জুয়েল বিন জহির
জাহাঙ্গীরনগর ছেড়েছি অনেকদিন। কিন্তু আজও ঢাকার রাস্তায় ক্যাম্পাসের সবুজ বাস দেখলে ভেতরটা কেমন জানি হয়ে পড়ে। আর পত্রিকায় যত ছোট করেই প্রিয় জাহাঙ্গীরনগরকে নিয়ে সংবাদ ছাপা হোক না কেন তাতে চোখ আটকাবেই। খুটিয়ে খুটিয়ে পড়ি সবসময়। আজও ঘুম থেকে ওঠে প্রথম আলো পত্রিকার পাতায় চোখ বুলানো। আটকে গেলাম দ্বিতীয় পাতার চতুর্থ কলামে। “ঢাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে ছাত্রের মৃত্যূ” শিরোনাম। তাতে লেখা, “জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সানোয়ার হোসেন গতকাল রোববার রাতে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে...”। এক নি:শ্বাসে ২০ লাইনের নিউজটা শেষ করলাম। বিশ্বাস হচ্ছিল না। আচ্ছা, গত ২৯ ডিসেম্বর রাত ১০টার দিকে ফারুক, নিপু, মিঠুর সাথে যে সানোয়ার চুনিয়ার ওয়ান্নাতে যোগ দিয়েছিল, সেই সানোয়ার না তো? পত্রিকায় নিপুর নামটা উল্লেখ থাকা সত্বেও আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য ওর বন্ধুদের কয়েকজনকে ফোন দিলাম। রিং হলেও কেউ রিসিভ করছিল না। শেষে রিপন চাঙমাকে ফোনে পাওয়া গেল। জানলাম ঘটনা সত্য। গতকালই ওরা ক্যাম্পাস থেকে অনেকেই মাদারীপুরে সানোয়ারের দাফন সম্পন্ন করে এসেছে। উহ! এটা যে মেনে নিতে পারছি না। কিভাবে সম্ভব এটা? ওয়ান্নার জন্য আমি চুনিয়া চলে গিয়েছিলাম ২৫ ডিসেম্বর। ওয়ান্নার প্রথম দিন বিকেলের দিকে মিঠু ফোনে জানায় ওরা আসতে চাচ্ছে। তখন বাজে ৫ টার মতন। তখন রওনা দিলেও তারা আদৌ চুনিয়া পৌছতে পারবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থাকায় আমাদের পক্ষ থেকে জানানো হয় পরদিন সকালে রওনা দেওয়ার জন্য। কিন্তু না, ঠিকই পাঁচ-সাড়ে পাঁচ ঘন্টার মধ্যে চুনিয়া পৌঁছে ওরা ওদের তারুণ্যকে তুলে ধরেছিল আমাদের সামনে। আমি তখন আগুনপাড়ে। অলক আম্বির বাড়িতে রুগালা করছে খামাল দীনেশ নকরেক। বিভিন্ন গ্রামের যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা মত্ত নাচ-গান আর চু পানে। রিপন আর সোহেল ওদেরকে দোখলা থেকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে। নিপু, ফারুক, মিঠুর সাথে আগে থেকেই ভালো সম্পর্ক। আরেকজনকেও চেহারাতে চিনি, তেমন কথা হয়নি এর আগে। নিপু পরিচয় করিয়ে দিল ওর ক্লাসমেট সানোয়ার। ওরাও দেবতা মিসি আর সালজং এর প্রতিনিধি হিসেবে মিশে গেল ওয়ান্নাতে। ফাঁকে ফাঁকে পরিচিত হলো অনেকের সাথে। আমি একটু অন্যদিকে ব্যস্ত থাকায় ওদেরকে তেমন সময় দিতে পারিনি। সম্ভবত রাত ২টার দিকে সানোয়ার, মিঠু আর নিপুকে নিয়ে সবুর চিরান তার বাড়িতে চলে যায় ঘুমানোর জন্য। ঘন্টা খানেক পড়ে নিপু আর সবুর ফিরে আসে জনিক আচ্চুর বাড়িতে। জানলাম সবুর ওদের নতুনদের সম্মানে চু নামিয়েছিল, সেটা পান করেই সানোয়ার, ফারুক আর মিঠু ঘুমিয়ে পড়েছে। পরদিন একটু বেলা করেই ওদের সবার সাথে দেখা হলো বিজন্তীদির কাচারি ঘরে। দিদির ছেলে বেনজন ওয়ান্না উপলক্ষ্যে ওদের বের করা পত্রিকা স্ফি দিল সানোয়ারদের। ওরা স্ফির দাম দিল, সাথে ওয়ান্নার আয়োজনেও কিছুটা শরিক হলো। রাতে খেয়াল করিনি। দিনের বেলায় সানোয়ারকে একটু চুপচাপই মনে হলো। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়িতে গাম্ভীর্যটা আরো প্রকট ছিল। ভেবেছিলাম হয়ত চু এর নেশা ঠিকঠাক কাটেনি এখনও। দুপুরে একসাথেই আজুগির পাতায় ওয়াকবেন, ফুরা দিয়ে ভাত খাওয়া। মিঠু, নিপুদের কথাবার্তা চললেও সানোয়ার যেন শুধুই শ্রোতা। আমি জানি না, সানোয়ার স্বভাবতই এমন চুপচাপ কি না। নাকি সে অন্য কিছুতে আচ্ছন্ন ছিল? সেই আচ্ছন্নতা কি নিয়ে ছিল? তখন ব্যাপারটা তত গুরুত্ব দিয়ে না দেখলেও আজ বড় জানতে ইচ্ছে করছে। পরে যতটুকু জানলাম মানসিক ভাবে বেশ বিপর্যস্ত অবস্থায় সানোয়ার অনেকদিন। পারিবারিক কী সব ঝামেলা যেন। কিন্তু সানোয়ার এই দুনিয়াতে কি আমাদের আর সবার কোন সমস্যা নেই? হ্যাঁ, মানলাম তোমার কষ্টটা হয়ত তোমার চারপাশের মানুষজনদের থেকে একটু বেশিই ছিল। কিন্তু তাতে কি। সেগুলোকে অতিক্রম করার শক্তি তোমার কম ছিল তা আমি মানব না। এছাড়া চুনিয়াতে ঘুরে আসার পরতো তোমার আরো সাহস পাওয়ার কথা ছিল। শত অভাব-অনটন, বাধা-বিপত্তির মাঝেও ওই মানুষগুলির লড়ে যাবার স্পৃহা কী তোমাকে স্পর্শ করেনি? এত হতাশার মাঝেও সহজ-সরল মানুষগুলোর মানুষকে-জীবনকে ভালবাসতে পারার দূদার্ন্ত ক্ষমতাটা কী তুমি একটুকুও আঁচ করতে পারনি? বা তোমার বন্ধুদেরটাও না? গত রোববারের সিদ্বান্তের বিষটা কী চুনিয়া থাকাকালীন সময়েও ভাবতে ছিলে? কিভাবে পারছিলে? উহ! না, আর ভাবতে পারছি না। আমি বুঝতে পারছি না বন্ধু, তোমরা এভাবে কেন চলে যাও?
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন