বেশ কিছুদিন আগের কথা। বাসে করে ঢাকা থেকে হোমনা যাচ্ছি। সামনের দিকে জায়গা পাইনি, বসেছি একেবারে পেছনে। আমার হাতে একটা বই-ড্যান ব্রাউনের ‘দ্যা দা ভিঞ্চি কোড’। কিছুক্ষণ পরই বুঝতে পারলাম জার্নিতে এত কঠিন একটা বই আনা উচিত হয়নি; প্রয়োজন ছিল হুমায়ুন আহ্মেদীয় সহজ কোন বই। যা পড়ে একটু পর পর জানালা দিয়ে বাইরে তাকানো যাবে, কিংবা কিছুক্ষণ কোন যাত্রীকে পর্যবেক্ষণ করে আবার বইয়ে ঢুকে যাওয়া যাবে। বাসে বেশিরভাগ লোকই ব্যবসায়ী শ্রেণীর। তাদের উচ্চস্বরের সাধারণ কথাগুলোই আমার কানে ঢুকছে ‘ঝগড়া’ হয়ে। বিরক্তিকর। আমি আগেও খেয়াল করেছি, এদের কথাবার্তার সাধারণ বিষয় একটাই- টাকা। তো নানাবিধ কারণে বিরক্তি চরম আকার ধারণ করার আগেই বাসটা হঠাৎ মাঝরাস্তায় সরিষা ক্ষেতের পাশে দাড়িয়ে গেল। দেখলাম দুজন লোক বাসে উঠছে। উঠেই তাদের একজন বাস ড্রাইভারকে হাত মুঠো করে কী যেন দিল, তারপর দু’জনেই আমার পাশে এসে বসে পড়ল।
প্রথম থেকেই চেনা চেনা লাগছিল। ভাল করে দেখার পর নিশ্চিত হলাম- ‘আরে হকসাব আর মজিদ সাব না!’ আমার সম্বোধন শুনে তারা দু’জনই সাংঘাতিকভাবে চমকে উঠল- ‘কি কইলেন ?’ আমি তাদের আশ্বস্ত করলাম- ‘শুনেন, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি আপনাদের গ্রামেরই লোক। কালেভদ্রে গ্রামে যাইতো, তাই চিনেন না। এখন তো শুনেছি আপনারা ও গ্রামে যান না...’ আমার বাড়ি দাড়িগাঁও শুনে তাদের মন খারাপ হয়ে গেল, হক আস্তে করে বলল- ‘আপনে আমাগো সাব কইয়া ডাকলেন?’
আমি জানালা দিয়ে বাইরে সরিষা ক্ষেতের দিকে তাকালাম। তীব্র হলুদ বলে অনেকক্ষন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে এক ধরনের ভ্রম হয়। সেই দৃষ্টিবিভ্রমের মাঝে আমি হারিয়ে গেলাম অতীতে। খুবই নিকট অতীত।
*** *** ***
হতদরিদ্র বাবা শখ করে নাম রেখেছিলেন- হকসাব আর মজিদ সাব। আগে পিছে আর কিছু নাই। শহরাঞ্চলে মূলনামের সাথে এভাবে সাহেব যুক্তকরণ সাধারণত দেখা যায় না। তবে নাম রাখলে কী হবে, গ্রামের মানুষ মাষ্টার, চেয়ারম্যান বা জমিদার ছাড়া অন্য কাউকে সাব ডাকতে নারাজ । তাই হক আর মজিদের নামের বিকৃতি ফরজ হয়ে গেল- হক থেকে হইক্যা আর মজিদ তেকে মইজ্যা । মাঝে মাঝেই আমি শংকিত হই, নিয়মিত গ্রামে থাকলে আমার নাম বিকৃত হয়ে না জানি কী হত! এক গ্রামবাসীকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম- ‘ভাই আপনারা যে লোকটাকে হইক্যা বলে ডাকেন, তার আসল নাম কী ?’
-হের আসল নাম হইল হক সাব।
-তাহলে হইক্যা ডাকেন কেন ?
-হেই বান্দীর পুতেরে আবার সাব ডাকবো কেডা? এহ্...
হক আর মজিদের বয়সের পার্থক্য মাত্র এক বছর। মজিদের জন্মের সময়ই মা মারা যায়, আর তার পাঁচ বছর পর বাবাও মারা যায়। কৈশোর থেকেই তাদের আয়ের একমাত্র উৎস হল ‘ফুটবল’। হ্যাঁ এটাই তাদের একমাত্র গুণ। তাই আশেপাশের সব গ্রামেই তারা পরিচিত। শোনা যায় তারা নাকি ঢাকায় কোন বড় ক্লাবেও আমন্ত্রণ পেয়েছিল; কিন্তু গ্রামের মায়া ত্যাগ করে যেতে পারেনি। তাছাড়া গ্রামের যুব সম্প্রদায়ের কাছেও তারা বেশ জনপ্রিয়। তাদের সম্পর্কে সবচেয়ে মজার তথ্য হল-কর্দমাক্ত, পিচ্ছিল মাঠ না হলে তারা খেলতে পারে না। কেউ কেউ মজা করে বলে- ‘শুগ্না মাঠে আমার বুজি (দাদী) ও হেরার থেইক্যা ভাল খেলবো।‘ আবার আরেকজন বলে- ‘বৈদেশের মাটিতে খালি প্যাক্ বানাইয়া ওগোরে নামাইয়া দেও, রুনালদো-ম্যারোডোনারও ক্ষ্যাম্তা নাই যে থামাইবো...’
দুই ভাইকে নিয়ে এসব আলোচনা, সমালোচনা, প্রশংসা চুড়ান্তরূপ ধারণ করত প্রতি বর্ষায়। স্কুলমাঠে আয়োজিত হয় ফুটবল টুর্নামেন্ট যা একটু ব্যাতিক্রমধর্মী- বিবাহিত বনাম অবিবাহিত। অর্থাৎ গ্রামের পুরুষদের মাঝে বিয়ের ভিত্তিতে দু’টি ভাগ। পুরষ্কার দেয়া হয় বড় সাইজের একটি গরু। তবে এক্ষেত্রে সম্মানটা বিরাট বড় ব্যাপার, কারণ খেলার দিন সারা গ্রামের ছেলে-বুড়ো, যুবক-যুবতী, মহিলা সবাই বেশ আগ্রহভরে হাজির হয়। হক আর মজিদের কৃতিত্বে গত কয়েক বছর ধরেই অবিবাহিতরা চ্যাম্পিয়ন।
অনেক সময় দেখা যায় বাপ-ছেলে একই খেলায় উপস্থিত। একবার বাপ বল নিয়ে আক্রমন করছে, ডিফেন্ডার ছেলের কর্তব্য তাকে ঠেকানো, ছেলে নিজে কিভাবে যাবে? তার কেমন যেন লজ্জা লাগছে, পাশের ডিফেন্ডারকে বলল- ‘এই তুই যা, গিয়া আব্বারে ঠেগ্ দে...’ এমন হাজারো ছোটখাটো হাস্যকর ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রতিবছর টুর্নামেন্ট চলে। হয়ত এটি খুবই সাধারণ একটা খেলা; কিন্তু গ্রামবাসীর কাছে এটি খেলার চেয়েও বেশি কিছু । কারণ সারাবছর ধরেই জয়ী দল আর বিজিত দলের মধ্যে কথার মারপ্যাঁচ চলতে থাকে। আর বিশাল অংকের টাকার বাজি তো আছেই।
*** *** ***
সেবার প্রথম খেলায় অবিবাহিত দল সহজ জয় পায়। হক আর মজিদের খেলার প্রশংসা সকলের মুখে মুখে। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচে হঠাৎ কী যেন হল, দুই ভাইয়ের কেউই খেললনা। বিবাহিত দলের হয়ে খেলা জিলানী কাকা মাঠে এসে বললেন যে ওরা দু’জনেই অসুস্থ, আজ আসবে না। সবাই অবাক! তাদের ছাড়াই খেলা শুরু হয়ে গেল আর ফলাফলও যা হওয়ার তাই হল। হঠাৎ পরিবর্তনে অবিবাহিত দল হেরে গেল। জিলানী কাকার মুখে তেলতেলে হাসি। পরবর্তী শুক্রবার ফাইনাল ম্যাচ। গ্রামের মানুষ তখনো জানে না কী হতে চলেছে...
*** *** ***
জিলানী কাকার বাসায় হক ও মজিদ এসেছে। তাদের চোখেমুখে উৎকন্ঠার ছাপ স্পষ্ট। কাকা বললেন- ‘শোন বাবারা, আইজ হোক কাইল হোক তোমরা তো বিয়া করবাই। তখন তো আমাগো দলেই খেলবা, নাকি?’
-কিন্তু আমরা তো একটা ম্যাচ হেই দলে খেইল্লা ফালাইছি, এখন আবার...
মজিদ ক্ষীণ স্বরে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে।
-এইডা কুনু বিষয়ই না, আমরা তো বেআইনী কিছু করতাছি না। আইজ রাইতেই তুমরা বিয়া করবা। আমাগো দলের খেলুয়ার রহমতের দুই মাইয়ারে।’
হক আর মজিদ একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। হক বলল- ‘কিন্তু মেম্বার সাব তো আবিয়াইত্যা (অবিবাহিত) দলের উপরে এক লক্ষ ট্যাকা বাজি ধরছে, আমরা দল পাল্টাইলে যদি কুনু ক্ষতি করে...’ জিলানী কাকা রাগত স্বরে বললেন- ‘ওই মেম্বার হালার লগে একবার ইলেকশানে হারছি, আর না। এবার ওরে বাজিতে হারামুই। শোনো তোমাগো বিয়ার যৌতুক নগদ পঞ্চাশ হাজার ট্যাকা। আর কুনু কতা না। আইজই বিয়া।‘
*** *** ***
শুক্রবার, বাদ জুম্মা। স্কুলমাঠে সাজ সাজ রব পড়ে গেছে, তিলধারনের জায়গা নেই। বাজারে আজ বেশি করে মাল তোলা হয়েছে, লোক সমাগমের দরুন কেনাকাটা বেশি হবে। ইতিমধ্যে সবাই হক আর মজিদের বিয়ের খবর জেনে গেছে। তাদের মধ্যে চাপা একটা গুঞ্জন। ব্যাপারটা আপাত দৃষ্টিতে হাস্যকর আর ছেলেমানুষী। কিন্তু গ্রাম্য পলিটিক্স অতটা সহজ না। স্বার্থে আঘাত আসলে এখানে মানুষ যে কোন কিছু করতে পারে। সেটা হোক অস্তিত্বের স্বার্থ কিংবা মান সম্মানের স্বার্থ।
*** *** ***
বাস আরেকটা ষ্টেশনে থামলো। আমি মজিদকে বললাম,
-কত বছর আগে গ্রাম ছেড়েছেন?
-তিন বছর। আর যামুনা ওইখানে, সব বদলোক...
মজিদের এই অভিমানের কারণ আমি জানি। দল পরিবর্তন করায় গ্রামের যুবকরা তাদের দুইজনের উপর সাংঘাতিক ক্ষেপে যায়। পরাজয়ের জন্য তাদেরকেই দায়ী করা হয়। তারপরের ঘটনা আরও বেদনাদায়ক। ষড়যন্ত্র করে তাদের দুইভাইকে চুরির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। মেম্বারের কারসাজিতে তারা হয় গ্রামছাড়া। জিলানী কাকাও সুবিধামত সটকে পড়েন।
চুরি না করেও চোর সাজতে হল। অর্থোপার্জনের জন্য শেষে দুই ভাই চুরি করাই শুরু করল। শেষ যেবার আমি গ্রামে গিয়েছি তখন শুনেছি যে তারা নাকি প্রতিষ্ঠিত চোর। বউ নিয়ে অন্য গ্রামে থাকে, তবে এক গ্রামে বেশি দিন নয়।
কিন্তু এখন তারা কী করে? আমি আবার তাদের ভালো করে দেখলাম। বেশভূষায় বেশ পরিবর্তনের ছাপ। শার্ট-প্যান্ট, পায়ে সু, চোখে সানগ্লাস, মুখে চুইংগাম আছে মনে হয়- একটু পর পর মুখ নড়ছে। আমি বললাম- আপনারা আর ফুটবল খেলেন না?
