নাস্তিকের ধর্মকথা
=====================================
পূর্বপাঠ্যঃ বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর.............. প্রশ্ন পর্ব-২ ( http://www.sachalayatan.com/guest_writer/12654)
......যারা তর্কে বহুদূর যেতে চান,
তাদের উদ্দেশ্যে কিছু প্রশ্ন।
গত সংখ্যদুটিতে কিছুদূর এগিয়েছিলাম, এবার পালা আরেকটু এগিয়ে যাবার। দেখা যাক কতখানি এগুনো যায়...........
প্রশ্ন পর্ব ৩: আবারো প্রশ্ন হিসাবে না দিয়ে প্রসঙ্গটি কথোপকথন আকারে উপস্থাপন করছি.........
:আচ্ছা, এই চশমাটি তো, একজনকে ন্যায়-অন্যায়ের বোধ দিচ্ছে, তাই নয় কি? জন্মের পর থেকে পাওয়া এসব বোধের কারণেই মানুষ- সত্য মিথ্যা সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছে। চশমা পরিহার করলে সেটা মানুষের জন্য আরো বিপদ বয়ে আনবে না কি? আর, সত্য-মিথ্যা তাহলে কোনটি? ঠিক-বেঠিক বলে কি তাহলে কিছুই নেই? সমস্ত কিছুই মানুষের পরিবেশ থেকে পাওয়া কিছু ধারণা মাত্র?
:আমি কিন্তু বলিনি সত্য-মিথ্যা নেই, ন্যায়-অন্যায় নেই, ঠিক-বেঠিক নেই। আমি যা বলেছি তা হলো, এ সমস্ত কিছুই চলমান ও গতিশীল, তা স্থির নয়। এসমস্ত কিছুর সাথে টাইম-স্পেসের সম্পর্ক জড়িত। সত্য-মিথ্যাকে একটি নির্দিষ্ট স্থান/কালের ভিত্তিতেই বিচার করতে হয়। নির্বিশেষ বা চরম সত্য বা মিথ্যা বলে কোন কথা থাকতে পারেনা।
:আপনি এ মুহুর্তে যে ধারণাটির কথা বললেন- সেটাও কি পরিবেশ থেকে পাওয়া না? সেটাকে কি বলবো- নির্বিশেষ না চরম? আর সত্য নির্ধারণের মাপকাঠি তাহলে কি হবে? ন্যায়-অন্যায় নির্ধারণেরই মাপকাঠি কি হবে?
:হুম, এটাকেও চরম সত্য বলবো না এই কারণে যে, টাইম-স্পেসের প্রয়োজনীয়তা বলি আর ধারণার কথা বলি- তা আমাদের মানুষের ক্ষেত্রে বিশেষ। আর এই বিশেষকে বিবেচনা করেই, বলছি- সত্য-মিথ্যা নির্ধারণে বর্তমানে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনই কার্যকর। যাছাই-বাছাই, যুক্তি-তর্ক, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, বিজ্ঞান এসবই একটি সময়ের- একটি নির্দিষ্ট পেরিফেরিতে সত্য নির্ধারণের মাপকাঠি হতে পারে। ন্যায়-অন্যায় বোধ যেহেতু মানুষকে কেন্দ্র করে, সমগ্র মানব জাতিকে বিবেচ্য ধরেই এর মাপকাঠি হতে পারে।
:আপনার কথা মত মাপকাঠিকে সত্য ধরে- এই বিজ্ঞানকে ধরেই, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে বিবেচনায় নিয়েই বলি- আমাদের ধর্মটি সত্য। সমগ্র মানব জাতিকে বিবেচ্য ধরেই বলছি, আমাদের ধর্মই দিতে পারে প্রকৃত ন্যায়ের সন্ধান। আজকের আধুনিক বিজ্ঞান, বিগ-ব্যাঙ্গ থিওরি বলেন আর জীবের সৃষ্টি বলেন আর গ্রহ-নক্ষত্রের গতি- তাদের সম্প্রসারণশীলতা বলেন সব কিছুই কিন্তু হাজার বছর আগের আমাদের ধর্মগ্রন্থে পাবেন। আরেকটি কথা,- মানুষ বলেন আর বিজ্ঞান বলেন, কেউ কিন্তু কোন কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। যা পারে, অলরেডি যা একজিস্ট করে তা আবিস্কার করতে।
:এটা আপনার ব্যক্তিগত ধারণা, যে ধারণাটি তৈরি হতে আপনার সেই ধর্মীয় বিশ্বাস বোধ তথা রঙ্গীন চশমাটি ভূমিকা নিয়েছে, এবং যার সাথে প্রকৃত সত্যের কোন সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রমান চাই, চাই অন্ততপক্ষে কিছু যুক্তি; তা না হলে আপনার কথা হয়ে যায় আপনার ধারণাপ্রসূত কিছু সিদ্ধান্ত। ন্যায়ের কথা যদি বলেন, তবে স্বীকার করি, সেই সময়ে এর মানব কল্যাণে একটা ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল। কিন্তু, তা কি উষালগ্নে প্রায় সকল ধর্মের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়? ইবনের পূর্বেকার রীতি নরবলী প্রথা রদ করে পশুবলী প্রথা চালুতে মানব জাতি যতখানি উপকৃত হয়েছে তার জন্যই তো মানুষ তাঁকে স্মরণ রেখেছে। মানুষ যুগে যুগে সেসব ব্যক্তিকেই স্মরণ রাখে যারা বীর নতুবা যাদের দ্বারা একটা সময় মানবকূল সবিশেষ উপকৃত হয়েছে। কিন্তু, আজকের মত লিখন যন্ত্র তথা মুদ্রণ যন্ত্র আবিস্কারের পূর্বে মানুষ সেসব ব্যক্তিকে স্মরণ রাখতো মুখে মুখে বংশ পরম্পরায়, ফলে সেসব ক্যারেক্টার মিথিকাল ফর্ম পেয়ে যেত। আমাদের এ অঞ্চলের রামের কথাই ধরুন, সে-তো আসলে একটা কাপুরুষ, রাবনের তুলনায় যুদ্ধবিদ্যায়ও নিতান্ত ছেলে মানুষ- তাকে জিততে হয়, ভগবানের সহায়তায় হনুমানকে সাথে নিয়ে- তারপরও পারে না শেষ পর্যন্ত তাকে কন্সপিরেসি করতে হয় বিভিষণকে হাত করতে হয়। সীতার প্রতি তার আচরণও কাপুরুষতায় ভরা। তথাপি, এহেন একজনকে ব্যক্তিকে বংশ-পরম্পরায় স্মরণে রাখলো কেন মানুষ, তাকে এমন দেবতার মত শ্রদ্ধার উচ্চ আসনে কেন বসালো? সেটাও কিন্তু মানুষের প্রতি অবদানের জন্য, সেটি হচ্ছে কৃষিতে বিশেষ অবদান। কৃষির প্রতি এই অবদান মূর্ত হয়ে ওঠে রামায়নের ছত্রেছত্রে মিথিকাল রূপকের ভিতর দিয়ে। সীতার লাঙ্গলের ফলায় করে আবির্ভাব আবার শেষ পর্যন্ত ধরিত্রি মাতাতেই বিসর্জন, এমনই অনেক রূপকের ভিতরে পাওয়া যায় কৃষি, কৃষি জমির বন্দনা।
:এটাও কি আপনার মনগত ধারণা নয়? বা ধারণা-প্রসূত সিদ্ধান্ত নয়? আপনার এ বক্তব্যের কোন প্রমান আছে?
:না যেহেতু ঘটনাকাল সুদূর প্রাচীণ সেহেতু কোন প্রত্যক্ষ প্রমান দেয়া সম্ভব নয়। তবে, ইতিহাসবিদরা, নৃত্বাত্তিকরা এভাবেই অতীতের বা প্রাচীণ যুগের ঘটনাসমূহ বিশ্লেষণ করেন; মসেস এর নীল নদকে শাসন সংক্রান্ত মিথকে সেচ ব্যবস্থায় তাঁর বিশেষ ভূমিকা হিসাবেই তাঁরা দেখান, এভাবেই বিভিন্ন গুহা চিত্র দেখে তাঁরা প্রাচীণ আমলের লোকদের জীবনপ্রণালী সম্পর্কে ধারণা দেন। সবই সম্ভাবনা হিসাবে আমাদের সামনে উপস্থিত হয় ঠিকই, কিন্তু এসব সম্ভাবনার সত্যের কাছাকাছি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
:বই থেকে পাওয়া এসব জ্ঞানকে সত্য মনে করেন? সব বইতেই কি সত্য লেখা থাকে?
:হ্যা এসব কে এখন পর্যন্ত সত্য বলে মানি, কেননা এর বিপরীত কোন বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি পাইনি এখনও।
:আর বিজ্ঞান নিয়ে কি বলবেন? বিগ ব্যাঙ থিওরি কতদিন আগের আবিস্কার, কিন্তু সেই কোন আমলে আমদের ধর্মগ্রন্থে সে আলোচনা করে গেছেন আমাদের ঈশ্বর! আজকের বিজ্ঞান বলে জীব সৃষ্টির শুরুর দিকে সাগরের বুকে অ্যামিবা নামক প্রাণীর উদ্ভব, এই বিজ্ঞানও কিন্তু বেশি আগের না। অথচ, সে কোন আমলে হাজার বছর আগে আমাদের ধর্মগ্রন্থে এটিও পাবেন।
:আপনি যে মিলের কথা বলছেন, তাতে একটা বড় গলদ থেকে যাচ্ছে। আপনি বিগ ব্যাঙ থিওরি পড়েন ও আপনি আপনার ধর্মগ্রন্থের এক/দু লাইনের ঐ সংক্রান্ত আলোচনা পড়েন, পাশাপাশি পড়েন- পার্থক্য বুঝতে পারবেন। এক জায়গায় ডিটেইলসে পাবেন যুক্তি-প্রমাণ নির্ভর ও গাণিতিক ব্যাখ্যা সহকারে আলোচনা, আর অন্যদিকে পাবেন খুবই সাদাসিধে এক-দুটি বাক্য- যার সাথে কোনভাবেই বিজ্ঞানের আলোচনার কোন মিল পাওয়া যাবে না। 'আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী মিশে ছিল ওতপ্রোতভাবে?' 'ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিবস এবং সূর্য ও চন্দ্র; প্রত্যেকেই বিচরণ করে আপন আপন কক্ষপথে' এই লাইনসমূহকে বিগ ব্যাঙ থিওরির সমার্থক মনে কি হয়? আকাশমন্ডলী বলতে আজকের বিজ্ঞানে আমরা কি বুঝি? 'প্রাণবান সমস্ত কিছু সৃষ্টি করলাম পানি থেকে'- আপনাদের ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত এই লাইনটির মাধ্যমেও আপনারা আপনি দাবি করছেন, বর্তমান বিজ্ঞানের জীবসৃষ্টি সংক্রান্ত আলোচনা আপনাদের ধর্মগ্রন্থেই কত আগেই করা হয়েছে! অথচ, বিবর্তন সংক্রান্ত বিজ্ঞানের বাকি আলোচনা কি আপনাদের ধর্মগ্রন্থ সমর্থন করে? সৃষ্টির প্রথম পর্যায়ে অ্যামিবা সমুদ্রে তথা পানিতে অবস্থান ছিল, কিন্তু অ্যামিবার গঠন উপাদান কি শুধুই পানি? অ্যামিবার আরো আগের পর্যায়ের যে জীব অণু, যে নিউক্লিয়িক এসিড- তার গঠন উপাদান কি? এভাবে বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের কোন কথাকে মিলিয়ে দেয়াও এক ধরণের অন্ধতা।
এ প্রসঙ্গে, আরেকটি কথা বলতে চাই, নিউটনের ১ম গতিসূত্র আবিস্কারের ২ সহস্রাধিক বছর আগে(খৃষ্টের জন্মেরও ৩০০/ ৩৫০ বছর পূর্বে) এরিস্টোটল বলেছেন, বায়ুশূণ্য অবস্থায় বস্তু একই অবস্থানে থাকবে নতুবা সমগতিতে চিরকাল চলতে থাকবে। এরিস্টোটল তার সিদ্ধান্তের পেছনে কোন প্রমাণ তো হাজির করতে পারেনই নি, বরং পরক্ষণেই তার সেই আবিস্কারকে অস্বীকার করেছেন এই ধারণা থেকে যে, বায়ুশূণ্য স্থান থাকতে পারে না, ফলে ইহা অসম্ভব। কোপারনিকাসেরও সহস্র বছর পূর্বে আর্যভট্ট (৪৭৬ খৃস্টাব্দ) বলেছেন, পৃথিবী গোলাকার, এটি নিজ অক্ষের চারদিকে ঘুরে এবং সাথে সাথে এটি সূর্যকেও প্রদক্ষিণ করে। ভাস্করাচার্য (২), নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র প্রদানেরও ৫ শতাধিক বছর পূর্বে বলেছেন, পৃথবীতে বস্তুসমূহ পতিত হয় পৃথিবীর টানেই, এবং পৃথিবী, গ্রহসমূহ, জ্যোতিস্কসমূহ, চাঁদ ও সূর্য নিজ নিজ কক্ষে এই আকর্ষণের কারণেই অবস্থান করে। এমন আরো উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। এটা এ কারণে প্রয়োজন যে, মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশটি বুঝা খুবই দরকার। ওনারা (এরিস্টোটল, আর্যভট্ট, ভাস্করাচার্য) জ্ঞান সৃষ্টিতে নিরলস সাধনা করেছেন, পৃথিবীর মানুষকে করেছেন ঋদ্ধ। আর সমসাময়িক ধর্মগুলো কিন্তু তাদের সময়কার প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানকে অগ্রাহ্য করতে পারেনি, ফলে তাদের ধর্মগ্রন্থেও স্থান পেয়েছে সেসব জ্ঞান। তেমনি উদাহরণ আপনার ধর্মগ্রন্থের বিজ্ঞান সম্পর্কিত আলোচনাসমূহ।
(চলতেও পারে)
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন