আজকাল অনেককেই বলতে শোনা যায়, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে "আমার সোনার বাংলা...." গানটি থাকার যৌক্তিকতা কতখানি? তারা যুক্তি হিসাবে উপস্থাপন করে যে, রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশ চেতনার বিরুধী ছিলেন, বা বাংলাদেশ তথা পূর্ববঙ্গের উন্নতির বিরুদ্ধপক্ষ মানুষ ছিলেন- কেননা,
১। তিনি বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা নিয়েছিলেন।
২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে কলকাতায় আয়োজিত সমাবেশের সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৩। আমাদের স্বাধীনতা হরণকারী ব্রিটিশদের তাবেদার ছিলেন। কেননা, তিনি জনগণমন ভাগ্যবিধাতা গানটি রচনা করেছিলেন সাদা চামড়ার স্তুতির উদ্দেশ্যে।
উপরের তিনটি ঘটনাকে সত্য ধরেও কি তাঁকে বাংলাদেশ চেতনার বিরুধী বলা যায়? (ক্রমানুসারেঃ)
১। বঙ্গভঙ্গের ঘটনার সাথে বাংলাদেশ চেতনার কোন সম্পর্কই নেই। এটা ঠিক যে, পূর্ববঙ্গের মুসলিম উঠতি বুর্জোয়া শ্রেণীর তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণী বিভিন্ন দিক থেকে এগিয়ে ছিল, কেননা- তারা মুসলিমদের আগে থেকেই ইংরেজী শিক্ষার দিকে ঝুকেছিল এবং বণিকী পেশাতেও তারা অগ্রজ ছিল। ফলে, ইংরেজরা যখন ডিভাইড এণ্ড রুল এর নীতিতে বঙ্গভঙ্গ করলো- ঐ হিন্দু বুর্জোয়া অংশ স্বভাবতই তার বিরুধীতা করে। এবং মুসলিম অংশটিকে গোষ্ঠী স্বার্থেই ইংরেজরা পক্ষে পায়। তবে, এই অংশদুটির বাইরে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে দুই বঙ্গের অনেক মুক্তমনা এই বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করেছিল এই জায়গা থেকে যে, প্রথমত ইংরেজরা প্রথমবারের মত সাফল্যের সাথে হিন্দু-মুসলিমে বিভেদ টানতে সক্ষম হয়, যা স্পষ্ট হয় পরবর্তি দাঙ্গায়, নজরুল সহ অনেকের লেখনীতে এই দাঙ্গা-বিরোধী বক্তব্য পাবেন [যার চুড়ান্ত ফলাফল গিয়ে দাঁড়ায় দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মকেন্দ্রিক পাকিস্তান নামক হাস্যকর রাষ্ট্রটির উদ্ভব]; এবং দ্বিতীয়ত- অবিভক্ত বাংলার স্বপ্নচারী ও অভ্যস্ত মানসিকতায় ইংরেজ কর্তৃক নির্মম আঘাতের কষ্ট।
এটা পরিস্কার যে, এই বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনাকারী ইংরেজরা, মুসলীম লীগের উত্পত্তির পেছনেও তাদের ভূমিকা ছিল এবং এটাও ঠিক যে, তাদের এ উপমহাদেশে কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বী একটি রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন ছিল- এবং হিন্দু ও মুসলিমকে বিভক্ত করাও প্রয়োজন ছিল; বেশীদিন এখানে তাদের শাসন-নির্যাতনের রাজত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদেই।
২। ঢাকা কিন্তু তখন বাংলাদেশের রাজধানী নয়, ফলে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধীতার সাথে বাংলাদেশ চেতনার কোন সম্পর্কই থাকতে পারে না। একটি উদাহরণ দেই- ধরেন এই মুহুর্তে পদ্মাসেতুর একটি সিদ্ধান্ত হতে যাচ্ছে। এখন কোথায় এই সেতু নির্মিত হবে সেটা নিয়ে দুদল লোক এলাকাগত সুবিধার ভিত্তিতে একদল মাওয়া আরেকদল পাটুরিয়ায় সেতু নির্মাণের দাবি করলো। সে দাবিতে- পাটুরিয়ায় সেতু নির্মিত হলে যারা লাভবান হবেন তারা সমাবেশ করলো- মাওয়ায় সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করে। সেক্ষেত্রে কি বলা যেতে পারে? আমরা এটুকুই বলতে পারি পাটুরিয়ার লোকজন দেশের বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভাবতে ব্যর্থ হয়েছে, কেননা মাওয়া সেতু হলেই সবদিক থেকে মঙ্গল। কিন্তু বাংলাদেশ যদি দুটুকরা হয়ে দুটি দেশ হয় যার একদিকে মাওয়া আর দিকে পাটুরিয়া তবে মাওয়ার দিকের লোকজন কি দাবি করবে- অমুক ঐ সমাবেশে মাওয়া সেতুর বিরোধিতা করেছিল- সেজন্য সে আমাদের এই দেশের চেতনা পরিপন্থী??