মজিদ বলল- নাহ্।
হক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- ফুটবল খেইলা কী হইবো? ফুটবল কি আমাগো ভাত দিব?
আমি বললাম- তো এখন কী করা হয়?
মজিদ বলল- ভাইজান আমরা ভালা হইয়া গেছি, এখন আর চুরি-চামারী করিনা। বেলেক এর বিজনেস ধরছি।
‘ব্ল্যাকের বিজনেস’ কথাটা মজিদ এমন ভাবে বলল যেন এটা মহৎ কোন কাজ! হক উৎসাহের সঙ্গে বলল- ‘ডলার, ইউরো ভাঙ্গাইতে চাইলে বা বিদেশী মোবাইল, সিডি, টিভি লাগলে কইয়েন। ইন্ডিয়া থেইক্যা চালান আসে। জানেন তো আমরার কুমিল্লার এদিক দিয়া এইসবের বন্দোবস্ত মাশাল্লাহ্।’
আমি তাদের বড় ব্যাগটি দেখিয়ে বললাম- ‘ব্যাগে কী ? এইসব জিনিস?’
- জ্বে না ভাইজান, এইগুলান ফেনসিডিল। বাংলা ও আছে- চাইর নাম্বার থেইক্যা এক নাম্বার পর্যন্ত...’
আমি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে তাকালাম। গ্রামের সহজ সরল ছেলেগুলো এখন কোন পর্যায়ে অপরাধী হয়ে গিয়েছে। অথচ তাদের চোখেমুখে বেশ তৃপ্তির ছাপ, ব্যস্ততা তারা উপভোগ করছে। আমি ভাবি, শত ব্যস্ততা শেষে রাতে ঘুমোতে যাবার সময় একবারও কি তাদের বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হয়না? একবারও তাদের প্রিয় গ্রামখানির কথা মনে পড়ে না? যে গ্রাম ছেড়ে একদিন তারা শহরের বড় ক্লাবে আসতে রাজী হয়নি।
----------------------------------
বিঃ দ্রঃ এই গল্পটা ২০০৬ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালীন লেখা...
রিজভী
মন্তব্য
সচলের মজার লেখার মাঝে এমন লেখা হয়ত প্রায় অচল।কারন কোন রেটিং নেই ভোট নেই। তাহলে কি হক আর মজিদের মত তাদের গল্প গুলো ও অবহেলিত হবে ? লেখক কে অনেক সাধুবাদ।ভাল লাগলো।
অভী আগন্তুক
ধন্যবাদ, অভী ভাই- ধৈর্য্য ধরে আমার লেখা পড়ার জন্য এবং সুন্দর মন্তব্যের জন্য...
রিজভী
--------------------------------
কেউ যাহা জানে নাই- কোনো এক বাণী-
আমি বহে আনি;
গল্পটা খুব ভালো লেগেছে রিজভী... তোকে এখানে দেখেও। নিয়মিত লিখিস।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
হ্যাঁ তারেক, তোকে দেখেও আমি খুশি হয়েছি...আমি সাধারণত দিনপঞ্জী টাইপ লেখা বেশি লিখি, যেটা ৩৬০ তে করা খুব সহজ। কিন্তু এখানে তো সবাই পড়ে, তাই কি ধরনের লেখা দেব তা নিয়ে সংশয়ে থাকি...যাই হোক আমি ভাল কিছু লেখার চেষ্টা করব; আমাকে সচল করা হোক বা না হোক...
রিজভী
নতুন মন্তব্য করুন