ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পর্ব-২।

জাহিদ হোসেন এর ছবি
লিখেছেন জাহিদ হোসেন (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৮/১১/২০০৭ - ১১:২৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সে অনেক আগের কথা। তখোন আরবের লোকেরা গুহায় বাস করিত।
একটি ছোট শহরের মায়া কাটিয়ে ঢাকায় এলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এলাম। চোখে হাজারো স্বপ্ন, মনে লাখো আশা।
প্রথম সমস্যা থাকবো কোথায়? সায়েন্স এর ছাত্র হওয়া বিধায় তখন ফজলুল হক হল অথবা শহিদুল্লাহ হল এদুটোর যে কোন একটাতে থাকতে হবে। গেলাম হল অফিসে। বললাম, সিট চাই। অফিসের কেরানী গোলগোল চশমার উপর দিয়ে জুল জুল করে তাকালেন আমার দিকে।
"সিট চাই? কোন ইয়ার?"
"ফার্স্ট ইয়ার।"
সেকথা শুনে ভদ্রলোক বাংলা সিনেমার ভিলেন স্টাইলে একখানা অট্টহাসি দিলেন। আমি বেকুব হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
"ফার্স্ট ইয়ারে সিট চাও? মাথা-টাথা ঠিক আছেতো?"
তারপর তিনি যেটা বললেন তার সারমর্ম হচ্ছে এই যে আগামী দু বছরের মধ্যে নিজের ঘর পাবার কোনই সম্ভাবনা নেই আমার। কারো সাথে ডাবলিং করার পরামর্শ দিলেন তিনি। ডাবলিং জিনিসটা কি তাইই বুঝিনা তখন।
যাই হোক, শেষমেশ দুর সম্পর্কের এক ভাইয়ের রুমে উঠলাম। তিনি থাকেন জহুরুল হক হলে। কি আর করা? প্রতিদিন কুড়ি মিনিট হেঁটে কার্জন হলে ক্লাশ করতে যাই, কেননা রিক্সাভাড়া প্রায় দিনই থাকেনা।

এরই মাঝে শুরু হোল ক্লাশ। ছাত্রদের বেশীর ভাগই ঢাকার, অতএব তারা আমাকে পাত্তা দেয়না। একা একাই ঘোরাঘুরি করি। মাঝে মাঝে সুনীলের কবিতার পংক্তিটি আওড়াই, "বাবা বলেছিলেন, দেখিস একদিন আমরাও---।"

ঢাকায় আসবার আগে শুনেছিলাম, অনার্স হচ্ছে তিন বছরের ক্লাশ। পরীক্ষা হবে তৃতীয় বছরের শেষে। যিনি এই তথ্যটি আমাকে দিয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন, "প্রথম বছরে ক্লাশে না গেলেও কোন সমস্যা নাই, তবে মাঝে মাঝে স্যারদেরকে চেহারা দেখানোর জন্য যাওয়া ভাল। দ্বিতীয় বছরে বই-টই কিনবে, আর তৃতীয় বছরের ছ'মাস গেলে পড়তে বসবে। এতেই যা রেজাল্ট হবে তাই খায় কে?"

আমি মুরুব্বীর উপদেশ মেনে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াই। ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি পড়ান জয়েনুদ্দিন স্যার। তাঁকে বাঘ বললে ছোট করা হবে। মোটাসোটা মানুষ, গায়ের রং শ্যামবর্ণ (স্যারকে কালো বলি কিভাবে?), অল্প পান খেতেন, গলার স্বর না তুলে কথা বলতেন। কিন্তু তাতেই ছেলেমেয়েরা ভয়ে থরহরি কম্প।

স্যার ক্লাশে পড়ান কোয়ান্টাম মেকানিক্স, স্রোয়েডিংগার ইকুয়েশন,পলি'র এক্সক্লুশন প্রিন্সিপল, আরো কত গালভরা কঠিন কঠিন সব নাম। কিছুই বুঝিনা, মাথা নীচু করে খাতায় আবোল তাবোল লিখি। আর মাঝে মাঝে ঘড়িতে সময় দেখি। একদিন সেটা স্যারের নজরে পড়লো।
"এই ছেলে, দাঁড়াও।"
কান-টান লাল হয়ে গেল আমার। সবার সামনে, বিশেষত: মেয়েদের সামনে এ বড় অপমানের ব্যাপার।
"আমার ক্লাশে বসে সময় দেখবেনা আর কোনদিন। ভাল না লাগলে বেরিয়ে যাবে। দুষ্ট গরুর চেয়ে----।"

এত লজ্জা জীবনে আর কখনো পাইনি।

মাসখানেক পর স্যার ক্লাশে ঘোষণা দিলেন, পরের সপ্তাহে পরীক্ষা। আমি তো সাত হাত পানির নীচে। পরীক্ষা, মানে? পরীক্ষা তো হবে সেই তিন বছর পর। এখন আবার পরীক্ষা কিসের?

সংকোচ ভুলে পাশের ছেলেকে শুধালাম। সে বললো, "এটা মিড-টার্ম পরীক্ষা।"
আমি মিনমিন করে বললাম, "আমিতো জানতাম যে পরীক্ষা-টরীক্ষা সব হবে তিন বছরের শেষে।"
সে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়। "ও সব তো বহু আগের কথা। এখন আমরা কোর্স সিস্টেমে পড়াশুনা করি।"

মাথায় বজ্রাঘাত। এসব কি শুনছি? সাতদিন পর পরীক্ষা। আমারতো বই ই কেনা হয়নি।

পরীক্ষার দিন প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে চোখে পানি এলো। প্রশ্নই বুঝিনা, তার জবাব কি দেব? মেরুদন্ড দিয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল। আমার স্বপ্ন, আমার আশা, মিলিয়ে গেল শূণ্যে।

সে পরীক্ষায় কোনমতে পাশ করেছিলাম। কি ভাবে তা আজও আমার কাছে একটি রহস্য।

জয়েনুদ্দিন স্যার আমার কাছে একটি বিভীষিকা হয়েই রইলেন কোর্সের বাকী সময়টা ধরে। তার ক্লাশে যাবার আগে ঘড়িটা হাত থেকে খুলে পকেটে রাখি। কে জানে কখন আবার ভুলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ফেলি। স্যার তখন আরো দুরূহ সব সমীকরণ দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ড ভরিয়ে ফেলছেন প্রতিদিন। তার ভয়ে রাতে ঘুম আসেনা।

যাই হোক, একদিন শেষ হোল কোর্স। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম আমি।

কিছুদিন পর শুনলাম স্যার আমাদের বিভাগ ছেড়ে অন্য বিভাগে চলে যাচ্ছেন। যাকগে-আমার কি?

এর দু-তিন বছর পরের কথা। ততদিনে আমি জহুরুল হক হলের ডাবলিং করার পাট চুকিয়েছি। হলে সিট পেয়েছি, রুমমেটরাও ভাল। প্রতি রাতে তাস খেলি, যে হারবে সে পরদিনের চা-নাস্তার খরচ দেবে। জীবন মধুময়।

এমনি এক সময় হঠাত বিশ্ববিদ্যালয়ে গন্ডগোল হোল। গুলী চললো দুই ছাত্র সংগঠনের মধ্যে। যে যেদিকে পারে দৌড়াচ্ছে, টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চারদিক। ঘোষণা হোল, বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ, সন্ধ্যার আগেই হল ছেড়ে দিতে হবে।

মাথায় বাজ পড়লো। এমনতো কথা ছিল না। এখন কোথায় যাবো? বিশ্ববিদ্যালয় কতদিন বন্ধ থাকবে? আমরা কি ঢাকা ছেড়ে বাড়ী চলে যাবো, নাকি ঢাকাতেই থাকবো কয়েক দিন?

এক রুমমেট বললো, 'চলো, আমাদের চেয়ারম্যান স্যারের সাথে দেখা করি। দেখি তিনি কি উপদেশ দেন।"

ফুলার রোডে চেয়ারম্যানের বাসা। দরজায় বেল বাজালাম অনেকক্ষণ। এক সময় কাজের মেয়েটি এসে বললো, "বাসায় কেউ নাই।" বুঝলাম স্যার দেখা করবেন না।

চলে আসবো, এমন সময় পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে গেল। সেখানে দাঁড়িয়ে জয়েনুদ্দিন স্যার। আমার বুকের মধ্যে হিমশীতল কি যেন একটা বয়ে যায়। এর চেয়ে তো টিয়ার গ্যাস খাওয়াই ভাল ছিল।

স্যার বললেন, "ভিতরে এসো।"
স্যারের ড্রইংরুমে বিলাসিতার ছাপ নেই। কয়েকটা বেতের চেয়ার-টেবিল মাত্র।
"চা খাবে?"
মাথা খারাপ। আমরা পালাতে পারলে বাঁচি। মাথা নেড়ে বললাম, লাগবে না।
স্যার বললেন, "তোমরা বোসো। আমি চা নিয়ে আসি। তোমরা কি খেয়েছো কিছু আজকে?"

চা এলো, অন্য খাবার এলো। স্যার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনলেন আমাদের সব কথা।

পরে বললেন, "তোমাদের ঢাকায় কোন থাকবার জায়গা আছে আজকের রাতের জন্য? না থাকলে তোমরা তাড়াতাড়ি হল থেকে তোমাদের জিনিসপত্র নিয়ে আমার এখানেই আজ থাকো। কালকে পরিস্থিতি দেখে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। তোমাদের হয়তো শুতে একটু কষ্ট হবে এখানে।"

আমরা অবশ্য সেদিন থাকিনি সেখানে। চলে আসবার সময় দুজনেই চোখের পানি মুছেছি একে অন্যকে লুকিয়ে।

স্যারের সাথে এর পর আর দেখা হয়নি। জানিনা আজ তিনি কেমন আছেন, কোথায় আছেন। বেঁচে আছেন আশাকরি।

