সূর্য তখন রক্ত-লাল

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২১/০৩/২০০৮ - ১২:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার আগের একটা লেখা , একটা ই-ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল, ভয়ে ভয়ে সচলে দিলাম

বাশার চোখ খুলে তাকালো । সামনে বিশাল আকাশ । দূরে কিছু মেঘ জটলা পাকিয়ে আছে। বাতাসে কোন নাম না জানা ঘ্রাণ। চারিদিক একেবারে ম ম করছে । বাশারের উত্সুক চোখ খুজে বেরায় এদিক ওদিক । কোথা থেকে আসছে গন্ধটা ? সামনে নদী ধার, বাতাস আর বাতাস । মনে হচ্ছে উড়িয়ে নিয়ে ফেলবে । আশফাকটা পাশে দাড়িয়ে আছে নাক মুখ কুঁচকে ।
“ কিরে বেটা, মুখ এরকম করস কেন? ”
“ হু ? ” ওইভাবেই বললো আশফাক, কি জানি খুঁজছে এদিক ওদিক
“ গন্ধটা কিসের রে বাশার? ”
বাশার হাহা করে হেসে উঠে -
“ বুঝতেসি না দোস্ত, আমারও একি প্রশ্ন ”
“ আজিব গন্ধ দেখি! কি ফুল এইটা! ”
“ এইটা যে ফুল-ই তরে কে কইসে ”
“ মনে হইতাসে ”

বাশার শব্দ করে একটা বড় হাই তুললো । আনন্দ সামনে একটু দূরে বসে আছে মাথা নিচু করে। বাশার ডাক দেয় –
“ আনন্দ ওই আনন্দ ”
“ হু? ”
“ ঝিমাস কে, ওই শালা ”
আনন্দ গা কাপিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে।
“দেখ দেখ শালা ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া হাসে।”
তিনজনেই হাসতে থাকে গা দুলিয়ে।

একটু দূরে ঘর থেকে সব দেখছিল রমিজ আলী। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলতে থাকে,
“এগুলির এতো ফুর্তি আহে কোনহান থিকা, দলের তিনটা গেলগা, একটা যায় যায়, এত ফুর্তি আহে কোনহান থিকা?”
এক কোনায় বসে বিড়ি টানছিলো নূরে আলম, কিছু না বলে মুচকি হাসে।
“চলেন রমিজ ভাই, বেশি সময় নাই, আবার উত্তর বাড়ী যাইতে হইব”
রমিজ চায়ে শেষ চুমুকটা দিতে দিতে নূরে আলমকে দেখতে থাকে, একটু হেসে বলে,
“মাঝে মাঝে তোরে খুব ডর লাগে আমার”
নূরে আলম হেসে উঠে, রমিজ কাপ রেখে বলে উঠে “চল ”

দূর থেকে রমিজ আর নূরে আলমকে আসতে দেখে বাশার। আনন্দের দিকে তাকিয়ে বলে
“বাড়ীর খবর পাইছিলি আর কোনো?”
মাথা নাড়ে আনন্দ, ডানে বামে।
“আশফাক?”
“হুম?”
“বাড়ীর খবর পাইছিলি?”
“জাফর-রেই তো পাঠাইছিলাম, খবর দেওনের আগেই ত...”

বাশারের মনে পড়ে, জ়াফরের রক্তাক্ত মুখ, একটা কান নেই, বুকে মনে হই একশো ছিদ্র । বাঁধা হাতটা শক্ত হয়ে উঠে নিজে থেকেই, রক্ত জমাট বেধে আছে দুহাতে। জাফর ছিল সবচাইতে ছোট । ওকে ওরা খুজে পায় একটা গ্রামে । অপারেশন শেষ করে ফিরছিল সামনে পড়ে একটা পোড়া গ্রাম, ওরা ওকে পায় একটা বাড়ীর পিছনের ডোবায় । হাতে শক্ত করে ধরা ছিল একটা মাটির ঘোড়া, বাশারের মনে পড়ে... জাফরের সেই পলকহীন শীতল চাহনি , কাঁপছিল থেকে থেকে । জাফরকে ওরা কখনো কথা বলতে শোনেনি । ওদের সাথে থেকে টুকটাক কাজ করতো, এতটুকু একটা ছেলে , কখনো হাসতে দেখেনি ওরা ওকে । বাশাররা ওইদিনই চলে যেত, একটা বড় দল-এর সাথে মিলতে । জাফরের পিছু পিছু এসেই রাজাকার রমিজের দল ওদের ধরে ফেলে । ওরা অনেক মিলিটারী নিয়ে এসেছিল । ওইদিনই জামাল ভাই, তারেক আর জাফর মারা যায়, যুদ্ধ করতে করতে । জাফর জামাল ভাইয়ের স্টেন গানটা পেয়ে গুলি করার চেষ্টা করছিল, তার আগেই ঝাঁঝরা হয়ে যায় ও ।

বাশার বাম চোখটা আরেকবার খোলার চেষ্টা করে... খুলতে পারে না, এক চোখ দিয়েই চারপাশটা একবার দেখে নেয় ।
রমিজ আলী তার সঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বেরিয়ে আসে ।
“ওই সবগুলিরে নিয়া যা নদীর ধারে, তাড়াতাড়ি শেষ করবি, ক্যাপ্টেন সাব খবর দিসে, যাইতে হবে ।”
নূরে আলম দাঁত খোচাচ্ছিল, মুখ হাসি হাসি করে বলে উঠে,
“আমি বলতাসিলাম কি, এডির লেইগ্গা বুলেট খরচ করার দরকার কি, দাও একটা আছিলো যখন”
রমিজ় আলী আলমের দিকে তাকায়, কিছুক্ষন পড়ে বলে, “কার্তুজ আছে কেমন ?”
“আরে যাই থাকুক, আপনে যান আমি দেখতেসি... ওই কালাম দাও-ডা বাইর কর”

নদীর ধারে হাটু গেড়ে বসে আছে বাশার... ওপাশ থেকে আনন্দের বোবা শব্দ ভেসে আসে... মুখ বেঁধে নিয়েছে ওরা, নূরে আলম এর গলা শোনা যায় “আরে! শক্ত কইরা ধর ! এত নড়ে কেন! মাথাটা ধর শক্ত কইরা !”... পাশে আশফাক কুঁকড়ে ছটফট করছে...গোঙ্গাচ্ছে ... বাশারের চোখ দৃষ্টিশূণ্য...
ডুবতে থাকা সূর্যটাকে দেখতে দেখতে হঠাৎ একসময় ও গন্ধটাকে চিনে ফেলে।

- খেকশিয়াল


মন্তব্য

ফারুক হাসান এর ছবি

ভয়ে ভয়ে কেন?
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।

অতিথি লেখক এর ছবি

না আসলে অন্য জায়গায় আগে প্রকাশিত হয়েছিল তো তাই ভাবলাম এখানে আবার দেয়া যাবে কিনা । হাসি

- খেকশিয়াল

তারেক এর ছবি

চমৎকার হইছে ... বিপ্লব
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

- খেকশিয়াল

সবজান্তা এর ছবি

এবং যে কথাটা আপনি উল্লেখ করেননি, লেখাটা সেই ই ম্যাগাজিনের শ্রেষ্ঠ গল্প হিসেবে পাঠক ভোটে নির্বাচিত হয়েছিল !

অসাধারণ লেগেছিল গল্পটা আমার।

---------------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ কমরেড, আর আমি উল্লেখ করতে চাই আমার লেখাটা আপনার-টার থেকে মাত্র এক ভোটে এগিয়ে ছিল দেঁতো হাসি

- খেকশিয়াল

রায়হান আবীর এর ছবি

এই লেখা দিতে কেউ ভয় পায়?
---------------------------------
এসো খেলি নতুন এক খেলা
দু'দলের হেরে যাবার প্রতিযোগিতা...

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

ডুবতে থাকা সূর্যটাকে দেখতে দেখতে হঠাৎ একসময় ও গন্ধটাকে চিনে ফেলে।

এখানে লেখাটা পরিপূর্ণ গল্প হয়ে উঠলো।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

চমৎকার !

অতিথি লেখক এর ছবি

রায়হান আবীর , মুহম্মদ জুবায়ের , আনোয়ার সাদাত শিমুল আপনাদের মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ ।

- খেকশিয়াল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।