ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পর্ব-৬(খ)।

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ৩১/০১/২০০৮ - ১:৪০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(আগের অংশটুকু জানার জন্য 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পর্ব-৬(ক)' পড়ুন)

এক সপ্তাহের আগেই রিপোর্ট এলো যে আমাদের প্ল্যান সাকসেসফুল হয়েছে। শুধু সাকসেসফুল না, একেবারে সুপার সাকসেসফুল। যাবতীয় মেয়েরা ভয়ে চিটাগং এর নামও মুখে আনছেনা।
এমনকি কয়েকজন ছেলেও পিছিয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে একজন হোল রফিক। তার সাথে আমাদেরই ক্লাশের মিতুর কঠিন প্রেম চলছে তখন। মিতু এমনই ভয় পেয়েছে যে সে রফিককে দিয়ে কসম কাটিয়েছে চিটাগং না যাওয়ার জন্য। ভাগ্যিস-চিকনবুদ্ধির আশরাফ আমাদেরকে আগেই সতর্ক করে দিয়েছিল ভয় দেখানোর প্ল্যানটা রফিককে না বলার জন্য। রফিক মুখভার করে বললো,"মনে কত আশা ছিল মিতুকে নিয়ে একটু সী-বীচে ছবি-টবি তুলবো। কিন্তু ও যে কেন এত ভয় পেল, কে জানে? যাক-প্রেমের জন্য নাহয় একটু স্যাক্রিফাইস করলামই।"
আমরা তার দীর্ঘশ্বাসে মুখ লুকিয়ে হাসি।

মেয়েদের এবং দু চারটে নাবালক টাইপের ছেলেদের বাদ দিয়ে আমাদের সংখ্যা দাঁড়ালো উনিশ জন। দশদিন পর আমাদের যাত্রা।

কিন্তু তখনো একটা বড় কাজ বাকী। সেটা গুবলেট হলে পুরো ট্রিপই ক্যানসেল হয়ে যাবে। কাজটি হচ্ছে আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য একজন টীচার ঠিক করা। কাজটি আপাত দৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও স্যারেরা কেউ এই কাজে রাজী হন না। কারণটি সোজা। এক দংগল ছেলের দায়িত্ব কেইই বা সুস্থ মাথায় নিতে চায়?

দু এক জনকে বললাম, এবং বলাই বাহুল্য তারা আমাদের ফিরিয়ে দিলেন। শেষমেশ গেলাম ফজল স্যারের কাছে। জীবনের শেষ চিকিত্সা। উনি ফিরিয়ে দিলে সবকিছু বরবাদ হয়ে যাবে।

এই প্রসংগে ফজল স্যার সম্পর্কে দু-একটি কথা না বললেই নয়। আমার জীবনে দেখা সমস্ত শিক্ষকদের মধ্যে উনি হচ্ছেন অতুলনীয়, লাখো মেঁ এক। কারণ উনি মাথা আউলা লোক ছিলেন। মাঝে মাঝেই উনাকে দেখতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের বন্ধুরা আসতো। স্যারকে দেখার ফি হচ্ছে একটা সিগারেট আর স্যারের সাথে পাঁচ মিনিট কথা বলার ফি হচ্ছে টিএসসি র এক প্লেট বিরিয়ানি। যারাই এসেছে তাদের সবারই পয়সা উসুল হয়েছে বলে শুনেছি।
উনি দুবার বাইরে গিয়েছিলেন পি এইচ ডি করার জন্য, এবং দু বারই ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছিলেন। বর্তমানে উনি কোথায় আছেন জানিনা।
তাকে দেখবার পর আমার এক বন্ধুর মন্তব্য ছিল, "দোস্‌-এইরকম লোক কোটিতে একজন জন্মায়। বাংলাদেশের জনসংখ্যা দশ কোটি (তখন ছিল), অতএব এই রকম লোক দেশে আছেই মাত্র দশজন। তাদের মধ্যে নয়জনই গণপিটুনিতে মারা গেছে, ইনিই হচ্ছেন ওই প্রজাতির শেষ এবং একমাত্র জীবিত উদাহরণ। সেই হিসেবে ইনি আমাদের জাতীয় সম্পদ। তোর দোহাই লাগে, তোরা ইনাকে চিড়িয়াখানায় রেখে আয়। আমাদের জগতে উনি নিরাপদ নন।"
আর এক বন্ধুর মন্তব্য ছিল,"শুনেছি কিছু কিছু লোকের মাথার স্ক্রু ঢিলা হয়। ইনি বোধহয় পয়সার অভাবে উনার মাথার সব স্ক্রু সের দরে বেচে দিয়েছেন।"

