পাকিস্তানে দানবশক্তি : ভয়ের কারণ আমাদেরও আছে
ফকির ইলিয়াস
=====================================
পাক ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে, আরেকটি মর্মান্তিক দু:খজনক ঘটনা ঘটে গেল। শক্তিশালী আত্মঘাতী বোমা হামলায় নৃশংসভাবে নিহত হলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো। এই চরম লজ্জাজনক ঘটনাটি জানান দিয়ে গেল, উপমহাদেশে একটি কালো দাঁতাল শক্তি কতো জঘন্য ভাবে বেড়ে উঠছে। মাত্র আড়াই মাস আগে বেনজির দীর্ঘ নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে পাকিস্তানে ফিরেছিলেন। তার এই ফেরা নিয়ে নানা কথা হচ্ছিল। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার নাকি, স্বৈরশাসক পারভেজ মুশাররফের সাথে আাঁতাত- নিয়ে বিতর্ক ছিলে। কিন্তু বেনজির খুব সুদৃঢ় কন্ঠে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি মৌলবাদ মুক্ত, স্বৈরশাসনমুক্ত পাকিস্তান চান। যে কোন মূল্যে তিনি কাজ করে যাবেন সে লক্ষ্যে। বেনজির তাঁর প্রাণ দিয়ে কথা রক্ষা করেছেন।
পাকিস্তানের ইতিহাসে বেনজির ভুট্টোর নামটি রাজনৈতিক ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। তার পিতা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ছায়ায় তাঁর রাজনীতির শুরু হলেও ক্রমশ: তিনি নিজের আসনটি সুপ্রতিষ্ঠিত করে নিতে পেরেছিলেন।
মূলত: একাত্তর সালের ষোলই ডিসেম্বর বাংলাদেশের মহান বিজয় সাধিত হবার পর ‘পশ্চিম পাকিস্তানের’ শরীর থেকে পশ্চিম শব্দটি খসে পড়ে। একক পাকিস্তান রাষ্ট্রের পুনর্জন্ম হয়। যা ১৯৪৭ সালেই হতে পারতো। বাঙালীদের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম সে সময়ে হলেই তা হতো উত্তম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হয়নি। ফলে চব্বিশ বছর ‘হামভি মুসলিম, তুমভি মুসলিম’ এই বুলি আওড়িয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী উর্দু ভাষীরা বাঙালি জাতিকে শাসন এবং শোষণ দুটিই করে। জিন্নাহ-লিয়াকত আলীরা যে গণতন্ত্রী ছিলেন না- তা সে সময়ের ইতিহাসই বলেছে। গণতন্ত্র মানলে সংখ্যাগরিষ্ট বাঙালী জাতির শাসক, সংখ্যালঘিষ্ট উর্দু ভাষীরা হয় কি করে?
কিন্তু তারপরও রাজনীতিকদেরকে চিরতরে ধ্বংষ করে দিতে তৎপর ছিল সামরিক জান্তারা। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খাঁ, কিংবা জে. ইয়াহিয়া খাঁ-রা জনগণের টুটি চেপে ধরতেই ক্ষমতা গ্রহণের নামে মার্শাল ল’ জারি করেন। এমন কি তারা বাঙালি জাতিকে মাতৃভাষা বাংলা পরিত্যাগ করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের বল প্রয়োগ করার ধৃষ্ঠতা দেখান।
এরপরে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির অভ্যুদ্বয় ছিল এ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ঘটনা। কিন্তু তারপরও কি পাকিস্তানে গণতন্ত্র চর্চা হয়েছে? না হয়নি। বেলুচ, সিন্ধী, পাঞ্জাবী, পাঠান প্রভৃতি গোত্র-সম্প্রদায়ের নানা কুটকৌশলের কাছে পাকিস্তানীরা নিজেদের কাছেই প্রতারিত হতে শুরু করে বিভিন্ন ভাবে।
শাসক জুলফিকার আলী ভুট্টোর দগি কেঁপে উঠে বিভিন্ন কারণে। কারণ তার গণতন্ত্র চর্চা স্বচ্ছ ছিল না। কিন্তু তা যাই হোক না কেন আবার সামরিক শাসক জে. জিয়াউল হকের ক্ষমতা গ্রহণ প্রমাণ করেছিল, পাকিস্তানীরা গণতন্ত্রের চেয়ে গাদ্দারী মার্কা একনায়কতন্ত্রই বেশী পছন্দ করে। বিভিন্ন টালবাহানা করে প্রায় জোর করেই ভুট্টোর ফাঁসির হুকুম দেয় সামরিক জান্তারা। যে জুলফিকার আলী ভুট্টো জনরায় না মেনে দুই পাকিস্তানের শাসক হতে চেয়েছিলেন, তাকে বিদায় নিতে হয় অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে।
জেনারেল জিয়াউল হক বিভিন্ন ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে শাসন চালাতে থাকেন। এরপর মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় জিয়াউল হককে নিহত হলে দেশের রাজনৈতিক প্রবাহ ভিন্নখাতে প্রবাহিত হয়। একটি কথা লক্ষ্যনীয় পাকিস্তানে মৌলবাদী জঙ্গীরা কিন্তু মূলত: সংঘটিত হতে শুরু করে জেনারেল জিয়াউল হকের সময়েই। কারণ এ রকম একটি মোল্লাবাদীতন্ত্রের খুব প্রয়োজন ছিল জিয়াউল হকের।
এরপরে পাকিস্তান শাসন করেন বেনজীর ভুট্টো। কিন্তু জঙ্গীবাদের বিষক্রিয়া তিনি থামাতে পারেননি। তাছাড়া তার নিজ স্বামী আসিফ জারদারীসহ মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের সিংহভাগের দুর্নীতি ছিল সীমাহীন। ফলে তিনি টিকে থাকতে পারেননি। ক্ষমতায় আসেন নওয়াজ শরীফ। কিন্তু জঙ্গীবাদ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, রাষ্ট্রীয়ভাবে দেউলিয়া করে তুলে তার সরকারকেও। বিশেষভাবে সীমান্তবর্তী দেশ আফগানিস্তান থেকে আল-কাযেদা পন্থী জঙ্গীবাদের দাপট কাঁপিয়ে তুলে পাকিস্তানের গুহা, মরু, পর্বত। কারো কারো মতে পাক গোয়েন্দা বাহিনী আইএসআই খুব কৌশলে নিজেদের রাষ্ট্রটিকে আংশিক অকার্যকর করে তোলে। সে সুযোগ নিয়ে খুব পারিকল্পিতভাবে নওয়াজ শরীফকে হটিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ।
দুই.
জে. মোশাররফ শুরু থেকে কি বলে আসছেন, তা বিশ্বাবাসীর অজানা নয়। তিনি যে গণতন্ত্রকে ভয় পান, তা কারোই না জানার কথা নয়। বেনজীর এবং নওয়াজকে নির্বাসনে পাঠিয়ে তিনি খুব কঠোরভাবে চালাতে থাকেন তার ষ্টীম রোলার।
সবচেয়ে মারাত্মক কথা হচ্ছে, জে. মোশাররফ ও জেনারেল জিয়াউল হকের কায়দায় পাকিস্তানে জঙ্গীবাদী নেটওয়ার্ককে মদদ দিয়েছেন, নিজে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। বাংলাদেশে জোট সরকার প্রাকশ্যে যেমন বাংলা ভাই, শায়খ রহমানকে মদদ দিয়েছিল জে. মোশাররফ একই কাজটি করেছেন নওয়াজ-বেনজীরের জনপ্রিয়তা কে হরন করার জন্য। আর খুব দুর্ভাগ্যজনকভাবে বলতে হয়, জে. মোশাররফের এসব ভাওতাবাজী, ভন্ডামীকে সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, বুশ প্রশাসন। জে. মোশাররফ ওয়াশিংটনে এসে বুশের সাথে করমর্দনরত ছবি ছাপিয়েছেন, বিশ্ব মিডিয়ায় আইওয়াশ করেছেন বিশ্ববাসীর। অথচ তার প্রধান লক্ষ কি তা প্রমাণিত হয়েছে, নওয়াজ শরীফকে প্রথমবার দেশে আসতে বাধা দেয়া। এরপরে বেনজীর ভুট্টোকে কৌশলে পাকিস্তানে ফিরিয়ে এনে তার জীবন বিপন্ন করে তোলা। বেনজীর পাকিস্তান আসার পরপরই আক্রান্ত হন। কিন্তু তারপরও তার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়নি।
লাল মসজিদে জঙ্গীরা যে কান্ড ঘটিয়েছে, তা ছিল গোটা পাকিস্তানের প্রতিচিত্র। কিন্তু জে. মুশাররফ তা কঠোর হস্তে দমন করতে পারেননি। বরং প্রকারান্তরে ডানপন্থী ছোট ছোট রাজনৈতিক গ্রুপগুলোর সাথে মোর্চা করে কিভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়, সে ভাবনায় বিভোর রয়েছেন।
বেনজীর আক্রান্ত হতে পারেন, তা তিনি নিজেও জানতেন। তারপরও জঙ্গীমুক্ত স্বদেশ ছিল তার একমাত্র আরাধ্য মাতৃভূমি। রাওয়ালপিন্ডিতে তার শেষ জনসভায়ও তিনি তা বলেছেন খুব স্পষ্ট ভাষায়। পাকিস্তান পিপলস পার্টির ব্যর্থতা যতো বেশীই থাকুক না কেন, জঙ্গীবাদী গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে পিপিপি যে কঠোর ভাষা উচ্চারণ করে যাচ্ছে, বর্তমান বিশ্বে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ, স্বার্থক দিক। পাকিস্তানের আপামর মানুষও বেনজীরের পাকে সাড়া দিয়ে সমবেত হতে শুরু করেছিলেন।
বেজনীরকে কে বা কারা হত্যা করেছে, তা খোঁজার পাশাপাশি তাকে কেন হত্যা করা হয়েছে, তার নিগুঢ় কারণটি বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে খুঁজে দেখতে হবে। কারণ বিশ্বে জঙ্গীবাদ দমনে বেনজীর একা ছিলেন না। তার সহযোদ্ধ অনেক নেতা এখনো বেঁচে আছেন। এমন কি আছেন বুশ প্রশাসনও।
পাকিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেনজীরকে হত্যার মাধ্যমে খুনীরা জানিয়ে দিয়েছে- তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি। জে. মুশাররফ যে কালো সাপগুলো তার আস্তিনের পকেটে পুষেছেন এবং পুষছেন- এরা একদিন তাকেই কামড় দিতে পারে। বেনজীরের পর চরমভাবে বিপন্ন হতে পারে নওয়াজ শরীফের জীবনও।
পাকিস্তানে এই যে দানব শক্তি রক্তাক্ত মহড়া দেখাচ্ছে তা গুড়িয়ে দিতে যুক্তরাষ্ট্রের দ্রুত ব্যবস্খা গ্রহণ করা উচিত বলে আমি মনে করি। ভারত-সরকার ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রকে এ বিষয়ে গভীরভাবে ভেবে সিদ্ধান্ত নেবার আহ্বান জানিয়েছে। সেদিন হয়তো আর খুব দুরে নয়, আফগাস্তান থেকে ইঙ্গঁ-মার্কিন বাহিনী ইসলামাবাদ অভিমুখে মার্চ শুরু করতে হতে পারে। কারণ পাক-আফগান সীমান্তবর্তী মরু অঞ্চলই এখন শীর্ষ সন্ত্রাসী আল কায়েদা গ্রুপের ব্যাপক নিরাপদ আশ্রয় বলে চিহ্নিত হচ্ছে। শীর্ষ মার্কিন মুখপাত্ররা, বিশেষজ্ঞরা এ বিয়ে বেশ কিছুদিন থেকেই একমত পোষন করে আসছেন। তারপরও মুশাররফ প্রশাসনকে, বুশ প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতা প্রদান ছিল খুব দুর্ভাগ্যজনক, লজ্জাজনক ঘটনা।
পাকিস্তানে দানব শক্তির উথান, বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, গোটা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াসহ বিশ্ববাসীর জন্য শংকার কারণ চরমভাবে। যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী উপমহাদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এ বিয়ে মার্কিন সিনেট-কংগ্রেসে লবিং শুরু করেছেন। পাক-আফগান সীমান্তে অবস্খানরত জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্খা নিতে যুক্তরাষ্ট্র ও পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি বদ্ধপরিকর। কিন্তু এর পাশাপাশি যে সব রাষ্ট্রনায়করা জঙ্গীবাদকে মদদ দিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্খা গ্রহণ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। কারণ, জঙ্গীরা মানবতাবাদের প্রকৃত শত্রু। #####
নিউইয়র্ক,
৭ জানুয়ারী, ২০০৭
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন