"এক বাক্স আদর" গল্পটা দেখে আমার আরেকটা গল্পের কথা মনে পড়ল। বছর তিন-চার আগে গল্পটার একটা পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন একটি মেয়ে আমাকে পাঠিয়েছিল। এই গল্পটার কোনো নাম নেই, ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে অনেকে এই গল্পটা হয়ত পড়েছেনও। পুরনো হোক, নতুন হোক, চর্বিতচর্বণ হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। গল্পটার স্বাদ আমার ঠোঁটে লেগে আছে এখনও। হাতে ভুরভুর করছে সুগন্ধ।
গল্পটা এরকম :
অনেক পরিশ্রম করে রাতের বেলা বাসায় ফিরেছে এক ব্যবসায়ী। কদিন আগেও ব্যবসাটা খারাপ যাচ্ছিল তার, ইদানিং অনেক খেটে একটা জায়গায় দাঁড় করানো গেছে। এই দুনিয়ায় ভালো কিছু করা যে কত কঠিন, সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে। বাসা থেকে বের হয়ে যায় সকাল সাতটার মধ্যেই, ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা-বারোটা!
মা-মরা ছেলেটাকে সেরকম সময় দেয়া হয় না। বাচ্চা ছেলে, দশ বছর মাত্র বয়স। সকালবেলা যাবার সময়ও সে ঘুমিয়ে থাকে। রাতে ফেরার সময়ও।
সেদিন বাসায় ফিরে দেখে ছেলে জেগে আছে। জামা-জুতা খুলতে খুলতে ছেলেকে বলল, কী রে ব্যাটা, এখনো জেগে আছিস?
ছেলে বলল, হ্যাঁ, আজকে তোমার সাথে একটু দরকার ছিল!
কী দরকার বল দেখি?
একটা জিনিস জানতে চাই!
কী জিনিস?
একটা তথ্য।
বাবা গলায় তোয়ালে ঝোলাল, তাড়াতাড়ি বল কী তথ্য, আমি গোসল করতে যাব এখন!
তুমি রাগ করবে না তো?
না করব না!
সত্যি না তো?
ধ্যাত্তেরি! বল তো দেখি!
রাগ করব না বলেও বাবার মেজাজটা ঠিকই খারাপ হয়ে গেল! সারাদিন শেষে বাসায় ফিরে এরকম ঢঙ-মার্কা কথাবার্তা ভালো লাগে?
ছেলে বলল, প্রতি ঘণ্টায় তুমি কত ইনকাম কর?
মানে? ...বাবার এবার সত্যি সত্যিই পিত্তি জ্বলে গেল!
--কে তোকে এসব কথা শিখিয়েছে?
কেউ শেখায় নি, আমি এমনিই জানতে চাইছি!
বাবা খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঠাণ্ডা গলায় বলল, কদিন আগেও ঘণ্টায় আমার ইনকাম ছিল ১০০ টাকার মতো, এখন ৫০০ টাকা!
তাই? ...ছেলে খুসি হয়ে উঠল, তাহলে বাবা, তোমার তো এখন অনেক টাকা, আমাকে সেখান থেকে ১০০টা টাকা দাও না!
ইচ্ছে করছিল ঠাস করে গালের ওপর একটা রাম-চটকানা বসিয়ে দিতে। কিন্তু বাবা অনেক কষ্টে নিজেকে সম্বরণ করল। মাথার ওপর দেখভাল করার মতো অভিভাবক না থাকলে কী হয় বোঝাই যাচ্ছে! বখে যাচ্ছে ছেলেটা! এই বয়সেই বাপের প্রতি ঘণ্টার ইনকাম নিয়ে তার চিন্তা! সারাদিন খেটে কিনা এই সংসারের জন্যই এত কষ্ট!
বাবা কাটা কাটা গলায় বলল, কোনো টাকাপয়সা তোমাকে দেয়া হবে না! প্রতিদিন টিফিন আর হাতখরচের জন্য তোমাকে যে ২০ টাকা করে দেয়া হত, এখন থেকে সেটাও বন্ধ। তোমার স্কুলে বাসা থেকে টিফিন যাবে!
দপ করে একটা প্রদীপের মতো নিভে গেল ছেলেটার মুখ! মুখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল সে। বলল, বাবা, তুমি কিন্তু বলেছিলে, রাগ করবে না!
বাবা ঠাণ্ডা গলায় বলল, কই, আমি কি রাগ করেছি? চেঁচামেচি করছি? যে ধরনের ফাজলামি তুমি আমার সাথে করেছ, সেটার জন্য একটা শক্ত থাপ্পড় তোমার পাওনা ছিল! সেটা কিন্তু তোমার গালে পড়ে নি!
ছেলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
বাবা বলল, অনেক রাত হয়েছে। যাও, এবার ঘুমুতে যাও!
ছেলে চলে গেল তার বেডরুমে। বাবা বাথরুমে।
গোসল করে-টরে বাবার মাথা একটু ঠাণ্ডা হল। একটু অনুতপ্ত বোধ করতে লাগল সে। কতই বা বয়স ছেলেটার, মাত্র দশ। সেই ছোটবেলায় মা মারা গেছে, এখন মানুষ হয় কাজের বুয়ার হাতে, বাবার সঙ্গে তো তার দেখাও হয় না। ছেলেটার মাথায় যদি উল্টোপাল্টা কিছু ঢোকে, সেটা দায় তো আসলে তাকেই নিতে হবে।
মায়া হতে লাগল তার ছেলেটার জন্য। আহা, ঠিক আছে, ১০০টা টাকা চেয়েছিল, দেই ওকে! হয়ত কোনো দরকার আছে বলেই চেয়েছে! এরকম করে তো কখনো চায় নি এর আগে!
ছেলের বেডরুমে এসে উঁকি দিল বাবা। দেখে, ছেলে তখনো ঘুমায় নি। শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে।
বাবাকে দেখেই খুশি হয়ে উঠল সে। বলল, আস বাবা, বস আমার বিছানায়।
বাবা একটু অস্বস্তি নিয়েই ঢুকল রুমে। বসল বিছানায়। বলল, দেখি, কী বই পড়ছিস!
ছেলে বইটা এগিয়ে দিল।
বাবা বইয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ না তুলে অন্যমনস্ক একটা ভাব দেখাল নিজের অস্বস্তিটা কাটাবার জন্য।
বলল, তোকে বকাঝকা করার জন্য সরি! উল্টোপাল্টা কথা জিজ্ঞেস করে আমার মেজাজ খারাপ করবি না! এমনিতেই আমার মেজাজ খারাপ থাকে!
ঠিক আছে বাবা!
এই নে ১০০ টাকা!
ছেলে খুশিতে একেবারে লাফিয়ে উঠল, আমি জানতাম বাবা, তুমি ঠিকই দেবে আমাকে টাকাটা! থ্যাঙ্কিউ বাবা, থ্যাঙ্কিউ!
বাবা গম্ভীর গলায় বলল, ইটস ওকে!
ছেলে তার বালিশের নিচ থেকে বের করল অনেকগুলো ৫০, ২০, ১০ টাকার নোট! এইমাত্র পাওয়া ১০০ টাকার নোটটা সেগুলোর সাথে একত্র করল!
আরো টাকা বের করতে দেখে বাবার মেজাজটা আবার খ্যাঁচ করে উঠল! ভেবেছিল, ছেলেটার নিশ্চয় কোনো বিশেষ দরকার, এখন দেখা যাচ্ছে নিশ্চয় কোনো খেলনা-টেলনা কেনার জন্য পয়সা জমাচ্ছে!
আমি এত কষ্ট করে সারা দিনমান খেটে পয়সা কামাই, আর ছেলেটা টাকা দিয়ে নানান নকশা করে!
থাপ্পড় মারার ইচ্ছাটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল!
কড়া গলায় বলল বাবা, কী করবি এই টাকা দিয়ে? খেলনা কিনবি? সেটা আমাকে বললেই তো হয়! ফকিরের মতো খুচরা টাকা জমাচ্ছিস কেন?
ছেলে এবার আর মন খারাপ করে মাথা নামিয়ে নিল না। বাবার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, না বাবা, খেলনা কেনার জন্য না!
তাহলে?
তোমাকে দেয়ার জন্য!
মানে? ফাজলামি করছিস নাকি?
ছেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার বাবার দিকে। তার চোখটা এবার একটু টলটল করে উঠল! নরম গলায় বলল, বাবা, আমি তো জানি তুমি অনেক ব্যস্ত মানুষ, ভোরে বেরিয়ে যাও, গভীর রাতে ফেরো! অনেক কষ্ট কর তুমি, আমার জন্য, শুধু আমারই জন্য! কিন্তু বাবা, সব জেনেও আমার যে তোমার সঙ্গে খুব গল্প করতে ইচ্ছে করে, তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে ইচ্ছে করে! এজন্যই আমি জিজ্ঞেস করছিলাম এক ঘণ্টায় তোমার ইনকামের কথা! এখানে, আমার হাতে একদম কাটায় কাটায় ৫০০ টাকা আছে, তুমি এই টাকাটা নিয়ে কালকে আমাকে এক ঘণ্টা সময় দেবে বাবা? অফিস থেকে এক ঘণ্টা আগে ফিরে আমার সাথে গল্প করবে?
একটু চুপ করে থেকে আবার বলল ছেলে, না কোরো না বাবা, আমার ওপর রাগও কোরো না, এই টাকাগুলো আমি গত এক মাস স্কুলে কোনো টিফিন না খেয়ে অনেক কষ্ট করে জমিয়েছি! ৪০০ টাকা ছিল, আজকে তোমার কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে ৫০০ টাকা হল! রাগ করলে বাবা? বাবা... কথা বলছ না কেন? একি, তুমি কাঁদছ? বাচ্চা ছেলের মতো হাউমাউ করে কাঁদছ কেন? কী হয়েছে বাবা, আমি কি খুব খারাপ কিছু করেছি? মনে কষ্ট পেয়েছ বাবা? রাগ করেছ! সেরকম হলে মাফ করে দাও বাবা প্লিজ... কথা বল বাবা, এভাবে কান্না কোরো না... তোমার কান্না দেখে তো আমারও কান্না পেয়ে যাচ্ছে...
মৃদুল আহমেদ
ahmed.mridul@gmail.com
মন্তব্য
খুবই অদ্ভুত লিখেছেন মৃদুল আহমেদ !
মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্প...
জনৈক "বেক্কল ছড়াকার"
aa_bd@yahoo.com
ভালো লেগেছে...প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক...
---------------------------------
এভাবেই কেটে যাক কিছু সময়, যাক না!
আগে অনেকবার পড়েছি তারপরও ভালো লাগলো
কল্পনা আক্তার
কল্পনাআক্তার@হটমেইল.কম
....................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা
গল্পটা লিখতে আমার ভারী ভালো লাগছিল। মনটা ভরে যাচ্ছিল কেমন একটা মায়ায়। মানুষের জন্য মানুষের মমত্বের এই ব্যাপারটা আমাকে ভারী নাড়া দেয়। গল্পের প্লটটা পুরনো, কিন্তু বাবা আর ছেলেকে খানিকটা চোখের সামনে জীবন্ত নড়েচড়ে বেড়াতে দেখতে ইচ্ছে করছিল, তাই এই লিখতে যাওয়া।
মৃদুল আহমেদ
হুম আগে পড়েছি, তবে আপনি তাতে অনেক অনুভূতির মিশেল ঘটিয়েছেন। ধন্যবাদ এই লেখাটার জন্য।
রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
আমার খুব ভালো লাগার একটা গল্প...
আপনার মমতামাখা অনুবাদ সেই ভালোলাগাটা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে...
চলুক।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
পড়তে পড়তে চোখে পানি এসে গেলো।
মন খারাপের গল্প ভালো হলেও কি তাকে ভালো বলা যায়?
এরকম একটা ইমেইল একসময় আমিও পেয়েছিলাম। তবে সেটা ছিল ইংরেজীতে। আপনার বাংলা রুপান্তর চালু হয়েছে। সাধু সাধু।
:ফেরারী প্রতীক্ষা:
প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক।
ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল
একটা গান শুনেছিলাম, সেখানে ঠিক এরকমই একটি গল্প আছে। ব্যস্তবাগীশ বাবা বলছেন, এই তো মাত্র সেদিনের কথা, আমার ছেলেটা যখন খুব ছোটো ছিলো তার সঙ্গে আমার খুব কমই দেখা হতো। আমার তখন সময় কোথায়? যতোটুকু সময় ঘরে থাকতাম, ছেলে আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করতো আর সারাক্ষণ বলতো, আমি আমার বাবার মতো হবো। এই তো সেদিনের কথা। সেই ছেলে এখন বড়ো হয়েছে, তার নিজের বউ-ছেলে-সংসার হয়েছে, দূরের শহরে থাকে। তার সঙ্গে আমার খুব কমই দেখা হয়। এই তো সেদিনের কথা, তাকে বললাম, আয় একবার। ছেলে বললো, জানোই তো বাবা, সময় পাই কোথায়? হায় এই তো সেদিনের কথা! বুঝলাম, ছেলে ঠিক তার বাবার মতো হয়ে উঠেছে!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
সেই পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে একটা মোরাল উল্লেখ করা ছিল এই গল্পটার... "জীবন বড় ছোট, প্রিয়জনকে তাই সময় দিয়ো... হয়ত তুমি জানোই না, তোমার একটুকু সঙ্গ পাবার জন্য কী বিশাল তৃষ্ণা তার ভেতরে জমা থাকে!"
আমার গল্পটা পড়তে গিয়ে আমাকে কিছুটা সময় দিয়েছেন দেখে সুখি হলাম!
মৃদুল আহমেদ
ahmed.mridul@gmail.com
omg .... কি দারুন ভাবে লিখলেন, আমার সত্যি কান্না পেয়েগেলো :'( খুব ভালো লাগলো
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
অসাধারণ হয়েছে !
আপনার লেখা ভীষন ভাল লাগলো।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
নতুন মন্তব্য করুন