মূল রচনাঃ পিটার ডি ওয়ার্ডের "ইমপ্যাক্ট ফ্রম দ্য ডিপ"
অনুবাদঃ মুহাম্মদ
---------------------------------
গভীর সংঘর্ষের সন্ধানে প্রবন্ধটি গত সংখ্যায় অর্থাৎ চার কিস্তিতেই শেষ হয়েছে। এই কিস্তিতে আমি পুরো প্রবন্ধের সারকথা অনুবাদ করেছি। সাইন্টিফিক অ্যামেরিকান কেউ পড়লে দেখবেন, সেখানে প্রতিটি প্রবন্ধের বিভিন্ন অংশে ছোট ছোট সচিত্র ক্লিপ থাকে। এই ক্লিপগুলো থেকেই সারমর্মটি প্রস্তুত করেছি। আমার উদ্দেশ্য, সবাই যেনো পরিবেশ রক্ষার তাৎপর্যটি বুঝতে চেষ্টা করেন। সবচেয়ে বেশী পরিবেশ দূষণকারী দেশ আমেরিকাও বুঝতে শুরু করেছে এই অবস্থা। ২০০৭ সালে অস্কার বিজয়ী প্রামাণ্য চিত্র "অ্যান ইনকনভেনিয়েন্ট ট্রুথ" দেখলে তা কিছুটা বোঝা যায়। আল গোরের রাজনৈতিক দর্শন সম্বন্ধে পরিষ্ককার ধারণা না থাকলেও তার পরিবেশবাদী আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছি এই অনুবাদ প্রবন্ধটির মাধ্যমে।
গণ বিলুপ্তির কথকতা
* গত ৫০০ মিলিয়ন বছরে গণ বিলুপ্তির কারণে বেশ কয়েকবার পৃথিবীর জীবকূল ধ্বংস হয়ে গেছে।
* এ ধরণের একটি গণ বিলুপ্তি উদাহরণ হল ডাইনোসরদের ধ্বংস। এই বিলুপ্তির কারণ হিসেবে গ্রহাণুর আঘাতকে দায়ী করা হলেও অন্য বিলুপ্তি ঘটানাগুলোর কারণ পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় নি।
* নতুন জীবাশ্ব ও ভূরাসায়নিক প্রমাণ থেকে বোঝা যাচ্ছে আগের বিলুপ্তিগুলো ঘটেছিল ভয়ংকর পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে। ভৌগলিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রতল থেকে উৎক্ষিপ্ত বিষাক্ত গ্যাসের কারণে এই বিলুপ্তিগুলো শুরু হয়েছিল। অক্সিজেনস্বল্পতাই ছিল এর প্রধান কারণ।
ধ্বংসের নমুনা
সুপ্রাচীন তিনটি বিলুপ্তি ঘটনার মধ্যে দুটিই দীর্ঘ সময় জুড়ে ঘটেছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। সে যুগের ভূতাত্ত্বিক মৃত্তিকা স্তর থেকে প্রাপ্ত কার্বন-১৩ 'র মাধ্যমে এই প্রমাণ করা হয়েছে। কোন যুগে জল ও স্থলভাগে উদ্ভিদ বেশি থাকলে বায়ুতে কার্বন-১৩ 'র পরিমাণও বেশি থাকে। বিপুল পরিমাণে উদ্ভিদকূল ধ্বংস হতে থাকলে বায়ুমণ্ডলীয় কার্বনের সমানুপাতে কার্বন-১৩ 'র পরিমাণ কমে যেতে থাকে। একটি সাধারণ কার্বন আদর্শের সাথে প্রাচীন নমুনায় প্রাপ্ত কার্বন-১৩ 'র পরিমাণের তুলনা করে দেখা গেছে; পার্মিয়ান ও ট্রায়াসিক যুগের শেষ ভাগে কার্বন-১৩ অনেক কমে গিয়েছিল। এসব যুগের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কার্বন-১৩'র পরিমাণ কখনও বেড়েছে কখনও কমেছে। কিন্তু ক্রিটাশিয়াস-টার্শিয়ারি সীমানায় দেখা যায়, এই পরিমাণ হঠাৎ করে অনেক কমে গেছে। তাই ধারণা করা হয়, এই বিলুপ্তিটি গ্রহাণুর আঘাতে হলেও অন্যগুলোর কারণ তা নয়।
ধীর বিষক্রিয়া
সম্প্রতি পার্মিয়ান যুগের শেষ দিককার বায়ুমণ্ডল ও পরিবেশের কম্পিউটার সিম্যুলেশন থেকে জানা গেছে, সে সময় সমুদ্রপৃষ্ঠের পানিতে বিষাক্ত হাইড্রোজেন সালফাইডের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল এবং ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছিলো অক্সিজেনের পরিমাণ। পেনসিলভ্যানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির কাৎসা এ মাইয়ার এবং লি আর কাম্প ২৫১ মিলিয়ন বছর পূর্বেকার প্যানজিয়া অতিমহাদেশের সাইবেরিয়া ট্র্যাপ্স অঞ্চল নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন। তাদের গবেষণা থেকে জানা যায়, ২৫১ মিলিয়ন বছর পূর্বের সময় থেকে সে অঞ্চলে অত্যধিক অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছিল যার কারণে ভৌগলিক উষ্ণায়ন প্রকট রূপ ধারণ করে। এর কারণে মহাসাগরগুলো জীবকূলের জন্য প্রতিকূল হয়ে পড়ে এবং পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র ভেঙে পড়ে।
ঘাতক গ্রিনহাউজ ক্রিয়া
একসময় ধারণা করা হতো বহির্জাগতিক বস্তুর আঘাতেই কেবল গণ বিলুপ্তি ঘটতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা দেখা গেছে ২৫১ মিলিয়ন বছর আগে পার্মিয়ান যুগের শেষ দিককার বিলুপ্তি ও ৫০ মিলিয়ন বছর আগে ট্রায়াসিক যুগের শেষ দিককার বিলুপ্তির কারণ এটি ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, ভৌগলিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্র ও ভূভাগের জীবকূল মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছিল। গ্রিনহাউজ ক্রিয়ার ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা হয়েছিল বিপুল পরিমাণ অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে। অগ্ন্যুৎপাতের থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণই ছিল এর কারণ। এরপর যা ঘটেছে তাকে ক্রমান্বয়ে এভাবে লেখা যায়:
০১. অগ্ন্যুৎপাতের কারণে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড ও মিথেন নিঃসরিত হয়।
০২. নিঃসরিত গ্যাসের কারণে ভৌগলিক উষ্ণায়ন ব্যাপক আকার ধারণ করে।
০৩. সমুদ্র উত্তপ্ত হয়ে পড়ায় আগের তুলনায় অনেক কম অক্সিজেন শোষণ করে।
০৪. অক্সিজেন স্বল্পতা সৃষ্টি হওয়ায় সমুদ্রজলের কেমোক্লাইন স্তর অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। সমুদ্রের একেবারে নিম্নস্তরে বসবাসকারী ব্যাক্টেরিয়া যখন বেশী পরিমাণে হাইড্রোজেন সালফাইড প্রস্তুত শুরু করে তখন নিচের হাইড্রোজেন সালফাইড সমৃদ্ধ জলস্তর উপরের দিকে উঠে আসে। ফলে অক্সিজেন স্তরের সাথে কেমোক্লাইন নামক যে স্তরের মাধ্যমে তা পৃথক ছিল সেটি ভেঙে যায়।
০৫. এভাবে চলতে থাকায় একসময় কেমোক্লাইন স্তর সমুদ্রতলে উঠে আসে। আর সেই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস উঠে গিয়ে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে।
০৬. জলভাগের সবুজ ও ধূসর সালোকসংশ্লেষী সালফার ব্যাক্টেরিয়া আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং অক্সিজেনের উপর নির্ভরশীল প্রাণীকূল ধ্বংসের সম্মুখীন হয়।
০৭. পরিবেশে ছড়িয়ে পড়া হাউড্রোজেন সালফাইড গ্যাস ভূভাগের জীবকূলকে ধ্বংস করে দেয়।
০৮. হাইড্রোজেন সালফাইড বায়ুমণ্ডলের ট্রপোমণ্ডলে উঠে গিয়ে ওজোন স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
০৯. ওজোন স্তর না থাকায় সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি পৃথিবী পৃষ্ঠে চলে আসে। ফলে অবশিষ্ট জীবকূলও ধ্বংস হয়ে যায়।
আরেকটি গণ বিলুপ্তি কি সন্নিকটে?
প্রাচীন যুগের গণ বিলুপ্তি ঘটনাগুলোর সময় বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশী ছিল যার কারণে ভৌগলিক উষ্ণায়ন ত্বরান্বিত হয়। বর্তমানে আমাদের বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ প্রতি মিলিয়নে ৩৮৫ ভাগ এবং প্রতি বছর এই পরিমাণ প্রতি মিলিয়নে ২ থেকে ৩ ভাগ করে বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী শতাব্দীর শেষে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ গিয়ে দাড়াবে প্রতি মিলিয়নে ৯০০ ভাগ। ৫৪ মিলিয়ন বছর পূর্বে প্যালিওসিন তাপীয় বিলুপ্তি ঘটনার সময় বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ এর থেকে খুব বেশী ছিল না।
সুতরাং, আরেকটি গণ বিলুপ্তির কথা চিন্তা করে আমাদের কি সতর্ক হওয়া উচিত না?
লেখকঃ পিটার ডি ওয়ার্ড
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের জীববিজ্ঞান বিভাগ এবং পৃথিবী ও মহাকাশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। তিনি এই দুই ক্ষেত্রেই গবেষণা করেন। পার্থিব পরিপ্রেক্ষিতে তিনি প্রাচীন গণ বিলুপ্তি নিয়ে গবেষণা করেন। এর পাশাপাশি জলভাগের নটিলাসের মত প্রাণীগুলো কিভাবে বিবর্তিত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল তা নিয়ে গবেষণা করেন। অ্যামোনাইট নামক এই প্রাণীগুলোর বিবর্তনের বিষয়টি তিনি ১৯৮৩ সালের সাইন্টিফিক অ্যামেরিকানের অক্টোবর সংখ্যায় লিখেছিলেন। এছাড়া নাসার অ্যাস্ট্রোবায়োলজি ইনস্টিটিউটের জন্য তিনি প্রাচীন পৃথিবীতে কিভাবে জীবনের উৎপত্তি ও বিবর্তন ঘটেছিল তা নিয়ে গবেষণা করেন। এর মাধ্যমে নাসা বহির্জাগতিক প্রাণের সম্ভাবনা সংক্রান্ত গবেষণা চালায়। প্রাচীন পরিবেশের এই বিষয়টি নিয়ে তিনি সাইঅ্যামের অক্টোবর ২০০১ সংখ্যায় লিখেছিলেন। প্রবন্ধটির নাম ছিল, "রিফ্যুজিস ফর লাইফ ইন আ হস্টাইল ইউনিভার্স"। এটি তিনি গুইলার্মো গঞ্জালেস ও ডোনাল্ড ব্রাউনলি'র সাথে যৌথভাবে লিখেছিলেন। ব্রাউনলি'র সাথে মিলে তিনি "রেয়ার আর্থ: হোয়াই কমপ্লেক্স লাইফ ইজ সো আনকোমোন ইন দ্য ইউনিভার্স" নামে একটি জনপ্রিয় বিজ্ঞান গ্রন্থ লিখেছেন।
---------------------------------
পূববর্তী কিস্তিসমূহঃ
* গভীর সংঘর্ষের সন্ধানে
* http://www.sachalayatan.com/guest_writer/12703
* গভীর সংঘর্ষের সন্ধানে - ৩
* গভীর সংঘর্ষের সন্ধানে - ৪
---------------------------------
সূত্রঃ সাইন্টিফিক অ্যামেরিকান, অক্টোবর ২০০৬
মন্তব্য
পুরো সিরিজটাই দারুণ লাগল।
পড়তে ভালো লেগেছে
সেইসঙ্গে এই গর্দভ মস্তিষ্কে কিছুটা জ্ঞানের ঠাঁই হল।
চালিয়ে যান...
---------------------------------
চোখের পাতায় হাত রেখে ওরা আমাকে স্বপ্ন দেখার যন্ত্রণা দেয়।
মন্তব্য পেয়ে ধন্য হলাম। আমার গর্দভ মস্তিষ্কেও যথেষ্ট চাপ পড়েছে এতো সব জানার অপচেষ্টা করতে গিয়ে। এই জন্যেই তো অনুবাদের মত সহজ জিনিসটা বেছে নিলাম।
-----------------------------------
মুহাম্মদ
মুহাম্মদ ছেলে ভালো।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
মুহাম্মদ ভালো পোলা?????????
---------------------------------
চোখের পাতায় হাত রেখে ওরা আমাকে স্বপ্ন দেখার যন্ত্রণা দেয়।
কি ব্যাপার মহিব, এত্তোগুলা প্রশ্নবোধক দিছস ক্যান? ছেলে তো আমি আসলেই ভালো। অতি সত্বর প্রশ্নকোধকগুলা উঠায়া নে।
-----------------------------------
মুহাম্মদ
একটা খুবই ভাল লেখা পড়লাম। ভাগ্যিস আপনার লেখা গুলো একে একে পড়তে শুরু করেছিলাম ..
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
সুন্দর লেখা। গনবিলুপ্তি বিষয়ক কিছু চোথা আছে আমার কাছে। Cycles Through The Earth's History কোর্সে পড়তে হয়েছে। মুহাম্মদের উপকারে লাগতে পারে .......
কি মাঝি? ডরাইলা?
লাগতে পারে আবার কি? অবশ্যই উপকারে লাগবে। ভার্সিটির পড়া পড়তে ভাল্লাগেনা। অফ টপিকেই মজা বেশী। কিন্তু, আপনের চোথাগুলা আমার কাছে আসবে ক্যাম্নে? একটা ব্যবস্থা দ্যাখেন।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
নতুন মন্তব্য করুন