জাহিদ হোসেন
মিরির একটাই দোষ। একই কথা বার বার বলা। গত কয়েক মাস সে সাদেকের কানের পোকা বার করে দিয়েছে বাচ্চা বাচ্চা করে। মাঝে মাঝে সাদেকের অসহ্য লাগে।
সুরেলা শব্দে দেয়াল ঘড়িতে সাতটা বাজলো। বহুদিনের পুরনো একটা সিনেমা পত্রিকায় সাদেক চোখ বুলাচ্ছিল। ঘড়ির শব্দে সে একটু চোখ তুলে তাকায়। বিদেশী ঘড়ি। ডায়ালে ভারী চমৎকার একটা পাহাড়ী এলাকার ছবি। চূড়ায় বরফ, নীচে সবুজ বনভূমি। ডাক্তারের রুচি আছে বোঝা যায়।
ঘরে প্রচুর লোক। ডাক্তার সাহেবের পশার ভালই। মিরি অনেকক্ষন হয় ভিতরে গেছে। আজ মিরিকে ডাক্তার দেখানোর জন্যে সে হাফ বেলা ছুটি নিয়েছে অফিস থেকে। বারোদিন আগে করা অ্যাপয়েন্টমেন্ট। সময় ছিল বিকেল চারটেয়। সাদেকের ইচ্ছে ছিল ডাক্তার দেখানোর পর তারা দুজনে মিলে একটু ঘুরবে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে বাদাম ভাজা খাবে। তারপর নিউমার্কেটে গিয়ে টুকটাক শপিং। তেমন বিশেষ কিছুনা। মিরির দু একটা ব্রা, চুলের কাঁটা আর পয়সায় কুলোলে একটা ছোট্ট টেবিল ল্যাম্প। রাতে ঘুমোবার আগে সাদেকের কিছু একটা পড়তে হয়। ঘরে বড় বাতি জ্বললে মিরির ঘুমাতে অসুবিধে হয়। কিন্তু যে হারে এখানে দেরী হচ্ছে তাতে মনে হয় না আজকে সেসব কিছু হবে।
পর্দা ঠেলে নার্স এলো ওয়েটিং রুমে, "এখানে সাদেক সাহেব কার নাম?"
সাদেক উঠে দাঁড়ায়। কোন এক অজানা কারণে তার হার্টটা লাফিয়ে ছুটতে থাকে। সবকিছু ভাল তো?
"আমার সাথে আসুন। ডাক্তার সাহেব আপনার সাথে কথা বলবেন।"
ডাক্তারের চেম্বার এয়ার কন্ডিশন করা। সাদা এ্যপ্রন পরা ডাক্তারকে দেখে মনে হয় বহুদিন আগের টিভি সিরিজের ট্র্যাপার জন এম ডি। দাড়িটাই শুধু নেই। মিরি একটি চেয়ারে মাথা নীচু করে বসে আছে। তার মুখ ঈষৎ লাল। নাকের ডগায় কয়েক ফোঁটা ঘাম।
"বসুন, আপনিই তো ওনার স্বামী?"
"জ্বি।"
সাদেক চেয়ারে বসে। মিরির দিকে অল্প হাসে। ডাক্তার কি যেন চিন্তা করেন। চশমা খুলে টেবিলে রাখেন।
"আপনাদের সমস্যাটা কি খুলে বলুনতো।"
"আমাদের বাচ্চা হচ্ছেনা ডাক্তার সাহেব।"
"বেশ, তারপর?"
"ব্যস এটাই। আমি এবং আমার স্ত্রী দুজনেই বাচ্চা চাই। আমাদের বিয়ের তো প্রায় চার বছর হয়ে গেল। এতোদিনেই কোন বাচ্চা হোলনা। এটা নিয়ে আমরা খুবই দুশ্চিন্তায় আছি। একটা বাচ্চা হলে দুশ্চিন্তাটা কাটতো। তাছাড়া আত্মীয় স্বজনেও নানা রকম কথা বলছে।"
"আমি আপনার স্ত্রীকে পরীক্ষা করেছি। শী ইজ পারফেক্টলি স্যুটেবল ফর বিকামিং প্রেগন্যান্ট। এটা নিয়ে আপনারা দুশ্চিন্তা করবেন না।"
"কিন্তু ডাক্তার সাহেব তাহলে এতদিনেও কেন কোন কিছু হোলনা? চেষ্টা তো কম করছিনা।"
ডাক্তার সাহেব সাদেকের কথায় হেসে ফেলেন। "সব কথার কি উত্তর হয় সাদেক সাহেব? আমরা কিই বা জানি বলুন?"
সাদেকের হঠাৎ মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। অফিস কামাই দিয়ে এতোক্ষন বসে থেকে এই রকম "আমরা কিই বা জানি বলুন" মার্কা কথা শোনার পর তার মত শান্ত মানুষও রেগে যায়।
"তার মানে আমাদের আর কোন আশাই নেই। এটাই বলবেনতো।"
ডাক্তার আবার হাসেন। তাঁকে এবার বেশ সুন্দর লাগে।
"সাদেক সাহেব, রাগ করবেননা প্লিজ। আসল কথা হচ্ছে যে আপনি এবং আপনার স্ত্রী দুজনেই ওকে। তবে এরপরও বাচ্চা না হবার প্রচুর ঘটনা আছে। আপনারা হতাশ হবেননা। ব্যাটেবলে হয়তো হচ্ছেনা, তবে এটা যে হবেনা তাতো না। একটু সময় লাগবে, একটু ধৈর্য্য লাগবে। আশা হারাবেন না।"
রিকশা পেতে দেরি হোল। শীতকাল বলে অনেক আগেই দিন শেষ হয়ে গেছে। মিরি ফোঁস করে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো, "আমি আগেই জানতাম, আমাদের সমস্যা হবে।"
সাদেক কথা বললোনা। রিকশাওয়ালা এই শীতেও ঘামছে। বেচারারা সত্যিই বড় পরিশ্রম করে।
"তুমি চুপচাপ যে? কথা বলছো না কেন?" মিরি প্রশ্ন করে।
"কি বলবো?"
"ডাক্তারকে তুমি তো কিছু বললেনা। অতোগুলো টাকা নিলো।" মিরির গলায় রাগ।
সাদেক এবার হেসে ফেলে। মিরি কি ভেবেছিল যে ডাক্তার ফি নিয়ে হাতে বাচ্চা ধরিয়ে দেবে। মিরি এখনো বড্ড ছেলেমানুষ।
মনে আছে বিয়ের তিন মাস পরে একদিন সে চোরের মত মুখ করে বলেছিল,"জানো বিয়ের আগে তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। তুমি হয়তো জানতেওনা কোনদিন, কিন্তু না আমি কষ্ট পাচ্ছি।"
সাদেক অনুভব করেছিল, তার বুকে হঠাৎ ঈর্ষার তীব্র দংশন। তবে কি অন্য কেউ ছিল মিরির? তারপরও মুখে পৃথিবীর নিস্পৃহতা নিয়ে বলেছিল, "থাকনা, আমি নাহয় নাইবা জানলাম সবকিছু।"
"না, না। তোমাকে বলা উচিত আমার। আমার মাথায় বেশ কতগুলো পাকা চুল আছে। সেই ছেলেবেলা থেকেই। আমি অবশ্য ঢেকে রাখি সব সময়। অন্য কেউ দেখতে পায়না।"
বিয়ের পরের দিন সকালেই সাদেকের চোখে পড়েছিল। মিরি তখনো ঘুমিয়ে। ভোরের সূর্য্যের আলোয় ভালোবাসাময় এক উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে ছিল ঘরের মধ্যে। মিরির কানের পিছনে দুটি রূপোলী চুল।
"তুমি চুপ করে গেলে যে। রাগ করেছো?" মিরির চোখে উৎকণ্ঠা আর ভয়।
সাদেক মিরিকে কাছে টেনে নিয়েছিল। নাকের ডগায় ঠোঁট ছুঁইয়ে বলেছিল,"তুমি একদম পাগল।"
সাদেকের কেন জানি মনে হয় আজকাল পৃথিবীতে মিরির মতো মেয়েদের সংখ্যা কমে আসছে। মিরির মুখে সর্বক্ষন স্পর্শ করে থাকে মোমবাতির কোমল শিখা। তাতে আলো আছে, দহন নেই। সাদেক ঘরে ফেরার পর দুরন্ত প্রজাপতির মত মিরি উড়ে বেড়ায়। সাদেককে নিয়েই তার ভালোবাসা, তাকে ঘিরেই মিরি সম্পুর্ণ। বিকেলে চা খেতে খেতে মিরি পবিত্র কিশোরীর মত নিস্পাপ গলায় প্রশ্ন করে," আজ কটা মেয়ের দিকে তাকিয়েছ? আমার গা ছুঁয়ে বলো। মিথ্যে বললে কিন্তু আজ রাতেই আমার মরা মুখ দেখবে।"
রিকশাটা একটু জোরে চলছে। শীত লাগছে গায়ে। রাস্তা ফাঁকা। মিরি আলতো করে সাদেকের হাতে হাত রাখলো। সাদেক বোঝে মিরির রাগ পড়ে গেছে। তার হাতে সাদেক অল্প চাপ দেয়। মিরির চোখে ভালোবাসা জ্যোত্স্নায় বিছানো দুধসাদা পলিমাটি হয়ে জড়িয়ে থাকে। সাদেক তৃষ্ণার্তের মতো সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
রাতে খাবার পর মিরি আবার কথাটা তোলে। "আমার মনে হয়, আমাদের কোনদিন বাচ্চা হবেনা। অন্যদের কি সুন্দর ফট্ করে হয়ে যায়। ডাক্তার যাই বলুক না কেন, আমাদের নিশ্চয়ই কোন ঘাপলা আছে।"
সাদেক বিছানায় শুয়ে সিগারেট ধরাচ্ছিল। আজকাল সে দিনে মাত্র দুটো সিগারেট খায়। গভীর তৃপ্তির সাথে সে একগাল ধোঁয়া ছাড়ে। মিরির আবার কথার খেই ধরে। "নাজু আপার বিয়ের বছর না পুরতেই বাচ্চা হোল। নাজু আপা আমার চেয়ে সাত বছরের বড়। শুনি বয়সী মেয়েদের বাচ্চা হতে চায়না। আমার এই বয়েসেই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে পরে কি হবে?"
"ডাক্তার যা বললেন তাতো তুমি শুনলেই। এতো হতাশ হলে কি ভাবে চলবে? সময় হলে আল্লাহ ঠিকই দেবেন।"
"তোমার মন বলতে কিচ্ছু নেই। পাথরের সাথে বিয়ে হয়েছে আমার।" মিরি হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। সাদেক ব্যস্ত হাতে সিগারেট এ্যাশট্রেতে গুঁজে দেয়।
"মিরি, তুমি এতো ভেঙ্গে পড়ছো কেন? দেখো- আল্লাহ দিলে তুমি এমাসেই কনসীভ্ করতে পারো।"
"জীবনেও না। প্রতিমাসেই তো আশা করে বসে থাকি। কিচ্ছু হয়না। ঠিকদিনেই ঝুপ করে পিরিয়ড হয়ে যায়।"
"তাতে কি? ডাক্তার বললেন না, তুমি যেকোন মাসেই কনসীভ্ করতে পারো। আচ্ছা, এমাসের তোমার পিরিয়ডের তারিখ কবে?"
মিরি চোখ মোছে। তারপর আঙ্গুলে গুনে দিনের হিসাব করে। "সাতাশ তারিখ। ঠিক এগারো দিন পর।"
"তাহলে তুমি এখনই আশা হারাচ্ছো কেন? সাতাশ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করে দ্যাখো। আমার মন বলছে, এবার তোমার পিরিয়ড হবেনা। আল্লাহ আমাদের এবার ফিরিয়ে দেবেননা।"
"পাশের বাসার আপা বলছিলেন কোন এক ফকিরের তাবিজ নিলে নাকি তিনমাসের মধ্যেই পেটে বাচ্চা আসে। চলো না- যাই একবার।"
"এমাসটা দ্যাখো মিরি।"
পরের দিনগুলো কেমন যেন ঘোরের মধ্যে কাটলো সাদেকের। অফিসের পিয়ন তোবারককে ভুলে মিরি বলে ডাকলো তিনবার। তোবারক ঘাবড়ে গিয়ে বললো,"পানি এনে দেই, স্যার।"
পাশের টেবিলের রাশেদ বললো, "সাদেক ভাই, দারুন একটা ভিডিও হাতে এসেছে, দেখবেন নাকি? ভীষন রগরগে।"
সাদেক মাথা নাড়ে ক্লান্ত ভাবে। ফাইলের মার্জিনে লাল কালিতে মিরির নাম হাজার বার লেখে। তারপর চমক ভেঙ্গে গেলে সেগুলো কেটে দেয়।
সাতাশ তারিখে ঘড়ি যেন আর চলতে চায়না। অফিসের মিটিং ছিল, বাসায় ফিরতে দেরী হোল। বাসার দরজা খোলা, তাতে মিরি হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চুল খোলা, আনমনে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। সাদেককে দেখে সে অল্প হাসলো। মাথা নীচু করে নখ খুঁটতে খুঁটতে বললো, " জানো- আজ আমার শরীর খারাপ হয়নি।"
মুহুর্তে সাদেকের চোখে ঘোর নামে। সে যেন দেখতে পায়, ঘরের মেঝেতে একটি শিশু হামাগুড়ি দিচ্ছে। পিছনে মিরি, তার চোখে স্নেহের প্রগাঢ় কাজল। দু হাত বাড়িয়ে সে ডাকলো,"প্রত্যুষ, আয় আমার কাছে আয়।"
শিশুটি বসে পড়ে, তারপর ঝর্ণাধ্বনির মতো হেসে ওঠে। মিরি শিশুটিকে বুকে তুলে চুমু খায়। "মায়ের কাছে আসতে চাওনা, না?"
রাতে বিছানায় শুয়ে মিরি বললো,"তুমি তো কিছুই বললে না।"
মাথার কাছে টেবিলফ্যানটা ঘুরছে। জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে পাতলা জ্যোত্স্না। মিরির পাথরের নাকফুলটি স্বল্প আলোয় ঝিকিয়ে ওঠে মাঝেমাঝে।
"আমাদের যদি ছেলে হয়, তবে তার নাম রাখবো প্রত্যুষ। নামটা হঠাৎ করেই পেয়ে গেলাম, মিরি।"
"প্রত্যুষ- খুব সুন্দর নাম তো। কে দিলো, বলোনা।"
সাদেক হাসে। "স্বপ্নে পেয়েছি।"
"তোমার সবকিছুতেই ঠাট্টা।" মিরিও হাসে।
পরদিনও মিরি দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। "আজও আমার শরীর খারাপ হয়নি।"
স্বপ্নের মধ্যে হঠাৎ শিশুটি উঠে দাঁড়ায়। টলোমলো পায়ে হাঁটে। তার হাসিটি দেখতে বড় সুন্দর। দুটি দাঁত উঠেছে সবেমাত্র। দুহাতে সে সাদেকের পা জড়িয়ে ধরে ডাকে,"বাব্বা, বাব্বা।" বেডরুম থেকে মিরি দৌড়ে আসে, "এটাকে নিয়েতো দেখি খুব ঝামেলা হয়েছে। একমুহুর্তও বসে না। আয়- আমার কাছে আয়, আমি কাপড় পরিয়ে দেই।"
নগ্ন শিশুটি মিরিকে দেখে শব্দ করে হাসে।
রাতে খেতে বসে মিরি তেমন কিছুই খেতে পারলোনা। তার বমিবমি লাগছে। সাদেক অবাক হয়।
"এতো তাড়াতাড়ি এসব শুরু হয় নাকি?"
মিরি সবজান্তার মতো হাসে। "তুমি এসব জানো কিভাবে? আগের পক্ষের বৌ ছিল নাকি?"
অফিসে মন বসেনা সাদেকের। প্রত্যুষ বড় হয়ে উঠছে। তার জন্য খেলনা কিনতে হবে। জন্মদিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। স্কুলে নাকি দু তিন বছর আগে থেকে বলে না রাখলে বাচ্চা ভর্তি করানো যায়না। পাশের টেবিলের রাশেদ অবাক হয়। সাদেক ভাইকে আজকাল বড় এলোমেলো লাগে। সর্বক্ষন কিসের ভাবনায় ব্যস্ত। দু বার ডাকলেও সাড়া পাওয়া যায়না।
সবচেয়ে মুস্কিল হয়েছে পিয়ন তোবারকের। এপর্যন্ত সে তিনবার ধমক খেয়েছে সাদেকের কাছ থেকে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সাদেক হুংকার দিয়েছে, "একি, ঠান্ডা কেন? তুমি কি জানোনা যে ঠান্ডা দুধ বাচ্চাদের জন্য ক্ষতিকর।"
মিরিও বদলে গেছে, নিজের মনে সে গুনগুন করে গান গায়, এক মনে শোকেসের পুতুল সাজায়। সাদেক ডাকলে সে বলে, "দেখছোনা আমি কাজ করছি। বাচ্চারা এলোমেলো ঘর পছন্দ করেনা।"
এক তারিখে বেতন পেল সাদেক। অফিস থেকে সে সোজা চলে গেল নিউমার্কেটে। মিরিকে বহুদিন শাড়ী কিনে দেয়নি সে। শাড়ী পছন্দ করার ব্যাপারে সাদেক মহা আনাড়ী। সাধারণতঃ মিরিই পছন্দ করে কেনে। তবে আজ সে মিরিকে সারপ্রাইজ দেবে। কষ্ট হলেও একটা দামী জামদানী কিনলো সে। হাল্কা পেঁয়াজ রং শাড়ীটির। দোকানের ছোকরা সেলসম্যান বললো, "ভাবীকে খুব মানাবে স্যার। পছন্দ না হলে নিয়ে আসবেন। আমি পালটে দেব।"
বাড়ী ফিরে সাদেক দেখলো দরজায় প্রতিদিনের মতো মিরি দাঁড়িয়ে নেই। কড়া নাড়তে গিয়ে দেখলো, দরজা খোলা। বেডরুমে জিরো পাওয়ারের বাতি জ্বলছে। আবছা নীল আলোর মধ্যে মিরি বিছানায় শুয়ে আছে কপালে হাত দিয়ে। মেঝেতে স্বপ্নের জগতে প্রত্যুষ ছোট পায়ে এদিক ওদিক হাঁটছে। ওর চোখে জল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে ডাকছে, "মাম্মা, মাম্মা।"
সাদেক মিরির গায়ে হাত রাখলো। "মিরি, কি হয়েছে? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?"
মিরি হুহু করে কেঁদে ওঠে। " আজকে আমার পিরিয়ড হয়ে গেল।"
"সেটাতো বেশ কয় দিন আগে হবার কথা ছিল। এত দেরীতে হোল কেন? মিসক্যারেজ না তো?"
"না, আমি বিকেলে ডাক্তারকে ফোন করেছিলাম। উনি বললেন, অনেক সময় নাকি পিরিয়ড দেরীতে হয়। আমি এতো আশা করেছিলাম।" মিরির চোখে জল উপচে পড়ে।
সাদেক মিরির চোখের পানি মুছিয়ে দেয়। "তুমি এতো ভেঙ্গে পড়োনা প্লিজ। এমাসে হোলনা, তো কি হয়েছে? সামনের মাসে হবে।"
মিরি হঠাৎ সাপিনীর মতো ফোঁস করে ওঠে। "তোমার কি? তোমার তো মন বলে কোন জিনিসনেই। থাকলে আমাকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে না। আসলে তোমার জন্যেই এইসব হচ্ছে। বাচ্চার কথা কোনদিন নিজে থেকে বলেছো আমাকে? সবসময় আমি বলি, তারপর তুমি সায় দাও। তুমিতো পাথর, তোমার মধ্যে দয়ামায়া বলে আছে কিছু? একফোঁটা পানি আছে চোখে? জানি নেই, তুমি সীমার।"
"মন খারাপ করে কি লাভ মিরি? সময় হলে সব হবে দেখো।"
"আমি মরলে তারপর সময় হবে। আমি কোনদিনই মা হতে পারবো না। জীবনটা আমার শেষ হয়ে গেল।"
গভীর রাতে শুনশান নির্জনতার মধ্যে সাদেক মিরির শিয়রে বসে থাকে। মিরি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষন আগে। তার একটা হাত আঁকড়ে আছে সাদেককে। অ্যাশট্রে ভর্তি সিগারেট। সাদেক তার শৈশবের কথা ভাবছিল।
মফস্বল শহরের দুঁদে উকিল ছিলেন বাবা। ঘরে তার দাপটে বাঘে গরুতে একঘাটে পানি খেতো, মা সংসারের অন্তরালে নিজেকে লুকিয়ে ছিলেন লাজুক ঘাসফুলের মতো। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে কেউ কোনদিন কথা বলার সাহস পায়নি, বাবা ছিলেন দূরের মানুষ। সূর্য্যের মতো এক প্রবল তেজবান পুরুষ, যার কাছে গেলে যে কেউই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।
সাদেকের মনে আছে, একবার ছেলেবেলায় তার প্রচন্ড জ্বর হয়েছিল। বাবা গভীর রাতে বাড়ি ফিরে সে কথা শুনলেন। জ্বরে প্রায় অচেতন সাদেক আবছা টের পেয়েছিল যে বাবা মসমস শব্দে ঘরে ঢুকলেন। কপালে হাত রেখে বলেছিলে, "এটার অবস্থা দেখি বেশ খারাপ।" সাদেকের আর কিছু মনে নেই, শুধু কপালে বাবার হাতের স্পর্শটুকু ছাড়া।
বাবা এখন অনেক বুড়িয়ে গেছেন। তার সেই দাপট এখন আর তেমন নেই। মাঝে মাঝে সাদেক বাবাকে মৃদু বকুনি দেয়। বাবা তখন মুখ কাঁচুমাচু করে বলেন, "আজকাল সব কিছু ভুলে যাইরে সাদেক।"
ঘুমের মধ্যে মিরি নড়েচড়ে ওঠে। অস্ফুটে কি যেন বলে। সাদেক প্রস্তরমূর্তির মতো বসে রাত দেখে। দূরে বেওয়ারিশ কুকুর কেঁদে ওঠে কোথাও। রাত বাড়ে।
বাবা কি কোনদিন এমনিভাবে তার সন্তানের কথা ভেবেছিলেন? এমনিভাবে নির্ঘুম চোখে মায়ের শিয়রে জেগে ছিলেন? বাবা কি কোনদিন মায়ের কানে কানে বলেছিলেন, "শাহীন, বাড়ীটা বড় শূন্য শূন্য লাগে। নতুন মানুষ দরকার।" মায়ের মুখে লজ্জার রংধনু ছিল হয়তো। তিনি কি উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে ছিলেন স্বামীর দিকে?
সাদেকের হঠাৎ বুক ভেঙ্গে কান্না এলো। ঘরের মধ্যে নীলাভ বাতির কুয়াশা। রহস্যময় আলো আঁধারী। তবুও স্বপ্নের ভুবনটি নেই আজ। সেই শিশুটি আর দেখা দেয়না, টলোমলো পায়ে দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসেনা। দুটি দাঁতে মোহন হাসি নিয়ে ডাকেনা, "বাব্বা, বাব্বা।"
সর্বনাশা ঘুর্ণিঝড়ের মতো কি যেন সাদেককে আঘাত করে। পাথর ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে জল। নিঃস্ব মানুষের মতো সাদেক মেঝেতে নতজানু হয়ে কাঁদতে থাকে। দু হাত দিগন্তে মেলে দিয়ে সে ফিসফিস করে শিশুটিকে ডাকে, "প্রত্যুষ-আমার কাছে আয় সোনা। আমার ঘরে আয়।"
মিরি নিঃসাড়ে ঘুমাতেই থাকে। সে এসবের কিছুই টের পায়না।
পুরুষের চোখের জল চিরকালই মেয়েদের অগোচরে থাকে।
(পুন:- প্রিয় ব্লগার নজমুল আলবাব এর পরামর্শ মোতাবেক আমি আমার "নির্বাসিত" নিক পরিত্যাগ করিয়া স্বনামে লেখা পোস্ট করা শুরু করিলাম)
______________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
মন্তব্য
নির্বাসনের কাল তাহলে শেষ হলো!
গল্পের গাঁথুনি নিটোল।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
অনেক ধন্যবাদ গল্পটি পড়ার এবং পছন্দ করার জন্য।
আমার নির্বাসনের কাল শেষ হবার নয়।
-জাহিদ হোসেন
________________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
সে এসবের কিছুই টের পায়না। ----
গল্পটা এখানেই শেষ করা যেত হয়তো।
ভাল লাগল । এমন গল্পই আমার ভাল লাগে-সহজ,সাদামাটা কিন্তু মন ছোঁয়া।
পড়ার এবং মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।
আমি একটু কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করছি, আপনার কাছে কি গল্পের শেষ লাইনটি ভাল লাগেনি, বা বাহুল্য মনে হয়েছে?
-জাহিদ হোসেন
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
ফুটনোটে আমার নাম! এসবে বেশ লজ্জা লাগে। তবে এইবার সেরকম হচ্ছেনা। এমন একজন লেখককে ছদ্মনামের আড়াল থেকে বের করতে আমিও ভূমিকা রেখেছি এই ভাবনা বেশ আরামদায়ক।
জাহিদ ভাই, আপনার লেখার ভক্ত আমি। যথারিতি এইবারও মুগ্ধ। সাফল্য কামনা করছি।
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
এইবার তো আপনি আমাকে লজ্জা দিলেন। মাঝে মাঝে কিবোর্ডে ঠোকাঠুকি করি আরকি। ব্লগের কয়েকজনের উত্সাহ না পেলে লিখতে বসাই হোত না।
দেখি আর কি লেখা যায়। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ছদ্মনামের আড়াল থেকে বেরোনোর যুক্তিগুলোর জন্য। ভাল থাকুন।
-জাহিদ হোসেন
______________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
খুব সাবলীল ভাবে তুলে ধরলেন সাধারণ একটা ঘটনা অসাধারণ ভঙ্গিতে, আমি ভয় পাচ্ছিলাম সিউডো-সায়েসিস হল কিনা!
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
নতুন মন্তব্য করুন