প্রিয় বাল্যবন্ধু,
বহুদিন কোনো যোগাযোগ নাই। বাংলাদেশে যাবো ভেবে মাসখানেকের ছুটি নিয়েছিলাম। কিন্তু, দেশে যাবার সময় ঘনিয়ে আসছিলো যখন, ঠিক তখন কিছু কাজের ঝামেলায় জড়িয়ে যাই। আর যথাসময়ে খরিদ না করায় পরবর্তিতে উড়োজাহাজের টিকিটও আর স্বল্পমূল্যে পাওয়া সম্ভব হয় নাই। ইত্যাদি নানা কারনে আমার বাংলাদেশে যাওয়া হয়ে উঠে নাই। অবশেষে ঘরে বসে এই ঠান্ডার মধ্যেই ছুটি কাটালাম। কাজের কাজ বলতে সচলায়তন এবং সচলায়তনে তোকে আবিষ্কার, তুই সহ অন্যদের লেখাগুলো পড়া আর এই বাংলা মুদ্রাক্ষরে রচনা শিক্ষা।
তোর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, স্মৃতিকথা আর সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে লেখাগুলি পড়লাম। প্রতিটি লেখা একধিকবার পড়লাম। অবাক হয়ে ভাবলাম এই বাল্যবন্ধুতো সেই বাল্যবন্ধু! সানদার ছুরির মতই ধারালো আর চকচকে। আজকের বাল্যবন্ধুর মধ্যেতো সেদিনের বাল্যবন্ধু এখনো বেঁচে আছে!!
আমি আজকাল পিছন ফিরে তাকাই প্রায়ই। দু'টি ব্যক্তিগত ব্যর্থতা সাংঘাতিকভাবে পীড়া দেয় আমাকে। প্রথমতঃ, আমি সঠিক মানুষের সাথে বন্ধুতা করি নাই। আমার সব বন্ধুরা অন্য জগতের মানুষ যেখানে আমি নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারি নাই। হাওয়া, পাখি ইত্যাদি বন্ধুরা এই দেশে থেকেও এখন জামাত পর্যায়ের লোকজন। প্রায় প্রতি কথায় বিসমিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, মাশাল্লাহ ইত্যাদি বিদেশি ভাষার প্রয়োগ করে। ওই ভাষাটিতে আমার বিশেষ দক্ষতা না থাকায় ওদের সাথে কথপোকথন ঠিক জমে উঠে না। অন্যদিকে রত্ন, বিদেশি কুকুর ইত্যাদি বন্ধুরা কি প্রজাতির মানুষ তা নিয়ে চিন্তা করতে করতে এক সময় অনুধাবন করি যে, এই বিশেষ প্রজাতিটিকে বুঝবার সাধ্যই আমার নাই। এদিকে আমেরিকার অন্য যেসব বাঙালিদের আমি এখানে এসে চিনেছিলাম, তাদের জাত বিচার করার দক্ষতাও আমার ছিলনা। তবে, একসময় আবিষ্কার করলাম যে, এই সব অবন্ধুদের সাথে একেকবার কথা বললে মুখে একটা তিটকুটে স্বাদের জন্ম হয় যা অনেকদিন ধরে কাটতে চায়না। তাই শেষে ভাবলাম, থাক, আর গোবর ঘাঁটাঘাঁটি না করাই বোধহয় ভাল হবে। সুতরাং, বন্ধুহীনতা এখন আমার প্রতিনিয়ত বাস্তবতা।
দ্বিতিয়তঃ, আমার পড়ালেখাতো কিছুই নাই! ব-কলম! তুই যখন একের পর এক বই পড়ে শেষ করে ফেলায় ব্যস্ত আর বিভিন্ন প্রগতিশীল কর্মকান্ডের সাথে জড়িত, আমি তখন একদল ছাগলের সাথে মাঠে চরে ঘাস খাই আর জাবর কাটি। যদিও ঘাস খাওয়ায় তোর আপত্তি ছিলোনা (ঘাস তুই পছনদই করতি), ছাগল সম্পর্কে আপত্তি ছিল খুব। মনে পড়ে বেশ কয়েকবার বিভিন্ন প্রসংগে তুই সেইসব ছাগলদের সম্পর্কে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলি। ক্ষোভের সংগে বলেছিলি একবার, 'তুই নষ্ট হইয়া গেছিস, ছাগলদের সাথে মিশিস, পোড়ালেখা করিসনা'। জীবনের এতগুলি বছর পার করে এখন সেই ভুলে ভরা দিনগুলির কথা ভেবে দুঃখ হয়। আসলে ভালোবাসা পাই নাই, তাই ভুলত্রুগুলিও শুধরানো হয় নাই।
তোর কথা সবসময় মনে পড়ে। কিছু কিছু সময়ে অন্য সময়ের চেয়ে বেশী। বছর খানেক আগে বব ডিলান এলেন তাঁর ব্যান্ড নিয়ে তাঁরই এই শহরে যেখানে তিনি শুরু করেছিলেন গান গাওয়া। তাঁর কনসার্টে বসে গান শুনতে শুনতে মনে পড়লো তোরও অতি প্রিয় এই কবিয়াল গায়ক ডিলান সাহেব। আরেকবার এলেন জাকির হোসেন আর বির্জু মহারাজ। তবলা আর নূপুরের মিলিত ঝংকারের দমকা বাতাস সেদিন স্মৃতির পাতাগুলো বারে বারে উল্টে দিচ্ছিলো। এইতো সেদিন গেলাম ফ্রিদা কাহলো'র চিত্র প্রদর্শনিতে। সেখানেও ছবিগুলি দেখতে দেখতে মনে পড়লো তোর কথা। একদিন তুই আর আমি কত ঘুরেছি কত চিত্র প্রদর্শনিতে! কত জটিল ছবি, কত না বোঝা ছবি!
নিজের কথাতো অনেক বললাম, এবার তোর কথা বল। কেমন আছিস তুই আর তোর ভালোবাসার নারী? সেবার সেই পানশালায় তোর ভালোবাসার কথা সবতো শোনাও হলো না। তোর ভালোবাসা, তার ভালোবাসা; তোর ভালোবাসা, তার অবহেলা মিশ্রিত ভালোবাসা; তোর ভালোবাসা, তার ভালোবাসার নষ্টামি, আরো অনেক কিছু বলছিলি সেইদিন। তবে পরদিন তুই যখন আমাকে দুরালাপনিতে জানালি যে তুই তোর ভালোবাসার নারীর দোষত্রুটিগুলো উপেক্ষা করেও তাকে ভালোবাসবি, সেদিন মনে মনে শুধু ভেবেছিলাম, নিশ্চয়! তুইতো সামাজিক এবং মানসিক সংকির্ণতাকে জয় করবি।
মনের নিভৃত কোনে গোপন আশা, একদিন দু'জনে আবার ভালো লাগা এক বিকেলে কড়া দুই কাপ কফি পান করে তোরই প্রিয় কোনো এক পানশালায় গিয়ে বসবো। নিজ নিজ পছন্দের পানীয়তে চুমুক দিতে দিতে, হালকা হতে হতে, মনের দরজা জানালাগুলো খুলতে খুলতে আর কথা বলতে বলতে পুরনো আর নতুন দিনের স্মৃতিগুলো ঘাঁটা ঘাঁটি করব আরেকবার।
পত্রপাঠ উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।
বাল্যবন্ধু
===================
সুশাচ
মন্তব্য
কে কার বন্ধু জানি না
তবে এই লেখাটি পড়ে মনে হয়ে গেলো
আমারও বহু বন্ধু বহুদিন থেকে প্রবাসে নিখোঁজ
তারা লেখেও না। বলেও না। তাদের কথা জানিও না
নতুন মন্তব্য করুন