বন্যাযাত্রা ২

গৌতম এর ছবি
লিখেছেন গৌতম (তারিখ: শুক্র, ০৩/০৮/২০১২ - ৬:২৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৩. নুনখাওয়া ইউনিয়নে ঢোকার রাস্তাটা বেশ সরু। মাঝখানে আবার একটি কালভার্ট ভেঙ্গে আছে। কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি হয়েছে, রাস্তার অবস্থা যাচ্ছেতাই। এক ভ্যানওয়ালাকে অনেক অনুরোধ করলাম, পাত্তাই দিলো না! আগেরদিন এরকম রাস্তায় বাটার জুতা পায়ে দিয়ে বেড়াতে গিয়ে নাকাল হয়েছি, রাতে কুড়িগ্রাম ফিরে ২৯০ টাকায় জুতা কিনলাম-বাটা, রবারের জুতা! তারপরও কয়েকবার মনে হলো আছাড় খেতে খেতে বেঁচে গিয়েছি; অথচ ছোটবেলায় এর চেয়েও কঠিন রাস্তা দাবড়াতাম খালি পায়ে! শহর আর গ্রামের মানুষের ফারাকগুলো এরকম ছোট ছোট, কিন্তু পরিমাণে অনেক।

১৪. মানচিত্র অনুসারে কুড়িগ্রামের রাজীবপুর ও রৌমারী উপজেলা সবচেয়ে দুর্গম। ব্রহ্মপুত্র নদ, ধরলা আর দুধকুমারের সমস্ত শাখা-প্রশাখা এই চিলমারী পার হয়ে রাজীবপুরে এমনভাবে মিশেছে যে, ওখানে নদীর স্রোত, বিস্তৃতি আর ভয়াবহতা অনেক বেশি। সে অনুযায়ী চরের পরিমাণও অনেক। অত্যধিক চরের কারণে রাজীবপুরের নামই নাকি চর রাজীবপুর! চিলমারীর ঘাটে নেমে অনেক দরদাম করে একটা ট্রলার ঠিক করলাম, আপাত গন্তব্য রাজীবপুর সদর। সেখান থেকে কোদালকাঠি এবং অষ্টমিরচর।

১৫. নৌকার মাঝির সাথে আলাপে বুঝা গেলে তিনি অনেক দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি। কথাটুকু স্বীকার করলে মাঝি অনেক খুশি হন, আমরাও তাই চটজলদি স্বীকার করে নিলাম যে, তাকে দেখলেই দক্ষ ও অভিজ্ঞ মনে হয়। সেই সঙ্গে আশাপ্রকাশ করলাম যে, তিনি থাকতে এই নৌকাযাত্রায় আমাদের কোনোই সমস্যা হবে না। আর বলতে বলতেই ঘটাং‍! কী হলো? ডুবোচরে ট্রলার আটকে গেল ঘট্ করে। আর একটু পর শুনি ট্রলারের পাখা নাকি ভেঙ্গে গেছে!

১৬. নানা ঝামেলা করে রাজীবপুরে পৌঁছলাম। সত্যি বলতে কি, ব্রহ্মপুত্র নদের বিস্তার এই এলাকায় এতো বেশি যে, ভয়ই লাগে। সাতার জানলেও খুব একটা লাভ নেই। কোদালকাঠি আর অষ্টমীরচরে কাজ করতে গিয়ে পড়লাম আরেক ঝামেলায়- এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি এতো দূর যে, রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠি। তারওপর রোজার দিন থাকাতে কিছু খাওয়ারও উপায় নাই। সব দোকান বন্ধ‍!

১৭. ফেরার পথে আমাদের মাঝি আরেক ট্রলার থেকে ট্রলারের পাখা কিনে নিল, এতোক্ষণ তিনি ট্রলার চালাচ্ছিলেন রিজার্ভ পাখা দিয়ে। নতুন পাখাটি হাতে নিয়ে দেখলাম, সহকর্মীদের জানালাম নেত্রকোনা ছাড়া মুক্তি নাই‍! কারণ পাখার গায়ে লেখা- কারখানা, জারিয়া, পূর্বধলা, নেত্রকোনা।

১৮. মাঝিকে অনুরোধ করলাম চিলমারীর বন্দরটা কোথায় চিনিয়ে দিতে। একটু আগেই আমাদের অনুরোধে মাঝি গান ছেড়েছিলেন- হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে..., কে যাসরে ভাটি গাঙ বাইয়া, আমার ভাইধনরে কইয়ো নাইয়র নিতো আইয়া...। মাঝি কিছুই বললো না, আমরা ভাবলাম ট্রলারের শব্দে হয়তো শুনতে পাচ্ছেন না, তাই আবার চিৎকার করে একই কথা বললাম। মাঝি শুধু হাত নেড়ে জানালেন- ঠিক আছে। একটু পরে সেই ডুবোচরে, যেখানে আগেরবার ট্রলার আটকে গিয়েছিল, মাঝি হুট করে নৌকা থামিয়ে দিলেন। বললেন, এটাই সেই চিলমারীর বন্দর! আমরা তো হতবাক! জানা গেল, যে চিলমারীর বন্দরকে ঘিরে আব্বাসউদ্দীন গান গেয়েছিলেন, সেই চিলমারীর বন্দর এখন ডুবোচর, হাঁটুপানি। আমরা সবাই নেমে হাঁটাহাটি করলাম ওখানে, হাঁটুপানিতেই প্রবল স্রোত; একবার ডুবোচরের তীর ভেঙ্গে প্রায় ডুবোডুবো অবস্থা আমার! কোনোমতে উঠে এলাম! ভেজা প্যান্ট শুকিয়ে গেল ট্রলারে ছাদে।

১৯. ইফতার হলো ট্রলারের ছাদে। ইফতার শেষ করার পর মাঝি আবার সেই আব্বাসউদ্দীনের গান ছেড়ে দিলেন! কোনো মানে হয়!

২০. কুড়িগ্রামের চরের মানুষগুলো বোধহয় এমনই। ডুবোপানিতে থাকতে থাকতে অভ্যস্ত। শুকনোর দিনে নিকটবর্তী শহরে হেঁটে যেতে সময় লাগে ঘণ্টা দুয়েক। সমস্ত নাগরিক সুযোগ-সুবিধা-বঞ্চিত এই মানুষগুলো যেভাবে থাকে, সেই তুলনায় নিজেকে বিল গেটসের চাইতেও ধনী মনে হয়! যে শিশুটিকে দেখে আসলাম ওখানে, ও জানে না ওকে দেখতে গিয়ে আমার ব্যয় হয়েছে হাজার হাজার টাকা- ওই টাকা দিয়ে হয়তো তার কয়েক ক্লাশ পড়া হয়ে যেত। যে পুরুষটিকে দেখে এলাম ভেজা কাপড়ে হেঁটে যাচ্ছে ওবাড়ি- এরকম একটা নৌকা থাকলে হয়তো তার ভাগ্য অনেকখানি বদলে যেত! আমরা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে হা-হুতাশ করি; অনেকে তো জানেই না আমাদের এই ‘স্বাচ্ছন্দ্য’-এর সত্যিকারের মানে কী?


চরবাসীদের জীবন! বাড়িঘর ভেঙ্গে নিয়ে সন্ধান করতে হয় নতুন চরের!

২১. কুড়িগ্রামের বাসন্তীকে কে না চেনে! তিনি সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন অসংখ্যবার; কিন্তু তাতে তাঁর ভাগ্য কতোটুকু বদলেছে? প্রতিবার বন্যা হয়, দুর্যোগ হয়; যে ত্রাণ আসে- সেখান থেকে বাসন্তীকেও কিছুটা দেয়া হয়। তাতে সবারই সুবিধা- বাসন্তীর দারিদ্র্যকে পুঁজি করে প্রচার পাওয়া যায়। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে বাসন্তী সেই বাসন্তীই থেকে যান! চিলমারীর ঘাটে এক ভদ্রলোক বলছিলেন একটু ভিন্ন কথা- তখনকার স্থানীয় নেতৃবৃন্দ নাকি যুক্তি করে বাসন্তীকে জালের শাড়ি পড়িয়েছিল! তাতে সায় ছিল অনেকের- এলাকার হোমড়াচোমড়াদের। এক বাসন্তীকে দিয়ে যদি এলাকায় কিছু ত্রাণ বেশি আনা যায়, তাতে ক্ষতি কী! - শুনে স্তব্ধ হয়ে যাই! সত্যিমিথ্যা জানার সুযোগ কম, কিন্তু ভদ্রলোক বললেন তার কথাটাকে একেবারে ফেলে না দিতে।

২২. কুড়িগ্রাম থেকে ফেরার মন কিছুটা বিষণ্নই। বহুবার বহুজায়গায় বলেছি এই ঢাকা আমার ভালোলাগে না- থাকতে হয় তাই আছি। ঢাকার বাইরে কোথাও গেলে তাই যেমন আনন্দে উৎফুল্ল হই, ফেরার পথে তেমনই বিপরীত অনুভূতি ভর করে। এ পর্যন্ত সম্ভবত ৫০০-এর বেশি উপজেলাতে আমার যাওয়া হয়েছে- একেকটি একেকরকম; কিন্তু এই ঢাকা আমার কাছে সবসময়ই একরকম- বিরক্তিকর!

২৩. কুড়িগ্রাম এবং লালমনিরহাটবাসীর সবচেয়ে বিরক্তিকর জায়গাটার নাম সম্ভবত তিস্তা সেতু। বহুবছরের ব্যবহারে অতিজীর্ণ এই সেতুটি নিরাপদ তো নয়ই, এটি অনেক সময়ও খেয়ে নেয়। সেতুটি একইসাথে রেল ও সড়ক সেতু। রেলগাড়ি আসলে অন্তত আধাঘণ্টা বসে থাকতে হয়। তারপর যে কোনো এক পাড়ের যাত্রীদের পর করে দিয়ে তারওপর পাড় হতে হয় অন্য যাত্রীদের। অথচ নতুন তিস্তা সড়ক সেতু তৈরি হয়ে আছে, সংযোগ সড়কের কাজও শেষ সেই কবে! এটা নাকি উদ্বোধন হচ্ছে না শুধু প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের সময় দিতে পারছেন না বলে। এ দেশে সব সম্ভব না হলেও অনেক কিছু যে সম্ভব, তা আর বলতে‍!


বামে দূরে: নতুন তিস্তা সড়ক সেতু, শুধু উদ্বোধনের অপেক্ষায়। ডানে: তিস্তা সড়ক ও রেলসেতু, বুকে শিহরণ, স্যরি কাঁপন জাগায়

২৪. শেষ পর্যন্ত এটি কোনো লেখা হলো কিনা কে জানে! হয়তো পড়তে গিয়ে আপনাদের খামোকা কিছুটা সময় নষ্ট হলো‍! লিখতে চেয়েছিলাম কিছু অনুভূতি, কিন্তু সম্ভবত হালকাপাতলা বর্ণনার বাইরে আর কিছুই হলো না! অনুভূতিও আজকাল প্রকাশ হতে চায় না-যেটুকু হয় তাকে পরীক্ষার রচনা বলে চালিয়ে দেয়া যায়; জীবনের ঘ্রাণ সেখানে পুরোপুরিই অনুপস্থিত! (শেষ)

বন্যাযাত্রার প্রথম পর্ব পড়তে পারেন এখান থেকে।


মন্তব্য

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

পড়ে খুবই ভালো লাগলো। এত চমৎকার করে অনুভূতিগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন! শেষ হয়ে গেল বললেই তো হয় না, নতুন জায়গা নিয়ে এরকম ব্লগ চলুক। এরকম লেখায় প্রাণ আছে।

গৌতম এর ছবি

ধন্যবাদ পিপিদা। নতুন জায়গায় গেলে অবশ্যই কিছু একটা লেখার চেষ্টা করবো। আপনার মন্তব্য পেয়ে উৎসাহবোধ করলাম।

