একটি অন্যরকম গল্প : : ০১

ইমরুল কায়েস এর ছবি
লিখেছেন ইমরুল কায়েস (তারিখ: বিষ্যুদ, ০১/০৫/২০০৮ - ১:০৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রাতুলের বাবার কথা :
রাতুল ওর একটা নিজস্ব জগত তৈরি করে নিয়েছে । এখানে খুব একটা লোকজন নেই , আমি আর ওর মা তো মনে হয় নেইই । রাতুল আমাদের মন খুলে কিছু বলে না । আমরা যে কোন কিছু সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে হা-না বলে চালিয়ে নেয় , পারতপক্ষে কথা বলতেই যেন ওর আপত্তি । রাতুলের ব্যাপারে কোন কিছু জানার দরকার হলে প্রথমে আমি ওর মার কাছে জানতে চাই । আমার মনে হয় মার কাছে হয়ত এ বিষয়ে ও বলবে কিন্তু খুবই হতাশ হই যখন জানতে পারি ওর মা ও এ বিষয়ে কিছু জানে না ।আমি বুঝতে পারি ওর সাথে একটা দূরত্ব তৈরী হয়েছে। দূরত্ব সৃষ্টির ব্যাপারটা এমন যেটা একবার তৈরী হয়ে গেলে সহজে ভাঙা যায়না ,বিশেষত ও যখন আঠারো বছরের তরুন , কলেজে পড়ে । মাঝে মাঝে আমি রাতুলের সাথে আমাদের এই দূরত্ব সৃষ্টির ব্যাপারটা নিয়ে ভাবি , খুঁজে বের করার চেষ্টা করি কোথা থেকে এই দূরত্বটা সৃষ্টি হল । ওর মাকেও বলি বিষয়টা । সে বলে না কোথায় দূরত্ব তৈরী হয়েছে , ঠিকই তো আছে সবকিছু । কিন্তু আমি জানি এটা ওর মনের কথা না , মায়েরা কখনোই মনে করেনা সন্তান একটু দূরে সরে গেছে । আমার মনে হয় দূরত্ব সৃষ্টির এই ব্যাপারটা তৈরী হয়েছে ওকে কম সময় দেয়াকে কেন্দ্র করেই । আমরা স্বামী -স্ত্রী দুজনেই সরকারী চাকুরী করি , নয়টা পাঁচটা অফিস সেরে ওকে সেভাবে সময় দেয়া হয়নি। এসময়টা ও হয়ত স্কুলে গিয়েছে অথবা একা একা বাসায় থেকেছে । অফিস থেকে একটু শহরে ঘুরে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে যখন দেখতাম ও অসময়ে টিভি দেখছে তখন আমার মেজাজ একটু খারাপ হত । ও হয়ত ব্যাপারটা বুঝতে পারত । আমি আসলেই টিভি বন্ধ করে পড়ার টেবিলে চলে যেত । পড়ালেখায় বরাবরই ভালো থাকার কারনে আমি কিছু বলতাম না । আমার সাথে বরাবরই ওর কথা হত কম । ও মূলত আমার সাথে কথা বলত টাকার ব্যাপারে । শুধুমাত্র স্কুলের বেতন বা ব্যাচে প্রাইভেট পড়ার জন্য টাকার দরকার হলে আমার কাছে টাকা চাইত , হাত খরচের টাকা পর্যন্ত চাইত না । ক্লাস ফাইভে এইটে বৃত্তি পেয়েছিলো । ওই টাকা দিয়েই হাতখরচ চালাত মনে হয় । এখন আমার মনে হয় কিছু কিছু জিনিস ভুল হয়ে গেছে । ওকে পুরোপুরি ওর মত থাকতে না দিয়ে সময়ে অসময়ে একটু কথা বলা উচিত ছিল আমার । হয়ত ও যখন টিভি দেখছিল তখন গিয়ে এর পড়ালেখার খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল , স্কুলের কোন স্যার কেমন , সামনে ওর জন্মদিনে বন্ধুবান্ধবদের ও বাসায় দাওয়াত দিতে চায় কিনা এসব হাল্কা বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল । মফস্বল শহরে ছেলেদের দল বেঁধে খেলাধুলা করতে দেখি বিকেলে । রাতুল ওসবে গিয়েছেও খুব কম । অবশ্য আমারও এখানে একটা দোষ ছিল আমিই যেতে দেইনি। কত খারাপ ছেলেই তো আছে কার সাথে মিশে কখন কোন পথে যায় । এখন বুঝতে পারি ব্যাপারটা খুব একটা ভাল হয়নি । ওর বয়সের ছেলেদের সাথে ওর মেশা উচিত ছিল , ভালোভাবেই মেশা উচিত ছিল । এতে হয়ত আমাদের সাথে ওর কথাবলার জড়তাটুকু কেটে যেত ।

রাতুলের মার কথা :

রাতুলের বাবা মাঝে মাঝে আমার কাছে রাতুলের নানান বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করে । আমি উত্তর দিতে পারিনা । ওর সাথে আমার কথাই হয় কম । বাসায় থাকলে হয় ও পড়াশুনা করে নাহয় টিভি দেখে । অফিসের অনেকের কাছে শুনি তাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করতে চায় না , নানান বায়ানাক্কা করে । কিন্তু রাতুলকে কখনও পড়াশুনার কথা বলতে হয়নি । হাইস্কুলে থাকার সময়েও ও খাওয়া , ঘুম , স্কুল , স্যারদের কাছে ব্যাচে পড়তে যাওয়া খুবই নিয়মমত প্রায় রুটিনমাফিক করত । আমি আশ্চর্য হতাম এত কম বয়স থেকে এই ছেলে এরকম নিয়মকানুন শিখল কোথা থেকে । আমারও ওর এ বিষয়গুলো ভাল লাগত , তাই আমিও ওকে ওর মত থাকতে দিতাম । রাতুলের বাবা মাঝে মাঝে বলে ওর সাথে নাকি আমাদের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে । আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারি কিন্তু হেসে উড়িয়ে দেই , আমিও সায় দিলে লোকটা হয়ত মনে মনে কষ্ট পাবে । যদিও আমিও জানি রাতুলের সাথে আমাদের আসলেই একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে ।

রাতুলের কথা:
কলেজে অনেকে আমাকে মেশিনম্যান নামে ডাকে । একবার আমি একজনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম মেশিনম্যান কি ? সে হেসে জবাব দিয়েছিল যন্ত্রমানব । আমি বুঝতে পারিনি কেন ওরা আমাকে এ নামে ডাকে । অনেকদিন পর একজন আমাকে বলেছিল আমি নাকি যন্ত্রের মত রুটিনমাফিক সবকিছু করি । নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাসে আসি , নির্দিষ্ট সময়ে কলেজ থেকে ফিরি ,যন্ত্রের মত স্যারদের লেকচার তুলি পাশের ছাত্রের সাথে কোন কথা না বলেই, অন্যদের সাথে কথাও বলি মেপে মেপে প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া বলতে চাই না । ওরা হয়ত ঠিকই বলে , নির্দিষ্ট একটা রুটিনের বাহিরে কেমন যেন এলোমেলো লাগে আমার । আগে মফস্বলে বাসায় থাকতেও এটা করতাম এখন ঢাকায় কলেজে পড়তে এসেও এটা করি । বাসায় থাকতে আম্মা পছন্দ করতেন এটা । পাশের বাসাতে গিয়ে গল্প করতেন আমাকে নিয়ে , রাতুল তো পুরো রুটিনমাফিক চলে , রুটিনের বাহিরে একপা ও যেতে চায় না । বাসায় আমার তেমন কিছু করার ছিল না । অনেকের বাসায় ভাইবোন থাকে একসাথে সবাই মিলে হল্লা করতে পারে কিন্তু আমাদের বাসায় দিনের বেলায় বলতে গেলে লোক থাকত দুইজন । একজন আমি আর একজন কাজের বুয়া । বুয়ারা অধিকাংশই থাকত দেশ থেকে আনা স্বামী পরিত্যক্তা বয়স্কা মহিলা । এরা বাসায় থাকার পরিবর্তে হাতের কাজ সেরে পাশের বাড়ীতে গিয়ে গল্পগুজবেই ব্যস্ত থাকত । ফলে অধিকাংশ সময়েই খালি বাসায় একলা থাকতে হত আমার । স্কুলে গিয়ে আমি শুনতাম ক্লাসের ছেলেরা নানান বিষয়ে আলাপ করত । সরকারী কলেজে একটা বড় পুকুর ছিল ওখানে ভরদুপুরে সাতরাত ওরা , বিভিন্ন এলাকায় দল বেঁধে ক্রিকেট খেলতে যেত , অখিলবাবুর বড় আমবাগানে চুরি করে খেত লিচু, নারকেল ,আম ইত্যাদি । আমি ওদের কখনো যেতাম না , বলা যেতে পারে যেতে ভয় পেতাম যদি আব্বা জানতে পারে। একবার ক্লাস সিক্সে থাকতে আমি কলেজের বড় মাঠটাতে ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিলাম বাসার কাজের বুয়াকে না বলে । আব্বা কি জানি কাজে অফিস থেকে বাসায় এসে আমাকে না পেয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে হাজির হয়েছিলেন মাঠে । বাসায় ফিরে রান্নাকরার একটা কন্চি দিয়ে মেরেছিলেন খুব । বাসায় আম্মা ছিলেন না । আমাকে উদ্ধার করতে কেউ আসেনি সেদিন। আমার সাথে সেদিন যারা মাঠে খেলছিল ওরা আমাকে আব্বা মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন দেখে খুব অবাক হয়েছিল , সম্ভবত ভয়ও পেয়েছিলো একটু । আমাকে আর কখনও খেলতে ডাকেনি ওরা। সেই থেকে আব্বাকে আমি প্রচন্ড রকম ভয় পাই । পারতপক্ষে পরতে চাইনা আব্বার সামনে । আব্বাও দেখি আমার সাথে কথা বলেন কম । অন্য বাবারা দেখতাম আমার বাবার থেকে আলাদা । ঈদের নামাজে ছেলেদের একসাথে নিয়ে যান , মেলা টেলায়ও নিয়ে যান নিয়ম করে । অথচ আমি ঈদের নামাজে যেতাম পাশের বাসার বদরুল ভাইয়ের সাথে , মেলার সময় আমার হাতে বাবা গুজে দিতেন বিশ টাকার একটা নোট । আমি ভাবতাম বাবা এমন কেন ? কিন্তু আমার বোধ একদিন পাল্টে । ঢাকায় পড়তে আসার সময় আব্বা আমার সামনে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন । আমি অবাক হয়ে যাই , এতটা ভালবাসা আব্বা কোথায় রেখেছিলেন এতদিন । মানুষ কতভাবে নিজেকে খোলসের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলে ভাবতে থাকি আমি । ছুটিছাটায় বাড়িতে গেলে সবাই নাকি আব্বা-আম্মা -ভাইবোনের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেয় । ঢাকায় এসে গল্প করে মেসে । আমি পারিনা ওদের গল্পে অংশগ্রহন করতে। বাসায় গেলে আব্বা আমাকে কিছু গতানুগতিক প্রশ্ন করেন আমিও হা-না করে উত্তর দিতে থাকি । আমি জানি আমার সাথে পিতামাতার একটা দূরত্ব আছে , আমি ভাঙতে চেষ্টা করি দূরত্বটা , পারিনা।

eru

-------------------------------------------------
সুগন্ধ বিলোতে আপত্তি নেই আমার
বস্তুত সুগন্ধ মাত্রই ছড়াতে ভালবাসে।


মন্তব্য

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

মানুষের মন বড়ই বিচিত্র! আপনার লেখায় তার ছাপ পাওয়া গেল। গল্প বলে মনে হলো না, মনে হলো যেন কারো জীবনের এক টুকরো স্মৃতি!

eru এর ছবি

গল্প মানেই তো ভাই জীবনঘটিত ব্যাপারস্যাপার সামনে তুলে আনা। গল্পের বিষয়বস্তু কারো কারো জীবনের সাথে মিলে যাবে , কেউ কেউ ভাববে আরে এরকমও তো হতে পারে । তাই নয়।
eru

-------------------------------------------------
সুগন্ধ বিলোতে আপত্তি নেই আমার
বস্তুত সুগন্ধ মাত্রই ছড়াতে ভালবাসে।

নজমুল আলবাব এর ছবি

ভয়ঙ্কর একটা গল্প। আমি আতঙ্কবোধ করছি বাবা হিসাবে।

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

হুমম

মুশফিকা মুমু এর ছবি

খুব ভালো লিখেছেন, একদম বাস্তব।
আমার ভাই এর সাথে আমার বাবা-মা র দূরত্বটা অনেকটা এরকম, যদিও এতটা ভয়াবহ না। আম্মু আমাকে প্রায়ই বলে, ওকে এটা করতে বল, ওটা জিগ্যেস কর, কারণ আম্মুর ধারনা ও আমাকে বলবে বা আমার কথা শুনবে। শুধু ভাই না, খালাতো ভাইদের নিয়েও একি সমস্যা। খালাও আমাকে বলে ওকে এটা বোঝাও ওটা করতে বল। আমি অনেকটা এই দূরত্বের মাঝখানে সেতুর মত খাইছে, আপনাকে পাঁচ তারকা হাসি

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

পরিবর্তনশীল এর ছবি

অন্যরকম গল্পের মাঝে নিজেকে আরো জড়িয়ে ফেলতে চাই। আরো লিখুন।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্পটা বেশ ভালো লেগেছে। আমার নিজের জীবনের সাথে কিছুটা মিলে গেল বলেই কি! আমার আব্বু আমার সাথে বেশ ভালোই মিশেন। কিন্তু কেন যেন উনি আমার প্রয়োজনগুলো বুঝতে পারেন না। মাঝেমাঝেই অবিশ্বাস করেন। খারাপ লাগে, খুব।

ফেরারী ফেরদৌস

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাই এত নাম থাকতে রাতুল নামটা নিলেন ক্যান???
আমি পড়ি আর ভাবি, আমারে নিয়া ল্যাখে নি তো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।