ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পর্ব-৮।

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ০৫/০২/২০০৮ - ১২:০৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমরা ভালই ছিলাম। ক্লাশ আর আড্ডা নিয়ে সবকিছু ভালই চলছিল।
কিন্তু কথায় আছে, সুখে থাকতে ভুতে কিলোয়। কাব্যিক ভাবে এই কথাটিই জীবনানন্দ লিখে গিয়েছেন,
"বধূ শুয়ে ছিল পাশে, শিশুটিও ছিল
জ্যোত্স্নায় তবু সে দেখিল
কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙ্গে গেল তার?"

এক সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আসাদ বললো,"পড়াশুনা পাঁচ মিনিটের জন্য বন্ধ করতে হবে। জরুরী কথা আছে।"
আমরা এমনিতেই অজুহাত ছাড়াই পড়াশুনা বাদ দেই। অজুহাত পেলেতো কথাই নেই। বই-খাতা বন্ধ করে কান খাড়া করলাম। কি সমস্যা?
আসাদ বললো,"আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমাদের সাহায্য দরকার। না করতে পারবেনা।"
মনে মনে প্রমাদ গুনলাম আমরা বাকী তিনজন। শালা কোন মেয়ের প্রেমে পড়ে নাইতো আবার? জহিরকে তার প্রেমের ব্যাপারে সাহায্য করার পর (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পর্ব-৩(ক)) আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে কারো কোন প্রেম-ভালবাসা বিষয়ক সমস্যায় আমরা আর নেই।

আসাদ বললো,"আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমি এবার ইলেকশন করবো। তোমাদের হেল্প দরকার।"

আমরা একে অন্যের মুখের দিকে তাকাই। প্রেম জাতীয় বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা যদি হয় শূন্য, তাহলে ইলেকশনের ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে মাইনাস তিন মিলিয়ন। কিন্তু আসাদ হচ্ছে এমনই একজন লোক যে একবার কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে তাকে সেখান থেকে হটানো রীতিমতো একটা অসম্ভব ব্যাপার। সে তখন ঢালু রাস্তায় একটি ব্রেক ফেইল করা সাতটনী ট্রাক। তাকে থামাতে পারে এমন মানুষ এখনো পয়দা হয় নাই। প্রসংগত উল্লেখযোগ্য যে "নিরিখ বান্ধো রে দুই নয়নে" ছিল আসাদের প্রিয় গান যেটি সে সব সময় গুন গুন করতো।

কথা শুনে আমরা বুঝলাম যে আসাদ তার নিরিখ বেন্ধে ফেলেছে। অতএব তাকে ফেরানোর চেষ্টা না করে তার পাশে এসে দাঁড়ানোই উচিত কাজ হবে। জাস্ট গো উইথ দ্য ফ্লো!

প্রথম কাজ হচ্ছে ইনফরমেশন নেওয়া।
"ওকে- আসাদ। কোন ইলেকশনে দাঁড়াচ্ছো তুমি?"
"ডিপার্টমেন্টে ছাত্র পরিষদের ইলেকশন। আমি সেখানে জেনারেল সেক্রেটারীর পদে দাঁড়াতে যাচ্ছি।"
"আমাদের ডিপার্টমেন্টে ইলেকশন হচ্ছে নাকি? জানতাম নাতো। কে বললো?"
"গতকাল টীচারদের মিটিং ছিল। সেখানেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দু মাস পর ইলেকশন। নমিনেশন পেপার জমা নেওয়া শুরু হবে সাত দিন পর থেকে। নমিনেশন পেপার প্রত্যাহার করার শেষ তারিখ আজ থেকে একমাস পর।"
"এই খবর তোমাকে দিল কে?"
"সেটা বলা যাবে না, টপ সিক্রেট। তবে খবরটা সত্যি। আজকালের মধ্যেই ঘোষণা দেয়া হবে।"
"ঠিক আছে, ঘোষণা দেয়া হোক। তারপর দেখা যাবে।"
আসাদ আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। "তোমরা ব্যাপারটা বুঝতে পারছ না। আমি চাচ্ছি আমার ইলেকশনে দাঁড়ানোর ব্যাপারটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সবাইকে জানিয়ে দিতে। আমার নাম দেখে তাহলে হয়তো অন্য কেউ আর দাঁড়াবে না। অনেকটা বিনা প্রতিদন্দ্বিতায় জিতে যেতে পারি আমি।"
"কেন-তোমার নাম দেখে অন্যেরা দাঁড়াবে না কেন?"
"আহ্‌হা- বোঝার চেষ্টা করো। ডিপার্টমেন্টের ইলেকশন হচ্ছে লো প্রোফাইল ইলেকশন। এখানে কেইই বা আবার এত উত্সাহ নিয়ে দাঁড়াতে চায়? যখন দেখবে একজন অলরেডী দাঁড়িয়ে গেছে, তখন খামাখা আর কেউ ওই পোস্টের জন্য কমপীট করবে না।"
কি জানি, হতেও পারে। আগেই বলেছি এ ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা মাইনাস তিন মিলিয়ন।
"তা তুমি কি একাই দাঁড়াচ্ছো? নাকি সাথে আরো কেউ আছে?"
"আমরা দুইজন দাঁড়াচ্ছি। দুইজনের প্যানেল। আমি জিএস, আর ভিপি পোস্টে দাঁড়াচ্ছে মাস্টার্সের মঞ্জু ভাই।"
মঞ্জু ভাইয়ের নাম শুনে আমরা মনে মনে প্রমাদ গুনি। মঞ্জু ভাইকে এক কথায় বলা যায় হাফ-বখাটে। উনি লোক খারাপ না, মাঝেসাজে আমাদের সাথে আড্ডা দেন, কিন্তু ডিপার্টমেন্টে উনার খুব একটা ভাল নাম নাই। উনি কয়টা ভোট পাবেন, তা এক হাতের আঙ্গুলেই হিসেব করা যাবে।
"মঞ্জু ভাই তোমার সাথে একই প্যানেলে দাঁড়াতে রাজী হোল কেন?"
"আরে উনিতো আগে থেকেই রাজী। উনিই তো এসে আমাকে তার সাথে দাঁড়াতে বললেন।"
এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে!। ইলেকশনে দাঁড়ানোর রহস্যটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে।
"তা টীচারদের মিটিং এর কথাটা কি তোমাকে মঞ্জু ভাইই বলেছে?"
"হ্যাঁ। তাতে কি হয়েছে?"
"না- কিছু হয় নাই। তবে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে মঞ্জুভাই তোমাকে ইউজ করছে।"
"তা করুক। আমি ইলেকশনে দাঁড়াতে চাই। এইটাই শেষ কথা। এখন বলো, তোমরা আমার দলে থাকবে, নাকি থাকবে না?"
বুঝলাম ব্রেক-ফেইল করা সাতটনী ট্রাক এখন টপ গিয়ারে চলছে। এবং তার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর মত সাহস আমাদের নাই। তার উপর আসাদ আমাদের রুমমেট এবং বন্ধু। আমরা ছাড়া ও পাগল আর কার কাছেই বা যাবে?

সমবেত ভাবে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমরা বললাম, "আমরা আছি তোমার সাথে। চালাও মন্টু, আনায় ডবল।" (শেষ বাক্যটির অর্থ জিজ্ঞেস করবেন না কেউ দয়া করে। আমি জানিনা, তবে শুনতে ভাল লাগে বলে লিখলাম।)

সাত দিন পর আসাদ আর মঞ্জু ভাই মিলে তাদের নমিনেশন পেপার জমা দিল। দ্য ব্যাটল হ্যাজ বিগান!

পরের কয়েকদিন চুপচাপ কাটলো। আসাদের কথাই ঠিক মনে হচ্ছিল। এমনিতেই ডিপার্টমেন্টের ছাত্র পরিষদের ইলেকশন। কার খেয়ে কাজ পড়েছে সেখানে দাঁড়ানোর। সায়েন্সের বেশীর ভাগ ছেলেমেয়েরাই পড়াশুনা নিয়ে এত সিরিয়াস যে ইলেকশনের মতো জিনিসে তাদের আগ্রহ স্বভাবতঃই অনেক কম। আমরা তাতে খুশী। বিনা ক্যাম্পেনে যদি কাজ হয় তাহলে সমস্যা কি?

চাচামিয়ার চায়ের দোকানে আসাদ আর মঞ্জু ভাইকে প্রায়ই একসাথে দেখা যায়। তারা একমনে কাগজে ভোটের সম্ভাব্য হিসেব-কিতেব করছে।
আমরা গেলে মঞ্জু ভাই একগাল হেসে বলেন,"কি খবর কর্মী-বাহিনী? রণক্ষেত্রের সর্বশেষ সংবাদ কি?"
রাগে আমাদের গা জ্বলে যায় সেই প্রশ্নে। কি আর বলবো, সিনিয়র ভাই। শুধু একটা দেঁতো হাসি দেই। আর মনে মনে আসাদের মুন্ডুপাত করতে থাকি। তুই আর লোক পেলি না?

দুঃসংবাদটা এলো দুপুর বেলায়। আমরা তখন চান খাঁর পুলের 'নীরব রেস্টুরেন্ট' এ ভাত খেয়ে কার্জন হলে ফিরছি। পথে দেখা জুনিয়র সেলিমের সাথে। সেইই দিল খবরটা।

মঞ্জু-আসাদ প্যানেল এক ধরণের আতংকের জন্ম দিয়েছে 'উপর মহল'এ। বেশ কিছু লোকে মনে করছে যে যদি এরা নির্বাচিত হয়, তাহলে ডিপার্টমেন্টের মান-সম্মান সব ধূলায় মিশে যাবে। পড়াশুনা শিকেয় উঠবে, মেয়েদেরকে অহেতুক হেনস্তা করা হবে, শিক্ষকেরা প্রতি পদে বাধা পাবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
অতএব, আর একটি পাল্টা প্যানেল তৈরী করা হচ্ছে যেখানে 'ভাল ছেলেরা' প্রার্থী হিসেবে থাকবে। এবং এদের জেতা নিশ্চিত করার জন্য বেশ কিছু ছেলেমেয়ে ইতিমধ্যেই প্রচারনা শুরু করে দিয়েছে।

সর্বনাশের মাথায় বাড়ি। সেলিমকে জিজ্ঞেস করলাম,"জি এস পদে প্রার্থী কে হচ্ছে জানো নাকি?"
সে বললো, "আমি শিওর না, তবে যতটুকু শুনেছি ওরা আপনাদের ব্যাচের হীরা ভাইকে বলছে দাঁড়ানোর জন্য। উনি নাকি মোটামুটি রাজিও হয়েছেন।"

এ তো বিনা মেঘে বজ্রপাত। হীরা (পর্ব-৪) হচ্ছে আমাদের ব্যাচের সবচেয়ে পপুলার ছেলে। সে এমনিতেই খুব ভাল মানুষ, আর তার উপর সে অন্যের বিপদে-আপদে পাশে এসে দাঁড়ায়। হীরার সাথে আসাদের কমপীট করার প্রশ্নই আসেনা।
বিশেষতঃ হীরা মেয়েদের মধ্যে অসম্ভব রকমের জনপ্রিয়। তারা 'হীরা ভাই' বলতে অজ্ঞান। আসাদকে খুব বেশী মেয়েরা চেনেনা। সেটা ভাল খবর, কেননা যারা তাকে চেনে, তারা তাকে মরে গেলেও ভোট দেবেনা।

বিকেলে ধরলাম হীরাকে। "কিরে- তুই নাকি আসাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছিস?"
হীরা বললো,"আমাকে দাঁড়াতে বলেছে। চিন্তা করছি আপাততঃ, সিদ্ধান্ত নেবো দু'দিন পর।"
"তোর না দাঁড়ালে হয়না? বেচারা আসাদ অনেকদিন ধরে আশা করে বসে আছে, আর তুই তাতে ছাই দিবি।"
হীরা বললো,"সমস্যা তো আসাদ না, সমস্যা হচ্ছে মঞ্জু ভাই। সে যদি জেতে তাহলে কিন্তু খুব ভেজাল হবে। এই লোককে তোরাই বা সাপোর্ট করছিস কিভাবে?"
"ঠিক আছে, তুই তাহলে ভিপি পোস্টে দাঁড়া। জি এস পোস্টে দাঁড়াস নে।"
"তাতে সমস্যা আছে। ভিপি পোস্টে শুধুমাত্র মাস্টার্সের স্টুডেন্টরা দাঁড়াতে পারে। আমরা পারিনা। আমাদের জন্য হাইয়েস্ট পোস্ট হচ্ছে জি এস।"
"এইসব কিছুর পিছনে বাতাস দিচ্ছে কে রে?"
"বাতাস অনেকেই দিচ্ছে। তার মধ্যে বেশী দিচ্ছে জেবীন। সেই আমাকে দাঁড়াতে রিকোয়েস্ট করেছে।"

জেবীন আমাদের ব্যাচের মেয়ে। ভাল ছাত্রী। পরীক্ষায় আমরা একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী। আগে জানতাম সে পড়াশুনা নিয়েই বেশী ব্যস্ত থাকে। এখন তো দেখছি সে পলিটিক্সেও আছে।

আরো কয়েক জনের সাথে কথা বলে বুঝলাম যে হীরা যদি সত্যি সত্যি ইলেকশনে দাঁড়ায় তাহলে আসাদের জামানত নিশ্চিত বাজেয়াপ্ত হবে।

হীরার দাঁড়ানোর খবরটা শুনে আসাদের খুব একটা রি এ্যাকশন হোলনা। সে শুধু বললো,"তোরাই ভাল জানিস কি করতে হবে এখন। আমাকে কিচ্ছু বলার দরকার নেই। যা করতে হবে করে ফ্যাল।"

আমরা তিনজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি। কেমন করে আমরা এই গাড্ডায় পড়লাম, তাই ভাবতে থাকি। কেমন করে এর থেকে উদ্ধার পাবো সে চিন্তা করার সাহস ছিলনা।

বুঝলাম, যদি কেউ আমাদের উদ্ধার করতে পারে, সে হচ্ছে আমাদের ব্যাচের সেরা কুচক্রী ব্রেইনের ছেলে আশরাফ।

(পড়তে থাকুন)

আশরাফকে খুঁজে পাওয়াটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। যদিও সে নিজে রাজনীতি করেনা, রাজনীতি করা ছেলেপেলেদের কাছে তার ভীষন কদর। বিভিন্ন সময়ে তারা আশরাফের শরণাপন্ন হয়। সে যে এই মুহুর্তে কোথায় বসে, কাকে, কি কুচক্র শেখাচ্ছে, তা আন্দাজ করা খুবই কঠিন।

যাই হোক, আমাদের ভাগ্য ভাল ছিল সেদিন। আশরাফকে শহীদুল্লাহ হলের পুকুর ঘাটে পাওয়া গেল। সে সেখানে বসে পানিতে ভেসে থাকা দুটো হাঁসের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। কেন তা সেই শুধু জানে।

আমরা তাকে গিয়ে বললাম আমাদের সমস্যার কথা। আগামী দুই দিনের মধ্যে হীরাকে যে করেই হোক নির্বাচনে দাঁড়াতে নিরুত্সাহিত করতে হবে।
আশরাফ মিনিট খানেক চিন্তা করে। "উপায় একটা আছে। কাজও হবে। গ্যারান্টিড। কিন্তু জিনিসটা একটু আগলি।"
"আরে, আগলি হোক আর পাগলি হোক, কাজ হলেই হোল। তুই বল কি করতে হবে।"
"ভয় দেখাতে হবে।"
"হীরাকে ভয় দেখাতে বলছিস। ও আমাদেরকে ভয় পাবে কেন?"
"হীরাকে ভয় দেখাতে বলছিনা। ওর মাকে ভয় দেখা।"
"কি বলছিস তুই?"
হাঁস দুটো পানি ছেড়ে উঠে দুলে দুলে হেঁটে চলে যায়। আশরাফ উদাস চোখে তাদের চলে যাওয়া দেখে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,"আমিতো আগেই বলেছিলাম টেকনিকটা একটু আগলি।"
"তাই বলে হীরার মাকে ভয় দেখাবো? হীরা যদি পরে কোনদিন জানতে পারে তাহলে কি ভাববে সে?"
"হীরা যা ভাবার তাই ভাববে। তোদের যদি এই তরিকা পছন্দ না হয়, তাহলে গলায় গামছা দিয়ে হীরাকে অনুরোধ করে দেখ যেন সে ইলেকশন না করে।"
আমরা কথা না বাড়িয়ে চলে এলাম।

আসাদের সাথে কথা বলার আগে আমরা তিনজনে একটু আলাপ করে নিলাম। শেষমেশ ঠিক করলাম যে আমরা আসাদকে ইলেকশন করার ব্যাপারে সাহায্য করতে চাই, কিন্তু তারও একটা সীমারেখা থাকা দরকার। হীরার মাকে ভয় দেখানোটা আমাদের পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব না।

আসাদকে বললাম আশরাফের দেওয়া বুদ্ধির কথা। শুনে আসাদও বেশ গম্ভীর হয়ে গেল। ইলেকশন জিনিসটা যে মানুষকে এত নীচে নামাতে পারে, সেটা আগে বোধহয় সে বুঝতে পারেনি। আসাদ বললো,"ব্যাপারটা মঞ্জু ভাইকে বলি তাহলে। উনি হয়তোবা অন্য কিছু একটা বুদ্ধি দিতে পারেন।"

মঞ্জু ভাই তো আশরাফের সাজেশন শুনে লাফিয়ে উঠলেন। "সুপার আইডিয়া। তোমাদেরকে কোন চিন্তা করতে হবে না। আমি এক্ষুণি মোজাম্মেলকে লাগিয়ে দিচ্ছি। সে সব কিছু আধা ঘন্টার মধ্যে কমপ্লিট করে ফেলবে।"
মোজাম্মেল লোকটা কে প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আসাদ চোখের ইংগিতে চুপ করতে বলায় আমরা আর কথা বাড়ালাম না। পরে জেনেছি যে মোজাম্মেল ছিল এক ভাড়াটে গুন্ডা টাইপের ছেলে। অল্প কিছু পয়সা দিলেই সে হেন কাজ নেই যা করতে পারেনা।

পরদিন ক্যাম্পাসে গিয়ে শুনলাম, হীরা ইলেকশনে দাঁড়াচ্ছেনা। সে জেরীনকে সবার সামনে না করে দিয়েছে। খবরটা শুনে আমাদের তিনজনের মন খারাপ হয়ে গেল। আমরা কি তাহলে সত্যিই এতটা নীচে নেমে গেলাম? তাও কিনা এক সামান্য ইলেকশনের জন্য।

আমরা জানতাম যে হীরা তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। পরে শুনেছিলাম মোজাম্মেল নাকি হীরার মাকে ফোনে বলেছিল,"আপনার ছেলেকে যা খাওয়াতে ইচ্ছে হয়, তাড়াতাড়ি খাইয়ে ফেলুন। তার ওপারে যাওয়ার সময় কাছিয়ে এসেছে। তার ইলেকশন করার খায়েশটা এবার আমরা ভালভাবেই মিটিয়ে দেবো।"
এই কথা শোনার পর কি কোন মা আর তার ছেলেকে ইলেকশন করতে দেয়? হীরার মা ও দেননি।

