ইন্টেল করপোরেশনের চেয়ারম্যান ড. ক্রেইগ ব্যারেট বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন মাত্র কিছুদিন আগে। তাঁর সফরের আগে কয়েকটি উদ্দীপনামূলক ও আশাবাদী লেখা ছাপা হয় পত্রপত্রিকায়। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পর এ বিষয়ে কোনো বিশ্লেষণ পত্রিকার পাতায় আসে নি, যদিও নিউজ হয়েছে বেশ। হয়তো তাঁর বক্তব্যে খুশি হতে পারেন নি আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষকরা। ইতোমধ্যে অনেকের মোহভঙ্গও হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে ড. ব্যারেটের সফরের আগে আমিও মোহাচ্ছন্ন ছিলাম যে, বাংলাদেশের ভাগ্য বুঝি বদলে গেলো। সেটি যে হয় নি, তা তো পরিষ্কার। তাই ইচ্ছে করেই অনেকদিন পর পুরনো পত্রিকা ঘেটে অনেকটা মোহমুক্ত থেকে দেখার চেষ্টা করছি-- তিনি কী দিলেন, আমরা কী পেলাম আর আমরা আরো কী পেতে পারি।
ড. ব্যারেট বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন একইসঙ্গে কিছু হতাশা এবং কিছু আশার জন্ম দিয়ে। হতাশা এ কারণে যে, অনেকেই আশা করছিলেন ব্যারেটের প্রতিষ্ঠান ভিয়েতনামে যেমন বিনিয়োগ করেছে, তেমনি বাংলাদেশেও তিনি এ ধরনের বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়ে যাবেন। কিন্তু সে রকম কোনো ঘোষণা তো তিনি দেনইনি, বরং বলে গেছেন এ মুহূর্তে বাংলাদেশে শিল্প বা ব্যবসাখাতে বিনিয়োগের কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। বরং এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোতে যে উৎপাদন চলছে, সেটি দিয়েই বাংলাদেশের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
অন্যদিকে আশার দিক হলো, ব্যারেট তাঁর ভাষণে সরাসরি বিনিয়োগের ঘোষণা না দিলেও অন্য একটি বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে আলোকপাত করেছেন। তাঁর মতে, বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য চারটি বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে-- তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা, তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে অন্যের সঙ্গে সংযুক্তি, সামর্থ্যের মধ্যে সমৃদ্ধ স্থানীয় তথ্য বা বিষয়বস্তু এবং শিক্ষা। সন্দেহ নেই, চারটি বিষয়ই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। ওয়ার্ল্ড অ্যাহেড কর্মসূচি উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছেন ড. ব্যারেট।
আগেই বলেছি, ড. ব্যারেটের ভাষণে কেউ হতাশ হয়েছেন, কেউ বা উদ্দীপ্ত। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতিতে বিদেশী বিনিয়োগ একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর এবং ইন্টেলের মতো প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ খুব সহজেই বড় ধরনের সম্ভাবনা নিয়ে আসতে পারে। তবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যে পরিমাণ দক্ষ জনশক্তি আমাদের আছে, তা দিয়ে হয়তো এখনই খুব বড় কিছু করা হয়তো সম্ভব হবে না; কিন্তু ইন্টেলের মতো প্রতিষ্ঠান এদেশে বিনিয়োগ করলে এদের হাত ধরেই পরবর্তী প্রজন্ম অত্যন্ত দ্রুতগতিতে উঠে আসতে পারতো। কিন্তু সেটা তো আমাদের দিক থেকে চাওয়া। ইন্টেল আমাদের এই চাওয়াকে কতটুকু মূল্যায়িত করবে, সেটি তাদের ব্যাপার। এখানে প্রশ্ন হলো, আমাদের চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শিল্প বা ব্যবসায় অবকাঠামোগত বিনিয়োগ করার জন্য যে পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া দরকার, সেই ধরনের পরিবেশ আমরা তৈরি করতে পেরেছি কি-না।
ড. ব্যারেটকে আমরা উঞ্চ সংবর্ধনা দিয়েছি। কিন্তু সংবর্ধনার বিপরীতে আমাদের একটি বড় চাওয়া পূরণ হয়নি। আমাদের মনে রাখতে হবে, একজন প্রকৃত ব্যবসায়ীকে যতো সমাদর করা হোক না কেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যবসায়ী তার ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ দেখতে পাবেন, ততক্ষণ সেখানে ব্যবসা করার আগ্রহ দেখাবেন না। সাদর বা উঞ্চ সংবর্ধনা ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত মনকে দ্রবীভূত করতে পারে, কিন্তু লাভ-ক্ষতির খাতা নিয়ে বসবেন, তখনই ব্যক্তিগত ভালোলাগাকে দূরে সরিয়ে রাখবেন। ব্যারেটের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এদেশে আসার আগে তিনি নিশ্চয়ই এদেশ সম্পর্কে কিছু ধারণা নিয়ে এসেছেন, এদেশকে তিনি কী দিয়ে যাবেন তাও ঠিক করে এসেছেন তিনি। কিন্তু যে বিষয়টি সম্পর্কে তিনি হয়তো কোনো পূর্বানুমান নিয়ে আসেননি, সেটি হচ্ছে আমরা তাঁকে কীভাবে গ্রহণ করছি, তাঁর মতো একজন ব্যক্তিত্ব ও তাঁর প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আমরা কী প্রত্যাশা করছি। তাঁকে পাওয়ার জন্য আমরা যে উদ্বেল ছিলাম, সেটি নিশ্চয়ই তিনি অনুধাবন করতে পেরেছেন এবং তিনি এখন জানেন তাঁর কাছে আমরা কী চাই। আমাদের এখন লক্ষ স্থির করতে হবে যে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এদেশে সরাসরি বিনিয়োগ করার জন্য পরিবেশ আমরা তৈরি করবো এবং ড. ব্যারেট বা এ ধরনের মানুষদেরকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে বুঝাতে সক্ষম হবো আমরা সবদিক দিয়েই প্রস্তুত। ড. ব্যারেট বা তার মতো বড় প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা যেনো এই দিক দিয়ে আমাদের ফিরিয়ে না দেন, সে জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে এখন থেকেই।
তবে ইন্টেলের চেয়ারম্যান হিসেবে ড. ব্যারেটের কর্মপরিধি ব্যবসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। মেধাসত্ত্ব বেড়াজালের মাধ্যমে কিছু নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া ব্যবসার বিরুদ্ধে, তথ্যকে বিশ্বের প্রতিটি মানুষের কাছে সহজলভ্য করার জন্য উন্মুক্ত তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলার এবং মানুষের প্রাযুক্তিক স্বাধীনতা ভোগের লক্ষ্যে যে ওপেন সোর্স আন্দোলন হচ্ছে, ইন্টেল সেটির একজন বড় পৃষ্ঠপোষক। তথ্যের অধিকার কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠীর হাতে কুক্ষিগত থাকলে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারও মানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। ব্যারেটের প্রতিষ্ঠান সেদিক দিয়ে মনোযোগ দেওয়ার পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তিকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার যে পরিকল্পনা নিয়েছে, বাংলাদেশ সেটিতে যুক্ত হতে পেরেছে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূর করতে তথ্যপ্রযুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের কম্পিউটার ও ল্যাপটপ বিতরণের পাশাপাশি এসব প্রযুক্তি উপকরণ দিয়ে মানুষ যেনো পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, সেজন্য ইন্টেল তারবিহীন ইন্টারনেট প্রযুক্তি বা ওয়াই-ম্যাক্স প্রযুক্তিনির্ভর অবকাঠামো গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। সন্দেহ নেই, এর ফলে সবচেয়ে উপকৃত হবে এদেশের শিক্ষার্থীরা। এর পাশাপাশি স্থানীয় ভাষায় মানসম্পন্ন তথ্যভাণ্ডার তৈরির যে প্রয়োজনীয়তা তিনি দেখিয়েছেন, তা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। সারা বিশ্বে যেভাবে ইংরেজি ভাষার বিস্তার ও প্রকাশ ঘটছে, নিরক্ষর বা আনুষ্ঠানিকভাবে কম শিক্ষিত মানুষ তার ফলে পুরোপুরি তথ্যপ্রযুক্তির উপকার গ্রহণ করতে পারছে না। ফলে এই কর্মসূচি প্রযুক্তি-উপকরণ যথাযথ ও সর্বোচ্চ ব্যবহারের নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম হবে আশা করা যায়।
ড. ব্যারেটের ঘোষণায় যে বিষয়টি শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উজ্জীবিত করতে পারে, সেটি হচ্ছে ইন্টেল সরাসরি শিক্ষার কিছু উপাদানের সঙ্গে কাজ করতে চায়। তিনি কোরিয়ার উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন সেখানকার শিক্ষকদের প্রযুক্তিবিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানের ফলে কী বিপুল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য উপকরণ বিশেষ করে বিজ্ঞান, গণিত বা প্রকৌশল শিক্ষায় ভাষাগত পরিবর্তনের মাধ্যমে ড. ব্যারেট স্থানীয় সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চান।
সারা বিশ্বেই তথ্যপ্রযুক্তি এখন শিক্ষার একটি অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রচলিত পদ্ধতির পাশাপাশি কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন ইন্টার-অ্যাকটিভ উপস্থাপনা শিক্ষার্থীদের যেমন শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়াচ্ছে, তেমনি এই প্রযুক্তিকৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার বিভিন্ন কারিগরি দিক সহজে উপস্থাপনের মাধ্যমে খুব তাড়াতাড়ি আয়ত্তীকরণ সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশ এ দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে আছে বললে ভুল করা হবে, বাংলাদেশ আসলে এই মাধ্যমটির পুরোপুরি ব্যবহার এখনো শুরুই করতে পারেনি। শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার একটি দেশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন যে বয়ে আনতে পারে, তা শুধু কোরিয়া বা ভিয়েতনামের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হবে। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য-- শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করলেই শুধু চলবে না, সেটি যেনো নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণী বা গোষ্ঠীর কাছে আবদ্ধ না হয়ে পড়ে সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। ডিজিটাল ডিভাইডের শিকার না হয়ে প্রতিটি শিক্ষার্থীই যেনো পর্যাপ্তভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগ পায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে আমাদেরই। ড. ব্যারেট ও তার প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিয়ে সে কাজটি আমাদেরকেই করতে হবে। সেটি করতে হয়তো সময় লাগবে কিন্তু ব্যারেটের সফরের পরবর্তী ধাপ হিসেবে সেদিকে পরিকল্পনা অনুযায়ী আগানোর চিন্তা করতে হবে আমাদের। আর আমরা আমাদের পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই ব্যারেটকে বলতে চাই, শুধু অনুদান নয়, সরাসরি বিনিয়োগ করলে আমরাও কিছু উপহার দিতে পারি এই বিশ্বকে।
গৌতম
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন