ক্লাস ফাইভে আমাদের স্কুলে একটা অলিখিত নিয়ম ছিল। ক্লাসে কেউ দুষ্টুমি করলে তার শাস্তি হতো- মেয়েদের বেঞ্চে দুইটা মেয়ের মাঝখানে বসে থাকা। মেয়েরা তো কখনো দুষ্টুমি করেনা (!!??), তাই বলা যায় এই শাস্তিটা শুধু ছেলেদের জন্য প্রযোজ্য ছিল। দুষ্টুমি করে ধরা খেলে- সবাই ( আমি বাদে ) বেত খেতে রাজি ছিল, কিন্তু তবুও মেয়েদের পাশে বসবে না।
সেদিন বাংলা ক্লাস হচ্ছিল। বাংলা স্যার ষাঁড়ের মত ছড়া আবৃত্তি করছিলেন
'' তারা একটি দুটি তিনটি করে এল...''।
সামনের দিকে বেঞ্চে বসত মেয়েরা। ভালো ছেলেরা এর পরে। আর আমরা গাধা-গর্দভরা এক্কেবারে পিছনে। তো সেদিনও যথারীতি শাকিলের নীচু গলায় বলা ভয়ংকর অসভ্য গল্পগুলো শুনছিলাম।
- তারপর বুঝলি- মেয়েটা ছেলেটাকে একটা চিঠি দিল। চিঠি যখন নিচ্ছে তখন ছেলেটার হাত মেয়েটার হাতে ধাক্কা খেল...
শাকিলের গল্প শুনে আমার অবস্থা বারোটা বেজে যাচ্ছে। ইস! যদি কোন মেয়ের হাত ধরতে পারতাম!
লেখাপড়ায় পর্যাপ্ত পরিমাণে গাধা হলেও- আল্লাহ তাআলা আমার মাথায় যথেষ্ট পরিমাণে বুদ্ধি দিয়েছিলেন ( কালের বিবর্তনে অবশ্য বুদ্ধি কিছুটা কমে যাচ্ছে )। বাংলা স্যারের ক্লাসে হঠাৎ করে জোরে হেসে উঠলাম। স্যার কিছু পড়াতে না পারলেও দুষ্টুমি ধরতে পারতেন। কেউ দুষ্টুমি করলে স্যার মনে মনে খুশিই হতেন। কিছুটা সময় না পড়িয়ে কাটিয়ে দেওয়া যাবে।
স্যার আমাকে দাঁড় করালেন।
- হাসছিস কেন?
আমি আমার সম্বলে যত দাঁত আছে সব বের করে দিয়ে বল্লাম।
- স্যার, এমনি।
উদ্দেশ্য একটাই। স্যার খেপে গিয়ে আমাকে মেয়েদের মাঝখানে বসিয়ে দিবেন। আমি দাঁতগুলো আরো প্রসারিত করলাম।
স্যার মনে হয় কিছুটা খেপলেন।
- এদিকে আয়। এখানে এসে নীল ডাউন হয়ে থাক্।
আমার মাথায় যেন বাজ পড়ল। তাহলে কেন শুধু শুধু এত কষ্ট করলাম। স্যারকে তো আর বলতেও পারছিনা- স্যার আমাকে নিশি আর রিপা'র মাঝখানে বসান। আল্লাহ মনে হয় আমার মনের অবস্থার বুঝতে পারলেন। ক্লাস ক্যাপ্টেন ইমরান চেঁচিয়ে উঠল।
- স্যার। প্রিন্সিপাল স্যার বলেছেন, কেঊ দুষ্টুমি করলে তাকে মেয়েদের পাশ বসাতে।
স্যার আবার কারো উপদেশ তেমন একটা সহ্য করতে পারতেন না।
- তুই নিজের জায়গায় বস। শিপন, তুই বইখাতা নিয়ে রিপা'র পাশে এসে বস।
আমি মুখে এমন একটা ভাব করলাম যেন এই লজ্জায় আমি কর্ণফুলী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মরব।
- জ্বী স্যার।
আমি রিপা'র পাশে এসে বসলাম। অন্যপাশে নিশি।
স্যার ভয়ংকর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। স্যার ধরেই নিয়েছিলেন আমি স্যারের কাছে মাফ চাইব আর স্যারও আ-কা করে ক্লাসটা কাটিয়ে দিবেন। এরপর ক্লাসে স্যার কি পড়িয়েছিলেন আমার কিচ্ছু মনে নেই। আমি আড়চোখে বারবার রিপাকে দেখছিলাম। রিপাটা এত্ত সুন্দর কেন?
আমার পাশে একটা পরী বসে আছে। আমি মানুষ হয়ে ক্লাসে মনোযোগ দেয় কি করে?
টিফিনের ঘন্টা বাজল। ছেলেরা হই হই করে বাইরে চলে গেল। মেয়েরা ক্লাসরুমে বসেই টিফিন করবে। আমিও বসে রইলাম। রিপার পাশে বসে থাকতে ভালো লাগছিল। খুব, খুব, খুব ভালো।
হঠাৎ করে রিপা বলে উঠল।
- চকলেট খাবা?
সাথে সাথে আমি হাজার হাজার স্বপ্ন দেখে ফেললাম ( আমি আবার স্বপ্ন দেখতে ভালোই পটু )। আমি আর রিপা গাছের নীচে বসে আছি, এইরকম টাইপ স্বপ্ন।
- কী? খাবা না?
ততক্ষণে আমার হাত কাঁপা শুরু করেছে। আমি কাঁপা হাত বাড়িয়ে দিলাম।
- হুঁ।
মনে হচ্ছিল চকলেট খেতে এত মজা আমি আগে কখনো বুঝিনি।
এরপর নিয়মিত ইচ্ছাকৃত দুষ্টুমি করা শুরু করলাম। মেয়েদের পাশে নিয়মিত বসতে লাগলাম। হাজার হাজার কোটি কোটি স্বপ্ন দেখতে লাগলাম।
সব মেয়েকেই মোটামুটি ভালো লাগত। তবে সবাইকে পরী মনে হত না। পরী ছিল একজনই। রিপা সাবিরা। তবে পরীই লাগবে এমন তো কোন নিয়ম নেই। শুধু মেয়ে হলেও আমার চলবে।
আগে যে আমি হাজার অজুহাতে স্কুলে যেতে চাইতাম না- সে আমিই নিয়মিত স্কুলে যেতে লাগলাম। আমার বৈপ্লবিক পরিবর্তনে বাবা-মা ও খুশি হলো। সবাই আশা করতে লাগল বার্ষিক পরীক্ষায় আমি অসাধারণ কিছু করে ফেলব।
একদিন টিফিন টাইমে মেয়েদের মাঝখানে বসে আছি। পাশে রিপা সাবিরা। ওর জন্য আজকে একটা জিনিস এনেছি। কিন্তু দেওয়ার সাহস পাচ্ছি না। শেষমেষ দিয়েই ফেললাম। একটা কিট-ক্যাট।
- খাবা?- আমি বললাম।
পরী যেন একটু লজ্জা পেল।
- না।
- নাও না, প্লীজ।
- আচ্ছা, দাও।
পরী হাত বাড়িয়ে দিল। মেয়েদের হাতও এত সুন্দর হয়!
মেয়েরা মনে হয় ছেলেদের মত এত লজ্জা পায়না। নইলে পরী আমাকে বলবে কেন?
- তুমি গল্পের বই পড়।
আমি বললাম
- না। কমিক্স পড়ি। তুমি পড়?
- আমি অনেক গল্পের বই পড়ি। তবে কমিকস ভাল্লাগে না।
আমার মন খারাপ হয়ে গেল। রিপা'র কমিক্স ভালো লাগে না। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। কমিক্স বাজে। এখন থেকে আর এসব ফালতু জিনিস পড়ব না। গল্পের বই পড়ব। রিপাকে বললাম।
- আমাকে একটা গল্পের বই দিবা?
- তুমি না বললা, গল্পের বই পড়না।
- এখন থেকে পড়ব।
এরপর আমাদের মধ্যে অনেক বই আদান-প্রদান হত। পরীকে জোর করে দুই একটা কমিকস দিলাম। ওর ভালো লাগল না। আমিও হাল ছেড়ে দিলাম। একদিন বাসার পুরানো খবরের কাগজের সাথে সব কমিকস বিক্রি করে দিলাম।
একদিন আব্বু-আম্মুর সাথে বই মেলায় গিয়েছি। আব্বু আমার নতুন অভ্যাসে বেশ সন্তুষ্ট। আমাকে অনেক বই কিনে দিচ্ছে। সেবা প্রকাশনীর স্টলে তিন গোয়েন্দা দেখছি। এমন সময় চকলেটের থেকেও মিষ্টি একটা কন্ঠ আমার নাম ধরে ডাকল।
- আরে। শিপন না?
পরী দাঁড়িয়ে আছে। সাদা একটা ফ্রক পড়ে। লজ্জায় আমার দম বন্ধ হয়ে এল। আব্বু-আম্মু কি ভাববে? একটা মেয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছে। আমি না দেখার ভান করলাম।
- আই। শিপন।
আব্বু বলল।
- শিপন। তোকে ডাকছে।
আমি ভয়ে ভয়ে রিপার দিকে তাকালাম।
- ও তুমি। আব্বু ও আমাদের ক্লাসে পড়ে। রিপা।
আব্বু-আম্মু রিপার আব্বুর সাথে কথা বলতে লাগল। রিপা আমার পাশে এসে দাঁড়াল। কী মিষ্টি একটা ঘ্রান। ফুলও এত সুবাস ছড়ায় না।
- কি বই কিনছ?
- এই তো। তিন গোয়েন্দা।
- তিন গোয়েন্দার নতুন বইটা পড়ছ? ' ভ্যাম্পায়ারের দ্বীপ'।
- হুঁ।
- কেমন লাগছে? আমার জিনার উপর খুবই মেজাজ খারাপ হইছে। এত খবরদারি করে। কিশোরের উপর খবরদারি করলে আমার একদম সহ্য হয় না।
- তুমি কি বই কিনলা?
- অনেক বই কিনছি।
- হুঁ।
- আচ্ছা যাই। ক্লাসে দেখা হবে।
পরী চলে গেল। আমার মন খারাপ হয়ে গেল।
আব্বুর সিলেটে পোস্টিং হয়ে গেছে। বার্ষিক পরীক্ষার পর আমরা চলে যাবো। আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। পরীর পাশে বসতে পারব না? ওর কাছ থেকে নেওয়া বইয়ের ঘ্রাণ নিয়ে ঘুমাতে পারব না?
- জানো? আমরা সিলেটে চলে যাচ্ছি। আব্বুর পোস্টিং হয়ে গেছে।
- তাই? গতবছর সিলেট গেছিলাম। কী সুন্দর!
আমার মনটা আরো বেশি খারাপ হয়ে গেল। ভেবেছিলাম ও মন খারাপ করবে।
- হুঁ। খুব সুন্দর।
- তুমি কি lucky! সিলেটে থাকবা।
- হুঁ।
পরীকে বলতে পারলাম না, আমি তাকে কি পরিমাণ miss করব?
বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট হলো। আমি যা করার তাই করলাম। ডিসেম্বরের ১৮ তারিখ আমরা সিলেট চলে এলাম। কয়েকদিন আকাশে-বাতাসে পরীকে দেখলাম। একদিন ভুলে গেলাম।
আমার জীবনের প্রথম ''মেয়ে''র ওইখানেই সমাপ্তি।
পরবর্তী ''মেয়ে''র কাহিনী পরে বলব।
ঠিক আছে???????
পরিবর্তনশীল
poribortonshil
মন্তব্য
সবই কি এরকম প্লেটনিক, নাকি প্লেট টেকটোনিক কিছু আছে?
হাঁটুপানির জলদস্যু
খুব ভালো লাগলো। cant wait till the next story
মহিব তার মেয়ে কাহিনী লেখা শুরু করছে। সচলায়তন কে জায়গা বাড়ানোর অনুরোধ জানাই।
ইস! আপনার ঐ প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র হওয়ার সুযোগ পেলাম না
আমার এরকম একটা প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়েছিল।তবে কাউকে দেখে পরীর মত লাগেনি।বর্তমানের বোধ নিয়ে আবার সেই পুরোনো দিনে ফিরে যেতে পারলে বোধহয় ঘটনাটা অন্যরকম হতে পারতো...
মহিব এর পরী নাম্বার ২ এর অপেক্ষায় রইলাম...
-স্বপ্নাহত
ছোট্টবেলার অধিকাংশ প্রেমই বোধহয় প্লেটোনিক হয়। আমি অবশ্য শিউর না। তবে যত শুনলাম আর মুভিতে দেখলাম, তাতে এমনই মনে হচ্ছে। এটা পড়েও ভাল লাগল। এ ধরণের অসমাপ্ত প্রেমে ছোটগল্পের স্বাদ পাওয়া যায়। সেটাও পেয়েছি।
শেষ হইয়াও হইল না শেষ।..
মুহাম্মদ২০১৭
- সেইরম লাগলো।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
আই ইউ টি তে বইসা প্রাইমারীর প্রেম মনে করা ছাড়া উপায় নাহি।
ratuliut@gmail.com
হক কতা...
স্বপ্নাহত
আহারে!
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
খুব ভালো লাগলো।
ভুল করলেন নাকি আমি ভুল পড়লাম - এই আসমাটি কে?
___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"
অনেক মেয়ে তো... তাই নাম উল্টা-পাল্টা হয়ে গেল। হি হি হি
-পরিবর্তনশীল
পৃথিবীর সব-থেকে সহজবোধ্য বস্তু হলো- মেয়েদের মন।
পৃথিবীর সব-থেকে সহজলভ্য বস্তু হলো- মেয়ে।
-পরিবর্তনশীল
অনেক মেয়ে তো। তাই ভুল করে ফেললাম। হা হা হা...
-পরিবর্তনশীল
লেখাটা ভাই জাঝা। চলুক...
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
নতুন মন্তব্য করুন