নিরপেক্ষ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ২৬/০২/২০০৮ - ৪:০৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(ক্যামেলিয়া আলম)

আদর্শের শিক্ষা দিয়ে কার না জীবনের শুরু হয়? প্রথম পাঠেই আমাদের আদর্শ হবার যতরকম উপকরণ আছে তা মুখস্থ করানো হয়। যেমন - সদা সত্য কথা বলিবে - গুরুজনে শ্রদ্ধা করিবে - জীবপ্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বরে ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। তেমন আমার জীবনও শুরু হয়েছিল ভিন্ন এক আদর্শ নিয়ে। তা হলো নিরপেক্ষতার আদর্শ। এ শিক্ষা দিয়েছিল আমার বাবা। মা ছিল না আমার। বাবার ধমনী ছিল বাউলের ধমনীর মতো। যদিও শুনলে হয়তো বা মনে হবে আমি বাউলের সন্তান। আসলে আমি ছিলাম এক বিশাল সম্পত্তির অধিকারী একজন বেকার বাবার সন্তান। যার আয় ব্যয়ের উৎস আর হিসাব নিকাষ নিয়ে চিন্তা করতে হয় না সে যে স্বভাবধর্মে বাউলেই পরিণত হবে তা আর বলাইবাহুল্য।

শহরের একেবারে শেষ মাথায় ছিল আমাদের বাড়ি। তার পাশ দিয়ে ছোট একটা ব্রিজ যার ওপারে পুরোটাই একটা গ্রাম। আর এইপাশে বিশাল অট্টালিকার প্রক্রিয়া। আমার যখন জন্ম হয় তখন থেকে এই এলাকায় প্রথম গ্যাস আসা শুরু হয়েছে। বাবার বাবা ছিলেন একজন সাধারন কেরানী। উনি কিভাবে এত বিঘা জমির মালিক হলেন তা আমার বাবাও স্বয়ং জানেন না। যদিও এসব ব্যাপারে বাবার আগ্রহও তেমন নেই। সারাজীবন বাবা তার মায়ের ছত্রছায়ায় বড় হয়ে আচমকা একই সঙ্গে মা ও বউ দুইই হারান। মা হারা সন্তান হয়ে টিকে থাকি শুধু আমি। জীর্ন এক টুকরো ন্যাকড়ার মতোন বিছানার ধারে শোয়া। বাবা দিশেহারা। আত্মীয় স্বজনেরা বেকার বিপতœীক জেনেও এ বাড়ির লোভে নিজ নিজ মেয়ে নিয়ে বেশ ক‘বার যাতায়াতও করেছিল বলে শুনেছি। কিন্তু বাবা এতটাই বিরূপ ছিলো যে প্রত্যেকে বাবাকে মনে মনে অভিশপ্ত করতে করতে ফিরে গেছে। সেও বাবার কথা। বাবার বিরূপের কারণ জানি ক’বছর আগে। বাবার বিয়ের আগের দিন রাতে বাবা কিনা এক স্বপ্ন দেখেছিল যে এ বাড়ি নারীবর্জিত বাড়ি। এখানে কোন নারী দশ বছরের অধিক কাল টিকতে পারবে না। সেই যুগেও বাবা স্বপ্নকে খুব একটা অনুসরণ না করে বিয়ে করেছিল এবং ঠিকই দুইবছরের মধ্যে নারী বিবর্জিত হতে হয়েছে পুরো বাড়িকে। বাবার বিয়ের মাত্র বছর তিনেক আগে এখানে এসে প্রথম সুখের চেহারা দেখেছিল আমার দাদী। সারাজীবন প্রায় বস্তিতে কাঁটিয়ে পুরনো দিনের মতো গোলাভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ পেয়েছিল। যা নাকি তার বছর দশেকে ওপার বাংলায় ফেলে এসেছিল। যদিও এসব কথা বাবার কাছ থেকে শোনা কারণ ঐ যে বললাম - আমার জন্মের আগের মাসে আমার দাদী আর আমার প্রথম জন্মদিনের পরবর্তী সপ্তম মাসে আমার মা মারা যায়।

ছেলেবেলা থেকেই জেনে এসেছি আমার মা বিষ খেয়ে মারা গেছে। আর এ যে একটা এ্যাবনরমাল ডেথ সেও বুঝেছি আমার বয়স কুড়ির পর। কেউ যখন মারা যায় তার দীর্ঘ দিন পর তার সম্পর্কে এক ধরণের উদাসীনতায় যেমন বলে অমুকে দুইদিনের জ্বরে মরেছে - অমুকে নিউমোনিয়ায় মরেছে - অমুকে ক্যান্সারে মরেছে। তেমন আমাকেও ছোটবেলা থেকে বাড়ীর কেউ লুকোচুরি করার চেষ্টাও না করে বলে এসেছে মা বিষ খেয়ে মরেছে। এমনকি আমার স্কুলের বন্ধুরাও ব্যাপারটা জেনেছে আর তারাও কখনও এ অস্বাভাবিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেনি। মাঝে মাঝেই আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। কেন একটা অস্বাভাবিক বিষয়কে সবাই স্বাভাবিক করে নিতে পেরেছিলাম?

আমার একুশ বছর বয়সে যখন প্রথম প্রেমে পড়তে শুরু করেছি। সেই সময়ে একটা ছায়াছবি দেখে সারারাত খুব কাঁদলাম। নায়ক মরে যাওয়ায় নায়িকা বিষ খেয়ে মরেছে। শেষ রাতে হঠাৎ ধরাস করে একটা কথা মনে হল। আমার মা বিষ খেয়ে মরেছে। বিস্ময়ে আমি অভিভূত হয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। এক সময়ে মনে হল আমি কি সারাজীবন ভুল শব্দ শুনেছি - কথাটি কি কোন বিষ বেদনায় হবে? নাহ তাতো জানি না - জানি বিষ খেয়ে - নাকি ছোটবেলায় কার কথা কি শুনতে কি শুনেছি। এ ভুল কি আমার? নাকি আমি যা জানি তা- ই সঠিক। ভোরে উঠে বাবার বিছানায় গিয়ে বসে রইলাম। এক পলকে বাবার মুখের দিকে তাঁকিয়ে থাকলাম। বাবার চোখ কেঁপে উঠতেই আচমকা বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম - আমার মা কিভাবে মরেছে? বিষ খেয়ে?

চোখ খুলে বাবা অবাক। সামলে উঠে জানতে চাইল - কি? আমি আবার প্রশ্নটি করলাম। বাবা নিরুত্তাপ গলায় বলল - হ্যাঁ। আমি অবাক।
- কেন?
- তোর মা খুব অভিমানী ছিল তাই ভুল করে ফেলেছে - নিরুত্তাপ গলায় বাবা বলল।
- ভুল মানে? মা তো মরেই গেছে - বিষ খাওয়ার সময় তুমি কিছু বলোনি?
- বলব সেই সময়টা কোথায় - একেবারেই ছেলেমানুষ ছিল - একটা পাগল - একটু যেন আন্মনে কথাগুলো বলল বাবা। এর পরে উঠে বসতে শুরু করতেই আমি আবারও থামালাম।
- বিষ খাওয়ার সময় তুমি কোথায় ছিলে?
- কাছেই ছিলাম -
- তুমি থামাতে পারলেনা ?
- আচমকা মুখে ঢেলে দিল -
- তুমি ডাক্তার দেখাও নি?
- নিতে নিতে - বলে থামলো বাবা। নিরুত্তাপ চেহারা।
- নিতে নিতে মানেটা কি? তুমি বিষ ধরতে দিলে কেন?
এবার বাবা খানিকটা সময় নিয়ে আমার দিকে তাঁকিয়ে থাকলো। তারপর নিরুত্তেজিত কন্ঠে বলল - ও প্রায়ই এরকম পাগলামো করে আমাকে ভয় দেখাত - সেদিনও তা ই হয়েছিল। তোর মাও মরতে বিষটা খায়নি - খাওয়ার পর ও নিজেই হতভম্ব হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল - আমাকে বাঁচাও - আমার মেয়েটা ছোট - আমাকে বাঁচাও -
বাবা আমাকে অবাক করে সেই সাতসকালে হঠাৎ ই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। তীব্র একটা নতুন কষ্ট - একেবারেই নতুন - অজানা - অচেনা কষ্ট আমার মনের গহবরে এসে জমাট বাঁধলো। এই কষ্টকে আর উপড়াতে পারলাম না সারাজীবন। কিন্তু নিরপেক্ষতার আদর্শে গড়া এই আদল আমায় ভাবতে বাধ্য করলো - এখানে বাবার কোন দোষ নেই। আবার মায়েরও কোন দোষ নেই। সবই প্রকৃতিগত একটা বিষয়।

আমি ছেলেবেলা থেকেই স্বভাবে ছিলাম খুব চুপচাপ। তবে কোন ধরণের দুঃখবোধ থেকে নয়। সবার মতোন আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে হাসতে বা খেলতে বা দৌড়াতে পারতাম না। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, সবাই ভাবতো মায়ের শোকে আমার এ হাল। অথচ মায়ের অভাব অনুভব করার কোন অনুভূতিই আমার কখনো হয়নি। আত্মীয় স্বজনেরা এসে আমাকে বুকে ধরে কাঁদতো - মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। আর আমি মুখখানা আরও গোমড়া করে চুপচাপ বসে থাকতাম। আর ভাবতাম সদ্য দেখা কোন সিনেমার কথা। কিন্তু এই দুঃখবোধ না হবার কারণ বাবার ভালবাসা নয় - কারণ হল নয়ন। নয়ন হচ্ছে আমার একেবারেই ছেলেবেলার বন্ধু। স্বভাবে আমার ঠিক উল্টো। মুখরা - চঞ্চল - উদ্যমী। ওর বাসায় ওকে সবাই ঘোড়া বলে ডাকে। সেই নয়নের চোখে ওর মা ছিল পৃথিবীর সর্বনিকৃষ্ট ব্যক্তি। এবং ওর মতে, ওর এই মা বেঁচে না থাকলে ও সবজায়গাতেই বিস্ময়কর রকম সফল বালিকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতো। যে বালিকারা একই সাথে লেখাপড়া সহ গান - নাচ - কবিতা - নাটক - সিনেমা - পেইন্টিং ইত্যাদি ইত্যাদি স্থানে সুপ্রতিষ্ঠিত। যাই হোক, সেই নয়নের কথা শুনে শুনে আমার নিজের মা না থাকার জন্য বরং ভাগ্যবান মনে হত। আর আরেকটা কথাও আমি সবার বেলায় খেয়াল করেছিলাম যে, আমার প্রত্যেকটা মেয়ে বন্ধুর স্বাধীনতার প্রধান অন্তরায় ছিল ওদের মা। কারণ ওদের ত’লনায় চলনে বলনে আমি ছিলাম অনেক বেশি স্বাধীন। তবে মজার ব্যাপার হল, এই স্বাধীনতা আমাকে অনেক বেশি রিজার্ভ করে দিয়েছিল। প্রত্যেকটা চলার পথ আমি খুব মেপে এগুতাম। অন্যদিকে নয়ন যাকে শাসন করবার জন্য ওর মা শেকল দিয়ে পর্যন্ত একরাত বেঁধে রেখেছিল। সে ধুমধাম করে প্রেমে পড়তো আর ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতো। আস্তে আস্তে ওর সবচেয়ে বড় গুণাবলী অর্থাৎ একটা স্বাভাবিক সুস্থ মন পাল্টাতে শুরু করলো। বিষয়টা আমার চোখেই পড়েছিল প্রথম। সদ্য কৈশোর পেরুনো নয়ন দেখলাম কথায় - চলনে - বলনে এক ধরণের পূর্ণবয়স্ক নারী হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির উপর ছেড়ে দেয়া জীবনে তীব্র হোঁচট খেল একবার। বিকেল বেলা নয়ন এল আমার কাছে। চোখ মুখ ফোলা। ভাবলাম ওর মা মেরেছে। জানতে চাইতেই আমাকে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়ে বলল সে প্রেগনেন্ট। আমি জানতাম সে ঘন ঘন প্রেমিক পাল্টায় তাই বুঝতে পারছিলাম না কোন জন যাকে নয়ন বিশ্বাস করে বিছানায় যেতে পারলো। সে বিভিন্ন রকমের হেলায় ফেলায় এড়িয়ে গেল নামটা। করণীয় ওর এ্যাবরশন। কোথায় কি আমি কিছুই জানি না - কাউকেই চিনি না। তবুও আমার এক চাচাত বোন ডাক্তার - ওর ঠিকানা নিয়ে ওর কাছে গিয়ে উঠলাম। বললাম, নয়নের স্বামী বিদেশ চলে গেছে পড়ার জন্য - আর নয়নও পড়ছে তাই এখনই বাচ্চা নিতে চায়না। স্পষ্টই বুঝলাম সে বিশ্বাস করলো না। তবুও কিছু না বলে তার এক গাইনি বন্ধুকে ধরে কাজটা করিয়ে দিল। আমি ক্লান্ত - বিরক্ত। আর অস্বাভাবিক রকম হতাশ নয়নকে নিয়ে একদিন পর বাড়ি ফিরলাম। জীবনে এই একটি বার আমি মিথ্যে বললাম যে আমি নয়নের বাড়ি থাকবো আর নয়ন বললো সে আমার বাড়ি। একদিন একরাত হাসপাতালে থেকে আমরা বাসায় ফেরার আগ মুহুর্তে আমার ডাক্তার বোন এসে আমাকে চুপ করে নিয়ে গিয়ে বলল, এই মেয়ের সাথে মিশিশ না। আমি মাথা নীচু করে চলে এলাম। নয়ন রাস্তার পুরোটা সময় তীক্ষè দৃষ্টিতে আমাকে দেখলো।
আমার তখন ফাইনাল শেষ। নয়নকে এড়িয়ে চলি যতটা সম্ভব। আপনারা হয়তো ভাবছেন এড়িয়ে চলার কারণ আমার সেই ডাক্তার বোনের কথা। আসলে তা নয়। নয়ন কেমন যেন এক ধরণের খ্যাঁপাটে আচরণ আমার সাথে শুরু করলো। আমি যতই শান্ত - ঠান্ডা থাকতে চাই। নয়ন তা হতে দেয় না। তীব্র আর ঝাঁঝালো কথায় সে আমাকে ক্ষত বিক্ষত করা শুরু করে। আবার আমার সাথে অন্য কোন ছেলে বা মেয়েকেও সে সহ্য করতে পারেনা। মাঝে মাঝে বিষ খাবার ভয়ও দেখায় আমাকে। ক্লান্তিতে আর বিরক্তিতে মন আমার বিক্ষিপ্ত হতে থাকে। কিন্তু তবুও আমি ধৈর্য্য নিয়ে সামাল দেই নিজেকে। কারণ হল আমার সেই নিরপেক্ষতার শিক্ষা। তাই ওর এই আচরণকেও আমি নিরপেক্ষ ভাবে দেখার চেষ্টা করি। আমি বুঝি যে, ওর সমস্ত কার্যকলাপই ওকে নিজের বিবেকের কাছে দংশন করে চলেছে। সেই অস্থিরতা থেকে মুক্তি পেতে ও আরও পাগলামো করে। সব কিছু বুঝে ওকে আমি যতটা সম্ভব মানসিক জোড় বাড়াবার চেষ্টা করেছি। এও বুঝিয়েছি যে, মানুষের প্রত্যেকেরই কোন না কোন কাজে জড়ানো উচিৎ। তাহলেই সে নিজেকে নিয়ে ভাববার বা হতাশার সময় কম পায়। সে এক কথাতেই সব উড়িয়ে দিয়ে পৃথিবীর সবার দোষারোপ নিয়ে মত্ত থাকে আর আরও হতাশায় ডুবতে থাকে। এর পর থেকে আমি নয়নের কাছ থেকে সযতেœ নিজেকে গুটিয়ে চলি। তা বুঝে নয়ন আরও ক্ষ্যাপাটে হতে থাকে।

এর মাঝে আমি প্রেমে পড়ি। আবীর হয়ে ওঠে আমার পরম বন্ধু। নয়নকে সে একেবারেই মেনে নিতে পারেনা। নয়নও তাই। যাই হোক, এই আবীরই আমায় নয়নের যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দেয়। বাবাকে আবীরের সাথে পরিচয় করাই। আবীর হয়ে ওঠে আমাদের পরিবারের একজন বন্ধু। আমাদের আর আলাদা জায়গা দরকার হয় না প্রেম করার। যখন তখন আবীর চলে আসে আমাদের বাড়িতে আর আমরা মেয়ে বাবা মিলে মেতে উঠি আড্ডায়। ফাইনাল শেষ হলে আমরা দ্রুত বিয়ের সিদ্ধান্ত নেই। নয়ন ততদিনে আমাদের বাসায় আসা কমিয়েছে। শুনেছি ওর আরেকটা বন্ধু গ্র“প হয়েছে যাদের সাথে মধ্যরাত অবধি ওর মাখামাখি। নয়নের মা ই একদিন খুব দুঃখ নিয়ে কথাগুলো আমাকে ফোনে জানাল। ঘন্টাখানেক বিলাপের পর ফোন রাখল মহিলা। কিন্তু ঠিক সেই সময়টা আমার এতই ভাল কাটছিল যে কারও দুঃখ তখন আমায় আর আলোড়িত করছিল না। আমার বিয়ের দিনক্ষনও ঠিক হয়ে গেল। বিয়ের কার্ড দিতে আমি গেলাম নয়নের বাড়ি। নয়নকে দেখে আমি তীব্র নাড়া খেলাম। হাড্ডিসার নয়ন - জোর করে পাউডারে সাদা করা মুখে টকটকে লিপস্টিক। নয়ন বাইরে বেরুচ্ছে। আমাকে দেখে নয়নও চমকে তাঁকিয়ে থাকলো। একসময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে এসে বলল, তুই সুন্দর হয়ে গেছিস। বিয়ের কার্ড দেখে অনেকক্ষন আমাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টায় মাতিয়ে রাখলো। দীর্ঘ দীর্ঘ দীর্ঘ সময় পরে আগের নয়নকে দেখলাম পয়তাল্লিশ মিনিট ধরে। অন্যদের কার্ড দেবার তাড়ায় দ্রুত উঠতে হল। নয়ন ওর মা প্রত্যেকে কথা দিল বিয়ের সব কিছুতে ওরা থাকবে। নয়নকে চাইছিলাম আমার বিয়ের সাতদিন আগে থেকে। কিন্তু ওর সময়ের অভাব। কথা দিল হলুদ আর বিয়েতে অন্তত থাকবেই থাকবে। আমি আনন্দ নিয়ে ফিরে এলাম।

বিয়ে হল আমার। চলে এলাম আবীরের বাড়িতে। বাড়ি বলতে আবীর আর আমি। কল্পনার চাইতেও সুখে কাটতে লাগলো আমার সময়। এর মাঝে একটা এন জিও তে প্রোগ্রাম অফিসার হিসেবে যোগ দিলাম। আর আবীর একটা বাইং হাউজে। দুজনের অঢেল পয়সা। ঠিক করলাম দেশের বাইরে যাব ঘুরতে একেবারে সার্কের দেশগুলো। যাবার দু’দিন আগে হঠাৎ নয়ন এসে হাজির। আমি অসম্ভব খুশি হলাম। নয়ন ঘুরে ঘুরে আমার বাড়ি দেখলো - আমাকে দেখলো - আমার সুখ দেখলো। তারপর চলে গেল। তার দুদিন পর প্রায় বিশ দিনের জন্য আমরা দেশ ছাড়লাম। ফিরে আসার ক’দিন পরেই টের পেলাম আমার আর আবীরের মাঝে আরেকজনের আগমনী। দুজনে অসম্ভব রকম সতর্কতায় কাঁটাবার চেষ্টা করলাম পুরো প্রেগনেন্সি পিরিয়ড। আমি যতটা পারলাম বই পত্র কিনলাম এ বিষয়ক আর আবীর ইন্টারনেট ঘেঁটে যত রকমের ছবি - রিপোর্ট ডাউনলোড করল। আমরা দুজনেই পুরো তৈরি হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম নবাগত শিশুটির। একটা গোলাপী ফুটফুটে মেয়ে হল আমার। এর মাঝে নয়ন হঠাৎ আমার বাড়িতে খুব ঘনঘন আসতে লাগলো। যতটা সম্ভব আমাকে সহযোগিতা করতে থাকলো। আমি আর আবীর গভীরভাবে কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম। যেই আমি আর আবীর ছিলাম এতদিন একসাথে ঘুরে বেড়াবার সাথী এখন আমাদের সাথে যোগ হল আমার মেয়ে পিউ আর নয়ন। যেখানেই যাই আমরা একসাথে যাই। একসাথে ঘুমাই। একবার ঢাকার বাইরেও চলে গেলাম আমরা চারজন একই সাথে।

ফিরে আসার দিন দশেক পর নয়ন খুব অন্যমনস্ক। বারেবারেই বিরক্ত হচ্ছে সব কিছুর উপর। কিছুটা ভয় পেতে শুরু করলাম নয়নকে। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম ওকে এড়িয়ে চলতে। কিন্তু নয়ন বারেবারেই আসে। আর কেমন একটা তীব্র আর তীক্ষè শব্দের আঘাতে আমাকে জর্জরিত করে। এমনিতেই বাচ্চা পালতে গিয়ে আমি ক্লান্ত বিরক্ত। তারপর আবার এ উপরি যন্ত্রনা। কিন্তু ঐ যে নিরপেক্ষতার আদর্শে গড়া আমার মন। আমার মন আমায় বোঝাল যে আমার এখন সব কিছুই আছে - একটা চাকরী - একজন বন্ধু বৎসল স্বামী - ফুটফুটে মেয়ে - একটা সাজানো বাড়ি। আর নয়নের যে এর কিছুই নেই। ও হতাশ হতেই পারে। কিন্তু দিন দিন নয়ন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। এক বিকেলে আমার দেড় বছরের মেয়েকে প্রচন্ড জোরে ধমক দিল। আমি আর আমার মেয়ে দুজনেই হতভম্ব। আমার মেয়ে পিউ রাতেও ঘুমের মাঝে ফোঁপাল। আমি থমথমে মুখে নয়নকে বিদায় জানালাম সেই রাতে।
এর প্রায় দিন বিশেক পর নয়ন এসে আমার সামনে দাঁড়াল। বলল যে আমার সাথে কিছু কথা আছে। আমি তখনও ভুলিনি আমার মেয়ের কান্নার কথা। আমি তেমনি গম্ভীর গলায় জানতে চাইলাম আর সেই সাথে তাকে আমার ব্যস্ততার সময়ও উল্লেখ করে বুঝিয়ে দিলাম যে খুব বেশি কথা বলার সময় আমার হাতে নেই। যাতে ওর ঐ আগের প্যানপ্যানানি আমার দীর্ঘক্ষণ শুনতে না হয়। ও কিছু সময় নিঃশব্দে থেকে জানাল যে সে প্রেগনেন্ট। তীব্র একটা জ্বালা ধরে গেল আমার ভেতরে। আমি যা কখনোই করিনা আর যে ভাষাতে আমি কখনোই কথা বলিনা ঠিক সেই ভাবে আমি বললাম যে, আমি প্রসটিটিউশনের লর্ড না যে এ সমস্যা বারবার আমারই মোকাবেলা করতে হবে। ও নিজে যেখান থেকে পারে করুক গে এ্যাবরশন। নয়ন অস্বাভাবিক শান্ত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল যে আবীরের বাচ্চা ওর পেটে। পুরো পৃথিবী আমার কেঁপে উঠলো। আরও জানলাম আমার আর আবীরের মাঝের এই গ্যাপে আবীর খুবই বিরক্ত। ও কোন কাজই প্রোপারলি করতে পারছেনা। তাই -
আমি নিঃশব্দে নয়নকে নিয়ে বের হলাম। আমার সেই বোনের ক্লিনিকে গিয়ে উঠলাম। কিছুই বললাম না আগের মতো। শুধু বললাম এ্যাবরশন করাতে। আর রাতে হসপিটালে থাকবার কথা জানতে চাইতে জানলাম এখন আর রাতে থাকবার প্রয়োজন নেই। আমি নিঃশব্দে লেবার রুমের বাইরে বসে থেকে নয়নের চিৎকার শুনলাম। ঘন্টাখানেক পর নয়ন চোখ মেলল। আমি কমলার খোসা আলতো হাতে ছড়িয়ে ওর মুখে দিলাম। আর পাশের রেস্টুরেন্ট থেকে কেনা স্যুপ চামচ দিয়ে মুখে তুলে দিয়ে জানতে চাইলাম এখন বাসায় যেতে পারবে কিনা? ওর সায় পেয়ে ধীরে ধীরে ওকে নিয়ে বের হয়ে একটা ক্যাবে উঠে ওর বাড়ি পর্যন্ত গেলাম। ক্যাবে ও ক্লান্ত ভাবে শোয়া। ওর বাড়ির গেইট পর্যন্ত আসতেই - আমি ওর হাত চেপে ধরে বললাম - আমার বাসায় আর আসিস না তুই কোনদিন। নয়ন কিছুই বলল না। ওর বাড়ির গেটে থামতেই গাড়ির গেট খুলে আমার দিকে তাঁকিয়ে বলল - এর আগের বার আমার পেটে কার বাচ্চা এসেছিল তুই জানতে চেয়েছিলি না? তখনও আমি একটা ঘোরের মাঝে কথা শুনছি। আমার নড়ার শক্তিও তখন নেই। ও আবার প্রশ্নটা করলো। আমি কোনমতে মাথা নাড়লাম। নয়ন বলল - তোর বাবার।

নয়ন নেমে চলে গেল। আমি অস্পষ্টচোখে নয়নের চলে যাওয়া দেখলাম। ফেরার পথে ভাবতে লাগলাম বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে ঠিক কোন কাজটা আমি আগে করবো - আবীরকে সমস্ত শক্তি দিয়ে কষে থাপ্পর মারবো? ড্রইংরুমের সমস্ত শোপিস গুলো টুকরো টুকরো করে আবীরের দিকে ছুড়ে মারবো? হাউমাউ করে কাঁদবো? আমার দীর্ঘ বেনিটিতে কেঁচির এক পোঁচ লাগাবো? না কতগুলো ঘুমের অষুধ খেয়ে মেয়েকে বুকে নিয়ে শুয়ে পরবো?

বাড়ির মেইন দরজা থেকে এই প্রথম আমার ফ্ল্যাটের দরজায় পৌঁছতে টানা বিশ মিনিট লাগলো। ঘরে ঢুকেই আবীর আর মেয়ের খুঁনসুটি দেখলাম। কি সরল দুটি মুখ। আবীর সুন্দর করে হাসলো। আমি গিয়ে সোফাটায় বসলাম। জোড়ে শ্বাস নিলাম। তারপর -

আমি আবীরকে দোষ দিতে পারলাম না। আসলেই তো ওর সাথে আমার ফিজিক্যালি একটা গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছে পিউকে কেন্দ্র করে। আবীরতো প্রকৃতির বাইরে নয়। আমি দোষ দিতে পারলাম না আমার বাবারও। বিপতœীক একজন ব্যক্তির পক্ষে এ ঘটনা স্বাভাবিক। আমি দোষ দিতে পারলাম না নয়নেরও। বেচারা পরাধীন থেকে থেকে স্বাধীনতার ছক কতটুকু ওর জন্য প্রয়োজনীয় হবে তা ই জানে না।

নিরপেক্ষ আমি তাই সব মেনে নিলাম। সব। আমি জানি এর সবই ন্যাচারাল - পুরোপুরি ন্যাচারাল। শুধু মনেই নিতে পারলাম না কিছু। এই আলোকজ্জ্বল প্রকৃতির মাঝে অন্ধকার একটা মন নিয়ে আমি একটা একটা দিন পার করি।


মন্তব্য

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

অদ্ভুত !
কেমন মন বিষন্ন করে দেয়া গল্প।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

মাহবুব লীলেন এর ছবি

মেয়েটা একটা বেক্কল
দুই দুইবার একই দুর্ঘটনা একইভাবে ঘটে কেমনে
একটু কেয়ার নিলেই হতো

অনিন্দিতা এর ছবি

নিরপেক্ষ হওয়ার এই এক জ্বালা। যে যত দোষ ,অন্যায় করুক না কেন তার পক্ষে ঠিকই যুক্তি বের করে ফেলা যায়। তখন কেন জানি তাকে আর দোষারোপ করা যায় না। নিরপেক্ষ জন সব কিছুর দায়ভার নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়।
বোধহয় নিরপেক্ষ আর বোকা সমার্থক।
লেখা ভাল লাগল।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।