কোনো মানে নেই, কোনো কিছুরই কোনো মানে নেই

গৌতম এর ছবি
লিখেছেন গৌতম (তারিখ: শনি, ২৪/১১/২০০৭ - ১:৫২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি নিশ্চিত নই যে, তসলিমার জন্ম হয়েছিলো ভুল সময়ে নাকি ঠিক সময়ে। হুমায়ূন আজাদ জানতেন, তার সাহিত্যকর্ম ও ব্যাকরণকর্ম মূল্যায়িত হবে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর। তিনি নিজে তা সরোষে বলে গিয়েছিলেন- আমি কী করেছি বাঙালি তা বুঝবে আরো পঞ্চাশ বছর পর।

হুমায়ূন আজাদের মতো গতি (!) হয়নি তসলিমার। তিনি কী বলতে চেয়েছিলেন তা আমরা বুঝেছি সাথে সাথেই। কারণ হুমায়ূন আজাদের কথা বিমূর্ত, বুঝতে সময় লাগে। অনেক কথাই যে আমাদের উদ্দ্যেশ্যে বলা, সেটিই আমরা বুঝতে পারি না। কিন্তু তসলিমার সরাসরি কথা আমাদের গায়ে লাগে, আমরা টের পাই এতোদিন ধরে বেতের পাকানো যে চাবুক আমাদের হাতে আছে, তসলিমা সেটি দিয়ে দিতে চাইছেন জাদুঘরে। কিংবা তসলিমা চাচ্ছেন তার হাতেও থাকুক এমন একটি চাবুক।

আমরা সেটি মানতে পারিনি। পারিনি বলেই তসলিমাকে বেরকরে দিয়েছি দেশ থেকে। বিদেশেও যেনো শান্তিমতে না থাকতে পারে, সে চেষ্টারও কমতি করছি না।

হায় নারী! নিজের অধিকার এভাবে মুখ ফুটে বলতে আছে! তুমি না অ-বলা! তুমি কি বোঝনি তুমি জন্মেছ আমাদের সময়ে!! তুমি কি বোঝনি তুমি জন্মেছ তোমার ভুল সময়ে!!

গৌতম


মন্তব্য

দিগন্ত এর ছবি

দেখুন, যেই এখনো অবধি প্রচলিত নিয়মকানুন মেনে চলতে অস্বীকার করেছে, তার ঘাড়েই খাঁড়া নেমে এসেছে। সে ইতিহাসে আপনি দেখতে গেলে লম্বা লিস্ট হয়ে যাবে। তসলিমা আর হুমায়ুন আজাদ নাহয় লিস্টে নতুন সংযোজন।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

কালোবিড়াল এর ছবি

আমার সীমিত সাহিত্যজ্ঞান থেকে মনেকরি, তসলিমার লেখা অতি সাধারন মানের এবং মানুষকে উদবুদ্ধ করার মত বড় মাপের কোন অবদান তার কাছ থেকে বাংলা সাহিত্য পায়নি। তসলিমাকে বিখ্যাত করার পিছনে মৌলবাদিরাই সবচাইতে বড় ভুমিকা রেখেছে; হুমায়ুন আজাদের মত লেখকের সাথে তার তুলনা করার কোন অর্থ হয় না। তসলিমার সব চাইতে বড় ক্রেডিট, সে যা মনে করে তা লিখেছে, যেটা করার মত মেরুদন্ড আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের নেই। কোন পশ্চিমা দেশে, এমনকি ভারতে জন্মগ্রহন করলেও হয়তো পাড়ার অখ্যাত লেখিকা হিসাবে তার ক্যারিয়ার শেষ হ'ত।

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

আপনার সঙ্গে প্রায় সহমত। 'প্রায়' বলা এ কারণে যে,

...সে যা মনে করে তা লিখেছে...
এই কথাটি, আমার ধারণা, সত্য নয়।

নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে, যখন যাযাদি-তে লিখতেন তসলিমা নাসরিন, সেই সময় তখনও অ-পতিত এবং সে-কারণেই শ্রদ্ধেয় সম্পাদক শফিক রেহমান আমার সামনে মন্তব্য করেছিলেন তসলিমা সম্পর্কে, "She doesn't believe in what she writes". তসলিমার প্রশ্নবিদ্ধ জীবনযাপন পদ্ধতি শফিক রেহমানের কথাকে সত্যতাই দেয়।

তবে তসলিমার মত প্রকাশের অধিকার খর্ব করাটা গ্রহণযোগ্য নয় কোনওমতেই। তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হোক।

আরেকখান কথা, হুমায়ূন আজাদ আর তসলিমা নাসরিনকে এক কাতারে দাঁড় করানোর কোনও যুক্তিযুক্ত কারণ আছে বলে আমি মনে করি না।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ক্ষেত্রেই আপনার সাথে একমত। তবে তসলিমা কিছু প্রশ্ন এবং বিষয় উত্থাপন করেছে যা অন্য কেউ করতে সাহস পায়নি। তাঁর প্রশ্ন উত্থাপনের ভঙ্গিটি আমাদের ভালো নাও লাগতে পারে। সেটি আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। মাঝে মাঝে এটাও ভাবি, আমি পুরুষ বলেই হয়তো তসলিমার 'নারীবাদী' প্রশ্নগুলো ভালো লাগে না।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

নারীবাদী টেক্সট হিসাবেও তাসলীমার লেখা আসলে ধর্তব্যে আসে না। নারীবাদের শক্তিশালী টেক্সটগুলো সমাজবিজ্ঞানের জার্নাল আর বামপন্থী পত্রিকার এলাকায় সীমাবদ্ধ। সেগুলো সামনে এলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজতত্ত্ব-নৃবিজ্ঞান তুলে দেবার দাবী আসতে পারে।
তাসলীমার গুরুত্ত্বের জায়গা হচ্ছে তার উপর প্রতিক্রিয়াশীলদের নিষেধাজ্ঞা। তাসলীমার কলম চালানো বা তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আক্রান্ত হওয়াটাই আমাদের লজ্জিত হবার বিষয়।



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

মুজিব মেহদী এর ছবি

তসলিমা নাসরিন আমার বিচারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন, যিনি বাংলাভাষাভাষী হাজার হাজার নারীকে নিজের দিকে ফিরতে শিখিয়েছেন, তাঁদের নিজেদের চিনতে শিখিয়েছেন ইত্যাদি।
তাঁর কবিতা, কলাম ও উপন্যাসের সাহিত্যমান বিচার করে তাঁর ব্যাপারে শেষ কথা বললে, বিনয়ের সাথে বলি, তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে। তিনি মূলত একজন সরব সমাজকর্মী ছিলেন। তাঁর কবিতা-কলাম-উপন্যাস সবকিছুই ছিল এ প্রয়োজন থেকে উৎসারিত। নারীবাদী ছিলেন তিনি অবশ্যই, কিন্তু নারীবাদী তাত্ত্বিক ছিলেন না। প্রথম শ্রেণির নারীবাদী তাত্ত্বিক আমাদের দেশে অনেকেই আছেন, কিন্তু তাঁরা দেশ-বিদেশের জার্নালেই সীমাবদ্ধ থাকেন অনেকটা। কিন্তু তসলিমা ছড়িয়ে পড়েছেন। তিনি তাঁর মতো করে নারীবাদের প্রয়োগ করছিলেন, প্রয়োগটা কোথায় কোথায় হতে পারে তাঁর ক্ষেত্র চিহ্নিত করছিলেন।
তসলিমা যা বলছিলেন ও করছিলেন তা শুধু মৌলবাদী নয়, গরিষ্ঠসংখ্যক পুরুষেরও বিরুদ্ধে যাচ্ছিল। ফলে তাঁরা সবাই তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেছেন, করছেন। তাঁর বলায়-করায় একটা বেপরোয়াপনাও ছিল, সেটা আমরা জানি। আর এজন্য অভিজাত নারীনেত্রীরাও তাঁকে অওন করতে পারেন নি। তাঁরা যেখানে সবকিছু একটু রয়েসয়ে করতে চান, তসলিমা তা চান নি। যেজন্য তসলিমার শেষ সংকটে (যখন দেশ ছাড়তে হবে হবে অবস্থা) বাংলাদেশের খ্যাত নারীনেত্রীরাও তাঁর পাশে দাঁড়ান নি।
এখন আমাদের দেশে নারী অধিকার নিয়ে যেসব কর্মশালা-সেমিনার হয়, সেখানে যেসব পুতুপুতু কথাবার্তা হয় তা বস্তুতপক্ষে সেমিনারকক্ষের বাইরে খুব একটা আসে না। তসলিমা এসব কথা অনেক আগেই বোল্ডলি কাগজে লিখে বহু মানুষের সাথে শেয়ার করে গেছেন। তুলনাটা এরকম করে করা যায়, তসলিমার একটা কলাম ও সে কলামের বক্তব্য যত মানুষকে ছুঁয়েছে, তার বিপরীতে পাঁচলক্ষ টাকা ব্যয় করে করা দশটি সেমিনারও ততগুলো মানুষকে ছুঁতে পারছে না।

এদেশে এখন তসলিমা নাসরিন এবং এরকম আরো আরো সাহসী নারী দরকার। এতদিনে তাঁর বিকল্পও তৈরি হতে পারত, কিন্তু তসলিমা নাসরিনের পরিণতি সাহসী নারীদেরও শেষপর্যন্ত সাহসী হতে দেয় নি। এতে আমাদের ক্ষতিই হয়েছে ও হচ্ছে।
আমি মনে করি, তাঁকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনবার জন্যই আমাদের কাজ করা দরকার।
...................................................................
অসংখ্য 'নেই'-এর ভিড় ঠেলে
জ্বলজ্যান্ত 'আছে' খুঁজে পাওয়া হলো আসল ফকিরি

... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী

হাসান মোরশেদ এর ছবি

মন্তব্যে বিপ্লব
-----------------------------------------
ভালো নেই,ভালো থাকার কিছু নেই

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

Joltorongo এর ছবি

চলুক

সুমন চৌধুরী এর ছবি

তসলিমার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দাবীর সাথে একমত।



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

??? এর ছবি

তসলিমা নাসরিন লেখক হিসেবে উঁচু না খাটো সেটা বোধয় জরুরি প্রসঙ্গ নয়। তিনি একটা প্রতীকে পরিণত হয়েছেন, সেটার অনেক গুরুত্ব আছে মুজিব যেমন বললেন। আমি প্রথম দিকে তার কিছু লেখা পড়েছিলাম। বছরদুই আগে পড়লাম "ক"। "ক" একটি দারুণ ইন্টারেস্টিং ডাটাবেজ, সমাজতাত্ত্বিকের জন্য। হয়ত এই বইয়ের অনেক কিছুই বিশ্বাসযোগ্য নয়, কিন্তু সবচে বড় বিষয় হল, বইটি লিখেছেন একজন নারী। একজন নারী তার যৌনজীবন তুলে ধরেছেন, যা সবসময় নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করে সঙঘটিত হয়নি। আর এই বইয়ের পাত্রপাত্রী সকলেই জীবিত (আমার এক বন্ধুও আছেন চোখ টিপি তসলিমার তালিকায়)। এই মাপের সাহস এবং পুস্তকী দৃষ্টান্ত দুনিয়ার আর কোনো নারী সেলিব্রিটি-র বইতে পাওয়া যাবে কিনা আমার জানা নেই।
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

গৌতম এর ছবি

...তবে মাঝে মাঝে কেনো যেনো মনে হয় তসলিমা যে প্রতীক হয়েছেন, সেটা তিনি নিজেও বুঝেন না।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

ব্লগস্পট ব্লগ ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

কালোবিড়াল এর ছবি

আমি একটু অফ্‌টপিকে যাই-যায়যায়দিন এর সম্পাদক শফিক রেহমান সম্পর্কে অনেক কিছু শুনি অনেকের কাছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই 'দালাল' বা এই জাতীয় কিছু। উনি কি আসলেই একজন 'শ্রদ্ধেয়' সম্পাদক? (@সংসারে এক সন্নাসী)

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন, আমি লিখেছি নব্বই দশকের মাঝামাঝির কথা। তখনও তিনি দালাল হয়ে ওঠেননি। তখন তাঁর বেশ সুনাম ছিলো সম্পাদক হিসেবে। আমি আমার মন্তব্যে লিখেছিলাম "...সেই সময় তখনও অ-পতিত এবং সে-কারণেই শ্রদ্ধেয়..."। বোধহয়, আমার লেখা উচিত ছিলো আরও স্পষ্টভাবে -"সেই সময় তখনও অ-পতিত এবং সে-কারণেই তখনও শ্রদ্ধেয়..."

আশা করি, বোঝাতে পেরেছি।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

অতিথি লেখক এর ছবি

মুজিব মেহদীর সাথে আমি একমত।

এখানে আরেকটি বিষয় বলা দরকার। অনেকে মনে করছেন, লেখায় আমি হুমায়ূন আজাদ ও তসলিমাকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছি। সেটি কিছুটা বা আংশিক সত্য। দুজনই বিদ্রোহী- সেই অর্থে তাঁরা এক কাতারে। দু'জনের কিছু কথা আমাদের নারী-পুরুষ সাম্যের ক্ষেত্রে অবদান রাখবে- সেই অর্থে তাঁরা এক কাতারে।

কিন্তু লেখার মান বা বিষয়বস্তু নিয়ে আমি তাঁদেরকে এক কাতারে দাঁড় করাইনি। লেখার স্পিরিটেও তেমন কিছু ছিলো না।

গৌতম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।