বন্ধনের মানুষেরা (৩)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১৩/০৪/২০০৮ - ১:১১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ক্যামেলিয়া আলম

আমার ডানাগুলো আর বাতাসের গন্ধে উদ্বেলিত হতে চায় না। বাতাসের ঝাপটা এখন শীতল মনে হয়। তাই নিজেকে আরও কাজের মাঝে ডুবিয়ে ঘরকুনো হয়ে যাই। ভাবি যে বর্ণের পাতাতেই নিজেকে ধরে রাখবো। ছুটে ছুটে বর্ণ আনি এখান থেকে সেখানে Ñ সেখান থেকে এখানে। সারাক্ষণ বর্ণের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে রাখি। দীঘির জল আর বাতাসের চাইতে মূক বর্ণগুলো হয়ে ওঠে আমার পরম সাথী। আমি পরিতৃপ্ত হয়ে আবার স্বাভাবিক হই। অনেকদিন পর ডানা ঝাপটাই Ñ আমি সুখী হই। আর আশ্চর্যের কথা আমার সবুজ বুক আবারও শিরশিরিয়ে ওঠে যা অ-নেক দিন আগে হারিয়েছিলাম। আমি বাদামী চোখে নীল আকাশ দেখি প্রাণ ভরে। অনুভব করি আকাশের ঐ নীলিমা ঠিক আমার চোখের মাঝখানটিতে এসে লাগলো। আরও অদ্ভুত সুন্দর হল আমার চোখ। তবে সবচেয়ে অবাক হলাম যে, আমার দৃষ্টি মনে হচ্ছে আরও স্বচ্ছ। আমি অভিভূত হয়ে পরীক্ষা করতে চাইলাম Ñ যা ভাবছি তা কি সত্যি? দূরের একটা সবুজ বনভূমির দিকে দৃষ্টি রাখলাম। বিস্ময়াভিভূত হয়ে দেখতে পেলাম গাছের প্রতিটি পাতা। গাছের পাতায় চোখ রাখলাম দেখলাম রঙীন পোকার বসতি। ছোট ছোট দাঁত দিয়ে কুচি করে কাঁটছে পাতাটা। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম ওর ভোজন। মাঝপথে থেমে গেল Ñ তাঁকালো এপাশ ওপাশ Ñ আশ্চর্য আমি সব দেখতে পারছি। দৃষ্টি এবার সরালাম গাছের কান্ডে। পিপড়ের সারি দল বেধে যাচ্ছে Ñ কারও মুখে লাল বিন্দু Ñ কারও মুখে সবুজ আবার কারও মুখে বাদামী। একটা ডালে ছোট পাখি এসে বসলো Ñ আমি চিনলাম ও টুনটুনি। টুনটুনির ছোট শরীরের কাছে যেতেই দেখলাম ওর ডানার একটি পালক কালচে সোনালী। বাতাস এসে হানা দিচ্ছে ওর সেই ডানায় আর ও আয়েশে চোখ বুজে ফেলছে।

আমার দৃষ্টির এই অদ্ভুত উত্তরণে আমি আকাশের দিকে তাঁকিয়ে কৃতজ্ঞতা জানালাম। আকাশ ডেকে উঠলো। দলে দলে মেঘেরা আনন্দের নৃত্য শুরু করলো। সেই নৃত্যে সিক্ত হলাম আমি। জলবিন্দু আমার প্রতিটি রোমকূপ গড়িয়ে পাতালে হারিয়ে গেল। জলের স্পর্শে আমার হাত পা শরীর দোল খেল। আর একবিন্দুও স্থির থাকতে পারলাম না আমি । মাতাল হয়ে গেলাম বাতাসের গন্ধে Ñ জলের স্পর্শে। মাভৈ মাভৈ তানে আমি আবারও উড়তে শুরু করলাম।

উড়তে উড়তে আমি যখন অনেক দূর যাবার কথা ভাবছি ঠিক তখনই আমার আড্ডার অন্য বন্ধুরা এসে ঘিরে ধরলো। আনন্দে আমি আবারও উদ্বেলিত হলাম। কতদিন পর ওদের কাছে কইলাম প্রাণের কথা Ñ মনের কথা। মন আমার হালকা হয়ে গেল। উচ্ছ্বাসের উত্তাপ গায়ে মেখে আমার ভোর মধ্যাহ্ন অপরাহ্ন রাত্রি গড়াল। পুলকিত বেশে আবারও আমি নিজেকে রাখলাম মুক্ত হাওয়ায়। কিন্তু ঐ যে বয়স আর সময় আমাকে বারবার দাঁড় করায় সত্যের লেলিহান শিখায় Ñ তার থেকে আমার মুক্তি কই?
কিছুদিন যেতেই দেখলাম আমার বন্ধুদের চোখে আমি যেন এক পোড়ো মন্দির। কেউ কেউ আমার সকল প্রাপ্তি নিয়েই প্রশ্ন তোলে Ñ কেউ কেউ সেই প্রাপ্তি নিয়ে করে উপহাস। কোন প্রাপ্যই নাকি আমার নিজের নয় অন্যের। সকলে আমায় দয়া করে! আমি হোঁচট খাই কিন্তু ভেঙে পরি না। আমার এক কালের সাথীরা একটু একটু করে আমার দূরে সরতে থাকে। শরীরে নয় মনে।

আকাশ থেকে পাওয়া স্বচ্ছ চোখের দৃষ্টিতে ওদের সোণালী রূপোলী বুকগুলো দেখতে পাই আমি। আর অবাক বিস্ময়ে দেখি যে, সেখানে আমাকে নিয়ে ওদের কারও করুণা, কারও ঈর্ষা, কারও বিরক্ত জমে আছে। আমার এক কালের সাথীরা! আমার জন্য নেই যাদের বিন্দু ভালবাসা। আজ আমার ডানা দু'টো আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়ায়। চারিদিকে শুধু শূণ্যতা। ভয়ে মাঝে মাঝে চোখ বুজে থাকি। আলো দেখা চোখ সেই অন্ধকারও সইতে পারে না বেশিদিন। দৃষ্টি খুলি দেখি এবার পুরো পৃথিবীই আঁধারে ঢাকা। সেই আঁধারে আমি পথ হাতড়ে চলি। হোঁচট খাই Ñ উঠে দাঁড়িয়ে রক্তকণা চুষে নেই Ñ মাটি হাতড়ে ঘন দুর্বা ঘাস নিয়ে দাঁত দিয়ে চিড়ে আঘাত পাওয়া স্থানগুলোয় বুলাই। একটু একটু করে আঁধার কাটে। আমি পরিষ্কার পথ দেখতে পাই। কিন্তু দেখি সেই পথে সবকিছুই একাকী। বুড়ো বট গাছ একাকী দাঁড়ানো Ñ দীঘি এখন কালো ডোবা আর দূরে একটাই শূণ্য মাঠ। আকাশে দৃষ্টি রাখি Ñ সেখানেও আর অজস্র আলো দেখতে পাইনা। দেখি একটি মাত্র সূর্য Ñ আর একটি মাত্র চাঁদ।

বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে সেই পথে দৃষ্টি রাখি। আরও জোড়ে শ্বাস নিয়ে সাহস সঞ্চয় করি Ñ তারপর ঐ পথে পা বাড়াই।

২৩ এপ্রিল, ২০০৭


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

তারপর ঐ পথে পা বাড়াই।


পা না বাড়িয়ে তো উপায় নাই
ঘরে বসে থাকলে ফার্মের মুরগির মতো হাপ-পা ফুলে কলা গাছ হয়ে যাবে
পরে রাস্তা পেলেও আর পা চলবে না
তাই দৌড়াদৌড়ি করে হাতপা সচল রাখাই জরুরি

মুশফিকা মুমু এর ছবি

খুব সুন্দর হাসি

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

হিমু এর ছবি

দয়া করে মেইল চেক করুন।


হাঁটুপানির জলদস্যু

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।