গেছি ঢাকা ভার্সিটির একুশে হলে। একটু সন্ধ্যার দিকে। আড্ডা এমন জমে উঠলো যে আর হলে ফেরাই হল না! একটু রাতে অবশ্য ওরা কার্ড নিয়ে বসল। আজগুবি টাইপের এক খেলা শুরু করেছে! নাম ‘টুয়েন্টিনাইন’!! বললাম ‘কল ব্রীজ’ খেলি। নাহ, ঐটা নাকি মেয়েদের খেলা! এই নতুন খেলার কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। অর্ধেক কার্ডই তো দেখি বাইরে রেখে দিয়েছে! কিছুক্ষন পর পর চারটা কার্ড ওলট পালট করছে। আর ফোঁটা গুনছে!!! আমি আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছি বুঝার জন্য। কিন্তু কোন কার্ডের পাওয়ার কত, তা ই বুঝতেছিনা! পুরা ভিন্ন। ধ্যাত! মনে হচ্ছে হলে ফিরে গেলেই ভাল হত! এমন সময় তীক্ষনো হুইসেল...
এসব কথাই ভাবছি হাজতে বসে! ব্যাটারা রেইড করার আর দিন পেলনা!! বহিরাগত উচ্ছেদ অভিজান! আসল গুলা আগে ভাগেই খবর পেয়ে পালাইছে। আমি খাইছি ধরা! অনেক দিন পর আজই গেছি একটু বেড়াতে। এমন কপাল!!! কাছে আইডি কার্ডও নেই। বুয়েটের স্টুডেন্ট বলার পরও কোন লাভ হয়নি। না, একটু লাভ হয়েছে। মার ধর করেনি। ফ্রেইন্ডদের বলেছি বুয়েটে খবর দিতে। সকালের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যাব মনে হয়। এখন লালবাগ থানার হাজতে চোর বাটপারদের সাথে বসে বসে মশার কামড় শেয়ার করে খেতে হচ্ছে!! এর মধ্যে আবার চোরা মত এক লোক কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করেছে। জ্বালা কত প্রকার!!! এই অবস্থায় ঘুম আসবে না। তাই বাধ্য হয়েই এর এই প্যান প্যানানি গল্প শুনতে হচ্ছে। এদের গল্প ইন্টারেস্টিং হবার কথা। কিন্তু গল্পের নায়ক হিসেবে এই লোককে পছন্দ হচ্ছেনা। বিশেষ করে নামটা। রুদ্র, সপ্নীল এরকম না। নাম হল আক্কাস! আকাশ হলেও হত। কিন্তু কি আর করা, তার প্যারেন্টস এরকমই রেখেছে! তার কথাই বলি...
আক্কাস আলী। পেশায় মোবাইল চোর। গিয়েছিল গুলিস্থানের পাতাল মার্কেটে। ইলেক্ট্রিকের কাজ শিখতে। কিছুদুর শেখার পর ঐ তারের প্যাচ ঘোচ আর তার মাথায় ঢুকেনি। তাই এই নতুন ব্যাবসা। ঐখানে এই জিনিশ হর হামেশাই বিক্রি হচ্ছে। প্রতি দানে দুই তিনশ টাকা পায় সে। একটু রিস্ক থাকলেও আরামেরই কাজ। এক ছেলে আছে। ছেলের নাম আবীর! নামটা ওর মা রাখছে। ছেলের মায়ের নাম মৈরম। ছেলের মা কোন সাহেবের বাড়িতে জানি কাজ করত। ঐখান থেকেই এই নাম শিখে এসেছে। বস্তিতে এই রকম নাম কারো নাই! ‘আক্কাস’ এর সাথে নাকি ‘আবীর’ এর একটা মিলও আছে!! যদিও আক্কাস আলী তা খুঁজে পায় না। এখন অবশ্য মৈরম আর বাসা বাড়িতে কাজ করে না। একটা গার্মেন্টসে ঢুকেছে। আক্কাস ছেলে কে ‘খোকন’ বলে ডাকে। সে অবশ্য আবু টাবু বলতে পারলে খুশি হত। কিন্তু মৈরম বলে দিয়েছে ‘খোকন’ ছাড়া অন্য কিছু যেন না ডাকে!
সকালে উঠে আক্কাস শোনে পরদিন নাকি পোলার ‘জম্মদিন’!! বস্তিতে এই জিনিশের কথা কেউ শুনছে কোনদিন!!? এইটাও মৈরম আমদানি করছে ঐ সাহেবের বাড়ী থেকেই। যত্তোসব! বলে পোলায় নাকি ফ্যান্টাসি যাইতে চায়! আরে, ফ্যান্টাসি যাইতে কত টাকা লাগে কোন ধারনা আছে!!? আক্কাস আলী বলে, ‘দেখুমনে! কি করা যায়’। কাজে বেরুনোর আগে মৈরম মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে বলে, ‘বুঝালা আবীরের বাপ। একটা সুখবর আছে!’। আক্কাস ভাবে সুখবর আবার কিসের? হাসি দেইখা তো সন্দেহ লাগতেছে। আবার পোলা মাইয়া হইবো নাকি! তাইলেতো মাগীর মাথায় চলা কাঠ দিয়া একটা বাড়ি দেওন লাগবো! আর বেশী কিছু না শুনেই হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসে সে।
সকাল সকালই একটা দান মেরে ফেলে সেদিন! ছগির মিয়ার কাছে জমা দিতে গিয়ে আমতা আমতা করে বলে, কোন বড় কাজ আছে কিনা? কিছু টাকার দরকার। এই ছগির মিয়াই তাকে এই ধান্দা শিখাইছে। অনেক দিনের পরিচয়। ডানে বায়ে তাকিয়ে ছগির মিয়া তাকে একটূ পেছনের দিকে নিয়ে যায়। তারপর একে বারেই একটা সহজ কাজ দিয়ে দেয়। মোবাইল চুরির চেয়ে অনেক সহজ!!! এই কাজে আড়াই হাজার টাকা পেয়ে যাবে, ভাবতেও পারেনি সে!
বেশ কিছু টাকা পাবে। তাই সিটিং বাসেই উঠে পড়ে। কাক্রাইল যেতে হবে। ঐটাই কাজের যায়গা। পাশের দুই সিটে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে বসেছে। ভার্সিটিতে পড়ে মনে হয়। বাসটা একটু আটকে আছে। গার্মেন্টসের মেয়েরা দলে দলে রাস্তা পার হচ্ছে। তাই। মেয়েটা একটু বিরক্ত। বাসের অন্য সবাইও। কেউ বলে ওঠে, ‘এই সব মেয়েরা ঢাকার পরিবেশটাই নষ্ট করে দিল!’ ছেলেটা মেয়েটাকে বলতে থাকে, ‘বুঝলে, পরিবেশ নষ্ট হোক বা না হোক। আমাদের অর্থনীতির চাকা কিন্তু এদের কাধে ভর দিয়েই ঘুরছে। তাই আমার কাছে এদের সম্মান কৃষকের চেয়ে কোন অংশেই কম না!’ চাকা মাকা না বুঝলেও, মৈরমের জন্য গর্বে বুকটা ভরে ওঠে আক্কাস আলীর। ধুস শালা! মাগীটা খালি আরেকবার না বিয়াইলেই হয়। একটু জীদ্ ও হয় তার। মৈরম এত কিছু করতেছে। আর তার পোলাটাই ফান্টাসিতে যেতে পারেনা! দাড়া, টাকা পেয়ে কালই নিয়ে যাবে সে। মৈরমকেও নিয়ে যাবে।
কাক্রাইল এসে গেছে। কাজের যায়গা এস, আর টাওয়ার। কাজ কিছুই না! এই বিল্ডিঙের মেইন সুইচের একটা কাট্আউটের তার কাটা থাকার কথা। সেই তারটা রিপ্লেস করে দিতে হবে। ছগির মিয়া একটা তার দিয়ে দিয়েছে। কাগজে মুড়ে। সেই তারই লাগাতে হবে। কাগজ সহ!! ব্যাস তাইলেই কাজ শেষ। আক্কাসের তো ইলিক্ট্রিকের কাজের একটু অভিজ্ঞতা আছেই! তাই কোন ঝামেলা ছাড়াই অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সে ছগির মিয়ার কথা। তবে তারটাকে হিটারের কয়েলের মত মনে হচ্ছিল। সেটাই একটা খট্কা! কিন্তু অনেক টাকার কাজ। তাই মাথা না ঘামানোই ভাল। ফেরার পথে অবশ্য ব্যাপার টা বুঝে যায় সে। একটা শীতল আতঙ্কও হয় তার। কিন্তু সেই জীদ টার কারনেই আবার ভাবে। যাউক গা! শালারা অনেক কামাইছে। এইবার বুঝুক ঠ্যালা!!
শেষ বিকেলে বাড়ি ফেরে সে। আজ মনটা অনেক ভাল। পকেট ভরাতো, তাই। খোকন এসে ‘আব্বু’ বলে জড়িয়ে ধরে তাকে! ‘আব্বু’ বলাও মৈরমই শিখাইছে। আর জড়িয়ে ধরে এই আল্লাদিপনা ও!! তবে পোলাটারে বুকে চেপে ধরে, কেমন যেন লাগে তার। বুকের মধ্যে আরেকটা বুক কেঁপে কেঁপে ওঠে। অজানা একটা সুখের মত লাগে! জীবনে শুধু এই একটা জিনিশই হারানোর ভয় আছে আক্কাস আলীর। না বুঝেই মৈরমের প্রতি আবারো কৃতজ্ঞ হয় সে। এরকম অজানা সুখের খোঁজ দেবার জন্য! কিন্তু নবাবের বেটিটা গেল কই?! পাশের ঘরের সখিনা বলে মৈরম নাকি আজ নতুন যায়গায় কাজে গেছে। বেতন আরো দুইশ টাকা বেশি দেবার কথা সেখানে!
এর পরের ঘটনা শুধুই ইতিহাস। মেইন সুইচে আগুন ধরে কিছুই হয়নি বিল্ডিঙের! শুধু আলার্ম বেজে ওঠায়, হুড় মুড় করে নামতে গিয়ে চাপা পড়েছে মৈরম। মাকে হারিয়ে আবীর অসুস্হ হয়ে পড়েছে। আছে ঢাকা মেডিকেলে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আক্কাস আলী। হাতে ধরে অনুরোধ করে, ‘স্যার, আমার পোলাডারে একটু দেইখেন!’
হাজত থেকে ছাড়া পেয়েছি। বাসায় আমার হাজত বাসের কথা বলা হয়নি। শুনলে নির্ঘাত বাবা হার্টফেইল করত। মাকে সাথে নিয়েই। টিপ টিপ বৃষ্টি টা একটু বেড়ে গেল যেন। পলাশীর মোড়ে হুড় মুড় করে মেয়েরা কাটাবনগামী বাসে উঠছে। ওরা গার্মেন্টসের। অনেকেই ভিজে যাচ্ছে। বৃষ্টি ভেজাকে আমরা কাব্য করে বলি ‘বৃষ্টি বিলাস’ আর ওরা হয়তো এই ভেজা গায়েই সারাদিন ঘুরাতে থাকবে আমার দেশের সেই ভগ্নপ্রায় চাকা। কখনো নিজেরাই পিষ্ঠ হতে হতে...!
অপেক্ষা করছি ৩৬ নাম্বার বাসের জন্য। সকালে গিয়েছিলাম ডি,এম,সি তে। আবীরের সাথে দেখা হয়েছে। বুকের সাথে চেপেও ধরেছিলাম ওকে। স্বার্থপরের মত আক্কাস আলীর সেই অজানা সুখের খোজটা পেতেই! তবে সুখের খোজ পাওয়া না গেলেও অজানা একটা অনুভুতি পাওয়া গেছে। এটাকেই মনেহয় কষ্টবলে ওরা!! বৃষ্টি আরো বেড়ে গেলো। মনে ভাসছে অসাধারন মায়াবী দুটি চোখ! কি অসহায় দৃষ্টি!! শুকনো অশ্রু গুলো ভিজে, আবার ধুয়ে যাচ্ছে এই পুরাতন গাড় বৃষ্টিতে!! থাক!
কষ্ট গুলো পেছনেই পড়ে থাক,
এখন আমার বৃষ্টি ভেজার কাল...
বিদায়।
----
স্পর্শ
মন্তব্য
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের "প্রেম ও প্রার্থনার গল্প" এর কথা মনে পড়ে গেলো কেন যেন এই লেখাটা দেখা।
হাঁটুপানির জলদস্যু
অনেক ধন্যবাদ! আপনার কমেন্টের জন্য। আপনি আমার লেখা পড়েছেন দেখে অনেক ভাল লাগছে!
অসাধারণ!!!
আপনার লেখা অনেকটা এমনাইট শ্যামালনের মুভির মতো...শেষে এসে বেশ একটা চমক থাকে...
আবীরের জন্য ভালোবাসা রইলো...
---------------------------------
জ্ঞানীরা ভাবলেন খুব নাস্তানাবুদ করে ছাড়া গেছে...আআআহ...কি আরাম। বিশাল মাঠের একটি তৃণের সাথে লড়াই করে জিতে গেলেন।
ছোট্ট তৃণের জন্য অপরিসীম ঘৃণা।
আরে! আপনার নামও তো দেখি আবীর!!!
মজার কোইন্সিডেন্ট!!
লেখা ভাল লেগেছে জেনে আমারো খুব ভাল লাগছে! আমি আসলে এ ধরণের গল্প লিখিনা তেমন। একটু হালকাচালের হাবিজাবি লিখতেই ভাল লাগে। মাঝে মাঝে কয়েকটা গম্ভীর গল্পও লিখে ফেলি। সেগুলোর ঠাই হয় সচলে!
আপনি পড়ছেন দেখে ভাল লাগছে!
ভাইয়া মৈরমের আহ্লাদগুলা খুব মজার করে লিখসেন...
রিজভী
--------------------------------
কেউ যাহা জানে নাই- কোনো এক বাণী-
আমি বহে আনি;
ধন্যবাদ রিজভী!
------
স্পর্শ
আচ্ছা লেখা মাঝে মাঝে মূল পাতায় দেখা যায়না! কিন্তু অতিথি লেখকের পাতায় থাকে!
ব্যপারটা কেন হয় কেউ বলতে পারবেন?
----
স্পর্শ
কোন কোন লেখা প্রথম পাতার পরিবর্তে অতিথি লেখকের ব্লগে প্রকাশিত হয়।
হাঁটুপানির জলদস্যু
জোশ্ হয়েছে! মারহাবা ! মারহাবা ! বেশ সুন্দর গল্প।
ফেরারী ফেরদৌস
নতুন মন্তব্য করুন