ভালোবাসার বাংলাদেশ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ০৪/০৩/২০০৮ - ৬:০২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বর-কনেএকবার এক বিদেশী বন্ধুর বাড়ীতে গিয়েছিলাম পানাহারের নিমন্ত্রণ বক্ষা করতে। পৌঁছে দেখি উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে আমি ছাড়া আর সবাই সাদা চামড়ার। ঘরে ঢোকা মাত্র সোফায় বসে থাকা এক যুবক আমাকে চমকে দিয়ে বলে, 'আসসালামালাইকুম।' আমি থতমত খেয়ে সালামের জবাব দিলাম ঠিকই, তবে মনে মনে ভাবলাম, এ বোধহয় সেইসব বেকুবদের একজন যে আমার গায়ের রঙ এর যে কাউকে দেখলেই সালাম ঠুকে দেয়। আমার গৃহকর্তা বন্ধু এ সময় এগিয়ে এসে আমাকে নিয়ে যায় পাশের ঘরে যেখানে নানা রকম খাবার ও পানীয় সাজিয়ে রাখা হয়েছে টেবিলে। হাতে একটি প্লেট ধরিয়ে দিয়ে সাজিয়ে রাখা খাবারগুলোর সাথে সংক্ষিপ্ত পরিচয় করিয়ে দিয়ে সে বলে 'এবার নিজে নিয়ে খাও', তারপর কেটে পড়ে অন্যদিকে অন্যান্য অথিতিদের সময় দিতে। সালাম দেয়া যুবককে ভালো ক'রে লক্ষ্য করার সুযোগ হয় না।

কিছুক্ষণ পরে আমি যখন পছন্দের পানীয় আর কিছু খাবার নিয়ে একটু কোনার দিকে সরে এসে নিরিবিলিতে নিজের পানাহারে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করছি তখন এক প্রিয়দর্শিনী এগিয়ে এসে সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, 'তুমি কি বাংলাদেশী।'

কনেভীষণ আশ্চর্য হই দু'টি কারণে। প্রথমতঃ, চেহারায় বাঙাল ভাব প্রবল হওয়া সত্বেও আমেরিকানরা আমার জন্মস্থান অনুমান করার চেষ্টা করলে সাধারণত ভারত বা ভারতবর্ষ বলে থাকে। এ দেখি সরাসরি আমাকে বাংলাদেশী অনুমান করছে। দ্বিতীয়তঃ, যারা বাংলাদেশ চিনে বা বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুটা জানে, তারা বাংলাদেশকে তাদের আমেরিকান উচ্চারণে বলে 'ব্যাংলাডেশ' আর বাংলাদেশীদেরকে মনে করে 'ব্যাংলাডেশান'। কিন্তু এ যে পরিষ্কার উচ্চারণে বলছে বাংলাদেশী। তখনও বুঝতে পারিনি আমার অবাক হবার পালা সবে মাত্র শুরু হয়েছে।

বর ও তার বন্ধুরাআমি যখন বিশ্ময়ের ঘোর কাটানোর চেষ্টা করছি তখন সেই সালাম দেয়া যুবক এগিয়ে এসে যোগ দেয় এবং তাদের পরিচয় জানায়। যুবকের নাম ফিলিপ, আর যুবতীর এরিকা। স্বামী-স্ত্রী। আলাপ থেকে জানলাম এই দম্পতি একসময় বাংলাদেশে বাস করেছে কিছুদিন। দু'জন ভিন্ন দু'টি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক্সচেঞ্জ স্টুডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশের একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলো দুই সেমেস্টারের জন্য। সেখানে হয় পরিচয়, ভালো লাগা, প্রেম, তারও পরে স্বদেশে ফিরে আসা এবং এক পর্যায়ে বিয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

কনে ও তার বান্ধবীরাআলাপ করে আরও জানলাম বাংলাদেশের প্রতি তাদের তীব্র ভালোবাসার কথা। তাদের বিয়েতে - যা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো মিনেসোটায় - নিজেরাতো বটেই, বর ও কনের বন্ধুরাও বাংলাদেশের প্রথাগত পোষাক পরেছিলো। কনে পরেছিলো শাড়ী, বর পরেছিলো শেরওয়ানী, কনের বান্ধবীরা পরেছিলো সেলওয়ার-কামিজ আর বরের বন্ধুরা পরেছিলো পাজামা-পাঞ্জাবী। কিন্ত বাংলাদেশ থেকে ফিরে আসার সময় যেহেতু জানা ছিলো না যে একদিন তারা বিয়ের বাঁধনে জড়াবে বা বাংলাদেশী পোষাক পরে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেবে, সেহেতু সেখান থেকে এসব পোষাক নিয়ে আসার কথা মনে হয়নি তখন। এর সবই কেনা হয়েছিলো নিউ ইয়র্কের কোনো এক বাঙালি দোকান থেকে।

শুভ বিবাহফিলিপের মতে মেয়েদের সবচেয়ে সুন্দর পোষাক শাড়ী আর বাসন্তী বঙ এর শাড়ী তার সবচেয়ে প্রিয়। এরিকা বাংলাদেশেও কয়েকবার শাড়ী পরেছিলো শখের বসে। কিন্তু সেখানে তার নিজে পরতে হয়নি কখনো। পরিচিত বা সম্পূর্ণ অপরিচিত বাঙালি মহিলারা সবসময় নিজ থেকে এগিয়ে এসে শাড়ী পরতে সাহায্য করেছে। কিন্তু বিয়ের সময় মিনেসোটায় যেহেতু কোনো বাঙালীর সাথে পরিচয় ছিলো না, শাড়ী পরতে হয়েছিলো তার সম্পুর্ণ নিজের চেষ্টায়। পরে বিয়ের ছবি দেখে বিশ্মিত হয়েছিলাম। কে বলবে আনাড়ীর হাতে পরা শাড়ী! ছবিতে সাদা শাড়ী দেখে অবাক হয়েছিলাম। এরিকা জানায় যে, বাংলাদেশের ট্র্যাডিশনের সাথে তার নিজস্ব আমেরিকান ট্র্যাডিশনের সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টাতেই সাদা রঙ এর শাড়ী পরা।

এই দম্পতি বিয়ের পরে একবার নিউ ইয়র্ক গিয়েছিলো শুধু ঈদ করতে। মিনেসোটায় যেহেতু বাংলাদেশীদের এমন কোনো কমিউনিটি নেই, তাই ভেবেছিলো নিউ ইয়র্কে বাঙালি দোকানপাট আছে যে এলাকায় সেখানে ঘুরে ফিরে ঈদ করবে, কেনাকাটা করবে, খাওয়া দাওয়া করবে, বাংলাদেশীদের সাথে আড্ডা দেবে। কিন্তু, গিয়ে দেখে ঈদ উপলক্ষে সব দোকানপাট বন্ধ। বেচারা! তাদের ইচ্ছে ছেলেমেয়ে হওয়ার পরে তাদের নিয়ে একবার বাংলাদেশে যাবে ভালোবাসার দেশটি দেখাতে।

সুখী হোক ফিলিপ আর এরিকার দাম্পত্য জীবন, বেঁচে থাক বাংলাদেশের জন্য তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা।

--------------------------------------
শামীম হক


মন্তব্য

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

সুখী হোক ফিলিপ আর এরিকার দাম্পত্য জীবন, বেঁচে থাক বাংলাদেশের জন্য তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা।

আমীন!

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

স্নিগ্ধা এর ছবি

আমার চেনা এক বেলজিয়ান দম্পতি হানিমুনের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছিল এবং তাদের মতে এ পর্য্যন্ত সবচাইতে ভাল সময় কেটেছে তাদের - 'বাংলাদেশে' !

আমার মনে আছে শুনে আমি মনে মনে হাঁ করে ছিলাম...

কিন্তু এখন ভাবি - তাই তো, নাইই বা কেন?!

রাবাব এর ছবি

আমি এক এস্তোনিয়ার মেয়েকে চিনি মাত্র দু'মাসের জন্যে ঢাকা আসে। প্রথম দু সপ্তাহ আমার বাসায় কাটানোর পর পরবর্তীতে অন্য জায়গায় বাসা নেয়। ঠিক সেই ঈদেই সাদা কামিজ পরে দাওয়াত খেতে আসে আমার বাসায়। তখনই বুঝে গিয়েছিলাম বাংলাদেশে বসত গড়তে ওর বেশিদিন সময় লাগবে না। আড়াই বছর হতে চলল এখনও সে বাংলাদেশে চাকরি নিয়ে আছে। ছেলেবন্ধু নিয়ে, বাংলাদেশের এমবিএ ডিগ্রি নিয়ে বেশ ভালই দিন কাটাচ্ছে।

নন্দিনী এর ছবি

আহ ! শুনেও আনন্দ ...

নন্দিনী

বিপ্লব রহমান এর ছবি

সুখী হোক ফিলিপ আর এরিকার দাম্পত্য জীবন, বেঁচে থাক বাংলাদেশের জন্য তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা।

ভিন্ন ধর্মী লেখার জন্য শামীম হককে আন্তরিক ধন্যবাদ।

এ বিষয়ে একটি আলাদা পোস্ট দেওয়া যায়? কি আছে এই পোড়া দেশে, বিদেশীদের কাছ থেকে জানতে ইচ্ছে করে। @ রাবাব।


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

রাবাব এর ছবি

বিপ্লব রহমান লিখেছেন:

এ বিষয়ে একটি আলাদা পোস্ট দেওয়া যায়? কি আছে এই পোড়া দেশে, বিদেশীদের কাছ থেকে জানতে ইচ্ছে করে। @ রাবাব।

আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ

আইডিয়ার জন্যে ধন্যবাদ। মেয়েটার সঙ্গে এবার না হয় দেখা হলে টুকটাক শুনে নিয়ে লিখব।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমারও মনে হয় বিপ্লব রহমানের আইডিয়াটি নিয়ে দারুন একটি লেখা হতে পারে। কেনো এই পোড়ার দেশে বিদেশীদের কারো কারো সবচেয়ে ভালো সময় কাটে, কেনো কেউ কেউ স্থায়ীভাবে বাস করে আর কেনোই বা কেউ কেউ বার বার ফিরে আসতে চায়? বিদেশীদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের ভিন্ন একটি রূপ ফুটে উঠতে পারে এমন লেখা থেকে।

- শামীম হক

ফ্রুলিক্স এর ছবি

আমি আমার বসের ডারলিংয়ের জন্য একটা কঠিন কফি কালারের শাড়ি গিফট এনেছিলাম দেশ থেকে। ব্যাটা আমার বাসায় এসে মা'কে দিয়ে ওর বউকে শাড়ি পরিয়ে অনেকগুলো ছবি তুলেছে। নেক্টস সামারে ওরা বিয়ের চিন্তা করতেছে। তখন নাকি মা গিয়ে ওর বউকে শাড়ি পরিয়ে আসার রিকোয়েস্ট এখন থেকেই করে বসে আছে।

দ্রোহী এর ছবি

প্রার্থনা করি যেন ফিলিপ আর এরিকার দাম্পত্যজীবন ভরে থাকে সুখ আর সমৃদ্ধিতে।

অসাধারণ একটি পোষ্টের জন্য শামীম হককে ধন্যবাদ।


কি মাঝি? ডরাইলা?

জাহিদ হোসেন এর ছবি

চমত্কার পোস্ট।
সেদিন আমাদের এখানেও পরিচিত হলাম একটি ককেশিয়ান দম্পতির সাথে। দুজনেই ছাত্র। এরা রাজশাহীতে ছিল প্রায় দু'বছর। বাংলাদেশ নিয়ে তাদের গল্প যেন আর ফুরোয়না। এমনই তাদের উত্সাহ যে শেষপর্যন্ত তারা আমাদের এক অনুষ্ঠানে লুংগী শাড়ী পরে নেচেনেচে গান করলো,"তোমার গরুর গাড়ীতে আমি যাবো না"।
তারা এখন রীতিমত হটকেক সবার কাছে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এ বিষয়ে একটি আলাদা পোস্ট দেওয়া যায়? কি আছে এই পোড়া দেশে, বিদেশীদের কাছ থেকে জানতে ইচ্ছে করে।

একমত বিপ্লব রহমানের সাথে

পরিবর্তনশীল এর ছবি

আমি ঘুরে এলাম সারা জগত রে
তবু মনের গোল তো যায় না।

এ দেশটা এত্ত ভালো কেন।
অসাধারণ লাগল লেখাটি।
---------------------------------
চোখের পাতায় হাত রেখে ওরা আমাকে স্বপ্ন দেখার যন্ত্রণা দেয়।

সুদীপ  এর ছবি

জটিল। লেখাটা পড়ে এই খারাপ সময়েও মনটা কিছু ভালো হয়ে গেল।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।