শায়েস্তা আবদুল করিম ছিল আমার এযাবত দেখা সব মানুষের মধ্যে সবচেয়ে পাকা মিথ্যেবাদী। চোখের পাতা বিন্দুমাত্র না কাঁপিয়ে মুহুর্তের মধ্যে সে অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য একটি গল্প ফেঁদে বসতে পারতো, এবং সেটাও তেমন কোন রকম চিন্তা ছাড়াই।
যেদিন প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশে এসে বসলাম, সেদিন শিক্ষক আসবার আগে আমি আমার চারদিকে ভাল করে তাকিয়ে ছিলাম। তাকিয়ে ভয়ে আমার বুকের ভিতরটা হিম হয়ে গিয়েছিল। আমার চারদিকে বসে থাকা এরা কারা? তাদের কাউকেই চিনিনা। কেমন হবে এরা? আমার স্কুল আর কলেজ জীবনের বন্ধুর সংখ্যা খুব বেশী ছিলনা, কিন্তু যারা ছিল তারা আমার খুব কাছের মানুষ ছিল। তাদের কেউই ছিলনা আমার সাথে। আরও ভয়ের কথাটা হচ্ছে যে এই সব নতুন ছেলেমেয়ের সাথে আমাকে চার বছর কাটাতে হবে (এবং কমপীট করতে হবে)।
সেই দিনের কথা ভাবলে আজও আমার বুকের মধ্যে গুর গুর করে ওঠে। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি পৃথিবীতে যেন আমাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। সেদিনই কেন ক্লাশ থেকে বেরিয়ে যাইনি তাইই আজ বসে ভাবি।
আস্তে আস্তে দু চারজনের সংগে পরিচিত হলাম। ঢাকা কলেজের মিঠু,সোহেল আর মুশফিক, নটরডেম কলেজ থেকে আসা ইফতি, শাহনেওয়াজ, রহমত আর বিশ্বদেব। ঢাকার বাইরের ছেলেদের মধ্যে চিনলাম রাজশাহীর আজিম, টাংগাইলের কামাল, সিলেটের খুরশিদকে। এতসব নামের সাথে তাদের চেহারা মেলানোতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ভয় হয় আবার ভুল করে না যেন কামালকে সোহেল বলে ডেকে না ফেলি।
ক্লাশ চলছে। কিছুই বুঝিনা বলতে গেলে। কলেজ পর্যন্ত পড়েছিলাম বাংলা মিডিয়ামে, এখানে সবই ইংরেজীতে। তার উপর বিষয়টিগুলিও ভয়ানক রকমের কঠিন। বোঝার উপর শাকের আঁটি হয়ে আছেন জয়েনুদ্দিন স্যার (পর্ব-২) । তিনি তো ততদিনে রীতিমত ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ফেলেছেন তার কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর ক্লাশে।
একদিনের কথা। ক্লাশ চলছে। কি পড়ানো হচ্ছে সেটা মিনিট দশেক বুঝবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে মনের দুঃখে খাতায় আবোল-তাবোল লিখছি। এমন সময় কানের কাছে ফিস ফিস আওয়াজ শুনলাম,"এইসব কি লিখছো তুমি?"
পাশ ফিরে তাকাই। ছেলেটির মুখ চেনা, কিন্তু নাম জানি না। এমনিতেই স্যারের ব্ল্যাকলিস্টে আছি বলে তার প্রশ্নের জবাব দিলাম না তখন। কিন্তু ক্লাশের পর পরিচয় হোল।
"আমার নাম শায়েস্তা আবদুল করিম।"
এতো দেখি তিন কেজি ওজনের নাম।
"তুমি আমাকে শায়েস্তা, অথবা আবদুল অথবা করিম যে কোন নামেই ডাকতে পারো। আমি কুমিল্লা থেকে এসেছি।"
ও- আমারি মতো বহিরাগত। মনে শান্তি পেলাম। "চল চা খেয়ে আসি।"
"তা নাহয় গেলাম। কিন্তু তুমি কি লিখছিলে তখন? কবিতা নাকি?"
আমি একটু লজ্জা পাই। "না না কবিতা কোথায়। সব হাবিজাবি।"
"আরে-দেখিই না, তুমি এত লজ্জা পাচ্ছ কেন?" জোর করেই খাতা নিয়ে নেয় সে। "পড়তে তো ভালই লাগছে। তুমি কি নিয়মিত লেখো? তোমার লেখা কি ছাপা হয়েছে কোথাও?"
"দূর- এটা কি ছাপা হওয়ার মতো জিনিস নাকি?"
ক্রমে ক্রমে বন্ধুত্ব বাড়ে। জানলাম করিম থাকে আরামবাগের দিকে। তার মামার বাসায়। আরো জানতে পারলাম যে সে আসলে ডাক্তারী পড়তে চেয়েছিল, কিন্তু মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা কি করে যেন খারাপ হওয়াতে সে চান্স পায়নি। তবে সে পরের বছর আবার চেষ্টা করবে। এই জন্যে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত না।
"আমিতো চলেই যাচ্ছি সামনের বছর।"
একদিনের কথা খুব মনে পড়ছে। আমরা তিনজন ছিলাম সেদিন, আমি, করিম আর মিজান (যে পরে আমার রুমমেট হয়েছিল, পর্ব-৩ )। কার্জন হল এলাকায় একটা চায়ের দোকানে বসে কথা বলতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে তখন। মিজান তার পরিবারের কথা বলছিল।
মিজানের জন্ম হবার চার বছর পর তার মা মারা যান। কিছুদিন পর মিজানের বাবা আবার বিয়ে করেন, এবং সেই সংসারে মিজানের জায়গা হয়নি। খুব ছোট বয়েস থেকেই মিজান হস্টেলে থাকা শুরু করেছে। এমনকি লম্বা ছুটির সময়েও যখন স্কুল বন্ধ থাকতো, তখনো মিজানকে হস্টেলে থাকতে হয়েছে। শুধু দুই ঈদের সময়ে বাড়ী যেতো সে।
সে বলছিল, "জানিস-তোদের সবার ছেলেবেলা কেটেছে এক রকম ভাবে, আর আমারটা কেটেছে সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে। মায়ের একটামাত্র ছবি আছে আমার কাছে। সেখানে তার চেহারাটাও ভাল করে বোঝা যায়না। তবুও ওটাই আমার মায়ের একমাত্র চিহ্ন। মাঝে মাঝে সুটকেস থেকে বার করে দেখি"। আবেগে মিজানের গলা ধরে আসে।
আমরা দু'জন সন্ধ্যের সেই আলো-আঁধারীর মধ্যে চুপ করে বসে থাকি। কি বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
এমনি সময় করিম একটু গলাখাঁকারী দেয়। "আসলে তোর অবস্থা তো এত খারাপ না। তোর মা তো মারাই গেছে।"
এ কথা শুনে আমি অবাক। মিজানের চোখের পানি থেমে যায়। সে কেমন যেন ভ্যাবলা মেরে গেল।
"মা মারা যাওয়াটা খারাপ ব্যাপার না? কি বলছিস তুই?" আমি বললাম।
করিম মাথা নীচু করে ঘাসের ডগা ছেঁড়ে। মিজান জিজ্ঞেস করে,"কিরে- তুই কথা বলছিস না কেন?"
করিম আস্তে আস্তে বলে,"আমার মা যদি মারা যেতো, তাহলে বোধহয় আমি বেশী খুশী হ'তাম। তুই তো মা মারা যাওয়ার দুঃখে কাঁদছিস, আমার মা মারা গেলে আমি আনন্দে দু হাত তুলে নাচতাম।"
আমি আর মিজান সে কথায় স্তম্ভিত হয়ে যাই।
(পড়তে থাকুন)
করিম আগের মতোই মাথা নীচু করে থাকে। তার হাতের কাছে এক গোছা ঘাস মুঠো করে ধরে সে। তারপর আমাদের দিকে সোজা দৃষ্টিতে সে তাকায়।
"তোরা নিশ্চয়ই ভাবছিস যে আমি একটা পাগলের মতো কথা বলছি। ছেলে হয়ে আমি আমার মায়ের মৃত্যু কামনা করছি। জানিস কেন করছি?"
প্রবল আক্রোশে সে একটানে ঘাসের গোছাটিকে উপড়ে তোলে। তারপর জোরে ছুঁড়ে ফেলে দূরে।
"কেননা যখন আমার বয়েস মাত্র এক বছর তখন আমার মমতাময়ী মা আর একজন লোকের সাথে সংসার ছেড়ে পালিয়ে চলে গেছে। ভাবতে পারিস কয়টা মা এই রকম নিষ্ঠুর একটা কাজ করতে পারে? বলতে পারিস কত বড় স্বার্থপর হলে একজন মা তার দুধের শিশুকে ফেলে চলে যেতে পারে? মিজান, তুই ভাগ্যবান কেননা তোর মনে যে মায়ের ছবি আছে সে মা ফেরেশতার মতো। আর আমার মনে যে মায়ের ছবি সে মাকে দেখে আমার মনে শুধু ঘৃণা ছাড়া আর কিছু আসেনা। আমি এমনই এক কপালপোড়া।"
মিজান আস্তে আস্তে বলে,"আমি খুবই দুঃখিত করিম। আমি জানতাম না যে তুই তোর মনে এই রকম একটা বিশাল দুঃখের ভার বয়ে বেড়াচ্ছিস।"
করিম ম্লান হেসে বললো, "দুঃখের ভার এর কথা বলছিস? তোরা কি জানিস মা চলে যাওয়ার পর কি হয়েছিল? মায়ের শোকে আমার দরিদ্র স্কুলশিক্ষক বাবা পাগলের মতো হয়ে গেলেন। শুনেছি উনি নাকি শুধু বলতেন, তোমরা দেখো, সুলতানা ঠিকই ফিরে আসবে। আমার উপর হাজার রাগ থাকলেও নিজের ছেলের মায়ায় ঠিকই ফিরে আসবে। মা কোনদিনই ফিরে আসেনি আর। মাঝখান থেকে কিছুদিন পরে বাবাই পুরো পাগল হয়ে গেলেন। আমার বয়েস যখন সাত বছর তখন তিনি পাগলা গারদে মারা যান। শেষদিন পর্যন্ত তিনি শুধু সুলতানা সুলতানা করে গেছেন। তিনি আমার কথা ভুলে গিয়েছিলেন কিন্তু বেইমান সুলতানার কথা ভোলেননি।"
মিজান করিমের ঘাড়ে হাত রাখে। "দুঃখ করিসনা রে করিম। মানুষের জীবনে আল্লাহ্ দুঃখ দিয়ে পরীক্ষা করেন। আগে আমি ভাবতাম আমিই বোধহয় একমাত্র দুঃখী মানুষ। তোর কথা না শুনলে তো বুঝতেই পারতাম না।"
ওদের দু'জনের পাশে নিজেকে বড় অপরাধী মনে হতে থাকে। আহা-এই দুটি ছেলে এই অল্প বয়সেই কত কষ্টের পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। সেই তুলনায় আমি তো রীতিমত গোলাপ বিছানো রাস্তায় হেঁটে এসেছি।
করিমের মা অথবা বাবা নিয়ে আর তেমন কোন কথা হয়নি। এর বছর খানেক পরে করিম সত্যি সত্যি সিলেট মেডিক্যাল কলেজে চান্স পেয়ে যায়। চলে যাবার আগে, আমরা তিনজনা আবার এক জায়গায় হয়েছিলাম। করিম বললো,"একদম যেতে ইচ্ছে করছে না। শুধ বাবার কথা মনে করে যাচ্ছি। তার খুব ইচ্ছে ছিল আমায় যেন ডাক্তার হই।"
করিম সিলেট চলে যাওয়ার পাঁচ-ছ' মাস পর একদিন হঠাত্ মিজান এসে বললো,"তুই কি জানিস যে করিম কত বড় মিথ্যেবাদী।"
"কেন- সে আবার কি করলো?"
"সে আমাদের কাছে তার বাবা-মা সম্পর্কে যা বলেছিল তার সবটুকুই মিথ্যে। তার বাবা দরিদ্র স্কুল টিচার না, তার বাবা কুমিল্লা শহরের একজন মোটামুটি নামকরা ডাক্তার। এবং তিনি বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন। করিমের মা মোটেও তাকে ফেলে পালিয়ে যায়নি।"
"তুই কিভাবে জানলি এসব?"
"গতকাল নিউমার্কেটে দেখা হয়েছিল করিমের মামার সাথে। সাথে ওর বাবা-মা। তারা ঢাকায় বেড়াতে এসেছেন।"
"তার মানে তুই বলতে চাইছিস যে করিম তার বাবা-মায়ের নামে খামাখা একগাদা আজেবাজে কথা বলেছে আমাদের কাছে।"
"ইয়েস।"
"কেন একজন এইরকম একটা কাজ করবে?"
"বিকজ ও একটা প্যাথোলজিক্যাল লায়ার।" মিজান রীতিমত চিত্কার করে ওঠে।
আমার কাছে নিজেকে প্রতারিত মনে হয়। করিম আমাদেরকে বোকা বানানোর জন্য এতবড় একটা মিথ্যে কথা বলতে পারলো!
সিলেট থেকে বার কয়েক ঢাকা এসেছিল সে। একবার আমি আর মিজান তাকে ধরলাম,"মিথ্যে কথা বললি কেন শালা?"
সে হাসে। "ধরে ফেলেছিস তাহলে। যাক ভালই হয়েছে। আমাকে আর গল্প বানাতে হবেনা।"
"এটা কোন ধরণের গল্প হোল? নিজের বাপ মা নিয়ে এতবড় মিথ্যে কথা কেউ বলে?"
"আসলে ওই দিন মিজানকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আর তাকে চিয়ার আপ করার জন্যই গল্পটা বানিয়েছিলাম। তাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম যে তার চেয়ে খারাপ অবস্থায়ও মানুষ থাকতে পারে। আমার মিথ্যায় কাজ হয়েছিল, রাইট?"
মিজান থমকে যায়। সে এই সম্ভাবনার কথা চিন্তা করেনি।
"তাও এতবড় মিথ্যে বলাটা নরমাল না।" মিজান তাও গজগজ করে।
করিম বলে, "হতে পারে। হয়তো আমার কোন মানসিক সমস্যা আছে। আসলে ছোট বোনটা নিউমোনিয়ায় মারা যাবার পর থেকেই আমাদের বাড়ীর সবাই একটু একটু অস্বাভাবিক হয়ে গেছে।"
আমরা চোখ পাকাই। আবার মিথ্যে কথা!
করিম বলে, "আচ্ছা ঠিক আছে। আর গল্প বানাবোনা। এবার দেখিতো তোদের সিলেটী ভাষার জ্ঞান কতখানি। বলতো এইটার মানে কি? ও বা খুদ্দুস, কইফল কাইয়া বাদুয়া জুলাইসে খে? তুমি দেখতাই নাইনি?"
আর দশজন বন্ধুর মতোই আস্তে আস্তে করিমের সাথে যোগাযোগ ক্ষীণ হতে হতে একসময় ছিন্ন হয়ে যায়।
ছাত্রজীবন শেষ হয়ে শুরু হয় আরও অনেক জীবন। চাকরিজীবন, বিদেশজীবন, স্বামীজীবন, পিতাজীবন, চাকরি হারানোর ভয়ে শংকিত জীবন। মানুষ তো আমি একা। এতগুলো জীবনের নানবিধ বায়নাক্কা মেটাতে গিয়ে হিমসিম খাই। হারিয়ে যায় বহুকিছু। রুদ্রের কবিতার পংক্তিটির মতো, "আঙ্গুলের ফাঁক গলে নেমে যায় বাসনার জল।"
আরো অনেক কিছুর সাথে সাথে আমার মাথা থেকে এক সময় হারিয়ে যায় শায়েস্তা আবদুল করিম।
(গল্প প্রায় শেষ, আর অল্প একটু বাকী আছে।)
একদিন একটি খবরের কাগজে দেখলাম একটি ছোট্ট লেখা। বিষয়বস্ত বাংলাদেশে এইচআইভি ভাইরাসের ঝুঁকি। একটু চোখ বুলিয়েই পৃষ্ঠা উলটাচ্ছিলাম প্রায়, এমন সময় খেয়াল করলাম লেখকের নামটি হচ্ছে ডাঃ শায়েস্তা আবদুল করিম।
থমকে গেলাম। আমাদের করিম নয়তো?
কিছুদিন পর আরেকটি সংবাদপত্রে একই লেখকের পরিবেশ-দূষণ নিয়ে একটি লেখা ছাপা হোল। আবারো থমকে গেলাম। আমাদের করিম নয়তো?
লেখাদুটির কোনটাতেই ঠিকানা দেয়া ছিলনা। যে ক'জন বন্ধুর সাথে তখনো যোগাযোগ ছিল, তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম করিমের কথা। কেউই জানেনা তার সন্ধান।
ততদিনে এসে গেছে ইন্টারনেট। আঙ্গুলের মৃদু স্পর্শে পৃথিবীর যাবতীয় তথ্যভান্ডার উন্মোচিত হয় চোখের সামনে।
অতএব সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম ইন্টারনেটে। গুগল, ইয়াহু এবং আরো যা যা সার্চ ইঞ্জিন হাতের কাছে পেলাম, তাই দিয়ে শুরু হোল খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার কাজ। কথায় বলে ঈশ্বর পরিশ্রমকারীকে সাহায্য করেন। আমার বেলায়ও তার বাত্যয় হোলনা।
খুঁজে পেলাম একজন ডাঃ শায়েস্তা আবদুল করিমকে। ইনিই কি সেইজন? একটি ফোন নাম্বারও দেওয়া ছিল তার নামের পাশে।
দুরুদুরু বক্ষে ফোনের বোতাম টিপলাম।
"হ্যালো।"
"ডাক্তার সাহেব আছেন?'
"উনি তো একটা মিটিং এ গেছেন, আজ আর ফিরবেন না। মিটিং থেকে সরাসরি বাসায় চলে যাবেন।"
"বাসার ফোন নাম্বারটা কি একটু দেওয়া যাবে দয়া করে?"
"লিখুন, আমি বলছি।"
রাতে ফোন করি বাসায়। একটি মহিলা কণ্ঠ জবাব দিলেন।
"ডাক্তার সাহেব কি আছেন বাসায়?"
"ওতো বেরিয়েছে একটু। আধাঘন্টা পর ফিরবে।"
"আচ্ছা ঠিক আছে। আমি নাহয় ঘন্টাখানেক পর আবার ফোন করবো।"
"আপনি কে বলছেন?"
"আমাকে আপনি চিনবেননা।"
"তবুও নামটা যদি বলেন।"
নাম বলে ফোন রেখে দেই।
হঠাত্ করে একটা কাজে আটকে পড়ি তারপর। যখন সেটা শেষ হোল, তখন ঘড়িতে প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। এত রাতে কি আবার ফোন করা উচিত হবে? দ্বিধায় দুলতে দুলতে ফোন করেই বসি।
"হ্যালো।" এবার পুরুষ কণ্ঠের উত্তর আসে।
"ডাক্তার করিম বলছেন?"
"আপনি কে বলছেন?"
"আমাকে আপনি চিনতে পারবেন কিনা জানিনা। আমার নাম নির্বাসিত।"
"তুই আমাকে জিজ্ঞেস করছিস আমি তোকে চিনতে পারবো কিনা। এই প্রশ্নের উত্তর কি ভাবে দেই? একটা কবিতা আবৃত্তি করি তাহলে। দেখি তুই মনে করতে পারিস কিনা।"
আমাকে কোন কথা না বলার সুযোগ দিয়ে সে গলা তুলে আবৃত্তি করে,
"চেয়েছিলাম একটু মাটি, বেঁচে থাকার টুকরো আগুন
তাইতো দেখো আমার ঘরে কেবল খাঁ খাঁ শূন্য হাওয়া
বাগানবাড়ী চাইনি আমি, চেয়েছিলাম দুর্বাঘাসই
চেয়েছিলাম তার শিয়রে বেড়ে ওঠা স্বর্ণ-শিশির।
আমার দেশের মতোন আমি ভীষণ রকম একলা দু:খী
মায়ের শাড়ির আঁচল চেয়ে নতজানু হই ক্রীতদাস
বলতে পারি চুমু খেয়ে তবু প্রিয়ার চোখের পাতায়
'মাটি হয়ে নিলাম তোমার ভালবাসার গাছের শিকড়'।"
কেমন যেন চেনা চেনা মনে হয় লাইনগুলোকে। কবে কোথায় যেন পড়েছিলাম। আজ এতদিন পর আর মনে নেই।
আবৃত্তি শেষ করে সে জিজ্ঞেস করে,"মনে পড়েছে এবার?"
আমি বলি,"লাইনগুলো চেনা চেনা লাগছে ঠিকই, কিন্তু কার লেখা মনে করতে পারছি না।"
ফোনের ও পাশ থেকে চিত্কার ভেসে আসে। "এই লাইনগুলো তোর লেখা, ইডিয়েট। তুই তোর ফার্স্ট ইয়ারের খাতায় লিখেছিলি ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির ক্লাশে বসে। তোর মনে নেই? তোর কিচ্ছু মনে নেই? তোকে একদিন চমকে দেব বলে লাইনগুলো গোপনে মুখস্থ করেছিলাম।"
আমার মাথার ভিতর ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে। এতগুলো বছর ধরে কি পরম মমতায় আর ভালবাসায় এই মানুষটি আমারই লেখা পংক্তিগুলো তার স্মৃতির মধ্যে ধারণ করে আছে। যাকে আমি আমার জীবন এবং চিন্তা থেকে অবলীলায় মুছে ফেলেছি, যার কোন রকম খোঁজ আমি রাখিনি, সেই লোকটিই আজকের এই মধ্যরাতের অপেক্ষায় ছিল এতদিন ধরে। যেদিন সে এই লাইনগুলো আবৃত্তি করে আমাকে চমকে দেবে।
আমার চোখ ভিজে আসে। কৃতজ্ঞতায়, লজ্জায় নাকি ভালবাসায়, তা বুঝতে পারিনা। শুধু এইটুকু বুঝি যে কবিতায় যত সহজে দুর্বাঘাসের শয্যা চেয়ে থাকিনা কেন, বাস্তবে আমি বাগানবাড়ীটির স্বপ্নেই বিভোর হয়ে আছি। বুঝি জীবনের সোনার হরিণের পিছনে ছুটতে ছুটতে আমি কত সহজে ভুলে গিয়েছি করিমের মতো স্বর্ণ-হৃদয় মানুষদেরকে।
করিমের মতো মানুষেরা অবশ্য তাদের হৃদয়ের বিশ্বাস নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে। তারা কিন্তু ঠিকই জানে একদিন ঠিক মধ্যরাতে বেজে উঠবে ফোন। ফিরে আসবে তুচ্ছ জাগতিক মায়ায় ডুবে থাকা একজন বেভুল মানুষ। সেদিনের অপেক্ষায় তারা প্রতিদিন বিড়বিড় করে আওড়ায় ভুলে যাওয়া কবিতার লাইন। একটি দাঁড়ি বা কমা যেন বাদ না পড়ে। আবৃত্তিটি যেন নিখুঁত হয়। বন্ধুকে কবিতায় স্বাগত জানানোর জন্য তারা প্রস্তুত হয় প্রতিদিন।
করিম জিজ্ঞেস করে,"কিরে এখন বিশ্বাস হয়েছে যে তোকে আমার মনে আছে কিনা? কথা বলছিস না কেন? কেমন আছিস? বিয়ে করেছিস? বাচ্চা কয়টা? কবিতা কি লিখিস আজকাল?"
কত কথা বলবো বলে ভেবেছিলাম, কিন্তু আমি তার কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারিনা। আবেগে আমার গলা আটকে আসে।
বন্ধুর জন্য এতখানি ভালবাসা নিয়ে ফোনের ওপাশে অপেক্ষা করে আছে একজন মানুষ। তাকে আমি কি বলবো? এতখানি ভালবাসা নিয়ে এখন আমি কি করি?
(তামাম শুদ)
-নির্বাসিত
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়,, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
মন্তব্য
এই পর্বটাও আগে পড়ছি (না পড়ার চান্স নাই, আপনার ব্লগ এড্রেস বুকমার্ক করা আছে , তবে এই পর্বটার কথা খুব ভাল মনে আছে ) ... আমার পড়া সেরা লেখাগুলির একটা ...
এইটাও প্রিয় পোস্টে অ্যাডিত হইল ...
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। ভাল থাকুন।
-নির্বাসিত
প্রশ্ন করতে ভুলে গেছি যে এই লেখাটা খুঁজে পেলেন কিভাবে? প্রথম পাতায় তো দেখলাম না।
-নির্বাসিত
কিং কং ভাইএর সহিত একমত।
এই সিরিজের অসাধারণ লেখাগুলোর একটা...
ভাল বন্ধুর উষ্ণতা বোধহয় সবাইকেই ছুয়ে যায়...
স্বপ্নাহত
শায়েস্তা আবদুল করিমের মত আমরা অনেকেই প্রয়োজন বোধে মিথ্যার আশ্রয় নেই। আমার বিশ্বাস এই আখ্যানে ব্যবহৃত নামের অধিকাংশই বানানো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদে এই সব নামের শিক্ষক স্মরণকালে ছিলেন না।
তবে খুব উপভোগ্য হয়েছে প্রায় প্রতি পর্ব।
বজলুর রহমান- আপনার অনুমান সম্পূর্ণ সত্য। আমি আমার নিজের নামের মতই এই সিরিজের সবগুলো নামই বদলে দিয়েছি। তবে চরিত্রগুলো সঠিক, ঘটনাগুলো সঠিক। আপনারা কেউ কেউ হয়তো আন্দাজ করতে পারবেন আমি কার কথা বলছি।
-নির্বাসিত
_______________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"
(বিপ্লব)
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
নতুন মন্তব্য করুন