মৃত্যু নিয়ে চিন্তাটা আমার একদিনের নয়। কিন্তু এখন যেভাবে ভাবছি তা আগে ভাবতে পারতাম না কয়েকটি কারণে, প্রথমত আগে মন এতোটা উন্মুক্ত ছিলনা এবং দ্বিতীয়ত হাতে তেমন কোন রিসোর্সও ছিলনা। সবই যখন একসাথে পেয়ে গেলাম তখন ভাবতে বাঁধা কোথায়। ভাবতে গিয়ে প্রথম রিসোর্স ছিল অভিজিৎ রায়ের "মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে"। অবশ্যই মুক্ত-মন নিয়ে পড়েছি বইটি। মরণ নিয়ে সেই থেকে চিন্তা হয়েছে জোড়ালো। সিদ্ধান্ত তো নিয়েই ফেলেছি, মরণের একটা এসপার ওসপার না করে অন্য কিছুতে মন দেব না। বিজ্ঞান নিয়েই তো প্রথমে ভাবা উচিত ছিল। কিন্তু সাহিত্য আর তা হতে দিল কই। জনপ্রিয় ধারার এই এক সমস্যা, চারিদিকে তাকালে সাহিত্যই আগে চোখে পড়ে; বিজ্ঞান একটু পশ্চাদপদই। আমার তো কিচ্ছু করার নাই, ভাল লেগেছে একটা আর লিখব আরেকটা তা হবেওনা।
নেটে সার্চটা শুরু করেছিলাম গুগলে "ডেথ" লিখে সার্চ দেয়ার মাধ্যমে। সবচেয়ে মজা লাগল "Welcome to Death - the last taboo" শিরোনামটি দেখে। চোখ কান খোলা রেখেই সোজা ঢুকে পড়লাম deathonline.net-এ। হতাশ হতে হয়নি। পড়া শুরু করেছিলাম "The face of death" লেখাটি থেকে। সেখান থেকে "ডেথ মাস্ক"। বাংলা দেখে নিলাম- "মরণ-মুখোশ"। একে ঘিরেই লেখা শুরু করার ফিকির করছি এমন সময় বাঁধ সাধলো "লাঁকোনু দ্য লা সেন"। এটা আবার কি? পেলামই বা কিভাবে? আসলে ডেথ মাস্ক লিখে ইংরেজি উইকিপিডিয়াতে সার্চ দিয়েছিলাম। নিবন্ধটিতে এক অদ্ভুত সুন্দর মুখাবয়ব দেখে থেমে যেতে হল। একটি মেয়ের মুখ, চোখ দুটি বন্ধ, মুখের হাসিটাই মূলত অদ্ভুত রকমের ভয়ংকর সুন্দর। এই মেয়েটিরই নাম "লাঁকোনু দ্য লা সেন"। উইকিপিডিয়ার এই নামের নিবন্ধে গেলাম, জানলাম, এ সদ্য যৌবনে পদার্পণোদ্যত এক ফরাসি রমণী, অন্তত ১৮৯০ সালের পরে ধরাভূমে যার পা পড়েনি। ১৮৮০'র দশকে প্যারিসের সেন নদীতে তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল; জেইন ডো, নাম পরিচয় নেই, কেউ কোনদিন সনাক্ত করতেও পারেনি। দেহে কোন আঘাতের চিহ্ন না থাকায় ধরেই নেয়া হয় আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু মুখে একি অপূর্ব হাসি। বদ্ধ আঁখিতে মৃত্যুর ছায়া থাকলেও আনন্দে এলিয়ে পড়া হাসি তাকে জীবিত করে তোলে। সৎকারের আগে মর্গে বেশ কিছুদিন তার লাশ রেখে দেয়া হয়।
