আমি মৌচাক খুব ভয় পেতাম। মৌচাক দেখে আমার চেয়ে জোরে কেউ ছুটে পালাত না। আর ওর কাজই ছিল আমাকে ধরে নিয়ে মৌচাকের কাছে নিয়ে ছেড়ে দেয়া।
একদিন দেখলাম, সেই ছেলেটি খুব কাঁদছে। আমি ভেবে পাচ্ছি না কেন এত কান্না তার?
আমার আম্মু সেই সাথে কাঁদছে নানুকে জড়িয়ে ধরে। কেউ কিছু বলছে না আমাকে।
আমি খেলতে চলে গেলাম নতুন কেনা বেলুনটা হাতে।
***
সব পুরুষেরা একসাথে মিছিলের মত করে কোথায় যেন যাচ্ছে। কিন্তু কেউ কোন কথা বলছে না। সবাই নিশ্চুপ, শুধু গুনগুণ গুঞ্জন। আমি খুব ছোট বলে সামনে কিছু দেখতে পাচ্ছি না কি হচ্ছে। সবার সাথে হেঁটে চললাম। পশ্চিমের পালানের পাশে একটা গর্তের ধারে সবাই গিয়ে একটা খাট থেকে সাদা কাপড়ে মোড়া কি যেন নামাচ্ছে গর্তে। আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে কাপড়ের ভিতরে কি। আমাকে কেউ কাছে যেতে দিচ্ছে না। সেই ছেলেটিকে সেখানে দেখলাম। আমার খুব হিংসে হল। কি সৌভাগ্য ওর! দাড়িওয়ালা একটা মানুষ বারবার বলছে, "বিসমিল্লাহি আলা মিল্লাতি রাসুলিহী"....
***
কান্নার রোল শেষে বাসার সবাই কিছুটা চুপ। থমথমে পরিবেশ। আমার খুব খিদে পেয়েছে, কিন্তু কেউ রান্নাঘরে যাচ্ছে না। আমি আম্মুকে জিজ্ঞাসা করার সাহস পেলাম না। পাশের বাড়ির একজন বলল, চল আমাদের বাসায় খাবে আজ। আমি বললাম, কেন, তোমাদের বাসায় কেন খাব? সে বলল, জাননা, যে বাড়িতে কেউ মারা যায়, সে বাড়িতে রান্না হয় না। আমি অবাক হয়ে বললাম, কে মারা গিয়েছে? বলল, তোমার খালাম্মা। আমি বললাম, খালাম্মা কে? সে সেই ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল, ওর আম্মু। আমি অবাক হয়ে তাকালাম আবার ওর দিকে তাকালাম। তখন আর ওর জন্য হিংসে হচ্ছিল না। মায়াময় টলটলে চোখদুটোতে অশ্রু শুকিয়ে আছে। তাতে রাজ্যের অভিমান। মা কেন একা একা চলে গেল ওকে রেখে?
***
ঠিক দুই মাসের মাথায় আমার খালু আবার বিয়ে করে ফেললেন তিনটি মেয়ে এবং দুটি ছেলে রেখে। সৎ মায়ের সংসারে যা হয়, তাই হতে লাগল। আমার খালাত বোনদের জোর করে বিয়ে দেয়া হল খুব কম বয়সে। আর ছেলে দুটিকে লাগানো হল গরু গোছড় দেয়া আর খেত নিড়ানোর কাজে, সাথে গ্রামের মক্তবে নাম মাত্র পড়া। আম্মু জোর করে সেই ছেলেটিকে আমাদের বাসায় নিয়ে এলেন একেবারে বললেন যে, ম্যাট্রিক পরীক্ষা পর্যন্তু ও আমার কাছে থাক, গ্রামে থাকলে ওর পড়াশোনা হবে না, রাখাল হবে। সবচেয়ে ছোট মেয়েটিকে যার জন্মের সময় আমার খালা মারা গিয়েছিলেন। আমার নিঃসন্তান মামাতো বোন নিয়ে গেলেন।
***
সেই ছেলেটিকে আম্মু আমাদের বাসায় নিয়ে এলেন। সেই ছেলেটি আমার সাথে থাকতে খেলতে শুরু করল। আমার খুব রাগ উঠত যখন আমার খেলনায় ভাগ বসাত, এমনকি আমার আম্মুর হাতে ভাত খেত। আস্তে আস্তে সব ভুলে গেলাম। খেলার সাথী, পথপ্রদর্শক, বন্ধু সবকিছু হয়ে উঠল ও আমার। বিপদে আপদে ও সবার আগে এগিয়ে আসত আমার কাছে। ক্যাডেট কলেজে যাবার পর আমার বাবা মার জন্য অতটা খারাপ লাগে নি। কিন্তু ওকে খুব মিস করতাম আমি।
************
ঠিক বার বছর পর।
আগস্ট ৫, ২০০৫
রাত আড়াইটা থেকে সাড়ে তিনটার মত হবে।
গত তিনদিন ধরে বাসার কেউ ঘুমুচ্ছে না।
আম্মু সেই সন্ধ্যা থেকে কোরআন শরীফ পড়ছেন। আমি জেগে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই।
হঠাৎ চিৎকার করে "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ" পড়ার শব্দে আমি দৌড়ে গেলাম পাশের রুমে। সেই ছেলেটিকে কোলে নিয়ে কানের কাছে চিৎকার করে কালেমা পড়ছেন আম্মু। আপুরা সবাই কালেমা পড়ছেন আর বড় আপু তখন মাটি চাপড়ে কান্না।
মানুষের মৃত্যুদৃশ্য দেখার খুব শখ ছিল আমার। কিন্তু সেই শখ আমি পূরণ করতে পারলাম না। পালিয়ে এলাম সেই ঘর থেকে। সেই দৃশ্য সহ্য করার মত কোন ক্ষমতা আমার ছিল না। কান্নার রোলে বাসার বাতাস ভারী। আমি দরজা খুলে বাইরে চলে এলাম। গলার কাছে কান্না দলা পাকিয়ে এলেও কেন যেন কাঁদতে পারছিলাম না আমি। বিশ্বাস হচ্ছিল না। সবকিছু মনে হচ্ছে দুঃস্বপ্ন। যেন ঘুম থেকে উঠেই দেখব, সব ঠিক আছে, সেই আগের মত।
জীবন থেমে থাকে নাঃ
সেই দিনই আমাকে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে যেতে হল, আমার মার্কশীট অথবা কি যেন কাজে, মনে নেই।
সব বন্ধুদের সাথে আবার দেখা হল, সব কিছু ভুলে গেলাম কিছুক্ষণের জন্য।
কাজ শেষে গ্রামের বাড়ি গেলাম। শেষবারের মত ওর মুখটা দেখলাম, লোবান, আগরবাতি আর কর্পূরের পুঁতিগন্ধময় পরিবেশে। ওর মুখটা যেন একটু হাসি হাসি।
মার কাছে যাচ্ছে এতদিন পরে... খুশি তো হবেই।
***
সেই পশ্চিমের পালানের ধারে। সবকিছুর পুনরাবৃত্তি হল আবার।
...দাড়িওয়ালা কিছু লোক...
..."বিসমিল্লাহি আলা মিল্লাতি রাসুলিহী"...
...সাদা কাপড়ে কিছু একটা মোড়ানো...
কিন্তু এবার আমি জানি সাদা কাপড়টার ভিতরে কি আছে।
নিষ্ঠুরের মত ওকে মাটি চাপা দিয়ে এলাম।
মানুষের অপ্রিয় ঘটনাগুলো কি বারবার ফিরে ফিরে আসে?
তার সপ্তাহখানেকের মাথায় সবকিছু ভুলে গেলাম সবাই। ভার্সিটি কোচিং, বিকেলের আড্ডা.... সবই ঠিকঠাক আগের মত। শুধু বাসায় একটা মানুষ কম। কম্পিউটারটা নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে হয় না এখন আর। আম্মুর হাতের নলাটা প্রথমে কে খাবে তার জন্য যুদ্ধ করতে হয় না কারো সাথে।
[[ আমার লেখার হাত ভাল না, যতটা আবেগ নিয়ে শুরু করেছিলাম, সেভাবে শেষ করতে পারি নি। দুঃখিত]]
---------------------------------------
কুচ্ছিত হাঁসের ছানা
মন্তব্য
আপনার লেখার হাত খুব ভাল...
---------------------------------
এসো খেলি নতুন এক খেলা
দু'দলের হেরে যাবার প্রতিযোগিতা...
কি করব ভাই! পা দিয়ে তো লিখতে পারি না!
----------------------
কুচ্ছিত হাঁসের ছানা
- আবেগের কমতি হয় নি। কিন্তু এতো অকালে! কী হয়েছিলো?
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
কিডনী নষ্ট, হয়তো বাঁচানো যেত, কিন্তু সেটা আরেক কাহিনী।
সেটা নাহয় আরেক দিনের জন্য তোলা থাক।
ধন্যবাদ।
------------
কুচ্ছিত হাঁসের ছানা
এই লেখা পড়ে তো আমার মাথায় মন্তব্যের কোন ভাষা আসছেনা।
ভাল হয়েছে। চলুক...
=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=
LoVe is like heaven but it hurts like HeLL
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
ধন্যবাদ।
আমি তো কোন লেখা পড়লাম না...
একটা দুঃখের ছবি দেখলাম শুধু।
অসাধারণ...
কাঁদানোর জন্য যথেষ্ট
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
ভুলে যাওয়ার চেষ্টা বৃথা, তার চেয়ে ভুলে থাকার চেষ্টাই ভাল।
----------------
কুচ্ছিত হাঁসের ছানা
যতটা আবেগ দিয়ে মন্তব্য করা উচিত ছিল ততটা আবেগ নিয়ে করতে পারলাম না। শুধু বললাম, একটা অতি বাস্তব অনুভূতির অসাধারণ রূপায়ন।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
রুঢ় বাস্তবতার রূপটা এখানে আমি তুলে ধরতে পারি নি।
এখানে শুধু আবেগের প্রকাশটাই হয়েছে।
কিন্তু আবেগ দিয়ে কি জীবন চলে?
----------------------
কুচ্ছিত হাঁসের ছানা
লেখাটা লিখে ঠিক শান্তি পাচ্ছি না, কারণ এর আগের বা পরের কোন কথাই এখানে লিখি নি আমি। পাঠকের সাথে এ এক অদ্ভুত প্রতারণা।
মিথ্যে কাহিনী লেখার চেয়ে কঠিন স্বার্থপর বাস্তবের কাহিনী লেখা অনেক কঠিন।
কিন্তু চোখের সামনে আপন মানুষগুলোর যে স্বার্থপর রূপ দেখেছি, তাকে কি করে অস্বীকার করি?
---------------
কুচ্ছিত হাঁসের ছানা
মাঝে মধ্যে মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকলে মানুষের ভেতরের কুকুরটাকে নাকি দেখা যায়... সুনীল বলেছেন
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
নতুন মন্তব্য করুন