খুব সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা প্রসঙ্গটি হঠাত্ করেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতা-বিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিকে কেন্দ্র করে নানা কথাও উঠে আসছে। এইবার এ ব্যাপারে অভিযোগের তীর যাদের দিকে সরাসরি অনেক দিন ধরেই সেই নিজামী-মুজাহিদ গং হঠাত্ করেই শেখ মুজিবের একটা কাজকে ধ্রুব ধরে নিয়েছে। সেটি হলো: শেখ মুজিব সাধারণ ক্ষমা করেছেন বলে দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। বর্তমান সরকার এ নিয়ে কী ব্যবস্থা নেবেন, সে নিয়ে কথা বলতে যাবার ঝক্কি অনেক। আপাততঃ বরং আমরা বিষয়টিকে পুরানো আঙ্গীকেই নতুন করে দেখি। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল একটি জাতীয় সরকার গঠিত হয়িছলো। এই সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার একটি ঘোষণা পত্রও প্রনয়ন করে, যেটি কি না বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রশ্নে প্রথম নথি। স্বাভাবিকভাবেই সেটিকে অস্বীকার যারা করেছেন, তারা বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রটির যেকোনো ধরণের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছেন। এই প্রক্রিয়ার ভেতরে হয়তো রাজনীতি ছিলো, নিরাপদে থাকার মানসিকতা ছিলো, সুবিধা লাভের আশা ছিলো, কিন্তু বিরোধীদের সবার মধ্যেই বাংলাদেশের বিরোধীতা ছিলো। যাকে আমরা বলতে পারি, সাধারণ প্রবণতা। এখন এই সাধারণ প্রবণতা যারা ধারণ করেছেন, তারা সবাই যে নরহত্যা চালিয়েছেন, তা কিন্তু নয়। এদের মধ্যে বেশিরভাগ হয়তো তা করেছেন। কিন্তু এরা সবাই রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছেন, এটা তো অনস্বীকার্য।
মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স
রাওয়ালপিন্ডি, ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
পাকিস-ান সরকার
নং৪/৮/৫২/৫৪৩ পি এস-১/ক/৩৬৫৯/ডি-২ক
১৯৫২ সালের পাকিস-ান আর্মি এ্যাক্ট (এ্যাক্ট নং ৩৯/১৯৫২) এর ৫ নং ধারার (১ এবং ৩ উপধারা) প্রদত্ত ক্ষমতাবলে কেন্দ্রীয় সরকার সন'ষ্টির সঙ্গে নির্দেশ প্রদান করিতেছি যে,
(ক) উক্ত আইনে সমস- ধারাসমূহ, যতদূর সম্ভব, পূর্ব পাকিস-ান রাজাকার অধ্যাদেশ ১৯৭১( পূর্ব পাকিস-ান অধ্যাদেশ নং ১০/১৯৭১) এর অধীনে সংগঠিত রাজাকারদের প্রতি প্রযোজ্য।
(খ) পাকিস-ান সামরিক বাহিনীর অফিসার যাহার অধীনে কোন রাজাকারকে ন্যস- করা হইবে, তাহার সম্পর্কে তিনি পাকিস-ান সামরিক বাহিনীতে ন্যস- সদস্যদেরপ্রতি যে ক্ষমতা প্রয়োগ করিবার অধিকার তদ্রূপ ক্ষমতা প্রয়োগ করিবেন।
-ওপরের এই অংশটি পাকিস্তান সরকারের গেজেট নোটিফিকেশন, যেখানে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এই বিরোধীদের মধ্যে যারা অগ্রগামী ও নেতৃস্থানীয়, তাদের আইন করে গণহত্যা আর লুটের পথ সুগম করে দেয়া হয়। যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কী ক্ষমতা ছিলো, যা রাজাকরদের ওপরও প্রয়োগ করার আইনের দরকার পড়লো। তা কিন্তু কিছুই নয়, জাতিকে নিৰশেষ করে দেয়া। এখন যারা মুক্তিযুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ বলে হাজির করতে চান, তারা কি বলবেন, কী কারণে তাদের সেই কথিত গৃহযুদ্ধের নায়করা পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে আইনের মাধ্যমে একীভূত হয়ে গেলো?
এই গৃহযুদ্ধের তত্ত্বকার ও তাদের জাতভাইরা পাকিস্তান সরকারের বেতনভোগীও ছিল। তাদের জন্য নির্দিষ্ট পোশাক ছিলো এবং তারা মাসে ১৫০ টাকা বেতন নিত পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে।
তাহলে একটা বিষয় বুঝতে হবে পাকিসত্দান রায় লড়াই করাই তাদের একমাত্র ল্ক্ষ্য ছিলো না। ছিলো আরো পরিস্কার ল্য। আর সেটি হলো ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে সহজ পথে শোষক হওয়া। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সেই ফরমান আর পৃষ্ঠপোষকতা তাদের এ পথে যাত্রাকে সহজতর করে দেয় এবং সেটা শুরু হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়্dই। মতিউর রহমান নিজামী সেই সময় পাকিসত্দান ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন। আজাদী দিবস উপল্যে আয়োজিত ছাত্র সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, পাকিসত্দান শুধু কোনো ভূখণ্ড নয়, একটি আদর্শের নাম। ইসলামী আদর্শের প্রেরণাই পাকিসত্দান সৃষ্টি করেছে এবং সেই আদর্শই পাকিসত্দানকে টিকিয়ে রাখতে সম। এরপর তিনি ইসলামপ্রিয় ছাত্র সমাজ বেঁচে থাকা পর্যনত্দ পাকিসত্দান টিকে থাকবে বলে উল্লেখ করেন। নিজামীর এই বর্ক্তৃতা প্রকাশিত হয় 1971 সালের 16 আগস্টের দৈনিক সংগ্রামে। অর্থ্যাৎ পাকিসত্দান রাষ্ট্রকে রা করতে হবে কারণ ধর্ম নিয়ে রাজনীতির পথ সুগম করতে হবে। নিজামীর ইসলামপ্রিয় ছাত্র সমাজ যদি তখন হয় ইসলামী ছাত্র সংঘ তাহলে তাদের উত্তরসুরী ইসলামী ছাত্র শিবির তো আজো টিকে আছে। তবে সেই পাকিসত্দান টিকে নেই। তারা দাবি করেন, ইসলামী আদর্শ তারা এখনো টিকিয়ে রেখেছেন। তারা সেই আদর্শের প্রেরণা দিয়ে কী সৃষ্টি করতে চান সেটিই কিন্তু এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়িয়েছে। 5 আগস্ট দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, চট্টগ্রামের এক সুধী সমাবেশে বর্ক্তৃতা করতে গিয়ে মীর কাশিম আলী বলেন, পাকিসত্দানের বুকে ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমেই একে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। মানে ভীষণ সোজা, রাজনীতিটা আসলে হবে ধর্ম নিয়ে এবং সেখানে ইসলামী শাসনব্যবস্থা বলে একটা ব্যবস্থা চালু করে নিজেদের সেই সিস্টেমের মাতব্বর বলে জাহির করা হবে, যাতে শোষণের পথটা পরিস্কার হয়। প্রকৃত ধর্ম সেখানে কতোটুকু উপস্থিত থাকবে আসলে মূখ্য বিষয় সেটিও নয়। ধর্মীয় আইন, না জানি সেটা কী! বাংলাদেশের মানুষের এই ভাবনার সুযোগ নেয়াটাই মুখ্য। 1971 সালের 6 জুন জামাতের আমীর সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী পাকিসত্দানের প েসাফাই গেয়ে এক বিবৃতি দেন। দৈনিক পাকিসত্দান পত্রিকায় সেটি ছাপা হয় পরদিন 7 জুন। এতে মুক্তিযুদ্ধকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইসলামী শিায় শিতি নয় বলেই এক শ্রেণীর চরমপন্থী পাকিসত্দানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরানো বন্ধু পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যারা কাজ করেছে, তারাও তো পুরানো বন্ধুই, না কী বলেন?
1971 সালের 25 সেপ্টেম্বর হোটেল এম্পায়ারে সদ্য গঠিত মন্ত্রিসভায় জামাতের দুই নেতা প্রাদেশিক শিামন্ত্রী আব্বাস আলী খান ও রাজস্ব মন্ত্রী মাওলানা একেএম ইউসুফ স্থান পাওয়ায় জামাত তাদের সংবর্ধনা দেয়। এই সংবাদটি পরের দিন 26 সেপ্টেম্বর দৈনিক পাকিসত্দানে ছাপা হয়। এতে জামাতের আমীর গোলাম আজম বলেন, জামাতে ইসলামীর কর্মীরা মুসলিম জাতীয়তাবাদকে বিসর্জন দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মেনে নিতে রাজী না। যে উদ্দেশ্য নিয়ে জামাত রাজাকার বাহিনীতে লোক পাঠিয়েছে, শানত্দি কমিটিতে লোক পাঠিয়েছে সেই একই উদ্দেশ্যে জামাত মন্ত্রিসভায় লোক পাঠিয়েছে।
এখন উদ্দেশ্য যাই হোক, প্রকাশ্যে রাজাকার-আলবদর বাহিনীকে নেতৃত্ব দেয়ার ইতিহাস তো আমরা জানি। যুদ্ধাপরাধের মধ্যে জেনসাইড বা গণগত্যাই হলো চরমতম অপরাধ। ১৯৪৮ সালের গৃহীত জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, জেনসাইড বা গণহত্যা হলো: “কোন জাতিগত,ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীল অঅংশিক বা সমগ্র জনমন্ডলিকে ধ্বংস করারর উদ্দেশ্যে সেই জাতির সদস্যদের হত্যা করা, শারীরিক ও মানসিক ভাবে ভীতসন্ত্রস- করা এবং তাদের জীবন ধারনের উপায়ের উপর মারাত্মক ক্ষতিসাধন করা।” জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে জেনেভায় ২৯তম অধিবেশনে বেশ কিছু নীতিমালা ও প্রস-াব গ্রহন করেছিল। তাতে বলা হয়েছে: যে হাজার হাজার বাঙ্গালী নির্যাতন কক্ষে যন্ত্রনা ভোগ করেছে, নির্যাতনে যারা প্রাণ হারিয়েছে, তাদের লাখ লাখ বিধবা ও এতিম সন-ান এবং যারা বেঁচে গেছে তাদের এটা আশা করার অধিকার রয়েছে যে, যারা এই ঘৃণ্য অপরাধের জন্য দায়ী, তারা যেন বিচার থেকে রেহাই না পায়। এই অধিবেশনের প্রস-াবের তৃতীয় অনুচ্ছেটিতে বিশেষ ভাবে বলা আছে: “অপরাধীদের বিচার করার অধিকার এবং কর্তব্য বাংলাদেশের আছে।” মানবাধিকার কমিশনের ঐ ২৯তম অধিবেশনের ঘোষণায় আরো বলা হয়েছে : “যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ যখন এবং যেখারেন সংঘটিত হবে, তার জন্য তদন- চলবে এবং কোন ব্যক্তি এ অপরাধ করেছে বলে প্রমাণ থাকলে তাকে গ্রেফতার করা, তার বিচার করা এবং দোষী প্রমানিত হলে তাকে শাসি- দেয়া যাবে। কোন লোক যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সম্পাদ করেছে বলে প্রমাণ থাকলে সে বিচার আওতায় আসবে ও দোষী প্রমাণিত হলে সে শাসি- ভোগ করবে এবং সাধারণ বিধান মতে যে দেশে অপরাধ সম্পাদিত হয়েছে সেদেশেই তা হবে। আবার, বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদ মাফিক এদের বিরুদ্ধে বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করে বিচার করা যায়। কাজেই আইনের আশ্রয় নেয়ার বহু পথ এবং সবগুলোরই উপযুক্ত ভিত্তি রয়েছে। এখন যা সবচেয়ে প্রয়োজন, তা হলো, মার্কিনীদের পুরানো বন্ধু রাষ্ট্র পাকিস্তানের সেসব অকৃত্রিম স্বজনদের প্রতিটি পদক্ষেপকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা।
শিবলী নোমান
মন্তব্য
এই চমতকার লেখাটা কী করে যেন চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল।
খুব কাজের লেখা
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
নতুন মন্তব্য করুন