তেলের চাহিদা, ইহার ভবিষ্যত, আর জলবায়ুর পরিবর্তন লইয়া কিয়দ খাঁটি কথার মুখমুখি হইতেছি। এই কয়টি কথা ঘুরিয়া ফিরিয়া নাচিয়া নাচিয়া সামনে চলিয়া আসিতেছে। তাহাদেরই লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিতে বসিলাম। নবায়নযোগ্য শক্তি এবং এর প্রসার জ্বালানি ও জলবায়ু সমস্যার মোক্ষম সমাধান – এই ধারনাটিকেও একটু খোঁটাখূটি করিবার অমার্যনিয় প্রয়াস পাইলাম।
আগামির দিকে তাঁকাইলে তিনটি অকাট্য সত্য নৃত্যরতা লহিত-নিল-কৃষ্ণ অপ্সরাসম উদ্ভত হয়।
ইহা যদিবা সার্বজনিন যে জ্বালানির চাহিদা দৈনিক বৃদ্ধি পাইতেছে, উক্ত প্রবৃদ্ধির কি অবিশ্বাস্য গতি, তাহার উপলব্ধি কিন্ত অতি সহজলব্ধ নহে। এইস্থলেই লহিত সত্যটির প্রকাশ। জ্বালানি চাহিদা একই হারে বাড়িতেছে না, ইহা ক্রমাগত এবং উত্তোরত্তর হারে বৃদ্ধি পাইতেছে। জ্ঞানিরা বলিতেছেন ২০৫০ খৃষ্টাব্দবধি ইহা দ্বিগুন কিংবা তাহারো অধিক হইবার সম্বাবনার কথা; কারন হিসাবে তাহারা জনসংখ্যা বিস্ফোটন, শৈল্পিক বিকাশ, জনজিবনের উৎকর্ষতা ইত্যাদিকে উল্লেখ করিতেছেন। চিন, ভারত, রুশদেশ আর ব্রাজিল (সমগ্রে BRIC) তাঁহাদের উন্নয়নপথে নিবিড় জ্বালানির্ভরতার ধাপ এ পদস্থাপন করিয়াছেন। প্রকাশ থাকিল, যেই রাষ্ট্রের সিংহভাগ গৃহস্থ স্বিয় এবং গৃহপালিতের খাদ্যবস্ত্রাদির উপায় দেখিবার পর টেলিভিশন, মোটর গাড়ি ইত্যাদি ক্রয় এবং ভোগ করিতে চাহিতেছেন, এবং এইরূপ সামান্য অগ্রসর হইলেই তাহার প্রথম বিমানোড্ডয়ন (উদাহরন) অবধি ভাগ্যচক্রের অন্তর্গত হইবে হইবে করিতেছে, সেই রাষ্ট্রকে যে নিবিড় জ্বালানিনির্ভরতা পাইয়া বসিয়াছে তাহাতে সন্দেহ অনবশিষ্ট। বিবেচ্য, চীন আর ভারত অধিবাসির সিংহভাগের বিমানোড্ডয়নেচ্ছা আদ্যবধি যদিবা অপুর্ন, অমোঘ পরিবর্তনের চাকার ঘূর্ণন শুধুমাত্র দিনান্ধেরই আগোচরে থাকিতেছে। গত বৎসরই চীন এক ধাক্কায় তাঁহাদের বিদ্যুতোৎপাদক্ষমতা যে পরিমাপ এ বাড়াইলেন, তাহা আজকের দিনের গ্রেট ব্রিটনের সাকুল্য বিদ্যুতোৎপাদক্ষমতার সমতুল্য।
দ্বিতিয়া নিলবসনা সত্যাপ্সরা উদ্ভুত হইতেছেন ভুগর্ভ হইতে। সহযোত্তোলনযোগ্য তেল/গ্যাস (conventional cacophony oil) এর সরবরাহ যেই হারে বৃদ্ধি পাইতেছে, তাহা জ্বালানির চাহিদা বৃদ্ধির সাঙ্গে তাল মিলাইতে পারিতেছে না। তবলচি ঠেকা দিতেছেন দাদ্রাতে, আর ওস্তাদ সারিংগিতে তুলিতেছেন রাধাবল্লভি; সংগিতের স্থলে শব্দদূষন হইতেছে। কিছু ক্ষেত্রে বরং বিপরিতটাই ঘটিতেছে, সহযোত্তোলনযোগ্য তেল/গ্যাস এর খনিগুলি উত্তরোত্তর নিঃশেষ হইয়া পড়িতেছে। এইস্থলে সমস্যাটি ভূগর্ভস্থ জ্বালানি (fossil fuel) অপ্রাচুর্যতা নহে; উপরন্ত সাম্প্রতিক হিসাবে ভুগর্ভে ২০ ট্রিলিয়ন ব্যারেল বা তদসমতুল্য (barrel oil equivalent) মজুদ রহিয়াছে, IEA আমাদিগকে তাহাই জানাইলেন। তাত্বিক ভিত্তিতে এই মজুদ পুর্বোক্ত উত্তোরত্তর প্রবৃদ্ধি হিসাবে লইবার পরেও জগতের ৪০০ বৎসর চাহিদা পুরনক্ষম। কিন্তু বাস্তবে, সর্বাধনিক প্রযুক্তি প্রয়োগে সর্বোর্ধ্ব এর ৫০% উত্তোলযোগ্য। জগতের বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা সাকুল্যে ১৩৫ মিলিয়ন ব্যরেল বা তদসমতুল্য । আগামি দিনগুলি এই উৎপাদন ক্ষমতাকে ক্রমাগত বাড়িতে দেখিব, আরও নতুন ব্যবাসায়িক ও প্রায়গিক প্রসার ঘটিবে, কিন্তু উক্ত উৎপাদনক্ষমতাবৃদ্ধি আর প্রযুক্তির উৎকর্ষতা মোলায়েমভাবে না ঘটিয়া, ধাপে ধাপে ঘটিবে না এবং ইহা একটি পর্যায়ে গিয়া যে ঠেকিয়া থাকিবে না, তাহা কে দলিলে লিখিয়া দিয়াছে?
তৃতীয় সত্যরত্নটি কৃষ্ণবর্ন। কয়লার অধিক ব্যবহার এর ফলে বাতাসে CO2 এর পরিমান চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়িতে থাকিবে। আগামী ২০ বৎসরে কয়লার ব্যবহারের ৬০% প্রবৃদ্ধির কথা হইতেছে। তেলের মুল্যের আকাশমুখি গতিতে ভড়কাইয়া গিয়াই হউক, আর জ্বালানির জন্য পরনির্ভরতা কমাইতেই হউক, বর্তমানে কয়লা সমৃদ্ধ রাষ্ট্রসমূহ বিদ্যুৎ, মায় তরল জ্বালানি উৎপাদন এর ক্ষেত্রে তাঁহাদের মাটির তলার কয়লার ব্যবাহার বাড়াইয়াই চলিবে, অন্তত BRIC রাষ্ট্রসমূহ সেইমুখেই অগ্রসর হইতেছেন।কিন্তু তাহাতে কি ফায়দা হইবে? তরল জ্বালানির পরিবর্তে কয়লা ব্যবহার করিলে, CO2 দ্বিগুন পরিমানে নির্গত হ্য়। জলবায়ুর পরিবর্তন এর বিরুপ প্রতিক্রিয়া রোধে ভূগর্ভস্থ জ্বালানী, বিশেষত কয়লা হইতে CO2 অপসারন একটি বৃহৎ ভুমিকা রাখিতে পারিত। Fische-tropsch, Clean-coal, ইত্যাদি নাম্নি কিয়ৎ সাম্প্রতিককালে জনপ্রিয় প্রযুক্তি, যাহা কিনা হ্রাসকৃত হারে CO2 নির্গত করিয়া বিদ্যুৎ, তরল জ্বালানি ইত্যাদি উৎপাদনের প্রতিস্রুতি দিতেছে, বাস্তব শিল্পক্ষেত্রে ইহাদের ব্যবহার আদ্যবোধি সৌরালোক দেখিতে পায় নাই। তথাপি তর্কের খাতিরে মানিয়া লইলাম, শিঘ্রই ইহাদিগের শিল্পাকারে প্রয়োগ শুরু হইবে। ইহাতে CO2 নির্গমন হয়ত কিয়ৎ হ্রাস পাইবে, কিন্তু সম্পুর্ন নিকাশ কি আর হইবে?
তাহা হইলে নবায়নযোগ্য শক্তির (renewable energy) উৎসগুলি কি কাজে আসিবে? বর্তমানে বিশ্বচাহিদার ১% পুরণ করা হইতেছে এই নবায়নযোগ্য উৎসগুলি হইতে। যাহারা খুব বেশি আশাবাদি, তাহারা ভাবিতে চাহেন যে বর্তমান শতাব্দির অর্ধভাগে যাইয়া এই পরিমান বৃদ্ধি পাইয়া ৩০% হইবেক। নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলির মধ্যে অন্যতম এবং প্রযুক্তিগত তুলনামুলক ভাবে অগ্রসর হইতেছে বায়ুশক্তি; ইহার উন্যতম উপাদান হইল turbine। বর্তমানে পৃথিবীর সকল কারখানা একত্রে সাকুল্যে অনধিক ৩০ হাজার টারবাইন যোগান দিতে পারে। কিছু অর্বাচিন এই বলিয়া তর্ক করিতে আসিতে পারে যে turbine বানাইতে আর কি লাগে, গরমকালের বৈদ্যুতিক পাখার মত দেখিতে কিছু বড় করিয়া বানাইলেই ত হইল। তাহাদের বলি, NASA র Discovery এর মিশনের supply chain এ প্রায় ২০০০ এর মত নতুন IP প্রয়োজন হইয়াছিল। টারবাইন এর দুনিয়ার কিংকং ডেনমার্কের Vestas কম্পানি, তাহাদের V90 (~ 3MW) নামনি turbine বাজারে এ আনিতে তাহাদের supply chain এর ২১১৬ টি নতুন IP খরচ করিয়াছেন। তাহারা IP এর উদাহরন তা বুঝিতে না পারিলে, বলিতে হইবে, বাবাজিবন, বায়ুশক্তির উন্নয়ন বাতাসে হইবে না, ইহাতে অনেক কাষ্ঠতৃণাদি উৎসর্গ করিতে হইবে। সে যাহাই হউক, আশাবাদিরা আরও বলিতেছেন যে, শতাব্দির মাঝামাঝি যাইয়া turbine উৎপাদনক্ষমতা ১০ লাখ এ চড়িবে। ততদিনে turbine গুলিও হইবে আরো বৃহৎ, তাহাদের এক একটির বিদ্যুতোৎপাদন ক্ষমতাও হইবে ঢের অধিক। ইহার সমান্তরালে সৌরশক্তির খেত্রেও ঘটিবে নানা অভিনব উদ্ভাবন। কিন্তু এতকিছুর পরেও অবশিষ্ট ৭০% জ্বালানি আসিতেছে কিন্তু ভূগর্ভ হইতেই। ইউরোপ আমেরিকার জনমত জরিপে অনুযায়ি যদিও আমজনতা ভাবিতেছেন যে খুব শীঘ্রই green energy এর সুফল তাহাদের হস্থগত হইতেছে, কিন্তু হায়, তাঁহাদের ভাবনা আর সত্যতার মধ্যে শতাব্দির ব্যবধান।
এর লাগিয়াই বুঝি শক্তির কর্মক্ষমতা (efficency) বৃদ্ধি এতটা জরুরী হইয়া পড়িল। জগতে প্রতিদিন যে পরিমান শক্তির প্রয়োগ ঘটে, তাহার অর্ধেকেরো বেশী অপচয় হইয়া যায়। টয়োটা আর BMW গাড়ির কর্মক্ষমতার প্রসিদ্ধি রহিয়াছে, কিন্তু তাহাদের সর্বাধুনিক ও সর্বোচ্চকর্মক্ষম গাড়িটিও কেবল প্রযুক্ত শক্তির ২০% কে