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা ছিল- সেটা তাঁর বিশেষ স্বপ্ন ছিল। আর, বিভিন্ন সময়ে কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ উভয়বঙ্গের শিক্ষাবিস্তার নিয়ে তাঁর অনেক নিরন্তর ইতিবাচক ভূমিকার কথা সকলেই জানে।
৩। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের আপোষকামী অংশের প্রতিনিধি। উঠতি বুর্জোয়া, জমিদার শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দল কংগ্রেসও তাই। সূর্যসেন-ক্ষুধিরাম-ভগত সিং- প্রীতিলতা- পরবর্তিতে সুভাষ বোস - এনাদের বিপ্লবী ধারার বিপরীতে কংগ্রেসের ভূমিকা ছিল ব্রিটিশদের সাথে আপোষ-লড়াই-সুবিধা আদায়-আপোষ- নীতিতে চলা এক রাজনৈতিক সংগ্রাম। যার ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি ব্রিটিশদের দান করা পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র- এ আমাদের লজ্জা যে, আমরা ব্রিটিশদের বিতাড়িত করতে পারিনি- এ লজ্জা আমাদের দান করেছে কংগ্রেস তথা মহাত্মা গান্ধী ও নেহরু- জিন্নাহরা; যদিও অগ্নিপুরুষ ঐ বিপ্লবীদের কারণেই ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল- তাই এ লজ্জা আমাদের লাঘবও হয়।
যাহোক, যা বলছিলাম- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপোষকামী অংশের প্রতিনিধি- ফলে ওনার চিন্তা-ভাবনার মধ্যে এই সংগ্রাম ও আপোষ উভয়েরই সংমিশ্রন পাওয়া যায়। তবে তাঁর সাহিত্য-কর্ম, তাঁর জীবন, তাঁর কর্মপদ্ধতি সবকিছু দেখে তাঁকে একজন অত্যন্ত সংবেদনশীল মনের অধিকারী- সত ব্যক্তি বলেই মনে হয়। ফলে, তার যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পেছনে সুবিধা গ্রহণের কোন বিষয় থাকাটা সম্ভব নয়, বরং চিন্তাগত সারল্য জনিত কিছু ভুলের প্রভাবই মনে হয় আপোষের অংশটুকুকে। মনে রাখবেন জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনায় কংগ্রেস তথা গান্ধীও এত তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
বাংলা ভাষা, বাঙ্গালি সংষ্কৃতি ও রবীন্দ্রনাথঃ
হুমায়ুন আজাদের ভাষায় বলি, "আকাশে সূর্য ওঠে প্রতিদিন, আমরা সূর্যের স্নেহ পাই সারাক্ষণ। সূর্য ছাড়া আমাদের চলে না। তেমনি আমাদের আছেন একজন, যিনি আমাদের প্রতিদিনের সূর্য। তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [১৮৬১-১৯৪১]। তিনি আমাদের জীবনে সারাক্ষণ আলো দিচ্ছেন। তিনি বাঙলা ভাষার সবার বড় কবি। তাই নয় শুধু, তিনি আমাদের সব। তিনি কবিতা লিখেছেন, গল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন, নাটক রচনা করেছেন, গান লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি কি লেখেন নি? তিনি একাই বাঙলা সাহিত্যকে এগিয়ে দিয়ে গেছেন কয়েকশো বছর। আজ যে বাঙলা সাহিত্য বেশ ধনী- তার বড় কারণ তিনি"। কিন্তু তিনি শুধু বাঙলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি নন, বাঙলা ভাষার শ্রেষ্ঠ বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানীও। তিনি তাঁর সৃষ্টির মাঝে বাংলাকে যেন নবপ্রাণ দান করেন। ভাষাকেই করে তুলেন সমৃদ্ধ।
সংক্ষেপে ইতিহাসটা একটু বলি (বিস্তারিত অন্য সময়ে বলা যাবে)। চর্যাপদ এর কালে বাঙলা ভাষা ছিল খুবই অবিকশিত। ১৮০১ সালে শুরু হয় আধুনিক বাঙ্গালীর বাংলা গদ্যের ধারা। কেরি, রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামমোহন রায়, অক্ষয়কুমার দত্ত এবং আরো অনেকের শ্রমে ক্রম বিকশিত হয় সাধুভাষা। ১৮৬০ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভাষায় সাধুরীতি স্থির মানরূপ লাভ করে। এরপরে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও আরো অনেকে সাধুরীতির বাংলায় নিয়ে আসেন আরো অনেক বৈচিত্র। তবে রবীন্দ্রনাথের কৃতিত্ব অন্যখানে। তা হলো চলতি বাংলা। প্যারীচাঁদ মিত্র ও প্রমথ চৌধুরীর পথ ধরে যখন রবীন্দ্রনাথ গদ্যরীতি হিসাবে চলতি রীতিতে লেখা আরম্ভ করেন- তখন থেকেই কিন্তু চলতি রীতিই মান ভাষা, বাংলা ভাষা। এ কাজ করতে গিয়ে তাঁর ভাষাকে সৃষ্টি করতে হয়েছে। তাই তিনি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সন্তান।
শুধু সাহিত্য ও ভাষার ক্ষেত্রেই নয়- রবীন্দ্রনাথ তাঁর অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রভৃতির মাধ্যমে বাঙ্গালীর মনন, রুচি, সংস্কৃতিও তৈরি করতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন।
ফলে, আমাদের ভাষা কেন্দ্রিক যে জাতীয়তা বোধ- সেই বাঙ্গালী জাতিয়তাবোধই অসম্পূর্ণ থেকে যায় রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে।
কেন ও কিভাবে সোনার বাংলা আমাদের জাতীয় সঙ্গীতঃ
পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর হাতে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা থেকে যায়- মুসলীম লীগের প্রতিষ্ঠাতা নেতা জিন্নাহর হাত ধরে। যে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব- সেখানে পূর্ব ও পশ্চিম দুটি অংশের মধ্যে একমাত্র মিল ধর্ম- ইসলাম।
পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী প্রথমেই আঘাত হানে আমাদের বাংলা ভাষার উপর। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেয়ার চেস্টা করা হলো। মূল কারণ ঐ ধর্মকেন্দ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সৃষ্টি। ভারতের এক বড় অংশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলা, এই ভাষার উতপত্তি-বিকাশে বড় ভূমিকা বিভিন্ন হিন্দু কবি-সাহিত্যিকদের, তদুপরি পূর্ববঙ্গের মানুষদের সাথে সমস্ত দিক দিয়েই পশ্চিম পাকিস্তানীদের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের সাথে আত্মিক যোগাযোগ যুগযুগ ধরেই অনেক ভালো ছিল। ফলে, পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী প্রথম থেকে এখানকার লোকদের ভাষা, কৃষ্টি-কালচারকে ভালো নজরে দেখতে পারেনি- যা তাদের চোখে হয়ে দাঁড়ায় হিন্দুয়ানি। বাংলাকে তারা দেখেছিল হিন্দুর ভাষা হিসাবে। ফলে খড়গ নেমে আসে ভাষার উপরে- তৈরি হয় বায়ান্নো।
এই ভাষার লড়াই করতে গিয়ে অনন্য এক অভিজ্ঞতা হয় বাংলার। আগের স্ট্রীমের বাংলা থেকে তার একটি পার্থক্য তৈরি হয়ে যায়। এবারে বাংলা পায় একটি লড়াই এর চেতনা। ভাষার জন্য লড়াই- পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের বাংলা হয়ে ওঠে তেজোদ্দীপ্ত বাংলা। আর, এর মধ্য দিয়ে আরেকটি ঘটনা ঘটে, সেটা হলো বাঙ্গালী জাতিসত্তার উন্মেষ। এই ভাষা আন্দোলনের তাতপর্য এখানেই অনন্য যে, এর মধ্য দিয়ে আমরা পাকিস্তানী ধর্মভিত্তিক জাতিসত্তার অন্তসারশূণ্যতা উপলব্ধি করি এবং একই সাথে- আবহমান অবিভক্ত বাংলার যে বাঙ্গালী জাতিসত্তা তার সাথেও একটা সীমারেখা তৈরি হয়ে যায় আমাদের এই ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া বাঙ্গালী জাতিসত্তার। ফলে, স্বভাবতই এই বাঙ্গালী জাতীয়তাবোধের সাথে আছে লড়াইয়ের তেজ, আছে অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা এবং ভাষার সাথে গাটছাড়া এক সম্পর্ক।
এদিকে ভাষার লড়াইয়ে হেরে গিয়ে শাসক গোষ্ঠী শুরু করে দেয় সাংস্কৃতিক দমন, পীড়ন, নির্যাতন। অন্যান্য অর্থনৈতিক শোষণের সাথে সমান তালে এসবও চলতে থাকে। ফলে, একে কেন্দ্র করে লড়াইও চলতে থাকে সমান তালে। সবচেয়ে বেশী আক্রমণ আসে, রবীন্দ্র চর্চার উপর। কেননা, আগেই বলেছি- রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে বাঙ্গালিত্বের আর কিছু থাকে। খুঁজে-ফিরে আমদানি করা হয় মুসলমান কবি-সাহিত্যিককে। এককালের কাফের উপাধী পাওয়া নজরুলকে মুখোমুখি করাতে চাইলো রবীন্দ্রনাথের। আমরা দুজনকেই আকড়ে ধরলাম, কাউকে কারো প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে নয়, দুজনকেই পরম বন্ধু হিসাবে। ফলে, আমরা প্রতিবাদী জলসায় কারার ঐ লৌহ কপাট এর সাথে সাথে আমার সোনার বাংলাও গাইলাম।
তারপর তো, সবই ইতিহাস। রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী। রবীন্দ্র চর্চার উপর নিষেধাজ্ঞা- জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনে বাঁধা, আর অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে লড়াই- এবং রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলাকে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদায় অভিষিক্ত করা।
এভাবে শাসক গোষ্ঠী রবীন্দ্রনাথকে যতই আমাদের কাছ থেকে দূরে সরাতে চেয়েছে- ততই রবীন্দ্রনাথ হয়ে গেছেন বাঙ্গালী চেতনারই অংশ-বিশেষ।
বাংলা ভাষা, রবীন্দ্রনাথ, জাতীয় সঙ্গীতের বিরোধীতা একই সূত্রে গ্রোথিতঃ
বাংলা ভাষা, রবীন্দ্রনাথ ও জাতীয় সঙ্গীতের বিরোধীতার মূলে আছে- সাম্প্রদায়িকতা, উপরের আলোচনায় তা নিশ্চয় এতক্ষণে পরিস্কার হয়েছে। আজ অনেকেই বলে যে, রবীন্দ্রনাথ নিজে ব্রাহ্ম হলেও তিনি হিন্দুত্ববাদের প্রচার করে গেছেন!!!
এরা আজ যেসব যুক্তি(!!) করছে- একই কথা পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী আমাদের এখানে প্রচারের চেস্টা চালাতো। তাদের হয়ে এ প্রচারকার্যের মূল দায়িত্ব পালন করতো এখানকার রাজাকার ও মুসলিম লীগের দালালরা। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, সে সময়ে চেতনার জায়গা বা লেভেলটা এমন জায়গায় ছিল যে, যখনই কেউ রবীন্দ্রনাথ বা হিন্দুত্ব নিয়ে কথা বলতে আসত- সাথে সাথেই তাকে দালাল হিসাবে প্রতিরো১ধ করতো। ফলে, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কোন চক্রান্তই হালে পানি পায়নি।
আজও, দালালরা, মানে রাজাকার-রাজাকারপুত্র-নব্যরাজাকাররা একই ধরণের যুক্তি করতে চায়- জাতীয় সঙ্গীত পাল্টানোর কথা বলে - এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যার অপরনাম বাঙ্গালিত্বের চেতনার মূল যে চেতনা সেই অসাম্প্রদায়িক সেক্যুলার চেতনাকে আঘাত করা।
আরেকটি চমতকার(!) যুক্তি আজকাল প্রায়ই শোনা যায়ঃ এই জাতীয় সঙ্গীত আমাদের বাংলাদেশকে ধারণ করে না; বা আরো ভালো কোন সঙ্গীত যদি বাংলাদেশকে ধারণ করতে পারে তবে- সেটিকে জাতীয় সঙ্গীত করা উচিত। আজ জাতীয় সঙ্গীতকে কেন্দ্র যিনিই কথা বলছেন- বুঝতে হবে চিন্তায়-মানসিকতায় সকলেই 'একই গোয়ালের গরু' প্রকৃতির। সেদিনের মত আজও তাদের দালাল-রাজাকার হিসাবে প্রতিরোধই কাম্য।
আর, বাংলাদেশকে ধারন করা প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য হলো- এই গানের মত বাংলাদেশকে ধারণ করে, আমাদের ইমোশনকে ধারণ করতে পারে আর একটি গানও আমি কোনদিন শুনিনি। এমনকি অন্য যেকটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের ইংরেজী অনুবাদ পড়েছি- সেগুলোকেও আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের তুলনায় কিছুই মনে হয়নি- কেননা আমাদেরটি একই সাথে দেশকে ও দেশের প্রতি আবেগকে তুলে ধরে। আর, যদি এই গানটির কথায়-সুরে তা এমন মাটিছোয়া-হৃদয়গ্রাহী না-ও হতো, তারপরেও এই গানটিকেই জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে রাখতে হবে এ কারণে যে, এর সাথে একটি ইতিহাস আছে, তাকে ছাপিয়ে আছে একটি চেতনা- যে চেতনাটি হলো অসাম্প্রদায়িক-সেক্যুলার বাংলার চেতনা।সকলকে ধন্যবাদ
মন্তব্য
পড়ে ভাল লাগল। পয়েন্ট করে করে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেছে। আশাকরি এভাবেই লেখা চালিয়ে যবেন।
জাতীয় সঙ্গীতের ব্যাপারে মনে করি, অবশ্যই "আমার সোনার বাংলা" 'র বিকল্প নেই; যেমন বিকল্প নেই রবীন্দ্রনাথের।
-----------------------
মুহাম্মদ
দুর্দান্ত!
চমৎকার একটি কাজ হয়েছে।
আবারো.........সাধুবাদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে রবীন্দ্রনাথ আদৌ বিরোধিতা করেছেন, এমন উদাহরণ ঠিক কোথায় আছে শুনতে বা পড়তে আমি আগ্রহী। কিছুদিন আগে সচলেই একটি পোস্টে একটি দৈনিক প্রকাশিত এ জেড এম আবদুল আলীর লেখা নিয়ে আলোচনায় পড়ছিলাম, কিভাবে রবীন্দ্রনাথের এই বিরোধিতার গল্প ফাঁদা হয়েছিলো। এ ব্যাপারে রবীন্দ্রবাবুর নিজের লেখা, কিংবা সংবাদপত্রে প্রকাশিত ভাষ্য, কিংবা চিঠি, যে কোন কিছুর রেফারেন্স দেয়া জরুরি। যে কাজ তিনি হয়তো আদৌ করেননি, সে কাজের পক্ষে যুক্তি দেখানো বা সাফাই গাওয়ার প্রয়োজন হয় না।
হাঁটুপানির জলদস্যু
* আরো অনেক গানই জাতীয় সঙ্গীত হতে পারতো। দ্বিজেনের ধন-ধান্য, রবি ঠাকুরেরই আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে, এমনি আরো অনেক গান। প্রতিটা গানেরই কোন না কোন অংশ বুকের ভেতর মোচড় দেয়। ভাইয়ের-মায়ের স্নেহ, কিংবা মুক্ত কেশের পুঞ্জ মেঘে আশ্রয় খুঁজতে পারার কথা অনেক বেশি ভাল লাগায়।
* পৃথিবীর অনেক দেশের জাতীয় সঙ্গীতেই বিভিন্ন রকম 'মেসেজ' থাকে। আমার সোনার বাংলায় এসবের কোন বালাই নেই। ফাল্গুন ভাল লাগে, অগ্রহায়নের ভরা ক্ষেত ভাল লাগে, কিন্তু এগুলোর কোনটাই দেশকে ভালবাসার কারণ বা উপলক্ষ নয়। দেশকে শুধুই ভালবাসি। এমনি এমনিই। খুব সহজ, সাধারণ, স্বাভাবিক ভাবে গানটা শুধু দেশকে ভালবাসার কথা বলে। 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি'র পর যেন উহ্য আছে, 'চুলায় যাক আর সব, জানতেও চাই না কিছু, স্রেফ ভালবাসি'। এখানেই জাতীয় সঙ্গীত আলাদা আর সব গান থেকে।
* রবীন্দ্রনাথ আমাদের সমাজ ও সাহিত্যের এত বড় অংশ বলেই তাঁর একটি গান জাতীয় সঙ্গীত হওয়া তাৎপর্যপূর্ণ। হাসিব ভাইয়ের একুশের তালিকায় একটা অনেক বড় কথা লেখা আছে, পৃথিবীতে আমরাই হয়তো একমাত্র জাতি যার ভাষায় একজন ব্যক্তির নামে একটি বিশেষ ঘরানার গান আছে।
ইশতিয়াক ভাই, আপনার ব্যাখ্যাটা ভাল লাগল। কখনো কখনো আমারো মনে হতো এই গানে দেশকে নিয়ে লক্ষ্যমূলক কিছু নাই কিন্তু আছে অতি সাধারণ কিছু কথা। সাধারণ ভালবাসার কথা। অতি সাধারণ কথাগুলোই অসাধারণ ভাব ধারণ করে আছে। অসাধারণ!
জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে বিতর্ক - এই প্রসঙ্গটাকেই আমার কাছে অপ্রাসঙ্গিক লাগে। কিছু ধান্দাবাজ লোকজন এই কথা তুলে কিছু বাজার গরম করার চেষ্টা করেছে বটে। কেউ এই নিয়ে সামান্য নড়েচড়েও বসেছে বলে মনে হয় না, যারা আওয়াজ তুলেছে সেই লোকগুলি ছাড়া। কিন্তু তা বিতর্কের পর্যায়ে গেছে বলে আমার কখনোই মনে হয়নি।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
নাস্তিকের ধর্মকথা
===================================
হিমু ও জুবায়ের,
আমিও একটি লেখায় পড়েছিলাম- রবীন্দ্রনাথ এধরণের কোন সভায় সভাপতিত্বতো দূরের কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করে কোন বক্তব্য পর্যন্ত কোথাও কখনও দেননি। এবং ঐ লেখাটিতে যথেস্টই তথ্যসূত্র উল্লেখ করে দেখানো হয়েছে- জামাতিরা যে সভার কথা দাবি করে- সেই সভার তারিখটিতে রবীন্দ্রনাথের দিনপঞ্জিতে মিলিয়ে দেখলে সে ধরণের কাজের খোজ মিলে না।
তারপরেও এ ধরণের লেখাটির উদ্দেশ্য- এই ধরণের বিতর্ক সৃষ্টির মূলে প্রবেশ করা, আজ ৩৬ বছর পরে জামাতিরা খুব জোরে শোরে এই যে বিতর্কটি সামনে নিয়ে আসার চেস্টা করছে- এর ইতিহাসটি আসলে কি- সেটা সামনে তুলে ধরা। এবং আমি এ কাজটি এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি, তারা যেভাবে বিতর্ক তৈরি করছে- বারবার এই কথাগুলো বলার মধ্যে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার চেস্টা করছে- সেটার যুক্তিযুক্ত জবাব দেয়ার উদাহরণও খুব বেশি দেখি নি। এখন এসব জামাতি প্রচারণাকে রাজাকার, বাজে কথা এসব বলে উড়িয়ে দিলে বা এটা বিতর্কের কোন বিষয় নয় বললে আমার মনে হয়- একটা বড় ধরণের ভুল হবে। কেননা- নতুন প্রজন্মদের শুধু আবেগ দিয়ে টানা সম্ভব হবে না- তাদের জন্য প্রয়োজন যুক্তির বাঁধন।
আর, এধরণের একটি জামাতি বিতর্কে যেরকম ভাবে উত্তর দেয়া হয়েছে- মূলত সেটি দেখেই এই পোস্ট লেখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছি, কেননা- সেখানে প্রধানত গালিগালাজ করা হয়েছে, যুক্তি করা হয়েছে- জনগনমন ভাগ্য বিধাতা গানটি আসলে রবীন্দ্রনাথ স্বেচ্ছায় না অনিচ্ছায় বা ভাগ্যবিধাতা মানে বৃটিশরাজ না ভগবান এনিয়ে যুক্তি হয়েছে, এবং যুক্তি করতে গিয়ে নজরুলকেও টেনে এনে ব্যঙ্গ করে বলা হচ্ছে- নজরুলের অমুক গানকে এখন জাতীয় সঙ্গীত বানাতে হবে!!!! ফল, আমার স্কুল পড়ুয়া ভাস্তির সেটি পড়ে প্রশ্নঃ আসলেই জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে সে গানটি থাকা দরকার কি-না???
আরেকটি কথা বলতে হয়, সেটি হলো, আসলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় যথেস্ট বিরোধিতা করা হয়েছে, এবং এই বিরোধিতা কারী অংশে পুরোভাগে ছিলো রবীন্দ্রনাথের সাথেকার বঙ্গভঙ্গরদের আন্দোলনের মহারথীরা। সুরেন্দ্রনাথ, স্যার আশুতোস মু. এনাদের বিরোধিতার কথার ডকুমেন্ট সহজেই পাওয়া যায়- বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের শাস্তি হিসাবে পশি্চিমবঙ্গকে দেয়া হয় কলকাতাকে ভারতের রাজধানী থেকে সরিয়ে দয়া, আর পূর্ববঙ্গকে পুরস্কৃত করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা। ফলে- পাশাপাশি এসব ঘটনাকে সামনে নিয়ে এসে, রবীন্দ্রনাথকে বিতর্কিত করে প্রচারণা তারা চালায়, এবং এটি খুব সহজেই অনেককেই বিভ্রান্ত করে ফেলে। সমস্ত কিছুর কারণেই এই পোস্ট লেখার গরজ বোধ করা।
১. আপনার লেখাকে আমি ছোটো করে দেখছি না। আপনি নিজে যেভাবে দেখেছেন বা ভেবেছেন তা-ই বলেছেন যুক্তিসহ। আমি শুধু যা বলতে চেয়েছিলাম তা হলো, একটি মীমাংসিত বিষয় নিয়ে কতিপয় মতলববাজ কিছু অযথা হৈ চৈ করবে আর তা নিয়ে আমরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বো - এটিকে আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। এমনও তো হতে পারে, এইসব আজগুবি তর্ক-বিতর্কে আমাদের ব্যতিব্যস্ত রেখে তারা অন্য কোনো অপকর্মের ব্যবস্থা করছে।
২. বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার হতে যদি বাধা না থাকে, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আপত্তি করে থাকলে (যদিও বাস্তব তা নয় বলে জানা যাচ্ছে) রবীন্দ্রনাথের লেখা গান আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হতে পারবে না কেন? বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আপত্তি জানানোটা কি গণহত্যায় অংশীদার হওয়ার চেয়ে বড়ো অপরাধ?
৩. রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিতর্ক তৈরি করা নতুন কিছু নয়, তা আশা করি মানবেন। পাকিস্তান আমলে বিস্তর হয়েছে, আজও হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও জীবনচর্যার সঙ্গে, বাঙালির আত্মায় রবীন্দ্রনাথ যেভাবে মিশে আছেন, তাঁকে বিন্দুমাত্র টলানো কখনো সম্ভব হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে করি না।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
পৃথিবীর বেশীরভাগ দেশের জাতীয় সংগীতের মুল বিষয়বস্তু হচ্ছে দেশকে বড় করে দেখানো- আমার দেশ সবচাইতে সেরা, এটাই হচ্ছে সবার কথা।
আমাদের জাতীয় সংগীতের মুল বিষয়বস্তু হচ্ছে দেশের প্রতি ভালোবাসা। দেশের আকাশ, বাতাসের প্রতি মুগ্ধতা। জাতীয় সংগীতের বিষয়বস্তু হিসাবে এর চাইতে ভাল আর কি হতে পারে।
বিতর্কের বিষয়ে বলতে গেলে এককথায় বলতে হয় - কেবলমাত্র জারজদেরই পিতৃপরিচয় নিয়ে বির্তক থাকে।
কি মাঝি? ডরাইলা?
-------------------------------
সবুজ পাহাড়ের রাজা
নতুন মন্তব্য করুন