যাক-হীরা দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেওয়ার পর মঞ্জু ভাই এবং আসাদের আনন্দ কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। ঘন্টা দুয়েক পর শোনা গেল যে হীরার অবর্তমানে জেরীন স্বয়ং দাঁড়াচ্ছে জি এস পোস্টে।
আসাদের অবস্থা হোল গরম তাওয়া থেকে জ্বলন্ত উনুনে। হীরা থাকলে মেয়েদের ভোট হয়তো তাও দু একটা পাওয়া যেতো, কিন্তু জেরীন দাঁড়ালে মেয়েদের একটা ভোটও আমাদের দিকে আসবেনা।

জরুরী মিটিং বসলো সেইদিন সন্ধ্যেবেলা। লোক বেশী না। আসাদ সহ আমরা চারজন, আর ওদিকে হচ্ছে মঞ্জু ভাই এবং অতিশয় বদ চেহারার একজন। আসাদ ফিস ফিস করে বললো, "এইই হচ্ছে মোজাম্মেল। সাবধানে কথা বলিস তোরা।"
আমরা ভয়ে ভয়ে ঘাড় নাড়ি।

আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে তাই নিয়ে। মঞ্জু ভাইয়ের স্ট্র্যাটেজী হচ্ছে ইলেকশনটাকে একটা ইস্যুর পিছনে দাঁড় করানো।"আমরা এটাকে ঢাকা বনাম ঢাকার বাইরের ছেলেদের ইলেকশন বলে কালার দিতে পারি। ঢাকাওয়ালার আধিপত্য না মানার ইলেকশন এটা। তোমরা চারজনই যেহেতু ঢাকার বাইরের, আর জেরীন যেহেতু ঢাকার, এই ইস্যুকে সামনে রেখে প্রচারণা চালালে আমাদের জেতার উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে। কেননা ঢাকার বাইরের ছেলে-মেয়েরা তখন আমাদের সাপোর্ট করবে।"

এরই ফাঁকে গলা খাঁকারি দিল মোজাম্মেল। "যদি দেখেন আপনাদের অবস্থা খারাপ , আমারে একটু আওয়াজ দিবেন ভোটের দিন। দুই চাইরটা বোমা ফাটানো কোন ঘটনা না। যদি দরকার হয়, লাশও ফালাইতে পারি দুই চাইরটা।"

মোজাম্মেলের কথা শুনে আমাদের চারজনেরই গায়ের রক্ত জমে যায়। বোমা, লাশ এসব কি শুনছি। আড়চোখে আসাদের দিকে তাকিয়ে দেখি তার মুখ ভয়ে সাদা হয়ে এসেছে। তাকে দেখে রাগও হোল, আবার মায়াও লাগলো। বুঝলাম তার ভরসায় থাকলে কপালে দুঃখ আছে। এবার আমাদেরকেই দায়িত্ব হাতে নিতে হবে।

মিটিং এর পর আসাদকে বিদায় করে দিয়ে আমরা তিনজনে ভাবতে বসলাম। কি করা যায় এখন? পরিস্থিতি তো নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বুঝলাম, আবারও কুচক্রী আশরাফের শরণাপন্ন হতে হবে।

এবার তাকে খুঁজে পেতে দেরী হোল বেশ। রাত যখন প্রায় বারোটা, তখন তার দেখা মিললো। সে নাকি নাইট শো তে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল।

যাই হোক, আশরাফকে লেটেস্ট পরিস্থিতি বর্ণনা করলাম। সে সব শুনে বললো,"খুবই সোজা সমস্যা। এর জন্যে আমার কাছে এসেছিস আবার। তোরা নিজেরাই তো এটা সমাধান করতে পারতিস।"
"আমাদের ব্রেন বর্তমানে ছুটিতে আছে দোস্ত। তুইই ভরসা এখন। বল কি করবো?"
"খুবই সহজ কাজ। তোদেরকে একটু ভয় দেখাতে হবে।"

আবার ভয় দেখাতে হবে? আশরাফের কাছে কি যাবতীয় সমস্যার জন্য এই একই সমাধান? (এই প্রসংগে একটি গল্প বলে নেই। অনেক পরে একবার হাতে "সহী সোলেমানী খাবনামা" নামের একটি বই পেয়েছিলাম যাতে বিভিন্ন স্বপ্নের ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। মজার ব্যাপারটি হচ্ছে যে প্রায় আশি ভাগ স্বপ্নের ব্যাখ্যাই ছিল 'সুন্দরী বিবি পাইবে'। বইটি পড়ার সময় কেন জানিনা আশরাফের কথা মনে হয়েছিল।)

"এবার আবার কাকে ভয় দেখাবো? মোজাম্মেলকে?"
আমাদের প্রশ্নে আশরাফ রীতিমত চটে যায়। "তোদের মাথার ব্রেন নাহয় ছুটিতে আছে কিন্তু আল্লাহ কি তোদের কোন কমন সেনসও দেয় নাই? তোদের ইন্টেলিজেনস একটা হাঁসের ডিমের বুদ্ধির চেয়েও কম।"
গালাগালি হজম করলাম নিঃশব্দে।

"ভয় দেখাবি তোদের ডিপার্টমেন্টের টীচারদের। তাদের বলবি যে অলরেডী হীরাকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। আর ইলেকশন হলে বোমাবাজী, মানুষ খুন, নারী অপহরণ ইত্যাদির রিস্ক আছে। কারো নাম বলার দরকার নেই। জাস্ট বলবি তারা যেন ইলেকশন ক্যানসেল করে দেয়। তা না হলে যদি কোন অঘটন ঘটে তাহলে তারা দায়ী থাকবেন। যা- তোরা এখন দুর হ'। আমার ঘুম পাচ্ছে।"

পরদিন সেই মোতাবেক কাজ করলাম। ইলেকশন ক্যানসেল হয়ে গেল দুদিন পর। আমাদের ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। মনের আনন্দে স্টেডিয়ামে গিয়ে (আসাদের পয়সায়) বিরিয়ানী খেয়ে এলাম আমরা চারজন।

আসাদ আর জীবনে কোনদিন ইলেকশনের নাম করেনি।

____________________________
ফুটনোটঃ
পরে আমরা হীরার কাছে গোটা ব্যাপারটা খুলে বলে মাপ চেয়েছিলাম। হীরা রেগে যাওয়ার পরিবর্তে খুব মজা পেয়েছিল এবং অনেকক্ষণ ধরে হেসেছিল। কেন জানিনা। বোধহয় সে একজন বড় মাপের মানুষ সেই জন্য।

-নির্বাসিত
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।


মন্তব্য

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

নির্বাসিত, প্রথম ২/১ প্যারাতে একটু হোঁচট খেলেও ধীরে ধীরে আপনাকে খুঁজে পেতে একটুও বেগ পেতে হয় নাই।
অসাধারণ লাগলো! আমি নিয়মিত পড়ছি।

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

অতিথি লেখক এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। আমার এই এলোমেলো লেখা যে আপনারা সবাই যে ধৈর্য্য নিয়ে পড়ছেন, আমি তাতেই ভয়ানক কৃতগ্গ (বানানটা ঠিক হোল না)। আপনাদের মন্তব্যতো আমাকে আরো ঋণী করে তুলছে।
আপনার কাছে লেখা ভাল লাগছে জেনে খুশী হয়েছি।

-নির্বাসিত
_________________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

আশফাক আহমেদ এর ছবি

চলুক

-------------------------------------------------

ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।