চলনকার্যে রুপান্ততরে সক্ষম, অবশিষ্টাংশ তাপ, শব্দ, বিকীরন ইত্যাদিতে নিকাশ পাইয়া যায়। ঊড়জাহাজের ক্ষেত্রে take-off করিবার কালে এই মাত্রা ৮% এ নামিয়া আসে। এই কর্মক্ষমতার দৌড় এ অগ্রগামি হইতেছে কয়লা চালিত বিদ্যুতোৎপাদনকেন্দ্র – কিন্ত হায়, সমগ্র পৃথিবির যেই সর্বাধুনিক প্রযুক্তির কয়লাচালিত বিদ্যুতোৎপাদনকেন্দ্র দিকে চাতকের মত তাকাইয়া আছে, পুর্ব জার্মানীর Lichtenberg এর সেই superstation এর সবচাইতে আশাবাদি পুর্বাভাস হইতেছে ৩৫% কর্মক্ষমতা।
তাহা হইলে দফায় দফায় শক্তির উৎপাদন বাড়াইতে আর নতুন নতুন উৎস খুঁজিতে কাড়ি কাড়ি কড়ি ফেলিয়া কি ফায়দা হইতেছে? শক্তির কর্মক্ষমতা নবায়নযোগ্য শক্তির সুফলের গুড় কি অপচয়ের পিপিলিকার ঊদরগতই হইতে থাকিবে?
==
ইতি
দুর্দান্ত (ওলন্দাজপুর)
মন্তব্য
মনোহারী উপস্থাপনা, সুন্দর বিষয়, গভীর ব্যাখ্যা। শুধু একটা বিষয়। কৃষ্ণবর্ণা অপ্সরাটির ক্ষেত্রে মনে হৈল, কেবল কয়লাই যেন দুনিয়াই কার্বনডাইঅক্সাইডের যোগান দিয়া যাইতেছে। বিষয়টা কি এরকম?
পরিবেশ দূষণের যে রাজনীতি আছে, সেইটাকেও একটা অপ্সরা আকারে খাড়া করতে পারেন। দুনিয়ার সমুদয় বায়ুদূষণের ৩৫ভাগ নাকি খোদ মার্কিন মুল্লুকই করিয়া থাকে!
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!
দুর্দান্ত বলিয়াছেন, যদিওবা আপনার বাক্যবাণের একটি বড় অংশই তাহাদের লক্ষ্য - i.e. আমার মস্তিষ্কের - উপরে দিয়া উড়িয়া গিয়াছে। তথাপি কেবলমাত্র 'বিমানোড্ডয়নেচ্ছা' শব্দখানি উদ্ভাবনের জন্যেই্ আপনাকে পঞ্চতারকা দিয়া পুরষ্কৃত করিবার প্রয়াস পাইলাম। অদূরেই সাক্ষাৎ হইবে, এই কামনায়।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
অতি উত্তম উপস্থাপনা এবং ততোধিক গুরুত্বধারী প্রসঙ্গ। ষাষ্টাঙ্গ সহমত হইয়াও বলি, কৃষকায় হইলেও শক্তির নবায়নই এই মুহুর্তে বিকল্পরূপে দৃশ্যমান। প্রয়োগ প্রশ্নে সুমন রহমানের প্রতিধ্বনী করিলাম।
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
সাধু! সাধু! ... লেখাখানি উত্তম/ ঝাঁজা হইয়াছে।
নিয়মিত লিখিবার আব্দার জানাই।
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
উত্তর পাওয়া যাবে পরের পর্বে।
হাঁটুপানির জলদস্যু
নতুন মন্তব্য করুন