গল্প বলার শুরু সেই ছোট্ট বেলার থেকেই। তাও রীতিমত প্রফেসনালী! মানে প্রতিদিন দুয়েকটা গল্প বানাই আর বিক্রি করি। ক্রেতা আমার একজনই। আমার ছোট বোন! এবং আমার গল্প কেনাতে তার কোন আপত্তি নেই। প্রতি গল্প এক টাকা!! গল্প বেশি ভাল লাগলে দুইটাকা। আর না লাগলে আটআনা ফেরৎ। ও তখনো পড়তে পারেনাতো! তাই আমিও মওকা পেয়ে দুহাত ভরে কামিয়েনিই। আমার এই সব গল্প শুনে ও কখনো কাঁদে কখনো ভয়পায়, আবার কখনো হাসে। কখনোবা আবদার করে “এই মেয়েটাকে রাজকন্যা বানিয়ে দাও” আমিও বানিয়ে দেই! আর ও মুগ্ধ হয়ে বলে “আমার ভাইয়া সবাআ...র সেরা!!”। কিন্তু ও সেরা বললে কি হবে, আমার মধ্যে হচ্ছে গোড়ামী ভরা। আর সেই সব গোড়ামী আমি ওকেও শিখিয়ে দেই বেশ ভাল ভাবেই। যেমন, গল্প বলতে বলতে কোকিল ডেকে উঠলে আমি চুপ। পরে বলি “শোন, কোকিল ডাকলে কথা বলা যাবে না। খুব মনযোগ দিয়ে শুনতে হবে। কারন ওর কথা যদি এক বার বুঝতে পার তাহলেই তুমি হয়ে যাবে একটা রাজকন্যা। আর যদি ও তোমার কথা শুনে ঊড়ে জায় তাহলে তুমি হয়ে যাবে দুওরানী! তাই চুপ্”।
এদিকে বড় হয়ে উঠছে ও। পড়তে শিখে ফেলছে দিনে দিনে। কিছুদিন পরেই স্কুলে যাবে! আমি একটু শঙ্কার সাথেই আমার এত বড় মার্কেটটা হারিয়ে যেতে দেখি। কিন্তু কি আর করা সবাইতো একদিন বড় হবে, নাকি?
বেশ কিছু দিন পর। আমার স্কুলে দিনগুল কাটছে যথারীতি বীভিষিকার মত। এমনিতেই ক্লাসে মার খেতে খেতে অস্থির। তার মধ্যে সব টিচারই মনে হয় খেপে গেছে আমার উপর। প্রায়ই বিভিন্ন রকম অভিযোগ পত্র সাইন করে আনতে হয় বাবা মার কাছ থেকে। আর এসবে বিরক্ত হয়েই, আমার বাবা নাকি ছোট সাইজের একটা লাঙ্গল, আর দুইটা বাছুর কিনে রেখেছে গ্রামে। আর কোন অভিযোগ আসলেই সোজা পাঠিয়ে দেবে গ্রামের বাড়ি। বাছুর টানা লাঙ্গল দিয়ে হাল চাষ করতে হবে তখন! আমাকে দিয়েতো এর চেয়ে বেশি কিছু হবেনা।
যথারীতি দুয়েক দিনের মধ্যেই আবার আরেক খানা পত্র পেয়ে গেলাম। স্কুলের পিছনে গীর্জার পাশে দীঘিটাতে অনেকগুল রাজহাঁস। ভাল মনে দেখতে গেছি এদের। হঠাৎ কি হল, সাবাই মিলে তাড়া করে বসল আমাকে! রীতিমত পেখম মেলে!! এদের তাড়া আর কামড় খেতে গিয়ে ক্লাসে পৌছাতে একটু দেরী হয়ে গেছে। ব্যাস আরেকটা পত্র পেয়ে গেলাম। ক্লাসে দেরী হওয়াতে দিদিমনির আপত্তি নেই। যত আপত্তি আমার অজুহাতে। রাজহাঁসে যে তাড়া করে, আবার কামড়ায়ও!! এমন কথা নাকি কেউ জীবনেও শোনেনি!!!
সঙ্গত কারনেই চিঠিটা বাবার হাতে পৌছায়নি। পরদিন ক্লাসে এসে চুপ করে বসে আছি এক কোনায়। পাশেই কোন গাছে কোকিল ডাকছে বোধহয়। মনযোগ দিয়ে বুঝার চেষ্টা করছি। এদিকে দেখি নাম ডাকা শেষ! আমাদের মনিটর নালিশ করে বসল। আমি নাকি চিঠি দেখানোর ভয়তে নাম প্রেজেন্ট দেইনি!! দিদিমনি একটা হুঙ্কার দিয়ে কানে ধরে নিয়ে গেল সামনে। কানধরে উঠবস আর বেতের বাড়িতেতো আমার কিছুই হয় না। তাই নতুন শাস্তি বিধান হল। মনিটর আমাকে স্কুলের সব ক্লাসে নিয়ে যাবে। আর আমি তার পিছনে কান ধরে হাটবো। রীতিমত গরু চোরের শাস্তি। কিন্তু আমার বেশ ভালই লাগল। আফটারঅল মনিটর আমাদের ফার্স্ট গার্ল। ক্লাসের সবচেয়ে কিউট মেয়েটা!
শাস্তি শুরু হল চার তলা থেকে। ও কেমনযেন নাচতে নাচতে আমার সামনে হাটে। আর প্রতি ক্লাসে গিয়ে সুরেলা কন্ঠে বলে “দিদিমনি আসি...” ... “ইয়েস” তার পর আমাকে অনেকটা ধমক দিয়েই বলে “এই আস্!” আমিও বুক ফুলিয়ে কান ধরে ক্লাসে ঢুকে সবার দিকে তাকিয়ে গর্বের হাসি দেই! এরকম পুলিশি দায়িত্ব পেয়ে মনিটর ও গর্বিত। কোন কোন ক্লাসে আবার শাস্তির কারনও ব্যাখ্যা করতে হয় তাকে। এর পর...“দিদিমনি যাআ...ই” ...“যাও”।
তো এরকম আসি যাই করতে করতে নিচ তলায় পৌছে গেছি আমরা। হঠাৎ করেই কি যেন হয়। ওজন বেড়ে যেতে থাকে আমার। শাস্তি তখন প্রায় শেষ। করিডোরের ঐ প্রান্তেই দেখা যাচ্ছে স্কুলের শেষ ক্লাস। ক্লাসটা নার্সারি এ। আমার বোনের। এখন আর ফার্স্ট গার্লের সাথে হাটতে পেরে গর্বিত মনে হয় না নিজেকে। পা টেনে টেনে হাটতে থাকি শুধু। যন্ত্র চালিতের মত। লজ্জা শরম কোন কালেই ছিলনা আমার, তখনো নেই। কিন্তু আমার বোনের তো আছে। প্রচন্ড লজ্জা পাবেও। তার 'সবার সেরা' ভাইয়াটার এই অবস্থা দেখে। ক্লাস চলছে। তাই চার দিক নীরব। সেই কোকিলটাই আবার ডাকতে থাকে তখন। থেমে থেমে মিহি একটা টানা সুরে। খুব মনযোগ দিয়ে না শুনলেও ওর কথা গুল এবার যেন বুঝতে পারি আমি। খুব ইচ্ছে হয় মনিটরকে বলি ঐ একটা ক্লাস বাদ দিতে।
কিন্তু কোকিল ডাকছে যে!
এখন কি কথা বলা যায়...
============
স্পর্শ
PS: লেখাটা প্রথমে দেই 'দিয়াশলাই' এর জন্য। মনে হয় বেশী বড় ছিল। অথবা হয়তো ভালো ছিলোনা যথেষ্ট।
মন্তব্য
সুন্দর!
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
অনেক ধন্যবাদ পরিবর্তনশীল।
উৎসাহ পেলাম আরো লেখার
আপনার লেখায় মন্ত্যব্য করার জন্যই অনেকদিন পর লগইন করতেই হল। আমার কাছে গল্পটা অসাধারণ লাগল।
-------------------------------------------------
আমিও যদি মরে যেতে পারতাম
তাহলে আমাকে প্রতি মুহূর্তে মরে যেতে হত না।
==============================
আমিও যদি মরে যেতে পারতাম
তাহলে আমাকে প্রতি মুহূর্তে মরে যেতে হত না।
আপনাকে লগইন করাতে পেরে নিজেকে সফল মনে করছি।
অনেক অনেক ধন্যবাদ
---------------
স্পর্শ
অসাধারন ! পাঁচ তারা ! দারুন লাগলো !
-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
অনেক ধন্যবাদ!
--------------
স্পর্শ
আমার কাছেও চরম লাগছে ভাই
দিয়াশলাইয়ে যায়নাই দেইখা মন খারাপ কইরেন না।
আপনেরে আমি পুরা এক কার্টন ডলফিন দিয়াশলাই গিফট দিমু।যদি কোনদিন চাকরি টাকরি পাই আর কি
আরো লিখতে থাকেন...
---------------------------
থাকে শুধু অন্ধকার,মুখোমুখি বসিবার...
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
আপনার গিফ্টের অপেক্ষায় রইলাম।
উৎসাহ পেলাম!
--------------
স্পর্শ
অতি ভাল লেখা। দিয়াশলাই এ থাকা না থাকা টা কি জরুরী ব্যাপার? লেখক লিখবেন, পাঠকেরা পড়বে। জীবনে পড়া বহু ভাল ছোটগল্পের কথা মনে আছে সবার, কিন্তু সেটি কোন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল তা কিন্তু বেমালুম ভুলে গেছে।
আরো লিখুন।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
না আসলে লেখাটা ঐখানে ছাপা না হওয়ায় আজ দুপুরে সামহোয়ারইন এ দিলাম।
কিন্তু এখানে তো নতুন লেখা দেওয়ার নিয়ম। সে আইন ও যে ভংগ হয়নি সেটা বোঝাতেই এই 'ডিসক্লেইমার'।
অনেক অনেক ধন্যবাদ! আমি লিখতেই আছি....
অসম্ভব ভালো লিখেছেন আপনি !
লিখতে থাকুন।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
অনেক ধন্যবাদ!
ব্লগে লিখে আপনাদের মন্তব্যই সবচেয়ে বড় পাওয়া।
---------
স্পর্শ
- ভালো লাগলো তো।
এরকম আরও লিখতে থাকেন।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
অনেক অনেক ধন্যবাদ!
আমি লিখছি...
--------------
স্পর্শ
তার পরে কী হল? ছোট বোন কি দেখলো নাকি.........
চির আমি
হুম... দেখলো!
ভালো লাগলো। লিখতে থাকুন।
আমার ধারণা, দিয়াশলাই বাক্সে এই আকারের কাঠি ঢোকানো সম্ভব হতো না
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আমি একগামী পুরুষ। একমাত্র নারীদের ভালোবাসি
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই।
আসলেই লেখাটা একটু বড় মনে হয়।
আপনি আমার লেখা পড়েছেন দেখে ভাল লাগছে।
রাত সাড়ে তিনটা বাজে। ঘুমানোর আগে শেষবারের মতো সচলে ঢু মেরে লেখাটি পড়লাম।
অসাধারণ একটা গল্প। হালকা চালে পড়ছিলাম। কিন্তু শেষে এসে একটা বিরাট ধাক্কা খেলাম।
এটা যেন শুধু গল্পই হয়। কারও জীবনে যেন এমন ঘটনা না ঘটে। অনুভূতিটা ঠিক বোঝাতে পারছিনা...
পাঁচতারা এবং প্রিয় পোস্টে যুক্ত হলো...
---------------------------------
জ্ঞানীরা ভাবলেন খুব নাস্তানাবুদ করে ছাড়া গেছে...আআআহ...কি আরাম। বিশাল মাঠের একটি তৃণের সাথে লড়াই করে জিতে গেলেন।
ছোট্ট তৃণের জন্য অপরিসীম ঘৃণা।
আপনার অনুভুতিটা আমি বুঝতে পারছি।
এরকম ঘটেছিল আমার সাথে।
আপনার প্রিয় পোস্টে যেতে পেরে আমি প্রচন্ড খুশি।
---------
স্পর্শ
কি যেন আছে গল্পটায়! কি যেন!
ভালো গল্প বোদ্ধা হলে ধরতে পারতাম। না হওয়াতে শুধু উপলব্ধি করলাম!
কিন্তু তাতে কি? এরকম অনন্য উপলব্ধির মাঝে পর্যাপ্ত আনন্দ আছে।
এই আনন্দ ছড়ানোর জন্য আপনাকে অকুন্ঠ সাধুবাদ।
শেষের এই মোচরটা না থাকলে এতো কথা লিখতাম কি না জানি না। এই কথাটার জন্যই আগের সমস্তটুকুই অসাধারণ হয়ে উঠলো!
___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"
আপনার চমৎকার কমেন্টের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ!!
শেষ লাইন দুটি লেখার সময় যে অনুভুতিটা হয়েছিল তার কিছুটা লেখনীতে ধরতে পেরেছি জেনে ভাল লাগছে।
আপনার বোনের কন্ঠে গান শুনতে শুনতে পড়লাম, আগে পড়া হয় নি।
মনটা ভাল হল, না আরো বেশী খারাপ হল বুঝলাম না।
এখন থেকে আপনার পোস্ট নিয়মিত পড়ব।
-----------------------------------------------------
We cannot change the cards we are dealt, just how we play the hand.
---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে
অনেক ধন্যবাদ
কিন্তু আমার যে সব আব্জাব লেখা! বিরক্ত হবেন মাঝে মাঝেই।
....................................................................................
অতঃপর ফুটে যাবার ঠিক আগে হীরক খন্ডটা বুঝলো, সে আসলে ছিল একটা মামুলি বুদবুদ!
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
লেখাটা আগে পড়িনাই, পুবার হাওয়ার সূত্র ধরে পড়েই ফেললাম।অনেক ভাল লেগেছে।মনিটর মেয়েটাকে বললেই পারতেন, হয়তো শুনতো হয়তোবা না।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ !
....................................................................................
অতঃপর ফুটে যাবার ঠিক আগে হীরক খন্ডটা বুঝলো, সে আসলে ছিল একটা মামুলি বুদবুদ!
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
আরো একবার পর্লাম।
---------------------------------
জানিনা জানবোনা... কোন স্কেলে গাইছে কোকিল
গুনিনা আমি গুনিনা...কার গালে কটা আছে তিল
এই লেখাটা এত দারুণ... আবেগগুলো এত সুন্দর করে গাঁথতে পারিস তুই...
প্রচণ্ড মন খারাপ হয় লেখাটা পড়লে... কষ্ট আর মুগ্ধতার এই সহাবস্থানের নাম কী দেওয়া যায় জানি না... কেবল বলে যাই "হ্যাটস অফ!"
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।
এত সুন্দর লেখা!
সজল
বুকে চাপমত লাগল, গলা খানিক ব্যথা ব্যথা করছে, খানকয়েক দীর্ঘশ্বাস ঠেকানো গেলনা।
এমন-ই কি স্বাভাবিক?
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
সচলায়তনে এসে এই লেখাটা পড়ে সচল নই বলে মনে দুঃখ পেয়েছিলাম।
আজকে তারা দিতে পেরেছি। সব ইচ্ছা তো পূরণ হয় না, একটা ইচ্ছা পূরণ করে গেলাম।
............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্ চিনে।
আপনি যে কেনো এতো কম লেখেন- বুঝি নারে ভাই...
খুবই, খুবই ভালো এবং যুগপৎ খারাপ লাগলো গল্পটা পড়ে।
দারুন !! সত্যি অসাধারণ হাত আপনার !!
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
নতুন মন্তব্য করুন