• Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_clear_votes_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_electoral_list_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_results_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_votes_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).
  • Warning: call_user_func_array() expects parameter 1 to be a valid callback, function '_advpoll_writeins_access' not found or invalid function name in _menu_check_access() (line 454 of /var/www/sachalayatan/s6/includes/menu.inc).

না বলে চলে যাওয়া এক প্রিয় মানুষের কথা

স্বপ্নাহত এর ছবি
লিখেছেন স্বপ্নাহত (তারিখ: শুক্র, ২৫/০১/২০০৮ - ১:০৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কিছু কিছু মানুষ চলে যাবার পরেও চলে যেতে অনেক সময় নেয়। কিছু কিছু মানুষ আবার আরেকটু বেশি ত্যাদোড় টাইপের। নিজে চলে গেলেও ছায়াটুকু কখন যেন পেছনে ফেলে যায়।বাস্তবতার কড়া রোদে পুড়েও পুরোপুরি তা’ মুছে যায়না।সময় অসময়ে, রাতে বিরাতে মনের দরজায় এসে খট খট করে শুধু।বয়স কতইবা হল। সবে মাত্র একুশের নৌকায় পা ডুবিয়ে বসে আছি। এমন বয়সে চলে যাওয়া মানুষের চেয়ে কাছে আসা মানুষের মুখচ্ছবিতেই পুরো বুক ভরে থাকার কথা। কিন্তু জীবনের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে সবকিছু ব্যাকরণের নিয়ম মেনে চলার কথা ভাবা তো মহা বোকামি (আমি পোলাডা যদিও বহুত বোকাই আছি)।যাই হোক… যার কথা বলতে চাচ্ছিলাম।সেই ত্যাদোড় মানুষটার নাম জাহিদ রেজা।ফজলুল হক হাউসের ৩২তম ব্যাচ এর জাহিদ রেজা ভাই। যে অমন করে কাউকে না বলেই হঠাৎ আসর থেকে উঠে চলে গেল, কিন্তু সাথে করে তার স্মৃতি গুলো নিয়ে গেলনা।নিতে চাইলেই বা কি,খুব বুঝি ছেড়ে দিতাম। কাছের কোন মানুষের কাছ থেকে এতটুকু না বলে নেয়া যেতেই পারে। না হলে আর কাছের মানুষ কিসের।

তার সাথে প্রথম যেভাবে পরিচয়। ৩ জুন,১৯৯৯। মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে আমার প্রথম দিনের কথা। মাত্র ক্লাস সেভেন এর মাসুম বাচ্চা। ক্যাডেট কলেজের ডান হাত,বাম হাত কিছুই চিনিনা। একটেল “ইজি লোড” এর ইউনুস টাইপ অবস্থা আর কি। প্রথম দিনেই ক্লাস এইটের ফাহিম ভাই আমার জান মালের সব দায়িত্ব বুঝে নিলেন। ক্যাডেট কলেজীয় পরিভাষায় আজ থেকে উনিই আমার গাইড। কলেজের অফিসিয়াল রুল আর সিনিয়রদের আনঅফিসিয়াল (এবং মোস্ট ইম্পর্টেন্ট) রুল শেখানোই হল গাইডদের পবিত্র দায়িত্ব।ফাহিম ভাই যে এই বিষয়ে অতি দায়িত্বশীল তা বুঝতে খুব বেশি সময় লাগলো না।রিসেপশন এর ঝামেলা শেষ হবার পর ব্যাগ সহ হাউসে পৌছানোর আগেই প্রথম রুলটা তার কল্যাণে শেখা হয়ে গেল।

“সবার উপরে সিনিয়র সত্য,তাহার উপরে নাই।সিনিয়র কখনো মিথ্যা বলেন না।”
আমি শুনে মনে মনে আশ্চর্য হই।এখানকার সিনিয়ররা এত ভালো যে কেউই মিথ্যা বলেনা।অবশ্য এই মিথ্যা না বলা যে কোন অর্থে বোঝানো হয়েছে তা’ বুঝতে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি।
মুখে শুধু বলি-”জ্বী আচ্ছা।”
রুমে নিজের জায়গায় আসার পর ফাহিম ভাই নিজেই লকারে কাপড় চোপড় গুছিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন যে সেগুলো কোন প্যাটার্নে রাখতে হবে।এর ফাকে ফাকে খুচরো নিয়ম কানুন শেখানোর ক্লাস ঠিকই চলছে।
ফাহিম ভাই হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- “বাস্তবে কোনদিন বাঘ দেখসো?একেবারে সামনা সামনি?”
- “জ্বী দেখসি।একেবারে সামনা সামনি।তবে আমাদের দুইজনের মাঝখানে লোহার গরাদ ছিল,মানে চিড়িয়াখানায় দেখসি আর কি।”
- “ধূর মিয়া…মশকরা করো? সিনিয়রদের সাথে কখনো জোক করবানা।”- আরেকটা আন অফিসিয়াল রুল শেখা হয়ে গেল।
ফাহিম ভাই এরপর ভিলেইন মার্কা একটা হাসি দিয়ে বললেন- “দেখবা,দেখবা…টাইগার হাউসে যখন আসছো একেবারে খাঁচা ছাড়া বাঘই দেখবা।” ফজলুল হক হাউসের প্রতীক আবার বাঘ কীনা।
এরপর জরুরী কোন গোপন কথা বলার ভংগিতে আমার দিকে আরেকটু ঝুকে এসে ফাহিম ভাই বললেন-”শোন,এই হাউসে যতদিন জুনিয়র হিসবে আছো দুই জনের নাম আর ক্যাডেট নং কখনো ভুলবানা।একটা হইলো জাহিদ রেজা,ক্যাডেট নং-১৭৫১।আরেকটা হইলো…(থাক আজকে শুধু জাহিদ রেজা ভাইএর কথা।আরেক দিন আরেকজনের টা নিয়ে লিখবো)।”
“বুঝলা,এরা খাচা ছাড়া বাঘের চেয়েও ডেঞ্জারাস।” বলা শেষ করে এই অবোধ জুনিয়রটাকে ফাহিম ভাই আরেকটা ক্রূর হাসি উপহার দিলেন।বিনিময়ে আমি কেবল কোন মতে ঢোক টা গিলতে পারলাম।মনে মনে ভাবি খালি ক্যাডেট লাইফ ক্যান,জীবনে যত লাইফ আসে সব লাইফেই মনে রাখুম। খালি আল্লাহ জানি আমারে ওই ব্যাঘ্র শাবক দুইজনের হাত থাইকা বাঁচায়া রাখে।
এম্নিতেই সবে মাত্র প্রথম দিন। আসার আগে বন্ধু বান্ধব,আত্বীয় স্বজন এর কাছ থেকে কত ভয়াবহ কথা শুনে এসেছি ক্যাডেট কলেজ নিয়ে।তার মধ্যে আবার এক দিন যেতে না যেতেই এরকম খাঁচা ছাড়া ব্যাঘ্র শাবকের সাথে পরিচয়।নিজেকে কেমন জানি মাতৃহীন হরিণের বাচ্চার মত লাগছিল।অনাগত দিনগুলোর কথা ভেবে দিনের বেলাতেই আমার রাতের ঘুম হারাম হওয়া নিশ্চিত হয়ে গেল।

জাহিদ রেজা ভাইএর সাথে প্রথম সামনা সামনি দেখার সৌভাগ্য হতে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হলোনা।কয়েকদিন পরের কথা।বিকেলে হাউসের সামনের পথ ধরে কয়েক জন ক্লাসমেট সহ ক্যান্টিনে যাচ্ছিলাম।হঠাৎ কেউ একজন ফিস ফিসিয়ে বললো-”দেখ দেখ…পোর্চে তাকিয়ে দেখ।” কথা শুনে লুক ডাউন অবস্থা থেকে সামনে হাউস পোর্চে তাকিয়ে দেখি দশাসই সাইজের এক সিনিয়র,ছয় ফুট লম্বা তো হবেই,শুধু একটা শর্টস পরে বডি বিল্ডিং করছে। সবজান্তা ইরাদ সাথে সাথে বলে উঠে-”তোরা কেউ এই সিনিয়রটাকে চিনিস?”আমরা এক জন আরেক জনের দিকে শুধু মুখ চাওয়া চাওয়ি করি।কেউই চেনেনা।
“আরে এইটাই হইল জাহিদ রেজা ভাই।” বলে ইরাদ এর সবজান্তা টাইপের হাসি। জাহিদ রেজা ভাইরে চেনার জন্যে এই বছরের নোবেলটা তারেই দেয়া হইতেসে এমন একটা ভাব।
মনে মনে ভাবি- হুম্‌ম…ইনিই তাহলে জাহিদ রেজা ভাই।যার কথায় ক্লাশ সেভেন আর ক্লাস নাইন এক ঘাটে জল খায়।(ক্যাডেট কলেজে ক্লাস সেভেন-নাইনের মধ্যেকার রিলেশন বাঘ মহিষের চেয়েও ডেঞ্জারাস।অবশ্য মাইর গুলা সব সময় নাদান ক্লাস সেভেন এর কপালেই জোটে।কিন্তু রুমে ফিরে এসে মাসুম বাচ্চাগুলা ক্লাস নাইনের উদ্দেশ্যে যে গালি অমৃত বর্ষণ করে তা’ শোনার সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য কারো হলে মাইর খাওয়াকেই বরং অনেকে স্বস্তিকর ভাবতে পারেন।)
যাইহোক…কয়েকদিন পরেই আরো ভাল ভাবে মোলাকাত ঘটল।আদনান দোতলায় জাহিদ রেজা ভাইএর রুমের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল।হঠাৎ ভিতর থেকে বাঁজখাই কন্ঠের ডাক-
“অই ক্লাস সেভেন,এইদিকে আয়।” ক্লাস সেভেনে কারো কোন নাম থাকেনা এমন একটা অবস্থা।সবচেয়ে বড় পরিচয় যে ক্লাস সেভেনে পড়ি।সবাই একই সাথে ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা। ফাই ফরমায়েশ খাটতে খাটতেই দিন গুজরান করতে হয়।
গায়ের স্লীপিং শার্টটা খুলে আদনানের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন-
- “নিচের বোতামটা ছিড়ে গেসে।যা,সেলাই করে নিয়ে আয়।”
- “জ্বী,আমাকে আরেক সিনিয়র কাজ দিসেন।” ভয়ে ভয়ে আদনানের উত্তর
কিছুক্ষন কট মট করে তাকিয়ে থেকে জাহিদ রেজা ভাই বললেন
- “আচ্ছা তুই যা,আরেকটারে পাঠা।”
নিচতলায় এসে আদনান আমাদের ক্লাসমেট একজনের পর একজনকে অনুরোধ করতে লাগলো যাবার জন্য।কিন্তু কারো নাম নির্দিষ্ট না করে বলায় কেউই যেতে চাচ্ছেনা।কে আর শখ করে মরতে চায়।সবাই খালি বলে-আমারে ক্যান,অমুকরে বল।ওর তো কোন কাম নাই। এরকম অমুক তমুক করতে করতে সময় যে বেশ গড়িয়ে গেছে সেদিকে কেউ খেয়াল করিনি।
ফলাফলটা বোঝা গেল একটু পরেই…
ক্লাস এইটের এক সিনিয়র রুমে এসে অতি আনন্দিত কন্ঠে বলে গেল
- “ক্লাস সেভেন সব দোতলায় ফল ইন। জাহিদ রেজা ভাইএর হুকুম “
সবার গলা শুকিয়ে কাঠ।লাস্টবেড এর দুইটা ঘুমাইতেসিল।ঐ দুইটারে ধাক্কায়া তোলা হল।
“ওঠ ওঠ,জাহিদ রেজা ভাই ডাকসে।”
ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো ওরা দুইজন।ঘুমের ঘোর তখনো কাটেনি।তবে জাহিদ রেজা ভাইএর নাম কানে ঢোকার পর দুনিয়াবী লাইনে আসতে বেশিক্ষন টাইম লাগলোনা।সবাই প্রপার ড্রেসে(তখন দুপুর বেলা।সবার স্লীপিং ড্রেস পরা) পড়ি মড়ি করে দোতলায় জাহিদ রেজা ভাইএর রুমের সামনে করিডোর এ এক সারিতে দাঁড়িয়ে গেলাম।অন্যদের কেমন লাগতেসিল জানিনা।আমার তখন বুকের মধ্যে পুজার ঢাক বাজতেসে।আমার হৃদপিন্ড যে এতটা সবল তা’ আগে কখনো এমন করে টের পাইনি।
অবশেষে তিনি করিডোরে পা ফেললেন।শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের একেবারে সাক্ষাৎ উত্তরসুরী।কেউ না আসার কারণ জিজ্ঞেস করার পর আদনান কাহিনী খুলে বললো।সব শুনে সারির একেবারে প্রথম থেকে কে কি কারণে আসেনি তা’ জিজ্ঞেস করা আরম্ভ করলো।আমার টার্ণ আসতে যতদুর মনে পড়ে টয়লেটে থাকার অজুহাত দেখিয়েছিলাম।এক সময় সবার বলা শেষ হল।এক জোড়া চোখ সারির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কয়েক বার টহল দিল। সবার মুখ নিচু।কারন দেখাতে গিয়ে একেক জন যে ডাহা মিথ্যা বললাম এতক্ষণ সেটা আমাদের চেয়ে উনিই বোধহয় আরো ভালো বুঝতে পেরেছিলেন।আমাদেরই বা কী দোষ।ক্যাডেট লাইফে মিথ্যা বলার ফার্স্ট ওয়ার্ম আপ ম্যাচ। ব্যাটে বলে ঠিক মত হচ্ছিলনা।সব বুঝতে পেরে অল রাউন্ডার জাহিদ রেজা ভাইও তেমন কিছু বললেন না।তাই সেদিন অল্পের উপর দিয়ে বেঁচে গেলাম।বাঁচবার আগে অবশ্য সবাইকে নিজ নিজ স্লীপিং শার্ট এর সবগুলা বোতাম ব্লেড দিয়ে কেটে সেখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেলাই করতে হয়েছিল। আদনানের জন্য জাহিদ রেজা ভাইএর শার্টটা বোনাস হিসেবে ছিল। যে ব্লেড দিয়ে সেলাই কাটা হয়েছিল সেটাও আমারই কোন এক ক্লাস মেটকে দৌড়ে রুম থেকে আনতে হয়েছিল।আর সুঁই সুতার সাপ্লাই যে জাহিদ রেজা ভাই করেন নি সেটা বোধহয় না বললেও চলে।

কয়েকদিন পরেই ঘটলো আরেকটা ঘটনা।হৃদপিন্ডটা এবারো লাফালো।তবে ভয়ে নয়।কেন্দ্রীয় চরিত্রে সেই পুরোনো জাহিদ রেজা ভাই।সাথে জুটলো নতুন এক নায়িকা।
গেমস টাইম শেষে অবসন্ন এক বিকেল।জুনিয়র ক্লাস বলে সিনিয়রদের দশ মিনিট আগেই গেমস আওয়ার শেষ হয়।অন্যান্য দিনের মত এদিনও নাক মুখ খিঁচিয়ে দৌড়ে এসে গোসল করার জন্য একটা বাথরুম ধরলাম।অতঃপর দুই মিনিটে ম্যাগী নুডলস তৈরির রেকর্ড ভেঙ্গে দেড় মিনিটে গোসল শেষ করলাম।কারণ সিনিয়ররা হাউসে এসে পড়লে দেড় সেকেন্ডের জন্যও বাথরুম খালি পাওয়া যাবেনা।গোসল শেষে মাগরিব এর নামাজে যাবার জন্য তৈরি হয়ে প্রেয়ার ড্রেসে হাউস গার্ডেনের পাশের রাস্তাটা ধরে হাঁটছি।বাগানে চোখ পড়তেই দেখি পারভীন ম্যাডাম।ম্যাডাম সম্পর্কে আমি কিছু না বলে বরং আমাদের ইংরেজীর চিরতরুন হান্নান স্যার কি বলেছিলেন সেটা বলি।কোন এক হাউস এসেম্বলিতে ম্যাডাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে হান্নান স্যার তার স্বভাবসুলভ ইংরেজী ঢংএর বাংলায় বলেছিলেন-

“সেদিন দূর থেকে ফজলুল হক হাউসের বাগানে চোখ পড়তেই দেখি লাল রঙের এক অপরুপ সুন্দর ফুল সবগুলো পাঁপড়ি মেলে ফুটে আছে।সবটুকু সৌন্দর্য উপভোগের আশায় আরেকটু এগিয়ে আসলাম। কিন্তু কাছে আসতেই দেখি… একী!…বাগানে দাঁড়িয়ে এ যে মিসেস ফরিদা পারভীন!!!”
ম্যাডাম নিজে সেই এসেম্বলিতে উপস্থিত ছিলেন।লজ্জা রাঙা সেই মুখের দিকে তাকিয়ে প্রথম বারের মত স্যারের একটা কথার সাথে এক মত হয়েছিলাম।স্যার মোটেও ভুল বলেননি!!
(কানে কানে একটা কথা বলে রাখি।ম্যাডাম কেন জানি আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন।সেই গর্বে এখনো আমার মাটিতে পা পড়েনা। কলেজের ফ্রেন্ডরা একত্রিত হলে একটু খানি সুযোগ পেলে এখনো আমি সে কথা বলে বেড়াই।)
সেই পারভীন ম্যাডামকে বাগানে দেখতে পেয়ে পিচঢালা ঐ পথটারে যেন আরো একটু বেশি ভালোবেসে ফেলি । এত বিশাল একটা রাস্তা থাকতে শুধু বাগানের পাশের রাস্তাটুকুতেই পায়চারি করছিলাম।কিছুক্ষনের মধ্যেই আবিস্কার করলাম আজ সিনিয়র জুনিয়র অনেকের বুকেই পথের জন্য ভালোবাসা একটু যেন বেশি বেশিই জমে উঠেছে। ক্রমশঃ পায়ের আওয়াজ আরো কয়েকটা বেড়ে যায়।কে জানতো যে শুধু পথই নয়,মাঝে মাঝে পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বুনো ফুলও পথিকের সৃষ্টি করে!!
ততক্ষণে সিনিয়র গেমস আওয়ারও শেষ। ঘামঝড়ানো খেলাধুলা শেষে সবাই একে একে যার যার হাউসে ফিরছে। ফিরছেন জাহিদ রেজা ভাইও।তার রুমটা ছিল বাগান বরাবর দোতলার এক ফাইভ সীটার রুম। অন্যান্য দিনের মত না গিয়ে হাউসে ঢোকার প্রথম দরজা এড়িয়ে আজ কেন যেন তিনি বাগানের পাশের পথের দিকেই হাঁটা দিলেন! পারভীন ম্যাডামকে দেখলেই তার চোখে কেমন দুষ্টুমি খেলা করতো সেটা আমরা কম বেশি সবাই জানতাম। তাই উৎসুক চোখে সবাই তাকে ফলো করছি। এরপর না জানি কি হয়।
তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি তিনি আস্তে আস্তে বাগানের পথ ধরে এগিয়ে আসছেন। ঘামে ভেজা খালি গায়ের অবাধ্য পেশীগুলো বিকেলের রোদ পড়ে চিক চিক করছিলো। অমন চমৎকার একটা শরীর গঠনের আশায় অনেক ক্লাসমেটই গেমস এর পর রুমে এসে নিয়মিত ব্যায়াম করতো।তাদের বেশির ভাগই আমার মত শেষ মেষ “হ্যাংলা পাতলা গ্রুপ” ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসতে পারেনি। কয়েকজন অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কারোরই আর ‘জাহিদ রেজা’ হয়ে ওঠা হয়নি।
আরেকটু কাছে আসতেই ম্যাডামও তাকে দেখতে পেলেন।অমন অবস্থায় দেখতে পেয়ে অপ্রতিভ ভাব লুকাতে ম্যাডাম হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন- “জাহিদ রেজা,কেমন আছো?” কোন উত্তর এলোনা। তখনো সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। একেবারে ম্যাডাম বরাবর। ধীরে ধীরে ম্যাডামের সামনে এসে থামলেন। দুজনের মাঝখানে কেবল পাতাবাহারের গার্ডেন ফেন্স। তখনো কারো মুখে কোন কথা নেই। আমরাও নিশ্চুপ দর্শক। কৌতূহল আস্তে আস্তে বাড়ছে। এর পর জাহিদ রেজা ভাই যা করলেন আমরা এতটা আশা করিনি। ম্যাডামও যে এমন কিছুর কথা ভাবেননি সেটা বাজি ধরে বলতে পারি। হাতের পাশেই ছিল পপি ফুলের গাছ। একটানে একটা ফুল ছিড়ে বাড়িয়ে ধরলেন ম্যাডামের দিকে। দুচোখের সব মুগ্ধতা মুখে ফুটিয়ে বললেন- “ম্যাডাম,আপনাকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে!!” ব্যাপারটাকে মোটামুটি ভয়ংকরই বলা যায়।ক্যাডেট কলেজের মত জায়গায় তো বটেই। কিন্তু ফুল বাড়ানো হাতের আহবান এড়ানো কি আর এত সোজা কথা। ম্যাডামও সেই কঠিন কাজটি করতে পারেননি। ক্ষনিকের জন্য অপ্রস্তুত ভাব সামলে হাত বাড়িয়ে ফুল নিয়ে কোনমতে কেবল বলতে পেরেছিলেন-”থ্যাংক্‌স!!”
আমি তখনো হা করে দাঁড়িয়ে। পুরো দৃশ্য গোগ্রাসে গিলছি। শেষ বিকেলের রোমান্টিক আলোয় দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় বারের মত ম্যাডামের ফর্সা মুখটাতে লজ্জা জমে ওঠার দৃশ্য উপভোগ করছি। হৃদপিন্ডটা এবারো লাফাচ্ছিল।তবে ভয়ে নয়। হঠাৎ করে দানা বেঁধে ওঠা মধুর উত্তেজনায়। আর কিছুটা বোধহয় হিংসায়। ঐ মুহূর্তটার জন্য আমার বড় বেশি ‘জাহিদ রেজা’ হতে ইচ্ছে করছিল।
এরপরেও নানা কারনে নানা সময়ে জাহিদ রেজা ভাইএর সংস্পর্শে এসেছি। কারণে অকারণে বকা খেয়েছি। মাইরও খাইসি। কিন্তু প্রথম বারের মত তেমন করে আর ভয় লাগেনি। ততদিনে ভীতিকর চেহারা ছাপিয়ে তাকে স্নেহ প্রবণ এক সিনিয়র হিসেবেও আবিস্কার করা শুরু করেছি। প্রথম দিকে কোন কারণে বকা দিলে বা মাইর খাইলে রাগ লাগতো,মন খারাপও হত।পরে অবশ্য সে নিজেই ডেকে মাঝে মাঝে বোঝাতো। “ভাই আমার উপরে রাগ করিস না। জানিসইতো মাঝে মাঝে আমার মাথা টাথার কোন ঠিক থাকেনা।” রাগগুলো কোথায় যেন চলে যেত তখন।
মানুষটা হাউসকে অসম্ভব ভালোবাসতো। ভালবাসতো হাউসে থাকা এই আমাদেরকে। কলেজ ছেড়ে চলে যাবার দিন জাহিদ রেজা ভাইএর মত অমন করে আর কাউকে কোনদিন কাঁদতে দেখিনি। বিশাল বুকটাতে মুখ গুজে সেদিন আমিও তার শার্ট ভিজিয়েছিলাম। কলেজ থেকে বেরোবার পর প্রথম পিকনিকটাতে তিনি এসেছিলেন হাউস কালার ব্লু ভেস্ট পরে। কোথায় পেলেন জিজ্ঞেস করতে জানা গেল যাবার আগে সেটা চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই আগের মতই ছোট ছোট করে ছাটা চুল। হাসিখুশি,প্রাণশক্তিতে ভরপুর এক মানুষ। আমাকে দেখতে পেয়ে অনেক দূর থেকে কাছে এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন- “কিরে,কেমন আছিস?” হৃদপিন্ডটা সেদিন লাফায়নি।ভালবাসার গভীরতা বুঝতে পেরে দিঘীর জলের মত শান্ত হয়ে গিয়েছিল।
সেদিনই তার মুখে শুনলাম পড়ার জন্য অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছেন। সাথে সাথেই মনে পড়লো সেই জেন (zane) নামের স্বর্ণকেশী অস্ট্রেলিয়ান মেয়েটার কথা। জাহিদ রেজা ভাইএর পেন ফ্রেন্ড। তার লকারে স্কচ টেপ দিয়ে বড় সড় একটা ছবিও লাগানো ছিল। কখনো তার রুমে গেলে আড় চোখে ঐ ছবি দেখতে কখনো ভুল হতোনা। সাগর নীল চোখ দুটোতে লুকিয়ে লুকিয়ে চোখ রাখতে গিয়ে কতবার যে ধরা খাইসি তার ইয়ত্তা নেই। হাউস অফিস থেকে এয়ার মেইলের মন ভোলানো খাম যেদিন তার হাতে এনে দিতাম বিনিময়ে সবসময়ই কিছু না কিছু দিতেন। বেশির ভাগ সময়ই পেয়েছি চকলেট। অস্ট্রেলিয়ায় গেলে নিশ্চয়ই সেই স্বর্ণকেশীর সাথে দেখা হবে।হয়তোবা অপেরা হাউসের সন্ধ্যা আলোয় প্রথম বারের মত একে অপরকে চিনে নেবে দুজন। কে জানে সেদিন হয়তোবা জেন আপুর মুখটা পারভীন ম্যাডামের চেয়েও আরো অনেক বেশি লাল হয়ে উঠবে। এইসব আকাশ কুসুম ভাবি আর মনে মনে হাসি। কিন্তু কথাগুলো আর মুখফুটে বলা হয়না।কী আজিব… এখনো ভয় লাগছে বলতে!! অথচ এমন হবার কোন কারণই নেই। কিছু কিছু মানুষকে বোধহয় ভয় পেতেও ভালো লাগে।
জাহিদ রেজা ভাই অস্ট্রেলিয়া চলে গেলেন। মাঝে মাঝে শুধু এর ওর কাছে টুকরো টুকরো খবর শুনতাম। শেষবার যখন দেশে এসেছিলেন তখন আমরা ক্লাস ইলেভেন এ। কলেজেও এসেছিলেন এনুয়াল এথলেটিক্স এর সময়। তাকে দেখে অবাক না হয়ে পারিনা। চার বছরের ব্যাবধানে ক্লাস সেভেনের সেই ছোট ছোট ছেলেগুলো একটু একটু করে অনেক বদলে গেছে। আমাদের দেখে নতুন আসা ক্লাস সেভেন এর পোলাপানগুলাই আজ ভয়ে কাচুমাচু হয়। ভারিক্কী ঢং এ পুরো কলেজ দাপড়ে বেড়াই। অথচ তিনি একটুও বদলাননি। আমাদের নতুন সময়েও পুরোনো সেই জাহিদ রেজা ভাই।আগের মতোই জোশিলা আর ছটফটে। আমাকে দেখে এবারো চিনতে ভুল করেননি। হাসিমুখে সেই একই প্রশ্ন-”কিরে,কেমন আছিস?”
দেখতে দেখতে এক সময় আমাদের কলেজ লাইফও শেষ হয়ে এলো। ঘুরতে ঘুরতে শেষমেষ আই ইউ টি তে এসে জুটলাম ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। ফার্স্ট সেমিস্টারের মাঝামাঝি কোন এক দিনের কথা। আই ইউ টি তে পড়া কলেজের এক সিনিয়রের মুখে প্রথম শুনলাম কথাটা। জাহিদ রেজা ভাই সিডনীতে কার এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছেন। শুনে হৃদপিন্ডটা লাফায়নি। মনে হলো কিছুক্ষনের জন্য স্থির হয়ে গিয়েছে। পাহাড়ের গা বেয়ে জড়িয়ে ওঠা রাস্তা থেকে অনেক নিচে খাদে ছিটকে পড়েছিলো গাড়িটা। জাহিদ রেজা ভাই নিজেই ড্রাইভ করছিলেন। অমন বিশাল আকারের মানুষটার শরীর নাকি এত বেশি পুড়ে গিয়েছিল যে লাশ দেখে সনাক্ত করা যায়নি। সব শুনে বুঝতেই পারিনি চোখদুটো কখন ঝাপসা হয়ে এসেছে। টুকরো টুকরো কত শত স্মৃতি ঠেলে ঠুলে বেরিয়ে আসতে চাইছে বুক ছিড়ে। খুব বেশি করে মনে পড়ছিল আন্তঃ হাউস প্রতিযোগিতায় তার একক অভিনয়টুকুর কথা। ডঃ ফস্টাস হয়ে লুসিফারের কাছে দু হাত জোড় করে জীবন প্রার্থনা করছিলেন চোখ ভরা আকুতি নিয়ে। অমন চমৎকার অভিনয় দেখে সেদিন চোখ ভিজে উঠেছিলো ডঃ ফস্টাস এর অসহায়ত্বের কথা ভেবে। কয়েক ফোঁটা গড়িয়ে পড়লো আজও। গাড়ির মধ্যে জীবন্ত দগ্ধ হতে হতে হয়তো সেদিনও আকুতি জানিয়েছিলেন অসহায় ডঃ ফস্টাস এর মত। লুসিফার নয়,বিধাতার কাছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। ছয় ফুটী শরীরটা পুড়তে লাগলো ততক্ষণ।যতক্ষন পর্যন্ত তাকে ‘জাহিদ রেজা’ বলে আর না চেনা যায়।