আজ আমি তাঁকে স্মরণ করছি। কোয়ান্টাম মেকানিক্স, স্রোয়েডিংগার ইকুয়েশন,পলি'র এক্সক্লুশন প্রিন্সিপল কিছুই মনে নেই আজ। শুধু মনে আছে তাঁর মায়াভরা কথাগুলো, মনে আছে ভয়ার্ত দুটি ছেলেকে আশ্রয়দানের কথা।

শ্রদ্ধেয় জয়েনুদ্দিন স্যার, আপনার কথা আজ আমার খুব মনে পড়ছে। জানিনা, আপনি এখন কোথায় আছেন, তবে কামনা করি ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন।

আমি আপনার কাছেই সেদিন জীবনের একটি জিনিস শিখেছিলাম। বিপদে পড়া মানুষকে সাহায্য করা আমাদের ধর্ম। সে শিক্ষা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের চাইতে অনেক বড়।


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

ড্যাবস !
মহামান্য অতিথি লেখক, আপনার নাম জানিনা তাই নাম ধরে সম্বোধন করতে পারছিনা । ভালো লাগছে ভীষন আপনার লেখা । পুরোটা লেখুন ।
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

ভাল লাগার কথাগুলো এমনভাবে বললেন যে চোখে পানি এসে গেল।

সুধীর এর ছবি

রসায়নের শিক্ষকরা বোধ হয় বরাবরই এমন সজাগ থাকতেন ক্লাসে। আমার রসায়ন না থাকলেও অনেক সময় বিরাট ক্লাসে বন্ধুদের সাথে বসে থাকতাম, এবং বিরক্তিতে ঝিমাতাম। অবশ্য এ বিষয়ে আমি আগেই বিভাগীয় হেড স্যারের অনুমতি নিয়ে রেখেছিলাম।একবার এক কড়া শিক্ষক বেছে বেছে আমাকেই একটা জটিল প্রশ্ন করে বসলেন। সবাই জানত আমার রসায়ন নেই,তাই সকৌতুকে আমাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল, মেয়েরাও ঘাড় বাঁকিয়ে। সৌভাগ্যক্রমে আমি উত্তরটা জানতাম, তিনি শুনে খুব বিমর্ষ বোধ করলেন, বন্ধুরাও একটা মজা থেকে বঞ্চিত হলো। আরেকবার আরেক শিক্ষক তাঁর সদ্য দেওয়া লেকচার ছাত্ররা শুনেছে কি না পরীক্ষা করতে প্রশ্ন করলেন। অনেকেই বই দেখে ঠিক উত্তরটাই দিল, কিন্তু তিনি একটু ভিন্নভাবে একটা টার্ম ব্যবহার করেছিলেন, সেটা তারা ব্যবহার করছিল না, তাই তিনি সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। তিনি যখন যুদ্ধ জয়ের আনন্দ সংঙ্গীত ক্লাসকে শোনাতে উদ্যত, তখনও এই বান্দাকেই উঠে দাঁড়িয়ে ক্লাসের মুখ রক্ষা করতে হয়েছিল।

এখন মনে হয় তখনই বোধ হয় বেশি স্মার্ট ছিলাম। 'পুরনো সেই দিনের কথা ...

আমার একটু খটকা আছে প্রথম বর্ষে মিড-টার্ম পরীক্ষার আগে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের শ্র্যোডিঙ্গার সমীকরণ আলোচনা সম্পর্কে। এটা এক সময় হুমায়ুন আহমেদ কোয়ান্টাম কেমিস্ট্রি ক্লাসে পড়াতেন। আরো উঁচু ক্লাসে। আর ৭৪ সালেই কোর্স পদ্ধতি প্রবর্তন হয়, বাৎসরিক ফাইনাল পরীক্ষা আর মিড-টার্ম সমেত। ভর্তি হওয়ার সময়েই এই বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া হতো, এবং পরেও সারাক্ষণ।
ব্লগের জয়েনুদ্দিন নামে কোন শিক্ষকের কথা আমার জানা নেই।

অতিথি লেখক এর ছবি

সুধীর-আপনার অনুমান সত্য। আমি আমার প্রতিটি লেখাতেই চরিত্রগুলোর আসল নাম বদলে দিয়েছি। তবে যে নামগুলো ব্যবহার করেছি সেগুলোর সাথে চরিত্রটির আসল নামের সাদৃশ্য আছে।

-নির্বাসিত
_______________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

হিমু এর ছবি
হযবরল এর ছবি

ভাল্লাগলো খুউব।
আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছি তখন আরববাসীরা গুহা ছেড়ে, গুয়ানতানামো বাস শুরু করেছে। তবে সে ও অনেককাল আগের কথা।

দ্রোহী এর ছবি

ভালো লাগলো লেখাটা।


কি মাঝি? ডরাইলা?

সাইফ তাহসিন এর ছবি

জাহিদ ভাই, আপনার ২য় পর্ব পড়ে আমার মত গাড়ল পাষন্ডের ও চোখ কড়কড় করতে লাগল, অনুভূতির জড় ধরে এমন টান দেন আপনে, কোন তুলনা হয় না
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদ্বপি গরীয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।