এক কবি, জয় গোস্বামী কি? নাকি শঙ্খ ঘোষ?
এমনি করে থাকতে গেলে শেষ নেই শঙ্কার, মারের জবাব মার
বুকের ভেতর অন্ধকারে ছলকে ওঠে হাড়, মারের জবাব মার
...বাপের চোখে ঘুম ছিলো না ঘুম ছিলো না মার, মারের জবাব মার
কিন্তু তারও ভেতরে দাও শব্দের ঝংকার, মারের জবাব মার
কথা কেবল মার যায় না কথার বড় ধার, মারের জবাব মার...
গৌতম ভাবে, আফসোস হয়, ধুসর গোধুলির পবল দিক্কার দেয়- কোন জীবন যে ফেলে এসেছে!... ভবের বাজারে আকুল করি প্রাণ...
১৫.
ডোমার বাসস্ট্যান্ডে ঢুকতেই বাম পাশে একটি রেস্টুরেন্ট আছে- কাউকে ভালো রেস্টুরেন্টের কথা জিজ্ঞেস করলে এটাই দেখিয়ে দিবে- অবাক ব্যাপার দুপুরে খেয়েছে, আর এখনি, এই মাঝ রাতেই গৌতম রেস্টুরেন্টের নাম ভুলে গেলো? এতো চমৎকার স্বাদের রেস্টুরেন্টের নামটা ভুলে গেলো? মানুষ তখনি অন্য মানুষ কিংবা বস্তুর নাম ভুলে, যখন সেটিকে সে গুরুত্ব দিতে চায় না- প্রমাণিত সত্যের থিওরিতে বিশ্বাসী গৌতম ভাবতে বসে- প্রান্তিক মানুষজন কখনোই শহরবাসীর নজর কাড়ে নি, ব্যবসার উপলক্ষ ছাড়া; খাবারের কথা তাই মনে আছে- মনে আছে ওপাশে টেবিলে বসা ভরাট যৌবনের মেয়েটির কথা- কেবল মনে নেই যে মানুষটি সযত্নে ‘ঢাকাত্থন আইসে’ মানুষকে খাবার দিলো, যার নামেই রেস্টুরেন্টের নাম, সেই মানুষটির নাম।
গৌতমের পক্ষ থেকে এই দিনপঞ্জির লেখক সেই মানুষটির কাছে দুঃখপূর্ণ হৃদয়ে সমস্ত উপেক্ষার জন্য নতজানু হয়েছে। মানুষকে ভুলে যাওয়া পাপ নয়, মানুষকে উপেক্ষার আরেক নাম পাপ।
১৬.
দিনাজপুরের কাহারোলে কান্তজীউ’র মন্দিরে গিয়েছে গৌতম, বেশ ক’বার। আজকে কি যাবে একবার? না, থাক। এসব জিনিস একবার দেখাই ভালো। প্রথম দেখাটি ভালো কাটে নি। মন্দিরটি দেখতে দেখতে কেমন যেনো অদ্ভুত অস্বস্তিতে ভুগছিলো প্রায় পুরোটা সময়। গৌতমের মতো মিডলক্লাশভদ্রলোকেরা যে সুশোভন ভবনগুলোতে কাজ করে, সেগুলো কি অসংখ্য গরীব মানুষের রক্ত-শ্রম-ফসল-অর্থ আর বঞ্চনার স্তুপ নয়? কান্তজীউ’র মন্দিরটিও কি তেমনি নয়? হয়তো কোনো গরীব প্রজার জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছিলো এই মন্দির বানানোর নামে। হয়তো হাজার হাজার মানুষের বিনামূল্যের শ্রম পড়েছিলো এর প্রতিটি কোণায়- মার্কসভাই উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বের প্রয়োগও হয়তো এখানে পাখনা মেলেছিলো- হয়তো হাজার হাজার প্রজার ফসলের ভাগ বসেছিলো কান্তজীউ’র বাজেটে, কিংবা রক্তনাঙ্গা শিশুর ধুলিমাখা শৈশবের পরিসমাপ্তিকে রঙিন হয়েছিলো এর পলেস্তরাগুলো। একটি মন্দিরের জন্য কতো মানুষকে না খাইয়ে থাকতে হয়েছিলো, এই ইতিহাস জানাবে আজকের কোন ইতিহাস? ইতিহাস বঞ্চিতকে বঞ্চিত করে, সবসময়, ইতিহাসের ইতিহাস তাই বলে... আর এই বঞ্চনা ইতিহাসই হয়তো আমাদের গর্বিত-প্রবল ঐতিহ্য!
১৭.
দিনাজপুর শহরে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সন্ধ্যা নেমে যায়। বাঁশেরহাটের রাস্তার দুদিকে ঘন গাছপালার ফাঁকে কোনো কুটিরের আলো আসে না, গাড়ির হেডলাইট সমস্ত কালোপথকে আরো অন্ধকার শাণিয়ে ছুটতে থাকে গন্তব্যের পানে, মানুষই একমাত্র প্রাণী যে কিনা অন্যের বাসখানায় থাকতে পারে নিজের গন্তব্যের মতো! গৌতম তার ব্যতিক্রম নয়, সারাদিন ছুটাছুটির পর বালিশ তাকে ডাকে- বালিশের নরোম উষ্ণ সঙ্গ কোনো রমণীর কথা মনে করায় না- রমণী কোনো এক দূর বিদর্ভ নগরের, সেখানে যাওয়া যাবে আরেকদিন...
১৮.
এই এক বিরল সমস্যা- ঘুম... গৌতমের বিবেক দিনপঞ্জি লেখে, গৌতম পড়ে, তার চোখে ঘুম নেই। বিবেক তাকে ঘুমাতে দেয় না, নাকি তার কারণে বিবেক ঘুমাতে পারে না, সেই হিসাব চুকাতে চায়। গাধাটা বুঝে না- পৃথিবীর সব হিসেব চুকাতে নই, তাতে গণ্ডগোলের মাত্রা বাড়ে, হিসেবে যে যতো বেশি কাচা, তার হিসেব ততো তাড়াতাড়ি মেলে।
২৩ মার্চ, ২০০৯। রাত ৯টা ২৩ মিনিটে লেখা শেষ।
মন্তব্য
এইধরনে বাংলাদেশ ভ্রমনের কাহিনী আমার ভাল লাগে। ওই পার্টটা হাইলাইট করে আরো লিখুন!
ধন্যবাদ, চেষ্টা করবো।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
::: http://www.bdeduarticle.com
::: http://www.facebook.com/profile.php?id=614262553/
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
অসাধারন লাগছে, তারা আগেরগুলোর মত দিতেই পারি
...........................
Every Picture Tells a Story
ধন্যবাদ, মুস্তাফিজ ভাই।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
::: http://www.bdeduarticle.com
::: http://www.facebook.com/profile.php?id=614262553/
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
আপনার সিরিজটা ভালো হচ্ছে। ভ্রমণটা যে আনন্দময় ছিলো বুঝা যাচ্ছে।
----------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
আরে, পুরা দৌড়ের ওপর ছিলাম। এইটা ভ্রমণ না। গাড়িতে বসিয়া মর্দ দৌড়াইতে লাগিল বলতে পারেন।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
::: http://www.bdeduarticle.com
::: http://www.facebook.com/profile.php?id=614262553/
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
দিনাজপুর ভ্রমনও ভালই হয়েছে তাহলে । এরপর কি কুড়িগ্রাম নাকি গাইবান্ধা ?
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
গাইবান্ধা-কুড়িগ্রাম হয়েই তো দিনাজপুরে আসলাম।! এর পর সোওওওওজা রাজশাহী।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
::: http://www.bdeduarticle.com
::: http://www.facebook.com/profile.php?id=614262553/
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
খুব ভালো লাগলো গৌতম
আরো লিখুন
ধন্যবাদ, শ্যাজাদি।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
::: http://www.bdeduarticle.com
::: http://www.facebook.com/profile.php?id=614262553/
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
আপনার এই সিরিজটা খুব ভালো লাগছে গৌতম । আর পর্বের অপেক্ষায় রইলাম ।
---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !
---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !
ধন্যবাদ, সুমন সুপান্থ। কালকেই হয়তো পরের পর্বটা আসবে।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
::: http://www.bdeduarticle.com
::: http://www.facebook.com/profile.php?id=614262553/
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
এই সিরিজের প্রথম পাঠক আমি অতলান্ত স্মৃতির শহর ঘিরে যে উচ্চারণ তা সত্যি আমার শৈশব স্বাদ দিল এবং চেতনাকে নাড়াল কিছুটা হলেও। নদীর বালু ভাঙ্গা পথে যেতে যেতে কখনও কি ভেবেছি এমন-ইতিহাস! নাহ, মনে পড়ে না। সুন্দর আগামীর পাঠক হলাম।
মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান.....
অসংখ্য ধন্যবাদ অম্লান অভি। আপনার মন্তব্য পেয়ে খুবই ভালো লাগলো। উৎসাহ পেলাম।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
::: http://www.bdeduarticle.com
::: http://www.facebook.com/profile.php?id=614262553/
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
যথারীতি সৈন্দয্য।
এই লেখাটা উপেক্ষা করাও পাপ হতো কি?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
যৌনদুর্বলতায় ভুগছি দীর্ঘকাল। দুর্বল হয়ে পড়ি রূপময়ী নারী দেখলেই...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
মানুষকে উপেক্ষার আরেক নাম পাপ, কিন্তু লেখাকে উপেক্ষার আরেক নাম পূণ্য। সন্ন্যাসি হয়েও আপনি পূণ্য থেকে বঞ্চিত হলেন। আফসোস!
ধন্যবাদ।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
::: http://www.bdeduarticle.com
::: http://www.facebook.com/profile.php?id=614262553/
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
খুব সুন্দর!
------------------------------------------
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে৷'
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
ধন্যবাদ, দময়ন্তী।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
::: http://www.bdeduarticle.com
::: http://www.facebook.com/profile.php?id=614262553/
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
নতুন মন্তব্য করুন