বড় অসময়ে চলে গেলেন তিনি।
হৃদপিন্ডটা মাঝে মাঝে আজো লাফিয়ে ওঠে বিশুদ্ধ আবেগে। জাহিদ রেজা ভাইএর কথা ভেবে। অবচেতন মন এখনো নিরর্থক অপেক্ষায় থাকে। কাঁধে পরিচিত সেই হাতের ভর অনুভবের আশায়। পিছন ফিরে তাকালেই যেন পুরোনো দিনের উষ্ণতায় বলে উঠবেন- “কিরে,কেমন আছিস??”

স্বপ্নাহত


মন্তব্য

রানা মেহের এর ছবি

বাহ!
আপনি তো ভালো লেখেন স্বপ্নাহত।
জাহিদ ভাইয়ের জন্য দুঃখীত

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

এত অসাধারণ একটা লেখা আগে পড়ি নাই কেন?

শুরু থেকেই খুব ভাল্লাগতেছিল লেখাটা, শেষটা এমন হবে ভাবি নাই ... খুব খারাপ লাগছে জাহিদ ভাইয়ের জন্য ...

অতিথি লেখক এর ছবি

রানা মেহের, আপনার কবিতাটা পড়ে আমি পুরা ফানা হয়ে গেসি।

কিংকর্তব্যবিমূঢ়, জাহিদ রেজা ভাই এর কথা ভেবে আমরা যারা তার জুনিয়র ছিলাম সবারই এখনো অনেক খারাপ লাগে।এমন মানুষ হঠাৎ করে এমন ভাবে শূণ্যে মিলিয়ে যেতে পারে চোখে দেখেও ঠিক বিশ্বাস হতে চায়না।না,ভুল বললাম।এমন মানুষ আসলে মিলিয়ে যায়না। বড়জোর চোখের আড়াল বলা যেতে পারে।
আল্লাহ তাকে বেহেশত নসীব করুন।

- স্বপ্নাহত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।