বদ্ধ আঁখির মরণ-মুখোশ বা সেই মুখোশের স্মিত হাসিতে জীবনের ছায়া- কোনটি দেখে যে, প্যারিসের সেই মর্গের জনৈক রোগ-নিরূপণবিদ অভিভূত হয়েছিলেন তা আমার জানা নেই। কেবল মরণ-মুখোশ তৈরীর মাধ্যমে লাঁকোনুকে চিরঞ্জীব করে রাখার জন্য তাখে সাধুবাদ দিয়ে ক্ষান্ত হতে চাই। কারণ কাজ অনেক বাকি, সব গুছিয়ে এনে তবেই না আবার তার লাশের অথেন্টিসিটি নিয়ে ভাবনা।
সেনের এই অচেনা নারীকে (ফরাসি ভাষায় "লাঁকোনু দ্য লা সেন" অর্থ সেনের অচেনা নারী) নিয়ে আরও জানতে হবে। এভাবে মরণ বিষয়ক চিন্তা-ভাবনা শুরু করতে পারায় আমি তখন এমনিতেই খুশি। তার উপর পেয়ে গেলাম একটি চমৎকার প্রবন্ধ। Anja Zeidler কর্তৃক লিখিত প্রবন্ধের লিংক ইংরেজি উইকির নিবন্ধেই দেয়া আছে। প্রবন্ধটিতে মূলত সাহিত্যে লাঁকোনুর সরব উপস্থিতির প্রমাণ দেয়া হয়েছে। এমনটিই চাইছিলাম। প্রথমেই এসেছে আলবের কামুর কথা। তিনি অনেককে তার সংগ্রহের ভাস্কর্য ও মুখাবয়বগুলো দেখাতে ভালবাসতেন। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছিল আঁকোনু (লাঁকোনু-কে ভেঙে লিখা যায় ল' আঁকোনু)। আঁকোনু দেখিয়ে তিনি বলতেন,
লাঁকোনু দ্য লা সেনের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া মুখচ্ছবি, ফুটে আছে এক ডুবন্ত মোনালিসার স্মিত হাসি।
আমার কাছে হাসিটা কিন্তু মুখ্য নয়, মরণ-মুখোশে ঠিক কিভাবে জীবনের ছায়া পড়েছে তা দেখেই আমি বিস্মিত। একই সাথে এটিও বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, সে জীবন-মুখোশ নয়, অকৃত্রিম মরণ-মুখোশ। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে পরবর্তী সাহিত্যিকদের লাঁকোনু-ভাবনা পড়া শুরু করলাম। রিচার্ড লা গ্যালিয়েন, ভ্লাদিমির নবোকভ এবং রাইনহোল্ড কনরাড মুশ্লারের ভাবনা নিয়ে তো ভলিউম রচনা করা যাবে। ফরাসি কবি জুল সুপের্ভিয়েলের চিন্তন দেখেই লাঁকোনু-সাহিত্যের ভুবনে প্রথমবারের মত বিস্মিত হয়েছি। তিনি ১৯৩১ সালে "লাঁকোনু দ্য লা সেন" নামে একটি গল্প লিখেন। গল্পে ১৯ বছর বয়সের একটি মেয়ে সেন নদীর স্রোতে সমুদ্রের দিকে ভেসে যায়। তার বর্ণনাটা এরকম,
শুধুই ভেসে বেড়াচ্ছে, সে নিজেও নিজের মুখের হাসিটার কথা জানেনা। অথচ জীবিত যে কারো চেয়ে অনেক অবিশ্রান্ত সে হাসি দেখে কেন জানি শিউরে উঠতে হয়। সামনে যা-ই আসুক তারই অনুগ্রহ ছিনিয়ে নেবে যেন।
মুহাম্মদ২০১৭
মন্তব্য
মরণ- মুখোশের ছবিটা দেখলাম। লেখাটি দারুন হয়েছে। অনেক কষ্ট করে লেখা তা বোঝা যায়। তবে ছবিটা কোথায় গেল কে জানে?
রায়হান আবীর
দারুন লেখা নিঃসন্দেহে। তবে কোন ঝামেলার কারণে হয়তো ছবিটা আসে নাই। সেন নদীর সেই কিশোরি ঠান্ডা, নির্মল হাসির সাথে ভিঞ্চির মোনালিসার তুলনা হয় না।
রায়হান আবীর
নতুন মন্তব্য করুন