ফজল স্যার কিন্তু আমাদের যাবার কথা শুনে প্রবল উত্সাহিত হলেন। "তোমরা সত্যিই চাও যে আমি তোমাদের সাথে যাই?"
"অবশ্যই স্যার। আপনি আমাদের যেরকম আদর করেন, আপনি ছাড়া আমরা তো যাবোইনা।"
"অলরাইট। লেটস্‌ গো বয়েজ এন্ড গার্লস!"
"স্যার-শুধুই বয়েজ। গার্লসরা যাবে না।"
"সেকি কেন? ওদের শিক্ষার কোন উত্সাহ নাই? চলো, আমি ওদের গিয়ে বোঝাবো।"
পাগলকে নিয়েতো দেখি মুস্কিলই হোল।
তাড়াতাড়ি বলি, "স্যার। ওদের মাথায় এখন শুধু বিয়ের চিন্তা। ওদের বাদ দেন। আমরা আমরাই এনজয় করি।"

ঢাকা থেকে চিটাগং যাবো ট্রেনে করে। পুরো কামরাটাই আমাদের জন্য বুক করা হয়েছে। একে একে সবাই উঠলাম ট্রেনে। ট্রেন ছাড়লো এক সময়। কি মজাই না লাগছিল। ঢাকা শহরের সীমানা ছাড়বার পর আমরা ক'জন মিলে স্যারের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। স্যার একটা বই পড়ছিলেন, আমাদের দেখে মুখ তুললেন। "কি ব্যাপার?"
"স্যার-একটা কথা আছে। যদি বেয়াদবী না নেন তবে বলি।"
"বলো।"
"স্যার আপনি বোঝেনই, আমাদের বয়েসটা খারাপ। নানান রকমের কু অভ্যাস আছে।"
স্যারের মুখ শুকিয়ে যায়। তিনি তুতলে বলেন,"কুঅভ্যাস? কি রকম কুঅভ্যাস?"
"বদসঙ্গে পড়ে সিগারেটের নেশা করে ফেলেছি। আপনার সামনে সিগারেট খাবার অনুমতি না পেলে তো প্রাণ যায়।"
স্যার হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন।"ও-সিগারেট খাবে? এটা আবার কোন কুঅভ্যাস নাকি? তা খাওনা যত ইচ্ছে। আমাকেও দিও দু একটা মাঝেসাজে। তোমাদের ভাবীর যন্ত্রণায় সিগারেট খাওয়াটা ছাড়তে হয়েছিল, তবে মাঝসাজে খেতে ভালই লাগে।"

ট্রেন চলছে কু-ঝিক-ঝিক। দুপুরে খাবার বগী থেকে লাঞ্চ এলো। সে পর্বের পর তাস খেলতে বসলাম। স্যারও ভালই তাস খেলেন। ভারী মজা লাগছে। আখাউড়া স্টেশনে নেমে ছবি তুললাম সবাই। চিটাগং পৌছালাম ঠিক সন্ধ্যেবেলা। স্টেশন থেকে সোজা পি ডবলু ডির রেস্ট হাউস।

পরদিন সকাল বেলায় উঠে দৌড় বাসস্ট্যান্ডে। গন্তব্য কক্সবাজার। যে বাস যাচ্ছিল, তাতে প্রচন্ড ভিড়। এর মধ্যেই কোনভাবে সবাই উঠলাম। বসার জায়গা পেলনা অনেকেই। আমি আর কয়েকজন বসলাম ড্রাইভারের পাশেই গিয়ার-বক্সের উপর।

বাস চলছে। খেয়াল করলাম, পাশে বসা একজন লোক আমাদের দিকে বার বার তাকাচ্ছে। লোকটির পরণে একটি ময়লা পাজামা। দেখে একদম অশিক্ষিত মনে হচ্ছিল না। কিছুক্ষন পর লোকটি আমাদের জিজ্ঞেস করলো, যে আমরা কোথা থেকে এসেছি। বললাম যে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। কক্সবাজার দেখতে যাচ্ছি।
লোকটি একটি সিগারেট ধরায়। তার একটু আনমনা ভাবেই বলে,"সবাই যায় কক্সবাজার। কক্সবাজারে কি আছে? কিছুই নাই। আসল জায়গায় কেউ যায়না। যাবে কেমনে? তার খবরতো কেউ জানেইনা।"

গল্পের গন্ধ পেয়ে আমরা তার কাছ ঘেঁষে বসি। "আসল জিনিসটা কি ভাই?"

লোকটা এক গাল ধোঁয়া ছাড়ে। তারপর আমাদের উত্সাহ দেখে হাসে। বলে,"আসল জায়গার কথা জানতে চান?"
আমরা ঘাড় নাড়ি।
"তাহলে শুনেন।"

(বাকী অংশটুকু পরের পর্বে)

-নির্বাসিত


মন্তব্য

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

ভালোই টেনশনে রাখার কায়দা জানেন মশাই। হাসি

বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।