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

স্যাম এর ছবি

আমার তো পড়তে ভীষন ভাল লাগল! ছুয়ে গেল অনেক জায়গায় --- বন্যাযাত্রা চলুক।

গৌতম এর ছবি

পড়ার জন্য আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

কিন্তু এই ঢাকা আমার কাছে সবসময়ই একরকম- বিরক্তিকর![/quote

একদম আমার মনের কথাটি বলেছেন গৌতম।

আপনার জীবন থেকে নেওয়া অভিজ্ঞতার বর্ননা সত্যিই অসাধারন। এরকম লেখা আরও আসুক। চলুক

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

গৌতম এর ছবি

ধন্যবাদ রাতঃস্মরণীয় দা। হাসি

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

পথিক পরাণ এর ছবি

লেখা আগের পর্বের মতই সুখপাঠ্য।

বাসন্তী সংক্রান্ত তথ্যটি আমিও ঐ ভদ্রলোকের বর্ননার আদলে জেনেছি।

অথচ নতুন তিস্তা সড়ক সেতু তৈরি হয়ে আছে, সংযোগ সড়কের কাজও শেষ সেই কবে! এটা নাকি উদ্বোধন হচ্ছে না শুধু প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের সময় দিতে পারছেন না বলে। এ দেশে সব সম্ভব না হলেও অনেক কিছু যে সম্ভব, তা আর বলতে‍!

ইয়ে- তিস্তা সড়ক সেতুটির নির্মান প্রকৃয়া শুরু হয়েছিল ২০০৫-০৬ সালের দিকে। টেন্ডার, অর্থবরাদ্দ হাবিজাবি মিলিয়ে এবং বছর বছর এর নির্মান খরচ বাড়িয়ে বাড়িয়ে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি ২০১২ সাল অর্ধেক পার করে ফেলেছে। সেতুটির কাজ কিন্তু খুব বেশিদিন আগে শেষ হয়নি।

গৌতম এর ছবি

এলাকাবাসীর মতে, মাস কয়েক আগে সেতুটির কাজ শেষ হলেও এখন উদ্বোধন হচ্ছে না কেবল প্রধানমন্ত্রী সময় দিতে পারছেন না বলে। কবে উদ্বোধন হবে তাও জানা নেই কারো। এলাকাবাসীকে দীর্ঘদিন ধরে এই সেতুটির জন্য নানান দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে; সে কারণে হয়তো সেতুটি নির্মাণ হওয়ার পর একটি দিন বেশি দুর্ভোগ তাদের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠছে।

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

ভালো লাগল পড়তে। অনেকদিন বাংলাদেশে ফিরে গেলাম।

গৌতম এর ছবি

ধন্যবাদ মুর্শেদ ভাই।

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

অতিথি লেখক এর ছবি

জীবনটা যে প্রতিদিনের যুদ্ধ, প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকাটা যে শুধু অভ্যস্থতা নয় তা বৈচিত্র্যময় জীবনধারায় বুঝা যায়। নাগরিক জীবনটা বড় বেশী একঘেয়ে, যদিও আমরা নিজেরাই এই জীবন বেছে নিয়েছি। ভাল লাগছিল এত দ্রুত শেষ করে দিলেন কেন?

জুঁই মনি দাশ

গৌতম এর ছবি

দ্রুত শেষ হয়ে গেল! অ্যাঁ

আমি তো ভাবছিলাম অনেক বড় লেখা লিখে ফেলেছি!

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

আশরাফুল কবীর এর ছবি

হালকাপাতলা বর্ণনার বাইরে আর কিছুই হলো না! অনুভূতিও আজকাল প্রকাশ হতে চায় না-যেটুকু হয় তাকে পরীক্ষার রচনা বলে চালিয়ে দেয়া যায়; জীবনের ঘ্রাণ সেখানে পুরোপুরিই অনুপস্থিত!

#আসলে দারুন লেখা হয়েছে, খুব সুন্দর অনুভূতির উন্মোচন করেছেন, অনুভূতিতে মিশে গেলো। ভাল থাকুন সবসময় উত্তম জাঝা!

গৌতম এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। হাসি

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

মুস্তাফিজ এর ছবি

ভালো লেগেছে

...........................
Every Picture Tells a Story

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।